টালিগঞ্জের দিকে হনহন করে হাঁটছিল মেয়েটা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই অত বড় পরিচালকের অফিস পর্যন্ত পৌঁছনো। যে সে লোক নয়, গোটা ইন্ডাস্ট্রি এক ডাকে চেনে। তাঁর মুখে এই কথা! মেয়েটা ভাবতেই পারছিল না।
সেই ছোট বয়স থেকে সে স্টেজে উঠছে। চাইল্ড আর্টিস্ট হিসেবে মুখ দেখানো হয়ে গিয়েছে কয়েকখানা নির্বাক ছবিতেও। কিন্তু আর খুদে অভিনেতা নয়, পুরোদস্তুর নায়িকা হতে চায় সে। বাঙালি নাম একটা জুটেছে ঠিকই, এ বার বাংলাটাও আর একটু ভাল বলতে হবে! তবে সবার আগে চাই একটা সুযোগ। সে জন্যই আসা। তার বদলে এই? দুর্ব্যবহার, উপেক্ষা, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া তার কাছে নতুন নয়। তাই বলে ইটের উপর দাঁড়াতে হবে!
ইহুদি স্কুলটিচার হায়াম কোহেন যখন বোম্বাই ছেড়ে কলকাতায় আসেন, মেয়ে র্যাচেল তখন ফ্রক পরে। চৌরঙ্গির একটা স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ের মন নাচগান-নাটকের দিকে। স্কুলে ফাংশন হলেই র্যাচেল স্টেজে। হায়াম বেশ বুঝছিলেন, এ মেয়ের লেখাপড়া হবে না। বরং সে যা ভালবাসে, তা করতে দেওয়াই ভাল। তার দুই বোনেরও একই রকম মতিগতি। তিন মেয়েকেই করিন্থিয়ান থিয়েটারে পাঠিয়েছিলেন বাবা। বাংলার পেশাদার রঙ্গমঞ্চ তখন জমজমাট। তিন কন্যা ভিড়ে গিয়েছিল সেই দলে।
তখনও এ দেশে সিনেমার বুলি ফোটেনি। অভিনেতারা বাংলায় কথা বলতে না পারলেও তাই ক্ষতি ছিল না। সাহেবসুবোরা দিব্যি দিশি রাজরাজড়া সেজে চালিয়ে দিত। তাতে সুবিধে হয়েছিল র্যাচেলেরও। এমনিতে মাতৃভাষা আরামাইক আর বোম্বাইয়া হিন্দিতে অভ্যস্ত সে। কলকাতায় এসে বাংলা বলছে একটু-আধটু। ছটফটে মেয়েটা চোখে পড়ে গেল ছবিওয়ালাদের। তেরো বছর বয়সেই ক্যামেরার সামনে। ছবির নাম ‘দালিয়া’। পরিচালক মধু বসু, কাহিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। র্যাচেল হয়ে উঠল ‘রমলা’— রমলা দেবী।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আরও তিনটে ছবিতে মুখ দেখিয়ে ফেলল, ‘মৃণালিনী’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গুপ্তরত্ন’। ওই ১৯৩১-এই হইহই করে শব্দ এসে পড়ল সিনেমায়। মুভি হয়ে গেল ‘টকি’। মার্চে মুক্তি পেল হিন্দি টকি ‘আলম আরা’, এপ্রিলে বাংলা ‘জামাইষষ্ঠী’। রুপোলি পরদায় নতুন যুগ শুরু হল। রমলা পড়ল চ্যালেঞ্জের মুখে। টিকে থাকতে গেলে এ বার শান্তিপুরি বাংলায় সংলাপ বলতে হবে! মেয়ে আর কাজ পায় না! ১৯৩২ সালে ‘গৌরীশঙ্কর’ নামে একটা ছবিতে কাজ পেল বটে, কিন্তু সে-ও নির্বাক।
কে নেবে তাকে টকিতে? কার কাছে গেলে মিলবে সুযোগ? ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ মনে হয় র্যাচেলের— নীতিন বসু! ১৯৩৫ সালে দিশি সিনেমায় প্লেব্যাক এনে তিনি হইচই ফেলে দিয়েছেন। নিউ থিয়েটার্স স্টু়ডিয়োয় রেকর্ড হচ্ছে গান। সেই থেকে খোঁজ খোঁজ। কত অনুনয়-বিনয়, চোখের জল ফেলে তবে এই অবধি আসা। এই তার পাওনা?
‘‘রমলা, স্টপ...’’ পিছন থেকে ভেসে আসছে কিদার শর্মার গলা। চোখের জলে চারদিক ঝাপসা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রুমালে মুখ ঢাকল মেয়েটা। ওরা কি কেউ জানে, কোন চোরাটানে তলিয়ে গিয়ে অসম্ভব জেদে ফের ভেসে উঠেছে সে? কত কেঁদেছে ব্রেবোর্ন রোডের পুরনো সিন্যাগগে শুক্রবারের প্রার্থনায়?
কখন তার বালিকা বয়স ফুরিয়েছে, কখন ঢেউ তুলে এসেছে জোয়ার, র্যাচেল ছাড়া বাকি সকলেই বোধহয় খেয়াল করছিল। ক্রমশ আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিল সে। রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ছিল যেন। জীবনে আসা-যাওয়া করছিল প্রেম।
হঠাৎই এক দিন টের পেল, সে মা হতে চলেছে। বয়স মোটে ষোলো। প্রেমিকটি ইহুদি নয়, র্যাচেলের বাড়ির লোক তাকে মানতে নারাজ। মেয়ের বিয়ে না দিলে কেচ্ছার একশেষ। ছেলেটিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, চাপ দিয়ে ধর্মান্তরিত করা হল। হয়ে গেল বিয়ে। ক’মাস বাদে জন্মাল পুত্র— স্যাম। কিন্তু র্যাচেলের এক আকাশ স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা। অযাচিত সন্তান এসে পায়ে পরিয়েছে পিছুটানের বেড়ি। সে চুপিচুপি কাঁদে, ঈশ্বর, আমি কি এ ভাবেই শেষ হয়ে যাব? কোনও দিনই আর ফিরতে পারব না সিনেমায়?
‘আলম আরা’ ছবির অভিনেতা জগদীশ শেঠির সঙ্গে রমলার পরিচয় ছিল। তিনিই রমলাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কিদার শর্মার সঙ্গে। পঞ্জাব থেকে কলকাতায় চলে আসা কিদার তখন নিউ থিয়েটার্সে দেবকী বসুর ছবিতে ব্যাক সিন আঁকেন, স্টিল তোলেন, টুকটাক ডায়লগ লেখেন আর ডিরেক্টর হওয়ার খোয়াব দেখেন। সেই কিদারকেই ধরে বসল রমলা, যে ভাবেই হোক এক বার নীতিন বসুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে হবে।
নীতিন তখন তাঁর পরের ছবির জন্য অভিনেত্রী খুঁজছেন। রমলাকে নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন কিদার। রমলার বুক দুরদুর, তাকে পছন্দ হবে তো ওঁর? দেবেন তো পার্ট? একটু বেঁটে বটে সে, কিন্তু এ রকম মিষ্টি মুখ তিনি আর পাবেন ক’টা? কিদার যখন গড়গড় করে রমলার গুণপনার কথা বলে চলেছেন, ডিরেক্টর আগাগোড়া মেপে নিলেন নবাগতাকে। তার পর কিদারের দিকে ফিরে বললেন, ‘‘ওকে আমার কাছে আনলেই যখন, উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য কয়েকটা ইট আনলে না কেন?’’
একটা ছুরি যেন বিঁধে গেল রমলার বুকে। কোনও রকমে ‘গুডবাই’ বলে মুখ নিচু করে বেরিয়ে এল সে। পিছু-পিছু কিদার। নিজে এক জন স্ট্রাগলার হয়ে বিলক্ষণ জানেন, অপমানের হুল কী তীব্র হয়ে বেঁধে? বললেন, ‘‘রমলা, ভেঙে পোড়ো না। যে দিন আমি ডিরেক্টর হব, তুমিই হবে আমার প্রথম হিরোইন।’’ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল সে, ‘‘বেচারা ডায়লগ রাইটার কিদারনাথ কোনও দিনই ডিরেক্টর হবে না, আর আমিও কোনও দিন হিরোইন হব না!’’
কিদার কিন্তু কথা রেখেছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বানান তাঁর প্রথম ছবি ‘আওলাদ/ দিল হি তো হ্যায়’। নায়িকা রমলা দেবী। তবে তার আগেই ১৯৩৭-এ চারু রায়ের ‘গ্রহের ফের’ টকি-তে শুভ মহরত হয়ে গিয়েছে র্যাচেলের। ডায়লগ লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘সচিত্র শিশির’ পত্রিকা লিখল, ‘‘শ্রীমতী লছমীর ভূমিকায় শ্রীমতী রমলা দেবীকে (ইহুদী-বালা?) আবিষ্কার করে চারুবাবু তার সুদ শুদ্ধ উসুল করেছেন। এই নূতন অভিনেত্রীটি দেখতেও যেমন সুন্দর, তার অভিনয়ও তেমনি অপরূপ।’’
পরের বছর রবি ঠাকুরের উপন্যাস নিয়ে তৈরি হল ‘গোরা’। তাতেও রমলা। কোথায় গ্রহের ফের, বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। একের পর এক হিন্দি ছবিও আসছে হাতে। নাম হচ্ছে। ১৯৪০ সালে ‘তটিনীর বিচার’ ছবিতে অভিনয়ের সঙ্গে প্লেব্যাকও করে ফেললেন রমলা। আর সবচেয়ে বড় কাণ্ডটা ঘটল তার পরেই। পরের বছর রিলিজ করল ‘খাজাঞ্চি’। মোতি বি গিদওয়ানির ছবিতে গুলাম হায়দারের ছক-ভাঙা সুর আর সামশাদ বেগমের গলা ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভূ-ভারত। ভাসিয়ে দিল রমলার অভিনয়ও।
রাতারাতি স্টার বনে গেলেন রমলা। ক’বছর আগেও যাকে কাজের জন্য দোরে-দোরে ঘুরতে হত, প্রযোজকরাই তখন তাঁর দরজায় লাইন লাগাচ্ছেন। পর পর হিট ‘মাসুম’, ‘খামোশি’, ‘জজসাহেবের নাতনি’। ’৪৩-এ ‘মনচলি’-তে অভিনয়ের জন্য বিএফজেএ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।
’৪৭-এ দেশ স্বাধীন হল। ক’বছর আগেই লাহৌর থেকে বোম্বাই চলে এসেছিলেন এক যুবক। কিছু দিন ইতিউতি ঘোরাঘুরির পর, দেশভাগের ঠিক আগের বছর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চাবিটা খুঁজে পেলেন তিনি— দেব আনন্দ! আর দু’বছর পর তিনিই হলেন রমলার হিরো। বক্স অফিসে হইচই ফেলে দিল ‘হাম ভি ইনসান হ্যায়’। মান্না দে-র গলায় ‘হম তেরে হ্যায় হমকো না ঠুকরানা’ তখন লোকের মুখে মুখে।
এরই মধ্যে ফের উথালপাথাল র্যাচেলের ব্যক্তিগত জীবন। বিয়েটা অনেক দিন ধরে নড়বড় করছিল। ছেলের দিকেও নজর দেওয়ার সময় ছিল না। বিয়েটা ভেঙেই গেল। র্যাচেলের অবশ্য তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। শুধু কাজ, আর স্বপ্ন, আরও উপরে উঠতে হবে।
পুরুষেরও অভাব নেই জীবনে। তবে র্যাচেলের মনে ধরেছিল এ দেশে পাইলটদের ট্রেনিং দিতে আসা এক ব্রিটিশ অফিসারকে। সেই দাঁড়েই ডানা গুটিয়ে বসা হল। আর মায়ের থেকে আরও দূরে ছিটকে গেল স্যাম। শেষে ’৫০-এর গোড়ায় মা’কে ছেড়ে ইজরায়েলে ফিরে গেল ছেলে। সেখানেই বিয়ে করে থিতু হল। স্যামের স্ত্রী বারবারার বয়ান অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিয়ের পর ছেলেকে চোখের আড়ালে ঠেলে দিয়েছিলেন র্যাচেল। গুটিকয় চিঠি লেখা, ওই পর্যন্তই।
ওই ১৯৫০-এর গোড়াতেই আচমকা গুটিয়ে গেল রমলার কেরিয়ার গ্রাফ। তত দিনে এক ঝাঁক নতুন মুখ এসে গিয়েছে— নার্গিস, মধুবালা, মীনাকুমারী, নূতন। আসতে চলেছে সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, সুচিত্রা, ওয়াহিদা রহমান; আর এক তরতাজা ইহুদি মুখ নাদিরাও, যাকে পরে দেখব ‘শ্রী ৪২০’, ‘পাকিজা’, ‘জুলি’-তে।
’৫১ সালে হিন্দি ছবি ‘স্টেজ’-এর পরেই রমলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় চিত্রজগৎ। শেষ বার তিনি ফিরেছিলেন ১৯৬০-এ, ‘রিক্তা’ ছবিতে, অহীন্দ্র চৌধুরী, নৃপতি, ছায়া দেবীদের সঙ্গে। নিভে যাওয়ার আগে যেন সব শক্তি জড়ো করে জ্বলে ওঠা।
এত দিনে সংসারে ফিরলেন রমলা। ক্লান্ত, অবসন্ন। কিছুই ভাল লাগে না। স্যামের কথা মনে পড়ে, কিন্তু সেই ফাঁক আর জোড়া লাগার নয়। চল্লিশ পার করে ফের মা হলেন র্যাচেল। এ বার মেয়ে, নাম দিনা। টিনএজার বম্বশেল হয়ে সে-ও সত্তরের দশকের শেষে নামবে সিনেমায়। একটা মাত্র ছবি— ‘অ্যাহসাস’। পরিচালক জি পি সিপ্পি।
র্যাচেল যে বছর জন্মেছিলেন, সেই শীতেই জন্ম রুশ বিপ্লবের। ইলাহাবাদে জন্মালেন ইন্দিরা, ব্রুকলিনে জন এফ কেনেডি। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। র্যাচেল বেঁচে ছিলেন সত্তর পেরিয়ে। ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৮ যে চোখ বুজল তার নাম রমলা নয়, শুধুই র্যাচেল।