ছবি: বৈশালী সরকার
ওই যে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সাদা অর্কিড ‘কার্সন রিপ’-এর আবাস, কার্শিয়াং-এর মেঘ রোদ-কুয়াশামোড়া পাথর-বাঁধানো পথ। ক্রিসানথিমামের মতো সুন্দর ও দৃঢ়চেতা একটি মেয়ে নেমে আসছে সে পথ বেয়ে। উনিশশো তিরিশ-চল্লিশের দশকে মেয়েটির অভিনয়, রূপ, কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়েছিল তামাম ভারতবাসী। প্রকাশবাবু-রূপী সায়গলের সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য জুটিতে হৃদয় হারিয়েছিল কত শিহরিত মন। লন্ডনে একগুচ্ছ ডাক্তারি ডিগ্রির খেতাবধারী তাঁর বাবা, সুবিখ্যাত উমেদরাম লালভাই দেশাই আর নানা বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী মা সত্যবালা দেবী, যিনি তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীও বটে। সত্যবালা তাঁদের কার্শিয়াং-এর বাড়ি লিলি কটেজেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। সেই কত কাল আগে সত্যবালার মিউজ়িকের সাহায্যে বম্বের চেম্বারে মানসিক রোগের চিকিৎসা করেছেন উমেদরাম। উচ্চশিক্ষিত পরিবারের লীলার জন্ম আমেরিকায়। আপনার মনে হতেই পারে, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। নারী দিবসের গল্পে লীলার মতো মেয়েরা থাকবে কেন? উমেদরাম যেমন প্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে লীলার মা সত্যবালাকে বিয়ে করেছিলেন, তেমনি ছেলেপুলে-সহ সত্যবালাকে পরিত্যাগ করে আর এক বিদুষী গুণবতী মিত্রকে বিয়ে করেন। লীলাদের জীবনে সুখের গল্প শেষ হয়ে সংগ্রামের পথ শুরু হয়। সে আমলেও এই ভাগ্যের মারকে অস্বীকার করে রুপোলি পর্দার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা বড় সহজ ছিল না।
না-হয় নারী দিবসের ভাবনায় আপনি লীলা দেশাইকে ছেড়েই দিলেন। ওই পাহাড়ি শহরে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসতে পারেন এক রেল কলোনির এক সাধারণ পরিবারে। সেখানে যে বাঙালি গিন্নিমাকে দেখতে পাবেন, তিনি আমার ঠাকুরমা শিখরবাসিনী। সেকালের নিয়ম অনুযায়ী তাঁর সাত-আটটি ছেলেপুলে হলে কী হবে, তিনি প্রকৃত অর্থেই সে বাড়ির ‘নারী the Boss’! তিনি কাকভোরে ওঠে উনুনে ঘুঁটে সাজান না। বাচ্চাদের মূত্র-বাহ্যের কাঁথা-কাপড় কাচেন না। তাঁর বর ইয়া বড় বড় মাছের আঁশ এনে দেন। পানের বাটার পাশটিতেই সেই আঁশ ধুয়ে শুকিয়ে নিপুণ ভাবে কেটে তাতে ছুঁচ ভরার জন্যে আস্ত একটা টুলবাক্স সাজানো থাকে। গিন্নিমার জন্যে কর্তা কাচের বাক্স বানিয়ে এনেছেন। তাতে ওই মাছের আঁশে তৈরি ফুল পাতা, যেন অবিকল পাহাড়ি উদ্যান। শিখরবাসিনী ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ সেলাই না করে শ’সাহেবের বাড়িতে দেখা গোলাপগুচ্ছ ও আইভিলতার ছবি হুবহু ফুটিয়ে তোলেন। কলকাতা থেকে পাহাড়ে দিদির বাড়িতে বেড়াতে আসা তার বিবাহিত দুই বোন চমকে চমকে দেখে জামাইবাবু, বাচ্চাদের আর বৌয়ের জন্য চিঁড়ে-দুধ মেখে অফিস যায়। আর দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা গিন্নি কোনও কোনও দিন সে সব ফেলে রেখে কাজের ছেলেটিকে বলেন, ‘ভাল করে ময়দা মাখ, লুচি ভাজতি হবে।’ এর পর ছেলেমেয়েরা স্কুলে বেরিয়ে গেলে বোনেদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। ‘হুইসেল খোলা’ নামে প্রবল ঝরনার ধারে গিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে পর্বত-প্রকৃতি দেখতে থাকেন। যা দেখেন, মাছের আঁশ আর কার্পেট সেলাইয়ে তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। শিখরবাসিনীর সংসারে তাঁর আর তাঁর ননদের মেয়েরা সদ্য স্বাধীন দেশের এক পাহাড়ি জনপদে বসে রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’, ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদার মহড়া দেয়। সেখানে যদি তাঁর মেয়ে সিক্তা ঘোষ প্রমদা হয়, শোভা ছেত্রী শান্তার ভূমিকায়। লায়লা ও মরিয়ম আহমেদ দুই বোন হয়ে যায় কুরূপা ও সুরূপা। শিখরবাসিনী লক্ষ্মীর পাঁচালির পাশে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আউড়ে যান। মাঝে-মাঝেই ছেলেমেয়েদের শোনান খুলনায় পিতৃগৃহে শুনে আসা পণপ্রথা বিরোধী এক দীর্ঘ কবিতা। সেই কবিতায় আজ থেকে একশো বছর আগের এক প্রতিবাদী বাঙালি কন্যার জবানিতে বলা হয়েছে, এমন অপমানের বিয়ে না করলেই হয় (বাবা থাক না আমার বিয়ে/ কত আছে এম এ, বি এ)। ক্লাস ফোর পাশ শিখরবাসিনী ছেলেপুলে, বর, ঘরভরা স্থায়ী আত্মীয়-স্বজন— শান্ত ভাবে সব সামলেও শিল্পী-সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখেন। সংসারের খলনুড়িতে সম্পূর্ণ পেষাই হয়ে সমপর্ণের মহত্ত্ব
খুঁজে পান না।
একেও যদি ঠিক মনে না ধরে, ঠিক এই সময়েই ঘুরে আসতে পারেন বরিশাল শহরে। লতিকা নাম্নী এক গৃহবধূ তার যুবক স্বামী ও শিশুসন্তান সামলে অনুশীলন সমিতির সভ্য হয়। দেশভাগের ক্ষত সামলাতে না পেরে ঊনত্রিশ বছরে অকালপ্রয়াত হয় লতিকা। তার অদেখা নাতনি বহু কাল বাদে লোকমুখে শোনে, তার দিদিমা লাঠি ও ছোরা খেলায় পারদর্শী ছিল। চুল দিয়ে লোহা তুলতে পারত। লতিকা তার স্বল্পায়ুর জীবনে এমন ভাবে নৈতিকতা আর দেশাত্মবোধ রোপণ করে দিয়েছিল যে, তাঁর ন’বছরের মাতৃহারা কন্যা অন্য দেশে এসেও অশ্বিনীকুমারকে মনে করেছিল রামের অধিক যুগপুরুষ, আর ব্রতচারীকে প্রকৃত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত! এই যে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থানের বা পেশার মেয়েরা, তারা কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম সুতোয় বাঁধা। মনে রাখা দরকার এই পরিবারগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সামাজিক তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু এরা কেউই ব্রাহ্মদের মতো উদার শিক্ষিত পরিবারের নয়। রুপোলি পর্দার লীলা দেশাই একটি উদাহরণ মাত্র। ভাগ্যান্বেষণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এঁরা প্রত্যেকে এক আঁচলে বাঁধা। কেউ সেই আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা দিয়ে তৈজসপত্রের সিন্দুক খুলেছেন, কেউ রুপোলি জগতের হর্ষধ্বনি।
ছবি: বৈশালী সরকার।
*****
ঠিক কাদের জন্য নারী দিবস পালন করা হয়, সে সব আমরা খনিকটা জানি। ৮ মার্চ, ১৮৫৭-এ আমাদের সিপাহি বিদ্রোহের বছরে নিউ ইয়র্ক শহরে মহিলা বস্ত্রশ্রমিকেরা যথাযথ কাজের পরিবেশ এবং কর্মক্ষেত্রে তাঁদের অসম অবস্থানের প্রতিবাদে মিছিল করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল কাজের নির্দিষ্ট সময় এবং উপযুক্ত মজুরির। এটি শ্রমজীবী মহিলাদের প্রথম সংগঠিত ধর্মঘটগুলির মধ্যে অন্যতম। ওই শহরেই ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রথম জাতীয় নারী দিবস পালন করে। কেউ কেউ বলেন, শ্রমিকদের ধর্মঘটের সম্মানে এই দিনটিকে তাঁরা মনোনীত করেছিলেন। যদিও প্রথম দিকে দিনটি পালনের নির্দিষ্ট তারিখ ছিল না। আরও খানিকটা পিছিয়ে গেলে দেখা যায়, আমেরিকায় ১৮৪৮ সালেই এই বিদ্রোহের সূচনা হয়ে গিয়েছিল। দাসত্ব-বিরোধী কনভেনশনে মহিলাদের কথা বলতে বাধা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন আমেরিকান নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম দুই পথিকৃৎ এলিজ়াবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন এবং লুক্রেশিয়া মট। নিউ ইয়র্কে তাঁদের দেশের প্রথম নারী অধিকার কনভেনশনে কয়েক শতাধিক লোককে জড়ো করেন। একত্রে তাঁরা একটি ঘোষণার মাধ্যমে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার দাবি করেন। আজ আমরা মেয়েদের অধিকার সংক্রান্ত যে সব কথা খুব সহজেই পাই, তার পিছনে এমনই নারীবাদী আন্দোলন কর্মী ও তাত্ত্বিকদের অবদান ও আত্মাহুতি আছে। ১৮১৫ সালে জন্মানো এলিজ়াবেথ ক্যাডি স্ট্যানটনের সমাজজীবনে অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ব্যতিক্রমী, অনুসরণযোগ্য। স্বামীর নামের একটি অংশ নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন কিন্তু ‘মিসেস’ ব্যবহার করেননি। সে সময় সন্তানজন্ম ছিল পরিবারের একান্ত গোপনীয় খবর, এলিজ়াবেথ পুত্র ও কন্যার জন্মের পর বাড়ির সামনে লাল ও সাদা নিশান উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বহু সন্তানের জন্ম যে সময় ছিল অতি স্বাভাবিক, সেখানে আশ্চর্য রকম ভাবে তাঁর সন্তান সংখ্যা সীমিত। অত দিন আগেই তিনি দৃঢ় ভাবে জানিয়েছেন, মেয়েদের শরীরের উপর অধিকার ও শারীরিক সম্পর্কে নিজস্ব মতামতের গুরুত্বকে স্বীকার করতে হবে। আজও ক’জন তাঁর মতো বলতে পারে, “আ হেলদি উওম্যান হ্যাজ় অ্যাজ় মাচ প্যাশন অ্যাজ় আ ম্যান।”
সতীদাহ প্রথা নিবারণ ও বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্যে রামমোহন রায়ের বাড়িতে যখন আমরা গরুর হাড়গোড় ছুড়তে পারি, ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য সঙের গান আর জুতোর মালা প্রস্তুত করি, তখন এ কথা নিশ্চয়ই বলে দিতে হয় না যে, এমন বিদ্রোহী মেয়েদের জন্য পরিবার ও সমাজ কুসুম-কুশন ছড়িয়ে রাখেনি। আশ্চর্য হয়ে ভাবি, অমন মধ্যযুগীয় প্রতিকূল সময়েও এই মেয়েরা কী ভাবে এমন মনের জোর সংহত করেছিলেন, এত দূর এগিয়ে ভাবতে পেরেছিলেন! আমেরিকায় শুরু হওয়া এই শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন সোভিয়েট ইউনিয়নে গিয়ে নতুন ভাবে প্রাণ পায়। সেখানে এই মেয়েদের ক্ষমতায়ন, অধিকার, শ্রমজীবী মেয়েদের কেন্দ্র করেই পূর্ণতা পেয়েছিল। পরবর্তী কালে আমেরিকায় আরও বৃহত্তর বা ছোট ছোট নানা দিকে আন্দোলনের অভিমুখ ছড়িয়ে যায়। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সঙ্গে যুক্ত রং হল বেগুনি, সবুজ এবং সাদা। বেগুনি ন্যায়বিচার এবং মর্যাদার প্রতীক, সবুজ আশার আর সাদা বিশুদ্ধতার প্রতীক। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪-এর প্রচারাভিযানের থিম হল ‘ইনস্পায়ার ইনক্লুশন’। এখানে সার্বিক ভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সমতার জন্য নারীদের সংগ্রামের গল্প কোনও একক নারীবাদী বা কোনও একটি সংগঠনের নয়, মানবাধিকারের বিষয়। যখন চাকরি থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রে মহিলারা দৃশ্যমান থাকেন না, তখন আমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে হবে, ‘যদি না থাকে, তবে কেন নেই?’ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা থেকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে, কর্মক্ষেত্রে, বাড়িতে এবং এর বাইরেও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন গঠন, মহিলা প্রতিভা নিয়োগ, তাকে কাজে ধরে রাখা এবং তার বিকাশ, নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলা, ব্যবসায় অংশ নিতে গেলে তাদের সমর্থন করা প্রতিটি ক্ষেত্র এই ‘ইনক্লুশন’-এর মধ্যে পড়ে।
ভারতের নিজস্ব একটি নারী দিবস আছে। ১৮৭৯ সালে হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে নায়ডু পদবিতে আমরা চিনি। তাঁর জন্মদিন স্মরণে আমাদের দেশে নারী দিবস তেরো ফেব্রুয়ারি। রাজনৈতিক সক্রিয়তা, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি ছাড়াও, এক জন বিশিষ্ট কবি হিসেবে ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ নামে তাঁর পরিচিতি ছিল। অনেক প্রাচীন পাঠকের মনে পড়বে সরোজিনীর ‘পর্দানশিন’ কবিতাটি। প্রথাগত ও রক্ষণশীল সমাজের মহিলাদের জীবনের জটিলতার উপর আলোকপাত করা এই কবিতাটি ঘোমটার মধ্যে থাকা জগৎ আর পুরুষের যাপিত প্রাণবন্ত, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের তীব্র বৈপরীত্যকে তুলে ধরেছিল। এই পর্দার আড়ালের মেয়ে বলতে পাঠকের রাসসুন্দরী দাসীর কথা মনে পড়তেও পারে। সেই অতি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের রাসসুন্দরীর অবরোধ এমন ছিল যে, দিনের বেলা কর্তার ঘোড়াকে দেখেও তিনি ঘোমটা টেনেছিলেন!
*****
এমন বিখ্যাত হয়ে যাওয়া মেয়েদের পাশে পথেঘাটে চলতে চলতে কত আশ্চর্য মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাদের কথা পথেই হারিয়ে যায়। সন্দেশখালি যাওয়ার পথে ভাঙড়, মালঞ্চ হয়ে ধামাখালির সরকারি বাসে এক মহিলাকে দেখতে পাবেন পরম মমতায় বুকের কাছে এক ছাগলের বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছেন। কথায় কথায় শান্তিবালা বলবেন, আয়লায় তার হাঁস-হাঁসিরা ভেসে চলে গেছে। জল এলে ছাগল জলে এ দিক-ও দিক চলে যায় না, মানুষের গা ঘেঁষে থাকে। ক’দিন পর অবাক হয়ে দেখবেন, সন্দেশখালির দুর্গম দক্ষিণ প্রান্তের স্কুলে শান্তিবালার মেয়ে আপনার ক্লাসে এসে বসেছে।
মেয়েটির ব্যাগ থেকে দুটো হাঁসের ডিম বেরোবে। বলবে, ‘মা আপনার সঙ্গে যাতায়াত করে। অত দূরে ফেরত যাবেন, তাই সেদ্ধই করা আছে।’
আপনি অবাক হয়ে বলবেন, ‘তবে যে বলল আর হাঁস পুষবে না?’
মেয়ে বলবে, ‘না পুষে উপায় কী? বেড়মজুরে আমাদের জমি নুনের তলায় চলে গেছে। শুনছিলাম নুন সইতে পারে আর জলের অনেক উপরে মাথা তোলা ধানের চাষ হবে, তা আর হল কই?’ আপনাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দম না ফেলে বলে চলবে, ‘মা আর মায়ের কয়েক জন বন্ধু মিলে ডিমের ব্যবসা করছে, ছাগল পালছে। না হলে আমি শহরে কলেজে পড়তে যাব কী করে? মা বলেছে, আপনি তো গ্রামে বেশি দিন থাকবেন না। শহর থেকে এখানে কেউ মরতে আসতে চায় না। আমাদেরই তো পড়াতে আসতে হবে।’
তোড়ে ভেসে আসা এই কথার পর হাতে দুটো সেদ্ধ ডিম নিয়ে কুঁকড়ে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা করবেন আপনি!
কে জানে শান্তিবালা আর ওর মেয়ে, বেড়মজুর, সরবেড়িয়ার আন্দোলনে মিশে আছে কি না, ওদের নুন-ঢোকা জমি ভেড়িতে পরিণত হয়ে গেছে কি না, তা-ই বা কে জানে। কিন্তু ওর মতো সাধারণ মেয়েদের প্রতিবাদ যে জারি আছে, তা আমরা সম্যক টের পাচ্ছি।
গল্পের কোনও শেষ নেই। প্রত্যন্ত পাহাড়ের বাঁকে এক ধোঁয়া ওঠা আঁশটে গন্ধওয়ালা দুধ চা, ফাকসা মোমো আর ইয়াকের দুধ জমিয়ে তৈরি ‘ছুরপি’ বয়ামে ভরে বিক্রি করা পেমা ছিরিং নির্বিকার ভঙ্গিতে দেখাবে, গর্জমান ঝরনার ও পারে তার ঘর। শীতে ঝোরার জল শুকিয়ে গেলে পাথর টপকে চলে আসে। বর্ষায় জোঁকে ভরা পায়ে চলা পাহাড়ি পথ ‘চোরবাটো’ পেরোনো মানে প্রাণ হাতে করে আসা। তুমুল বৃষ্টিতে কাঠের ছাউনির দোকানে পেমার তৈরি স্থানীয় লাল গোল লঙ্কা ‘ডল্লো খরসানি’র আগুন-ঝাল চাটনি চাটতে চাটতে শুনবেন, ছেলেরা পর্যটনের গাড়ির ব্যবসা ছেড়ে এলাকা ছাড়তে চায় না। এই ভাবেই হায়দরাবাদ বেঙ্গালুরু দিল্লিতে ওরা ওদের মেয়েদের পড়ায়। মেয়েরা পড়া শেষ করে ফিরে আসুক বা বাইরে প্রতিষ্ঠিত হোক, মা-বাবার পাশে থেকে যায়। প্রসঙ্গত মনে পড়বে, এই এলাকার অনেক মেয়ে সংসারে জোয়ার আনার আশায় ইজ়রায়েলে চলে গেছে। সেখানে বয়স্ক মানুষদের দেখাশোনার জন্য যথেষ্ট বেতন পাওয়া যায়। আপনার ছাত্র সুমন ভুটিয়া শান্ত ভাবে তার মায়ের বাঙ্কারে চলে যাওয়ার ভিডিয়ো দেখাবে। শিশুসুলভ সারল্যে বলবে, ‘ওখানে ডোম আছে এক রকম। সেখানে প্যালেস্টাইনের মিসাইল, বোমা সব আটকে যায়।’
মৃত্যুভয়ে যুদ্ধরত দেশ থেকে পালিয়ে এলে মা সংসার প্রতিপালন করবেন কী করে? আর এক উচ্চবিত্ত পরিবারের এক মায়ের আকুতির কথা মনে পড়ে। রাজস্থানের গ্রামে থাকা তার পরিবারের কানে যেন তার কন্যাসন্তানের অস্তিত্ব না পৌঁছয়, এই অনুরোধে পেরেন্টস-টিচার্স মিটিং-এ আপনি ভারী বিরক্ত হয়েছিলেন। তার মা শঙ্কিত হয়েছিলেন যখন আপনি আহ্লাদ ভরে বলেছিলেন, ‘আর একটু চেষ্টা করলে মেয়েটি বোর্ডের ফলাফলে উপরের দিকে থাকতে পারে।’ স্বাভাবিক ভাবে আপনি ভেবেছিলেন, রক্ষণশীল পরিবারে এর পরে হয়তো বিয়ে-থা দিয়ে দেওয়ার জন্য মায়ের এমন অভিব্যক্তি। কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, যখন শুনলেন, মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে চান বলেই নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি, মা-বাবার কাছে মেয়ে জন্মানোর খবর গোপন রেখেছেন। কোনও দিন তাকে গ্রামে নিয়ে যাননি। খুব ভাল রেজ়াল্ট হয়ে গেলে কাগজে নাম বেরিয়ে যাবে এবং তারা সব জেনে যাবে। তিনি চান, মেয়ে মোটামুটি একটু ভাল রেজ়াল্ট করে জীবনে নিজের ইচ্ছেমতো বেঁচে থাকুক, আর কিছু নয়।
এমন লড়াকু মায়ের পাশে উল্টো চিত্রটাও দুর্লভ নয়। শিক্ষিত যোগ্য মেয়েদের আপস বহু ক্ষেত্রে তাদের লড়াই থেকে পিছনে ঠেলে দেয়। ওই যে যশোধরা রায়চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মল্লিকা সেনগুপ্ত বলছেন, ‘আমার মা আমি যখন ছোট তখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার ঠিকমতো দেখাশোনা হবে না বলে। আমি সেজন্য মাকে সারা জীবনই অনুযোগ করি। কিন্তু আমার পাশের বাড়িতেও এক ভদ্রমহিলা এই সময় দাঁড়িয়েও ঠিক একই ভাবে ছেড়ে দিয়েছেন স্কুলের চাকরি। মানে এখনও এই ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। খুবই দুঃখের।’ কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ‘আমার কবিতাকে আমি কখনওই খুব বেশি উপরে জায়গা দিইনি। দিলে বোধহয় ভালো করতাম কারণ তা হলে আমার অনেক বেশি লেখা হত এবং নিজের প্রতি সুবিচার করা হত। তখন আমি খুব যত্ন করে সংসার করতাম... আমি সবটাই খুব সুন্দর করে করতে চেয়েছি। কিন্তু সব কিছু সুন্দরভাবে করা যায় না... একটাকে সুন্দর করে করতে হয়, অন্যগুলো না হল, না হল।’
এইটি হল আসল কথা। দেবী দুর্গার উপমায় যে কৌশলে মেয়েদের সর্বগুণান্বিত বলে, হাতে নিত্যনতুন কায়দার সার্ভিং স্পুন, স্প্যাচুলা ওভেন, পোর্টেবল সেলাই মেশিন আর ল্যাপটপ ধরিয়ে দেওয়া হয়, শেষ অবধি ওগুলি হাতা খুন্তি উনুনের নব্য অবতার। উপরন্তু যোগ হয়েছে ল্যাপটপ-রূপী অর্থ উপার্জনের বাধ্যতা। সরকারি কর্তা হোক বা কর্পোরেটের বৌমা, ছুটির দিনে এখনও বেশির ভাগ পরিবারের বর শ্বশুর শাশুড়ি সন্তান মায়ের হাতের পিঠে খাওয়ার আশা পুষে রাখে। অধিকাংশ মেয়েরা সপ্তাহের অন্য দিন সময় না দিতে পারার অপরাধবোধে ইউটিউব দেখে পার্শে ঝাল, মাটন কষা রাঁধতে বসে। এতে যে আম-ছালা দুই-ই চলে যাচ্ছে, তা আর কে টের পায়!
গৃহশ্রমের কোনও অর্থ উৎপাদক সত্তা নেই। পুরুষ দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে দেখা অনেক মেয়েই মনে করেন এই শ্রম মর্যাদার। এর বিনিময়ে অর্থ চাইলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মালিক-কর্মচারীর সম্বন্ধ তৈরি হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই গৃহলক্ষ্মীর মর্যাদার ভূমিকাটি সংসারে রক্ষিত হয় না, ফলে প্রতিদিন বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছনো থেকে বরের অন্তর্বাস কাচা নিয়ে শেষাবধি তাঁরা হতাশা আর ক্ষোভই প্রকাশ করতে থাকেন। এই বিনা মাইনের শ্রম-বাজারে কোনও মে দিবসের নির্দিষ্ট সময় দাবির প্রশ্নই নেই। অবরোধবাসিনীর বাধ্যবাধকতা যাদের নেই, স্বেচ্ছায় স্বর্ণখাঁচার হৃষ্ট পাখি হয়ে যে বেড়ির অধীনতা বেছে নেয়, তার কাছে নারী দিবসের অর্থ দাঁড়ায়— গোলাপ চালাচালি, শাড়ি ও গয়নার দোকানের মেয়ে-ঠকানো সেল।
*****
ক্ষমতা এমনি এমনি আসে না। তাকে অর্জন করতে হয়। অরণ্য-প্রকৃতি-নদী রক্ষায় কত যে মেয়েদের গল্প! কেউ সরাসরি মাঠে ময়দানে নেমেছেন, কেউ জয়া মিত্রের মতো মাঠের প্রতিরোধ জারি রেখেও তার সঙ্গে নদী-বিশেষজ্ঞ হিসেবে লেখাকে যুক্ত করে নিয়ত সতর্ক করে চলেছেন। অরণ্যপ্রাণের কথা উঠলে হস্তী বিশেষজ্ঞ পার্বতী বড়ুয়ার কথা উঠবেই। সুকনার জঙ্গলে বনরক্ষীদের এক সেমিনারে ঈষৎ দূরত্বে, প্রকৃতির মধ্যে তাঁকে দেখেছিলাম। অসমের গৌরীপুরের একদা রাজকুমারীর ছোটখাটো ক্ষীণ শরীর আর সারা জীবন শাড়ি পরে হাতির সঙ্গে ঘর-সংসার করা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। মনে পড়ছিল মার্ক শান্ড-এর বইটির কথা। রাজা চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার বোলসের অকালপ্রয়াত ভাই মার্ক শান্ড এক অভূতপূর্ব কীর্তি করেছিলেন। লন্ডনের ঐশ্বর্য আর উচ্চকোটির জীবনের ঝলমলানি থেকে হঠাৎই ভারতে চলে আসেন। মেলা থেকে তারা নামের এক হাতি কিনে মাহুতের মতোই তার পিঠে চড়ে ভারতভ্রমণে বেরোন। পার্বতী বড়ুয়ার প্রতি ছিল তাঁর অশেষ শ্রদ্ধা, অন্তরঙ্গতা। ডিসকভারি চ্যানেলে পার্বতীকে নিয়ে দুই পর্বের তথ্যচিত্রে মার্ক তাঁর গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘প্লাবন জল’ উপন্যাসে ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলন কর্মী হিসেবে কত অজানা নারীর কথা পাই। মেধা পাটকরকে আমরা জানি, কিন্তু তাঁর আঁতুড়ঘর কী ভাবে তৈরি হয়, সে কথা ক’জন জানি? মেধার মা ইন্দুমতীর কথা শুনতে পাই এ ভাবে, “তাঁদের বাড়িতে পুজোআচ্চা হয় না। মা চলে গেছেন সবে পাঁচ বছর হল। কুসংস্কার ধর্মবিশ্বাস কিছুই মাকে স্পর্শ করেনি। রাষ্ট্রীয় সেবা দলে কাজ করতে আরম্ভ করেছিলেন। অল্প বয়সে অফিসে কাজ করার পাশে ইউনিয়ন করেছেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও অফিস গেছেন।” ইন্দুমতী খানোলকরকে মেধা পাটকরের মা বললে সেটা অদ্ভুত শোনায়। যে মেধার সেমিনারে বসে আত্মশ্লাঘা অনুভব করি, এই মুহূর্ত অবধি তাঁর কাজের কোন খবরটাই বা আমরা রাখি, মনে মনে হলেও পাশে দাঁড়াতে পারি? মেধাকে নিয়ে ঔপন্যাসিক লিখছেন, “সাঁইত্রিশ বছর সময়। কত কাজ, কথা, কত সমালোচনা ও ধিক্কারের মুখোমুখি হয়েছেন। কত পদযাত্রা, কত ধরনায় বসা, জল সত্যাগ্রহে ভেসে যেতে যেতে বাঁচা। জীবন আর আন্দোলন এক হয়ে গেছে মেধার কাছে। এর কোনওটাই তাঁর ত্যাগ স্বীকার নয়, কেবল বাঁচা। অনেক জীবনে জড়িয়ে থাকা।”
বাস্তবের চরিত্র যখন কথাসাহিত্যে স্থান পায়, তখনও আমরা কত প্রত্যয়দীপ্ত নারীদের দেখি। আবার বাস্তব আর কল্পনার মেয়েরা কোথাও যেন মিলেমিশে যায়। আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-র সত্যবতীর নিঃসঙ্গ রক্তাক্ত লড়াই ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বাস্তবের কবি রাধারাণী দেবী যেন উপন্যাসের চরিত্রের মতো সামনে এসে দাঁড়ান। বাল্যবিধবা রাধারাণী দ্বিতীয় বিবাহের সময় পাত্র নরেন্দ্র দেবের কাছে নিজেই নিজেকে কন্যাদান করেন। তাঁর অসাধারণ কবিত্বে ও ব্যক্তিত্বে রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র প্রমুখ বিশিষ্ট জনদের গুণমুগ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার বিজেতা নমিতা গোখলের ‘থিংস টু লিভ বিহাইন্ড’ উপন্যাসে মেধার মতো বিশ্ববরেণ্য নেত্রী নন, নৈনিতাল আলমোড়ার এক সাধারণ মেয়ের গল্প আছে। বাবা-মায়ের সংসারে তার ভালবাসার অভাব নেই, কিন্তু সংস্কার তাকে বিবাহিত হয়েই ‘স্বাধীনতা’ পেয়েছে বলে মনে করায়। এই স্বাধীনতা নিজস্ব সংসারের কর্ত্রীপদ লাভ করার। রক্ষণশীল উচ্চবর্ণ পরিবারের কত বাছবিচার তার জীবনে। রান্নার আগে স্নান, সেলাইহীন কাপড় পরা। সে তার স্বল্প শিক্ষায়, কিন্তু গভীর কাণ্ডজ্ঞানে উপলব্ধি করে, ‘মাঙ্কি ইট হোয়াট দে প্লিজ়, অ্যান্ড দে ডোন্ট গো টু নরকলোক অ্যান্ড বার্ন ইন দ্য ফায়ারস অব হেল।’ এই যে সাধারণ মেয়েদের কাণ্ডজ্ঞানের কথা, দৈনন্দিনের রসুইঘর থেকে খিড়কি পুকুরেই যাদের বাধ্যত বাঁচতে হয়েছিল, তাদের ‘পর্দানশিন’ জীবনের কথা সরোজিনী নায়ডু থেকে আশাপূর্ণা দেবীর মতো মেয়েদেরই লিখে যেতে হয়। গল্প কবিতা উপন্যাসের নিখুঁত প্লট বিভাজন, কেবলমাত্র আঙ্গিক কলাকৌশল দিয়ে এর বিচার হয় না। যে সমাজ এখনও পুরুষের দৃষ্টিকোণে চালিত, সেখানে এই ছোট ছোট বিষয়গুলি মেয়েলি বলে হেলাফেলার বা গবেষকের কাছে মর্যাদার নয়— সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ‘সে-যুগে মায়েরা বড়’ বইটিতে বড় চমৎকার ও সহজবোধ্য ভাবে এই স্রোতটি নির্দেশ করেছেন। দেখিয়েছেন, যে সভ্যতা কৃষিকাজের উপর গড়ে উঠেছে, তার আবিষ্কারক মেয়েরাই। শিকার করতে শেখার আগে পর্যন্ত মানুষের দলের মধ্যে কাজের ভাগাভাগি ছিল না। চামড়ার কর্কশ পোশাক থেকে সরু সুতো বার করে, রং তৈরি করা পোশাক— মেয়েদেরই আবিষ্কার। প্রাথমিক ভাবে ঘর তৈরি করা বা ঘরামির কাজও ছিল মেয়েদের। দেবীপ্রসাদের কথাগুলি ধরেই মনে হয়, এর পর থেকে নানা অছিলায় মেয়েদের ঠেলে দেওয়ার গল্প শুরু হয়। ধীরে ধীরে তাদের শুধুমাত্র গৃহকর্ম, সন্তান উৎপাদন, পরিবার প্রতিপালনে রেখে দিয়ে দেবী বা দাসীতে পরিণত করা হল। প্রতিটি পুরুষ ধর্মগুরু তাদের বিচারের ভার নিলেন। গুরুদের হাত থেকে ব্যাটন গ্রহণ করলেন রাজা পুরোহিত সমাজপতিরা। তবু কিন্তু মেয়েদের কথা থামেনি। ব্যক্তিপুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত থেকেছে। কখনও কম, কখনও বেশি। আজ যখন ফের অশনি সঙ্কেত দেখা দিয়েছে, ফের যেন সারা পৃথিবী জুড়েই নিরাপত্তা ও ধর্মের কড়াপাকে মেয়েদের গৃহমধ্যে ফেরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন শ্রমজীবী মেয়েরাই শুধু নয়, বিপন্ন ওই লীলা দেশাই থেকে গিন্নিমা-ও। এক সময় ভদ্রঘরের মেয়েরা থিয়েটারে নৃত্যে অংশ নিত না। শান্তিনিকেতনে ছাত্রজীবনে এক হলুদ আলোয় ভেসে যাওয়া দুপুরে, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী ভঞ্জের মুখোমুখি বসে বিস্ময়ে ভেবেছিলাম, কোন অপার সাহসে তৎকালীন সমাজের অপার ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন? তবে সেই সাহসটির নাম অবশ্যই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গল্প শুনেছিলাম যে, নন্দলালপত্নী সুধীরা প্রভাতে উঠে সবে বাড়ির উঠোনে দৈনন্দিন কাজ শুরু করেছেন, এমন সময় রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ। নন্দলাল বাইরে বাইরে ঘোরেন, তাঁর কী হল ভেবে সুধীরা খানিক ত্রস্ত। রবীন্দ্রনাথ আসল কথাটি পেড়ে ফেলেন। তাঁর ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্যের জন্য গৌরীকে চাই তাঁর। সুধীরা নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা আপনার সংসারেই থাকি, তার নিন্দা হলে দায় আপনার, প্রশংসা হলেও আপনার।’ এ গল্পের সত্যি-মিথ্যে জানি না, গৌরী স্টেজে উঠেছিলেন এবং তাঁর
পাশে থাকার জন্য রবীন্দ্রনাথও একটি চরিত্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ভাবতে ভাল লাগে যে গণতন্ত্রের, স্বাধীনতার স্বাদ এক বার পেয়ে গেছি, তাকে রক্ষা করতে শেষাবধি আমরাও, সাধারণ মেয়েরাও ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গৌরীর মতো স্টেজে উঠে দাঁড়াব। না, রবীন্দ্রনাথ নেই বলে এখন আমাদের কোনও আফসোস নেই। আমাদের পিছনে স্বর্ণকুমারী থেকে বেগম রোকেয়া, কাদম্বিনী বসু, রাধারাণী দেবী, আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা, কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন আর অসীমা চট্টোপাধ্যায়, বিভা চৌধুরীদের মতো পূর্বসূরিরা অটল প্রহরায় দাঁড়িয়ে আছেন।