ঘুম ও ঘুমের ওপর দিয়ে ভেসে আসা মেঘ! মেঘের কটন ক্যান্ডির ও দিকে কী নীল আকাশ! আর সেইখানে কে দাঁড়িয়ে থাকে এমন দিনে! ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতে ফিরতে দেখতাম, শীতের কুসুম ভেঙে বসন্তের রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের ছোট্ট মফস্সলে। মা ডাকত, “বাবুই, ওঠ, আর ঘুমোস না! আজ সরস্বতী পুজো তো!”
সরস্বতী পুজো! ছোটবেলায় আমাদের কাছে কী যে আনন্দের ছিল এই দিনটা! যৌথ পরিবারের ছোট্ট বাড়িটা এই দিন জেগে উঠত খুব ভোরবেলা। আমাদের স্নান করিয়ে দেওয়া হত তাড়াতাড়ি। তার পর পাজামা পাঞ্জাবি পরিয়ে বলা হত, “কিছু খাবি না কিন্তু! অঞ্জলি দিতে হবে!”
অঞ্জলি ছিল পুজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ এর পরেই কুল খেতে পারব আমরা। আসলে সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে তো ঠাকুর
পাপ দেন! পাপ-পুণ্যের সে ছিল এক আশ্চর্য সাদা-কালো জীবন!
প্রায় সব বাড়িতেই পুজো হত। তার সঙ্গে পুজো হত যার যার পাড়ার মাঠে আর স্কুলে। ছোট ছিলাম বলে রাতে প্যান্ডেলে থাকার অনুমতি পেতাম না। কিন্তু শুনতাম নানা গল্প। শ্যামল পালিতের বাড়ির ফুলগাছ এক রাতে কী ভাবে সাফ হয়ে গেল! কী ভাবে গীতাজেঠিমার দশটা নারকোল গাছে আর একটাও নারকোল থাকল না! কী ভাবে খিটখিটে মিত্রকাকুর কলাবাগানের অর্ধেক পাতা হাওয়া হয়ে গেল এক রাতের মধ্যে!
এর কতটা সত্যি আর কতটা বানানো সেটা ঠিক না বুঝলেও, শুনতে কিন্তু দারুণ লাগত। আমাদের সামান্য নিস্তরঙ্গ জীবনে সে-ই ছিল এক অ্যাডভেঞ্চার। গোপনে ইচ্ছে হত, বড় হয়ে আমরাও এমন করব!
ছিল পুজোর আগের রাত অবধি চাঁদা তোলার হিড়িক। ছাপানো চাঁদার বই হাতে ছোটরা বেরিয়ে পড়ত। অধিকাংশ বাড়িতে বলা হত, “সরস্বতী বানান কর তো! ঠিক বললে এক টাকা দেব!”
ব্যস! ছোট্ট চাঁদা-পার্টিরা কষে সরস্বতী বানান শিখে যেত! সেখানে মাঝে মাঝে আমার দিদুনের মতো কেউ গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিত সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, “আমার নাতির
নাম স্মরণজিৎ। বানান ঠিক বলতে পারলে পাঁচ
টাকা দেব!”
প্যান্ডেলে সবাই যেতাম বই আর পেনসিল বক্স নিয়ে। নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা পাজামা-পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াত। আমাদের রংচটা জীবনে সে ছিল আশ্চর্য রঙিন একটা দিন।
সেই মফস্সলে অনেক বড় বড় মাঠ ছিল। প্রতিটি মাঠেই আলাদা আলাদা পুজো, আর সেখানে কত রকমের যে প্যান্ডেল হত, তার ইয়ত্তা নেই! শুধু আফসোস ছিল এই যে, আমাদের পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলটা হত সাদামাটা। তাও খুব ভিড় হত সেখানে। হবে না-ই বা কেন, বিউটিদি সকাল থেকে পুজোর আলপনা দিত যে!
বিউটিদি ছিল আমাদের জয়া প্রদা। সেই ন’-দশ বছর বয়সেও বুঝতাম, মানুষ আসলে কাকে দেখতে আমাদের পুজোর প্যান্ডেলে ভিড় জমাচ্ছে।
এ রকমই এক পুজোর দু’দিন আগে বিউটিদি আফসোসের গলায় বলেছিল, “আমাদের পাড়ার প্যান্ডেলটা আবারও সেই চৌকো দেশলাই বাক্সের মতো হবে! দূর! ভাল্লাগে না!”
কথা হচ্ছিল পাড়ার মাঠে। সেখানে পাড়ার সবাই ছিল। বিউটিদির আফসোসে আকাশ কালো করে এসেছিল প্রায়। কিন্তু কে কী ভাবে বিউটিদির এই কষ্টটা দূর করবে, ঠিক বুঝতে পারছিল না।
আচমকা শ্যামাকাকা বলে উঠেছিল, “ঠিক আছে, আমরাও ফাটাফাটি প্যান্ডেল বানাব এ বার! একটা খোলা বই। মাঝে সরস্বতী ঠাকুর! যা টাকা লাগে আমি দেব!”
আমাদের বাড়ির গায়েই ছিল পুকুর। তার অন্য পাশে একটা টালির বাড়িতে শ্যামাকাকা একা থাকত। বেঁটে রোগা মানুষটার চোখগুলো ছিল সার্চলাইটের মতো। বড় ঢাউস মাথায় ছিল কদমছাঁট চুল। দূর থেকে দেখলে মনে হত আলপিনের মাথায় মটরদানা বসানো আছে!
শ্যামাকাকা এত টাকা কী ভাবে দেবে! পাড়ার কেউই বুঝতে পারল না। কিন্তু শ্যামাকাকা টাকা দিল। সারা রাত সারা দিন কাজ করে মানিকদার টিম বানিয়ে ফেলল দারুণ এক প্যান্ডেল!
লোকে এবার শুধু জয়া প্রদা নয়, প্যান্ডেল দেখতেও ভিড় করল আমাদের পাড়ায়। সন্ধেবেলা অনুষ্ঠান হল। সোমাদি গান গাইল। পাড়ার ছোটরা নাচল। কত জন আবৃত্তি করল। আর সবার শেষে শ্যামাকাকা আচমকা বিউটিদিকে জিজ্ঞেস করল, “কী, খুশি তো?”
শ্যামাকাকার সার্চলাইটের মতো চোখে সে দিন যেন জোনাকি জ্বলে উঠেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য! ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বড়-হয়ে-উঠতে-থাকা আমি যেন বুঝতে পারছিলাম, পুজো আর শুধু পুজোয় আটকে নেই। কোথায় যেন সেখানে প্রেম এসে মিশল আজ!
পরের দিন ভাসান। শ্যামাকাকা জমিদারি গলায় বলল, “ব্যান্ড পার্টি আনো, এই যে টাকা!”
বিশুদা, বিধানকাকা, ছোটকাদারা সবাই ছুটল শেষ মুহূর্তে ব্যান্ড পার্টি জোগাড় করতে! আর তখনই সবাইকে অবাক করে পাড়ায় ঢুকল পুলিশের জিপ। কালো ভ্যান!
ছোট্ট আলপিনের মতো শ্যামাকাকা পাড়ার গলিঘুঁজি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। পুলিশ বলেছিল, কোথায় এক মারোয়াড়ির গদিতে কয়েক দিন আগে শ্যামাকাকারা নাকি চার জন মিলে ডাকাতি করেছে!
পাড়ার বড়রা প্রথমে হতভম্ব। তার পর গেল রেগে। কেউ বলল, “চোর!” কেউ বলল, “ডাকাত!” কেউ বলল, “পুজোয় ডাকাতির টাকা দিয়েছিস! ছি ছি! এ কী পাপ হল!”
শ্যামাকাকা সবার মাঝে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “ডাকাতির এক টাকাও এখানে দিইনি। সব আমার কাছে আছে। পুজোর টাকা আমি মায়ের দুটো বালা আর একটা চেন বিক্রি করে দিয়েছি। মা ওটাই রেখে গিয়েছিল আমার জন্য। ওটা পাপের টাকা
নয় মোটেও!”
এক জেঠু অবাক হয়ে বলেছিল, “মায়ের গয়না! তুই পাগল!”
পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় শ্যামাকাকা কারও দিকে তাকায়নি। শুধু গাড়ির মধ্যে বসে
জাল আঁকড়ে ধরে এক বার মাত্র তাকিয়েছিল বিউটিদির দিকে!
না, বিউটিদি তাকায়নি।
শ্যামাকাকা বিড়বিড় করে কিছু বলেছিল ভ্যানের মধ্যে বসে। কী বলেছিল শ্যামাকাকা? আমি জানি না। তাও যেন এখন মনে হয় বলেছিল, “প্রেমের কাছে সব তুচ্ছ!”
সাতাশি সালের সেই দিনটা আমার মনে কোথায় যেন সরস্বতী পুজোর সঙ্গে এক করে দিয়ে গিয়েছিল প্রেমকে!
না, তখনও পৃথিবীতে মুক্ত অর্থনীতি আসেনি। বিদেশি কোলা, জিনসের প্যান্ট আর ভ্যালেন্টাইন’স ডে বাঙালির ঘরের জিনিস হয়ে যায়নি। তখন ‘ডে’ বলতে আমরা শুধু জানতাম রিপাবলিক, ইন্ডিপেন্ডেন্স আর মে ডে। সত্যি বলতে কী ভ্যালেন্টাইন’স ডে যে আসলে কী, তা-ই আমরা জানতাম না। আমাদের কাছে সব দিনই ছিল প্রেমের দিন, ভালবাসার দিন।
তখন সমাজ অনেক বাঁধনে বাঁধা ছিল। একটা ছেলে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বললে সেই খবর মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ত চার দিকে। পাড়ায়-বেপাড়ায় সবাই ছিল অভিভাবক। উত্তম-সুচিত্রা আর সৌমিত্র-অপর্ণায় মোহিত বাঙালি নিজেদের আশপাশে প্রেমের ব্যাপারে ছিল ভীষণ রক্ষণশীল।
এই পুজোর দিনটায় কেবল একটু আলগা প্রশ্রয় পাওয়া যেত। পাজামা-পাঞ্জাবি আর বাসন্তী শাড়ি তাই সামান্য দ্বিধায়, সামান্য ভাললাগায় একটু কাছাকাছি আসত। অঞ্জলির ফুল দেওয়ার ছলে অসামান্যা কারও হাতের স্পর্শ পেত কোনও নবীন হাত! দুপুরের ঝাল-ঝাল খিচুড়ির স্বাদের
সঙ্গে মিশে থাকত কারও জন্য রুমাল দিয়ে রাখা পাশের সিট। বিকেলে কোনও প্যান্ডেলের পিছনের নির্জন বকুলগাছের তলায় দু’জনের প্রথম চুম্বন উঠে যেত ব্যক্তিগত ইতিহাসে। ভবিষ্যতের নির্জন ভাললাগার স্মৃতিতে।
নব্বই আসতে আসতে আমরাও বড় হয়ে উঠলাম। আমাদেরও জীবনে চলে এল গোলাপি শাড়ির কোনও রোগা কাশফুলের মতো মেয়ে। সুগন্ধী কাগজে লেখা সাহসী প্রেমপত্র। প্রত্যাখ্যানের নির্জন রাত ও প্রথম বিচ্ছেদের মনখারাপ। সরস্বতী পুজো হয়ে উঠল ভাল লাগার মানুষের কাছাকাছি যেতে চাওয়ার দিন।
আমাদের স্কুলের পুজোর ভার এসে পড়ল আমাদের উপর। রাত জাগার পারমিশন পাওয়া গেল। পাওয়া গেল বড় হয়ে ওঠার অনুমতিও! আমরা সে বার ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। পুজোর আগে নানা স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়া নিয়ে একটা ঝামেলা লাগল। আনন্দ রাউত পুজো কমিটির সেক্রেটারি, সে তো যাবেই, কিন্তু তার সঙ্গে কে যাবে সেই নিয়েই ঝামেলা! শেষে সবাইকে তর্কে ও
গলার জোরে হারিয়ে জয়ী হল আমাদের তাপু। তপোব্রত রায়!
তাপু আমাদের স্কুলেই কমার্স নিয়ে পড়ত। দারুণ ক্রিকেট খেলত। ফাস্ট বোলিং-এ যথেষ্ট নাম ছিল এলাকায়! কিন্তু ওর এই বোলিং-ই যে ওকে মহা বিপাকে ফেলেছিল সেটা ক’জন জানত!
মেয়েটির নাম ছিল শ্রমণা সেন। বাড়ি ছিল গঙ্গার ধারে। শ্রমণা আর তাপু একই ইংরেজি স্যরের কাছে পড়তে যেত। শ্রমণা ছিল শান্ত আর গম্ভীর। সে ভাবে হাসতই না কখনও! অদ্ভুত এক পারসোন্যালিটি ছিল মেয়েটার। সামনে দাঁড়িয়ে কেউ ফালতু কথা বলতে পারত না। এমনকি শুনতাম স্যররাও নাকি শ্রমণাকে সমীহ করে চলতেন! কিছু বখাটে ছেলে শ্রমণাকে আড়ালে ‘জ্যোতি বসু’ বলে ডাকত।
আমাদের তাপু, একটা ঘরোয়া ইংরেজি টেস্টে কী একটা উত্তর লিখতে না পেরে শ্রমণার থেকে টুকতে গিয়েছিল! ব্যস, মেয়ে সেটা বুঝতে পেরে সোজা স্যরকে বলে দিয়েছিল যে, তাপু চিটিং করছে! সেই ইংরেজি স্যর তাপুর বাবাকে ডেকে খুব করে কথা শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এমন চিটিংবাজ ছেলেকে উনি পড়াবেন না। তাপুর বাবা ছিল একটু মাথাগরম, হাটুরে ধরনের। স্যরের কথায় রেগেমেগে উনি সবার সামনেই তাপুকে পিটিয়ে আলুঝালু করে দিয়েছিলেন একদম।
ব্যাপারটা এখানেই মিটে যেত, যদি না পরের সপ্তাহে আমাদের বড় স্টেডিয়ামে ওই ক্রিকেট ম্যাচটা থাকত!
আমাদের স্কুলের সঙ্গে অন্য একটা স্কুলের ম্যাচে শ্রমণার ভাই খেলছিল ওদের ওপেনার হিসেবে। তাপু তখন আমাদের মনোজ প্রভাকর! দেড় হাত সুইং করায়। সঙ্গে দারুণ জোর! কলকাতার মাঠেও খেলব-খেলব করছে।
পঁচিশ ওভারের সেই ম্যাচের প্রথম ওভারেই তাপুর একটা বল আচমকা লাফিয়ে উঠে লাগল ভাইটির মাথায়! ভাইটি ব্যাট ফেলে “ওরে বাবা রে! ওরে মা রে!” বলে চিৎকার করে শুয়ে পড়ল মাটিতে। রক্ত ঝরতে লাগল বেশ।
কাছেই হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হল। তাপু খেলার শেষে গিয়ে দেখল ছেলেটির মাথায় ঢাউস ব্যান্ডেজ। তাপু গিয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে শ্রমণার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “দরকারে আমি রক্ত দেব। কিডনি দেব!”
শ্রমণা গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলেছিল, “ছিঃ!”
বল দিয়ে মেরেছে বলে ‘ছিঃ!’, নাকি কিডনি দেবে বলেছে বলে ‘ছিঃ!’ সেটা তাপু বোঝেনি। শুধু দেখেছিল, শ্রমণা স্যরের কোচিং ছেড়ে বাড়িতেই এক জন ম্যাডামকে ঠিক করে নিল ইংরেজি
পড়ার জন্য।
তাপু অনেক ঘুরল শ্রমণাকে ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য, কিন্তু আর নাগালই পেল না মেয়েটার। তাই ও টার্গেট করে নিল সরস্বতী পুজোকে। কারণ শ্রমণাদের স্কুলে শ্রমণাই ওদের পুজোর সেক্রেটারি। ফলে যে নেমন্তন্ন করতে যাবে, সে-ই দেখা করতে পারবে। তাপু ঝগড়া করে নেমন্তন্ন করার ব্যাপারে জায়গা করে নিল।
নেমন্তন্ন করতে গিয়ে তাপু কী করেছিল ভগবান জানে, মেয়েদের স্কুল থেকে আমাদের স্কুলে তাপুর নামে কমপ্লেন এল পুজোর দিন। ব্যস, হেড স্যর বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেন তাপুর বাবাকে। সবার সামনে বললেন, “আপনার ছেলে মেয়েদের স্কুলে গিয়ে অভদ্রতা করেছে!” আর যায় কোথায়! ঢাকির হাতের বেতের কাঠি কেড়ে নিয়ে তাপুর বাবার সে কী মার! ঢাকের বাজনা ছাড়াই তাপু নাচতে লাগল।
ঠিক কী করেছিল তাপু আমরা জানতে পারিনি। শুধু ঠাকুরের সামনে রাতে বসে আমরা জেনেছিলাম যে, তাপু আজ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, ওর মনে ভালবাসা জন্মেছে শ্রমণার জন্য!
স্কুল শেষ করে তাপু কলেজে ভর্তি হল। অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স নিয়ে দারুণ রেজ়াল্ট করল। ম্যানেজমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে এমবিএ-তে চান্স পেয়ে গেল। তার পর দু’হাজার সালের এমনই এক ফেব্রুয়ারিতে, সরস্বতী পুজোর চার দিন পরে, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে আচমকা আমাদের মুদিয়ালির বাড়িতে এল তাপু। বেল বাজানোর পরে দরজা খুলে দেখি, কী কাণ্ড, তাপু একা নয়, সঙ্গে শ্রমণাও দাঁড়িয়ে রয়েছে!
আমি হাঁ হয়ে গেলাম।
তাপু ভিতরে এসে হেসে বলল, “আজ ভ্যালেন্টাইন’স ডে, বুক ঠুকে ঊনচল্লিশতম বার ওকে প্রোপোজ় করেই দিলাম! আর আজ শ্রমণা আমায় ‘হ্যাঁ’ বলেছে!”
আমি হাঁ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ঊনচল্লিশ বার প্রোপোজ় করেছিস!”
তাপু হেসে বলল, “ভুল জিনিসে কনসেনট্রেট করছিস! ‘হ্যাঁ’-তে কনসেনট্রেট কর! এক সরস্বতী পুজোতে যা শুরু হয়েছিল, তা আজ এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে এসে পূর্ণতা পেল! জীবন সব মিলিয়ে দেয় রে স্মরণজিৎ। শুধু সৎ ভাবে লেগে থাকতে হয়!”
সে দিন নানা গল্পের পরে শ্রমণা গান একটা গেয়েছিল, ‘তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান গাহিবারে॥ / ফুলে ফুলে তারায় তারায়/ বলেছে সে কোন্ ইশারায়/ দিবস-রাতির মাঝ-কিনারায় ধূসর আলোয় অন্ধকারে।’...
গান শেষ করে শ্রমণা বলেছিল, “ক’দিন আগেই তো সরস্বতী পুজো গেল, তাই পূজা পর্বের এই গানটা গাইলাম।” আমি দেখলাম, পূজা পর্ব প্রেম পর্বের সঙ্গে মিশে গিয়েছে আনমনে। জীবন ধূসরতায়, তার আলোয়-অন্ধকারে যে ‘নয়ন’ গান গাইতে বলে, তার কথা আর কত দিন না শুনে থাকতে পারেন ঈশ্বর! কত দিন তার থেকে বিমুখ হয়ে থাকতে পারে মানুষ!
তাপু আর শ্রমণা এখন বিদেশে থাকে। ওদের এক কন্যা অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে। এ বার সরস্বতী পুজোর দিনে ওরা ফিরছে শহরে। আর কী অবাক কাণ্ড! এ বার সেই দিনই পড়েছে ভ্যালেনটাইন্স ডে! পূজা ও প্রেম আবার
মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে নিশ্চয়ই!
মফস্সল থেকে কলকাতায় চলে আসার পরে এমনিতেই জীবন পাল্টে গিয়েছিল অনেক। তার মধ্যে মুক্ত অর্থনীতি এসে সবটা আরও যেন বদলে দিল। কলেজে উঠতে উঠতে দেখলাম, ছোটবেলার সেই পৃথিবীটার সঙ্গে এই পৃথিবীর যেন মিলই
নেই কোনও।
দেখলাম, টেকনোলজি পাল্টে গেল নিমেষে! মাইক্রোচিপ এসে খেলাটাই বদলে দিল পুরো। কম্পিউটার বলে যে জিনিসের ছবি বইতে দেখতাম, সেটা এসে গেল পাড়ার দোকানে! ‘হরিহর বসনালয়’ উঠে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘হ্যারি’জ় সাইবার ক্যাফে’! চৌষট্টি টাকা পার মিনিট আউটগোয়িং হলেও মানুষকে কানেক্ট করতে আস্তে আস্তে জীবনে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে শুরু করল সিগারেটের প্যাকেটের মতো ছোট্ট মোবাইল ফোন। বাড়ি বাড়ি স্পাইডারম্যানের জালের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল কেবল টিভির তার। আমরা ‘ক্যান’-এ কোলা খেতে শিখলাম। ‘জিনসের প্যান্ট’ লাক্সারি থেকে আমাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল এক নিমেষে। রিপাবলিক, ইন্ডিপেন্ডেন্স আর মে ডে ছাড়াও আরও নানা রকম দিন এসে পড়ল আমাদের জীবনে। তাকে ঘিরে বাণিজ্য শুরু করল। বিখ্যাত কমিকস ক্যারেক্টারের নামে একটি গ্রিটিংস কার্ড আর গিফ্ট শপের ব্র্যান্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠল চার দিকে। আমরাও গ্লোবাল সিটিজ়েন হওয়ার হাওয়াই-গর্বে খুশি হয়ে উঠলাম। গভীর দীর্ঘমেয়াদি আনন্দের হাত ছাড়িয়ে আমরা মুহূর্তবাদী হয়ে উঠতে শিখলাম। শিখলাম বিজ্ঞান নয়, এ হল বিজ্ঞাপনের যুগ! আর এই প্রশ্ন করতে শিখলাম, সরস্বতী পুজো কি বাঙালিদের ভ্যালেন্টাইন’স ডে?
মুক্ত অর্থনীতির হাত ধরে ভ্যালেন্টাইন’স ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের জীবনে। এই একটা দিন নাকি প্রেমের দিন! আমার মনে হত বাকি দিনগুলো তা হলে কিসের?
দেখলাম ছেলেমেয়েরা সে দিন একে অপরের জন্য গিফ্ট কিনছে! পুজোর মতো সাজগোজ করে এক সঙ্গে ঘুরতে, খেতে বেরোচ্ছে! ওই দিনের আগের ছ’টা দিন রোজ ডে, হাগ ডে, কিস ডে ইত্যাদি নামে প্রচারিত হচ্ছে! সে একটা ধুন্ধুমার কেনাকাটা আর ডেটিং-এর উৎসব লেগে গিয়েছে চার দিকে! যাদের সে ভাবে ‘দোসর’ নেই, তারা রীতিমতো ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছে এই সব দিনে! আমার এক দাদু অবাক হয়ে বলেছিল, “এ কী দিন এল! এখন অন্য কেউ বলে দেবে, কবে কাকে প্রেম জানাতে হবে?”
‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে-টা ঠিক কী বল তো?” প্রশ্নটা করেছিল অশোক।
অশোক ভট্টাচার্য। মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিল বাংলায় এমএ পড়তে। রোগা-পাতলা চেহারা। থাকত গোলপার্কের কাছে একটা মেসে। ওই সাউথ সিটি কলেজের গলিতে। আমার সঙ্গে অশোকের আলাপ কলেজ স্ট্রিটে। আমি লিটল ম্যাগাজ়িন কিনতে যেতাম, অশোকও যেত।
প্রথম আলাপের সময় অশোক আমায় নাম জিজ্ঞেস করায় আমি নিজের নাম বলে পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমার নাম কী?”
অশোক হয়তো জীবনে প্রথম ও শেষ বার কায়দা করে বলেছিল, “আমার নাম মহান
সম্রাটের নামে!”
আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী, আলেকজ়ান্ডার?”
আমার প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে ও বলেছিল, “না,
না, অশোক!”
লিটল ম্যাগাজ়িনের হাত ধরে সেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। আমার বাড়ি মুদিয়ালি আর ওর মেস গোলপার্ক। হাঁটা পথ আমাদের কাছে। তাই আমরা প্রায়ই আড্ডা মারতাম। আড্ডায় আরও অনেক ছেলেমেয়েও থাকত।
সেই সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক জন ছিল সিয়োনা বাসু। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সিয়োনা তখন এমটেক করছে। দারুণ বাঁশি বাজাত সিয়োনা। সঙ্গে রবিঠাকুরের গানও গাইত ভাল। আর
এখানেই মিল ছিল ওদের। অশোকও খুব সুন্দর রবিঠাকুরের গান গাইত। সপ্তাহে তিন দিন আড্ডায় অশোক আর সিয়োনার গান একদম বাঁধা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আড্ডা শুরুর কিছু দিন পর এল সরস্বতী পুজো। মেসের সবাই মিলে ঠিক করল পুজো করবে। পুরোহিত কে? না, আমাদের অশোক!
সে দিন অনেক ক্ষণ সময় নিয়ে পুজো করেছিল অশোক। মেসেই খিচুড়ি, লাবড়া, ফুলকপির তরকারি আর চাটনি হয়েছিল। খেয়েদেয়ে সবাই শুরু করেছিলাম গানের আসর। সে দিন সিয়োনা গান গেয়েছিল প্রথম। তার পর আরও নানা জন গান গাওয়ার পর সবার শেষে গেয়েছিল অশোক।
আড্ডায় প্রথম আসা এক জন অশোককে বলেছিল, “তুমি যা গাইলে! বড় গায়কেরা ফেল!” অশোক লজ্জা পেয়ে বলেছিল, “সিয়োনা অনেক ভাল গায়!”
সেটা ছিল দু’হাজার চার সালের জানুয়ারির শেষ। তার পর ক্রমে আমাদের আড্ডা যেমন জমতে লাগল তেমন সিয়োনা আর অশোকের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও বাড়তে লাগল।
আমাদের এক বন্ধু মিলু এক দিন আমায় বলল, “ব্যাপারটা কিন্তু ভাল হবে না। আমি সিয়োনাদের জানি। ওদের বাড়ি ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেবে না! তুই অশোককে কিছু বল।”
এক দিন কলেজ স্কোয়ারে বসে আমি অশোককে বললাম ব্যাপারটা। অশোক বলল, “সিয়োনাকে আমি ভালবাসি। আমি পিছোব না! দেখ, গ্রামের বাড়িতে আমার ছোট ভাই আর মা আছে। আমি জানি আমার দায়িত্ব। সিয়োনাও জানে। ও ম্যানেজ হয়ে যাবে!”
কিন্তু ম্যানেজ হল না। ঠিক এক বছরের মাথায় সিয়োনার বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেল ব্যাপারটা। অশোককে ডেকে পাঠাল ওরা।
অশোক ফিরে এসে বলল, “ওরা খুবই ভদ্র। তবে বলে দিয়েছে যে, আমাদের সম্পর্কটা সম্ভব নয়। কিন্তু আই ডোন্ট কেয়ার। সিয়োনা তো চাকরি পেয়ে গিয়েছে। আমিও টিউশনি করে হাজার চারেক রোজগার করি। পরে চাকরি পেয়ে যাব। এ বার সরস্বতী পুজো তেরোই ফেব্রুয়ারি। পরের দিন, মানে তোদের ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে আমরা রেজিস্ট্রি করে নেব। সব ঠিক করে নিয়েছি।”
তেরোই ফেব্রুয়ারি অশোক মেসে পুজো করল আবার। সিয়োনার জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি থেকে একেবারে চলে আসার কথা বিকেলে। অশোক দুপুরে টেনশনে খেতেই পারল না ভাল করে। তার পর বিকেল হল। সময় কাটতে পাগল। সিয়োনা এল না। বোতাম-টেপা মোবাইলে ফোন করা হল সিয়োনাকে। ফোন ধরল না কেউ!
অশোক যখন টেনশনে লাল হয়ে গিয়েছে, তখন সন্ধেবেলা সিয়োনার গাড়ির শব্দ পেলাম আমরা।
“ওই সিয়োনা এসেছে!” অশোকের ধড়ে প্রাণ এল যেন।
সিয়োনা সে দিন এসেছিল বটে, তবে সঙ্গে ওর বাবা মা-ও ছিল। ওর বাবা এসে অশোককে বলেছিল, বাড়াবাড়ি করলে অশোকের খুব সমস্যা হবে। ও যেন সিয়োনার সঙ্গে আর যোগাযোগ না করে। সিয়োনাও শান্ত এবং দৃঢ় গলায় বলেছিল, ওদের মধ্যে আর কিছু নেই!
অশোক প্রতিবাদ করেনি। পাল্টা কিছু বলতে চায়নি। শুধু সিয়োনারা চলে যাওয়ার পরে চুপচাপ উঠে গিয়েছিল। আমরাও ফিরেছিলাম যে যার বাড়ি।
পরের দিন চোদ্দোই ফেব্রুয়ারির সকালে মিলু ফোন করে বলেছিল, অশোক দরজা খুলছে না। সাড়া দিচ্ছে না!
সর্বনাশ! আমি পড়ি কি মরি করে গিয়ে দেখেছিলাম, অশোক সদ্য দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। বড় ব্যাগে সব কিছু প্যাক করা। আমায় দেখে বলেছিল, “ভয় পেয়ে গিয়েছিলি? শোন, এটা সিয়োনাকে দিস।”
এক-ভাঁজ করা একটা কাগজ ও দিয়েছিল আমার হাতে। চিঠি? না, চিঠি নয়। ছোট্ট একটা গান — ‘অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে/ তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন্ বাতাসে॥ / যে ফুল গেছে সকল ফেলে/ গন্ধ তাহার কোথায় পেলে,/ যার আশা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে॥’
অশোক যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল, “স্মরণজিৎ, আজ ভ্যালেন্টাইন’স ডে না?”
আমি দেখেছিলাম, প্রেম এখানে কী ভাবে আশ্চর্য এক পূজায় মিশে যাচ্ছে!
আবারো সামনে সরস্বতী পুজো। এ বছর সেই দিনই আবার ভ্যালেন্টাইন’স ডে-ও। পুজো উপলক্ষে কী এক অনুষ্ঠান আছে, তাই তার প্রস্তুতিতে আমার মেয়ে সায়েকা সে দিন গান গাইছিল পাশের ঘরে। ও গাইছিল, ‘সকল গৃহ হারালো যার তোমার তানে তারি বাসা,/ যার বিরহে নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাষা।’ আর আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, সেই গানের মধ্যে এসে জড়ো হচ্ছে আমার শান্ত ছোট্ট মফস্সল! জড়ো হচ্ছে পুকুরধারে আমাদের সেই ফেলে আসা বাড়ি, সোমাদির গান, বিউটিদির আলপনা! জড়ো হচ্ছে শ্যামাকাকার চোখের মধ্যে জ্বলে ওঠা জোনাকি-সকল! জড়ো হচ্ছে আমার প্রাণের বন্ধু তাপু, শান্ত শ্রমণা, জড়ো হচ্ছে একাকী অশোক! আর ওর লিখে-যাওয়া সেই গান। এই গানের মধ্যে জড়ো হয়ে উঠছে আমাদের সবার সরস্বতী পুজো থেকে ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র মধ্যে বড় হয়ে ওঠার এই জীবন!
দেখো, শীতের শেষ হয়ে এল প্রায়! পৃথিবী আবার জাগছে নতুন বসন্তপঞ্চমীতে! জাগছে নতুন ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তেও! সরস্বতী পুজো কি বাঙালির ভ্যালেন্টাইন’স ডে? আমি সত্যি জানি না এর উত্তর। আমি শুধু জানি, ভালবাসার মধ্যে কোনও মিল-অমিল নেই। জানি— গোটা জীবন জুড়ে, গানে, গল্পে, স্মৃতিতে প্রেম ও পূজা পরস্পর মিশে যায় বার বার! জানি, ভালবাসার চেয়ে বড় সত্যি কিছু নেই এ জীবনে। জানি, ভালবাসার চেয়ে শক্তিশালীও কিছু নেই। জানি, আমরা সবাই প্রতি বার নতুন করে জাগব সরস্বতী পুজোয়। ভ্যালেন্টাইন’স ডে ছাড়িয়েও ভালবাসব প্রতিটা দিন। আমাদের গভীরে কোথাও শ্যামাকাকার জোনাকি জ্বলে থাকবে আজীবন। আমরা আবারও ভালবাসার জন্য টোকা মেরে সরিয়ে দেব সব প্রলোভন। এক বার তোমাকে তুমুল ভালবাসব বলে, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফিরিয়ে দেব অমরত্ব!
ছবি: অমিতাভ চন্দ্র