বিজ্ঞানসাধক: সস্ত্রীক অমলকুমার রায়চৌধুরী। (ছবি সৌজন্য: পারঙ্গমা সেন)
শৈশবে ও কৈশোরে খুব কাছ থেকে অমলকুমার রায়চৌধুরীকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি ছিলেন আমার মায়ের নিজের কাকা। তাঁকে আমি ছোটোদাদু বলে ডাকতাম। শান্ত, সৌম্য, স্থিতধী মানুষ। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। পোশাক-আশাকও ছিল অত্যন্ত সাধারণ। অনেক মানুষের ভিড়েও নিজেকে সরিয়ে রাখতেন। হয়তো বিছানায় বসে একমনে নিজের বইয়ের প্রুফ দেখছেন, আমি জানতে চাইতাম, তুমি বই লেখো? কোথায় তোমার বই? তিনি মৃদু হেসে টেবিলের ওপর রাখা তাঁর বইগুলি দেখাতেন। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এত সহজ এক জন মানুষ কী করে এত কঠিন কঠিন বই লিখতে পারেন!
আমার কাছে মামাবাড়ি ছিল খুব আনন্দের জায়গা। মা যখন মারা যান, তখন আমার এক বছরও হয়নি। বাবার হাত ধরে মামাবাড়ি যেতাম। ছোটোদাদু অনায়াসে শিশুদের সঙ্গে মিশে যেতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বয়সও যেন তাদের মতোই হয়ে যেত। তিনি তাদের মন বুঝে, যে ভাবে তাদের বুঝতে সুবিধে হয়, সে ভাবেই প্রশ্ন করে তাদের মনের কথা শুনতে চাইতেন। “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে বলতে পারো...” এই ভাবে শিশুদের কাছে কিছু জানতে চাইতেন। গলার স্বর ছিল মিষ্টি, আন্তরিক। সহজ, অকপট, মার্জিত ব্যবহারের জন্যই তাঁকে দেখলেই আমার মন আনন্দে ভরে উঠত।
ছোটোদাদু অমলকুমার এবং দাদু অমিয়কুমার মাংস খেতেন না। আমি জানতে চাইতাম, তুমি মাংস খাও না কেন? ছোটোদাদু হেসে বলতেন, “ওদের খুব ব্যথা লাগে যে। সেটা ভেবেই খেতে পারি না।” অল্প বয়সে বাজারে গিয়ে মুরগি কাটা দেখে ওঁরা মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন। গাঁধীজির আত্মজীবনী ‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ দুজনের জীবনেই গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলায় এক দাদা বলেছিলেন, “ইস, তোরা চিংড়ি খাস? চিংড়ি তো পোকা!” তার পর থেকেই অমলকুমার চিংড়িও ছেড়ে দেন। তবে তিনি ভালবাসতেন তোপসে মাছ ভাজা। পার্শে বা পাবদার ঝোল। সঙ্গে দই আর মিষ্টি।
ছোটোদাদু প্রায় সব সময়ই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। অবশ্য বিদেশের কথা আলাদা। তখন তিনি স্যুট পরতেন। পাহাড়, সমুদ্র দুটোই পছন্দ করতেন। পুরী বা দার্জিলিং বহু বার গেছেন। এক বার রাজস্থানেও গিয়েছিলেন। মৃত্যুর এক মাস আগেও, অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুরে এসেছিলেন মিরিক। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মাঝেমধ্যে ক্লাসিক সিনেমা দেখতে যেতেন। তাঁদের উৎসাহ দিতেন উচ্চ মানের বই পড়তে। সারা জীবন কাগজ-কলম দিয়েই লেখালেখি করে গেছেন। কম্পিউটার ব্যবহার করতেন না। তাঁর কন্যা, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পারঙ্গমা সেন নিতেন তাঁর সেক্রেটারির ভূমিকা।
ছোটোদাদু নিজে চুপচাপ স্বভাবের হলেও বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িটা থাকত জমজমাট। তিন দাদু, তিন দিদা, তিন মামা, মামি, মাসিদের নিয়ে হইহুল্লোড় লেগেই থাকত। পরে যে যার মতো ছড়িয়ে পড়েন। লেক গার্ডেন্সে চলে আসার পর অমলকুমার আরও চুপচাপ হয়ে যান। নিজের ভাবনায় ডুবে থাকতেন। দেশ-সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তিনি ছিলেন সচেতন। এক বার কথায় কথায় কার সম্পর্কে যেন বলে ফেলেছিলাম, ওদের তো অনেক পয়সা, তাই না? বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। মৃদু ধমকে উঠে বলেছিলেন, “এ সব কী শিখছ তুমি?” যেন বলতে চেয়েছিলেন, পয়সা দিয়ে মানুষকে বিচার করতে নেই।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর যশ-খ্যাতি সম্পর্কে থেকে প্রশস্তি শুনতাম, বিশেষ করে বাবার কাছে। কিন্তু সামনে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে সেই দিকপাল মানুষটাকে কিছুতেই যেন মেলানো যেত না। নিজের কথা বলতে চাইতেন না। লাজুক ভাবে হাসতেন শুধু। তিনি ছিলেন আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ মানুষ। কোনও কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াতেন না। নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত প্রকৃতির ছিলেন। ভাবতাম, বিশ শতকের বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই মানুষটা যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন! গোটা বিশ্বে তাঁর কাজের স্বীকৃতি! তিনি কিন্তু ও সব আমলই দিতেন না। ছাত্রদের অসম্ভব ভালবাসতেন। একটুও দেখনদারি ছিল না। কথাবার্তা, চালচলনে তাঁর উচ্চতা বোঝার উপায় ছিল না।
ব্যক্তিগত জীবনে অমলকুমার ছিলেন অন্তর্মুখী, কিন্তু আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। ২০০২ সালে তিনি এক বার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে এক জন অস্থায়ী কর্মী বিপুল খাটনির পর কত সামান্য আয় করে, তা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। আর মর্মাহত হয়েছিলেন সেখানে আরশোলার রাজত্ব দেখে। নিজের ভাইপো, পদার্থবিজ্ঞানী অমিতাভ রায়চৌধুরী (শংকর)-কে নিয়ে তাঁর ছিল খুব গর্ব। নিজের ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘অনেকে বোধহয় ভাবে যে শংকরের সাকসেসের পেছনে আমার কিছু অবদান আছে। এটা কিন্তু একেবারেই মিথ্যে। সে যা করেছে তা একান্তই তারই কৃতিত্ব। তবে আমার ভাইপো, এই ভেবে আনন্দ পাই।’
পদার্থবিজ্ঞানে এ বার রজার পেনরোজ় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছে অমলকুমার রায়চৌধুরীর নাম। তাঁর ‘রায়চৌধুরী ইকোয়েশন’ জেনারেল রিলেটিভিটি সংক্রান্ত গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। খুব সোজা করে বলতে গেলে, আইনস্টাইন এবং সত্যেন বোসের তত্ত্বের সঙ্গে রজার পেনরোজ় এবং স্টিফেন হকিংয়ের ভাবনার যোগসূত্র ঘটিয়ে দেয় এই সমীকরণ। ১৯৫৫ সালে ‘রায়চৌধুরী ইকোয়েশন’-এর প্রকাশ ঘটে ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি ওয়ান’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে। গোটা বিশ্বে হইচই ফেলে দেয় এই নতুন সমীকরণ।
অমল রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, বরিশালে। দশ বছর বয়সে, ১৯৩৩ সালে তিনি বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর কয়েক মাস পরে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। লেখাপড়া করেন তীর্থপতি, হিন্দু স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক বার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। চিকিৎসার সময় প্রচুর পরিমাণ কুইনাইন দেওয়া হয়। তিনি মারা গিয়েছেন ধরে নিয়ে তাঁর মা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র বাংলা গ্রন্থ, ‘আত্মজিজ্ঞাসা ও অন্যান্য রচনা’-য় নিজের ব্যাপারে অনেক কথা বলে গিয়েছেন।
অমলকুমারের গবেষণার শুরু ১৯৪৪ সালে, এম এসসি পাশ করার পরই। আশুতোষ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৪৯ সালে। বিভিন্ন বিদেশি জার্নালেও লেখা পাঠাতে থাকেন। বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকা এক বার একটি লেখার জবাবে জানায়, ‘আইনস্টাইন যখন ইংল্যান্ডে এসেছিলেন, এ সব কথা আলোচনা করেছিলেন।’ অমলকুমার বিস্মিত হয়ে যান, ‘‘নগণ্য আমি যা ভেবেছি, তাই স্বয়ং আইনস্টাইনও ভেবেছেন, আলোচনা করেছেন।’’
বাঙালি তথা ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহার এই সার্থক উত্তরাধিকারীর সঙ্গে তাঁর পূর্বসূরিদের সম্পর্ক ছিল কিছুটা জটিল। ১৯৫২ সালে অমলকুমার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’-এ রিসার্চ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সেখানকার লাইব্রেরি অতি সমৃদ্ধ। ওখানে ডিরেক্টর হয়ে এলেন স্বয়ং মেঘনাদ সাহা। ১৯৫৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সদ্য প্রকাশিত একটি পেপার নিয়ে তিনি দেখা করেন মেঘনাদ সাহার সঙ্গে। কিন্তু অধ্যাপক সাহার কাছ থেকে বিশেষ উৎসাহ পাননি অমলকুমার। মেঘনাদ সাহা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘‘তোমার যদি আমাদের কথা শোনার ইচ্ছে না থাকে, তুমি অন্যত্র চাকরি খোঁজো।’’ মেঘনাদ সাহা সেই সময় অমলকুমারের কাজের গুরুত্ব বোঝার ব্যাপারে সে ভাবে মনোযোগ দেননি।
আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু অমলকুমারের একটা লেকচার শুনে বলেছিলেন, ‘‘কাজটা কিছুই হয়নি, তবে ছেলেমানুষ কিছু যে করেছে, তার জন্য ওকে ভাল বলি। আশা করি, ভবিষ্যতে শুধরে যাবে।’’ তখনও তিনি ভাবতেও পারেননি, ভবিষ্যতে আইনস্টাইনের কাজের সঙ্গে তিনি ছাড়া আর যে বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে যাবে, তিনি হলেন অমলকুমার রায়চৌধুরী। বোস সংখ্যায়নের পাশাপাশি জায়গা করে নেবে রায়চৌধুরী সমীকরণ।
মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আচরণে অমলকুমার গভীর আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর আশা ছিল, প্রবীণ ও খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা তরুণ গবেষকদের উৎসাহ দেবেন, তাঁদের মধ্যে যদি সামান্য ক্ষমতাও থাকে, তার উন্মেষে সাহায্য করবেন। কিন্তু এ দেশে তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছিল এর বিপরীত। অমলকুমারকে সারা জীবন ভাবিয়েছে এই প্রশ্ন, ‘একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানে গবেষকদের কতটা স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং উপর থেকে তাদের উপরে কতটা খবরদারি থাকবে।’
অধ্যাপক কলসন তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক। বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর স্থান তখন বিশ্বের প্রথম সারিতে। তিনি একটি প্রবন্ধে অমলকুমারের উল্লেখ করে ভূয়সী প্রশংসা করে জানালেন, তাঁর একটি ভুল ধারণা এই ভারতীয় বিজ্ঞানী দূর করেছেন। সমস্ত পেপারে অন্তত দশ বার তিনি অমলকুমারের নাম উল্লেখ করলেন। বিদেশে যখন তাঁর কাজের এই রকম সমাদর চলছে, দেশে তখন আইএসিএস-এ তাঁর বসার জায়গা হয়েছে একটি রান্নাঘরে। রান্নাঘরটি বেশ ছোট, কোনও রকমে বসানো হয়েছে টেবিল ও চেয়ার, পিছনের জানলা দিয়ে তীব্র রোদ এসে ঘরটা সব সময়ই গরম করে রাখে। এর কিছু দিন পরই অমলকুমার প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন এবং সেখানে প্রায় তিরিশ বছর পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম এক ব্যক্তিত্ব।
অমলকুমার সব সময়ই নিজের বিশ্বাসের জায়গায় স্থির ছিলেন। তাই অকপটে মুখের ওপর জবাব দিতে কখনও সঙ্কোচ বোধ করেননি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে গেছেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কেন তিনি গবেষণা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চান। অমলকুমার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা জানতে চেয়েছেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কি গবেষণা নিষিদ্ধ?” পরে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “অতীতে আমাদের দেশ থেকে যত ভাল কাজ বেরিয়েছে, সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা করেছেন। কাজেই আমার মনে হয় না যে, পড়ানোয় গবেষণা বিঘ্নিত হবে।”
তিনি বিদেশের জার্নালে এত লেখা ছাপান কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে অমলকুমার বলেছিলেন, “আপনার প্রশ্ন অধ্যাপক বোসকে (সত্যেন বোস) করা উচিত। তিনি প্রখ্যাত ব্যক্তি, যেখানেই তাঁর কাজ ছাপা হোক না কেন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা পড়বেন। তা সত্ত্বেও তিনি বিদেশি জার্নালে কাজ ছাপান। আমি অতি সামান্য ব্যক্তি, দেশি জার্নালে ছাপা হলে কেউ হয়তো পড়বেই না।” বিয়ের কথাবার্তার সময় পাত্রীর দাদা জানতে চান, এখানে তাঁর উন্নতির সম্ভাবনা কী রকম। অমলকুমার সাফ জানান, “এখানে আমার কোনও উন্নতি হবে না। তবে আমার লাইনে আমার চেয়ে ভাল কাজ এ দেশে কেউ করছে বলে মনে হয় না।”
এ দেশে যাঁরা মৌলিক গবেষণা করতে চান, তাঁদের সবাইকেই নানা রকম বাধার সামনে পড়তে হয়। অমলকুমারও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও প্রায় একক প্রয়াসে তিনি সফল হয়েছিলেন। অমলকুমার এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সাধারণ যাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধির উপরে আস্থা ছিল না, বড় কোনও এক জনের তল্পিবাহক হয়ে একটা ডিগ্রি ও শেষ পর্যন্ত একটি সুবিধেজনক চাকরি পাওয়ায় তাদের কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু অন্যরূপ হলেই বিপদ, একমাত্র উপায় পশ্চিম থেকে স্বীকৃতি পাওয়া। পশ্চিম থেকে একটা ডিগ্রি আনা কষ্টসাধ্য কাজ ছিল না, কিন্তু দেশে বসে কেবলমাত্র কাজ করে স্বীকৃতি, একটু বেশি আশা করা।”
বিদেশে যখন অমলকুমার রীতিমতো আলোচিত, তখনও এ দেশে সে ভাবে কেউ তাঁকে চিনতেন না। তাঁর ডি এসসি থিসিসের ওপর অধ্যাপক জন হুইলার রিপোর্ট দেন, “হি হ্যাজ় গিভেন অ্যান অ্যানসার টু দ্য মোস্ট আউটস্ট্যান্ডিং প্রবলেম ইন রিলেটিভিসটিক কসমোলজি।” এ-হেন অমলকুমারের বয়স ষাটের ওপর হয়ে গেছে বলে যখন তাঁকে দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’-র সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছিল না, তখন জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিজ্ঞানে তাঁর অবদান বিশ্বের বিজ্ঞানিমহল স্বীকার করেন। আইএনএসএ কি এমন ব্যক্তিকেও ‘ফেলো’ হওয়ার অযোগ্য মনে করেন? এর কিছু দিন পরেই অমলকুমার চিঠিতে জানতে পারেন, তিনি ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। ২৫-২৬ বছরের এক তরুণ গবেষকের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ পল ডিরাক-এর কাছে একটা চিঠি তিনি পাঠিয়েছিলেন। সেই যুবক সরাসরি ডিরাক-এর কাছে গিয়ে কাজ করতে চান। কিন্তু ডিরাক তাতে রাজি নন। যুবকটিকে তিনি জানালেন, “তোমার এত দূরে আসার দরকার নেই। তুমি রায়চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করো।”
অমলকুমার মনে করতেন, বিজ্ঞানী হলেন এমন এক জন মানুষ, যার ধ্যানধারণা হবে শুদ্ধ বৈজ্ঞানিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যিনি সামাজিক দাবি মেনে কোনও আপস করতে একেবারেই নারাজ হবেন। শিক্ষক হিসেবে মনে করতেন, শিক্ষকের কর্তব্য তো সুমহান, তিনি শুধু একটি বিশেষ বিষয়ে শিক্ষা দেবেন না, ছাত্রকে মানুষ করে তুলবেন, তার প্রতিভার বিকাশে সাহায্য করবেন।
অমলকুমার লিখেছেন, ‘‘আমার কাজ মানুষ কতদিন মনে রাখবে? ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে স্মরণ করবেন। ধরা যাক, সেটা বছর ২০-৩০ পর্যন্ত চলবে। আর বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয় ১০-২০ বছর বিজ্ঞানের আলোচনায় আমার কাজের একটা স্থান থাকবে। বা বড়জোর আর বছর পঞ্চাশ, তারপরে আমার কাজের কোনও স্থানই থাকবে না।’’ রজার পেনরোজ়ের নোবেলপ্রাপ্তি যেন প্রমাণ করে দিল, যত দিন বিজ্ঞান থাকবে, অমলকুমারের অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।