Mount Everest

ভারতের সেই পতাকাটিও এক বঙ্গসন্তানের তৈরি

১৮৬৫ সালে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়া-র সুপারিশে রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি-র উদ্যোগে জর্জ এভারেস্ট-এর নামেই ১৫ নং শৃঙ্গের নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট।

Advertisement

চন্দ্রনাথ দাস

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৩ ০৮:৫০
Share:

স্মৃতিচিহ্ন: দলাই লামা প্রদত্ত এভারেস্ট অভিযানের অনুমতিপত্র। ডান দিকে উপরে, প্রথম সফল অভিযানে ব্যবহৃত সাজ-সরঞ্জাম। ছবি সৌজন্য: লেখক

যেটি তেনজিং নোরগে এভারেস্ট শীর্ষে উড়িয়েছিলেন সাত দশক আগে। সেই বাঙালির নাম রথীন্দ্রনাথ মিত্র। কেন ১৫ নম্বর শৃঙ্গ অভিযানের অনুমতি দিতে চাননি দলাই লামা? জর্জ ম্যালোরির স্ত্রীর ছবি কি রাখা হয়েছিল যথাস্থানে? এভারেস্ট জয়ের পিছনে আছে নানা অজানা গল্প।

Advertisement

তুষারাবৃত হিমালয়ের আকর্ষণে বার বার আমরা তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই হিমালয়ে কয়েক হাজার পর্বতশৃঙ্গ আছে যার আকর্ষণে অভিযাত্রীরা পাগল। প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার বিস্তৃত হিমালয়ের জরিপের কাজ শুরু হয়ে ছিল ১৮৩৮ সাল থেকে। প্রায় একশো বছর ধরে এই কাজ চলেছিল ব্রিটিশ সরকারের অধীনে। পূর্বে নামচে বোরওয়া থেকে পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বত পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালা। শুরুতে হিমালয়ের চূড়া গণনাই ছিল প্রথম কাজ। সেই উদ্দেশ্যেই শিখরকে শনাক্ত করে প্রত্যেকটিতে জরিপ নম্বর দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে নামচে বোরওয়া থেকে গণনা শুরু হওয়ার ফলে শিখরের নম্বর ১ থেকে শুরু হয়ে ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়েছে।

এই ভাবে এগোতে এগোতে ১৮৫২ সালে ১৫ নম্বর শিখরটি শনাক্ত হওয়ার পর কর্নেল স্যর জর্জ এভারেস্ট অনুমান করেছিলেন, এটাই হতে পারে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। বিশিষ্ট গণিতবিদ, বঙ্গসন্তান রাধানাথ শিকদারও ছ’বার পর্যবেক্ষণ করার পর প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ১৫ নং শিখরটিই বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ, যাকে আমরা মাউন্ট এভারেস্ট নামে চিনি। ১৮৫৬ সালে প্রায় ১০০ মাইল দূরত্বে, সম্ভবত বিহারের পূর্ণিয়া থেকে মাপজোখ শুরু হয়েছিল, এবং বেশ কয়েক বার মাপার পর প্রমাণিত হয়েছে— এটাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।

Advertisement

১৮৬৫ সালে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়া-র সুপারিশে রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি-র উদ্যোগে জর্জ এভারেস্ট-এর নামেই ১৫ নং শৃঙ্গের নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। কিন্তু নেপালে এই শৃঙ্গটি ‘সাগরমাতা’ হিসেবে পরিচিত। আবার তিব্বতে এর নাম ‘চোমোলঙমা’। ১৮৫৪ সালে ১৫ নম্বর শৃঙ্গটির নাম ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী ‘গৌরীশঙ্কর’ রাখার প্রস্তাব উঠলেও তা সফল হয়নি।

সর্বোচ্চ শৃঙ্গের তকমা পাওয়ার পরই পর্বতারোহীদের মধ্যে শুরু হয় এই শৃঙ্গে আরোহণের প্রচেষ্টা। ১৯১৩ সালে প্রথম ব্রিটিশ সরকারের ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি সোসাইটি ও ব্রিটিশ অ্যালপাইন ক্লাব-এর উদ্যোগে এভারেস্ট অভিযান শুরু করার জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল তিব্বতের রাজা ত্রয়োদশ দলাই লামার কাছে। কিন্তু তখন সেই অনুমতি মেলেনি, কারণ শৃঙ্গটিকে পবিত্র শৃঙ্গ হিসাবে শ্রদ্ধা করা হত। ১৯২১ সালে দ্বিতীয় বার আবেদন করার পর দলাই লামার অনুমতি মেলে এবং সে বছরই প্রথম এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়।

১৯২৪-এ দ্বিতীয় বার অভিযান হয় ব্রিটিশ সরকারেরই অধীনে। এই অভিযানের সাফল্য স্পষ্ট নয়, কারণ জর্জ ম্যালোরি ও আরভিন দু’জনে অভিযানে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু কেউ নিশ্চিত নন, পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে যাওয়ার পথে তাঁরা মারা গেছেন না কি শৃঙ্গ জয় করে ফিরে আসার পথে দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই জানেন না, জর্জ ম্যালোরি তাঁর স্ত্রীর একটা ছবি সঙ্গে নিয়ে অভিযানে গিয়েছিলেন এবং স্ত্রীকে বলেছিলেন, “যদি এই অভিযানে সাফল্য পাই, তা হলে তোমার ছবি পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দেব।” ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালের ১ মে যখন জর্জ ম্যালোরির দেহটির সন্ধান পাওয়া যায়, তখন তাঁর কাছ থেকে স্ত্রীর ছবিটা কিন্তু পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ ধারণা করেন, হয়তো তাঁরা সফল হয়েছিলেন। নির্ভুল প্রমাণ না থাকার জন্য এই অভিযানের সাফল্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।

১৯৫৩-তে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে এভারেস্ট অভিযানে সপ্তম বারের প্রচেষ্টায় স্যর জন হান্ট-এর নেতৃত্বে প্রথম সাফল্য আসে। শেরপা তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি— দু’জনে এক সঙ্গে পা রাখলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। রচিত হল ইতিহাস। তারিখটা ২৯ মে, ১৯৫৩। সময় সকাল সাড়ে এগারোটা। ২৯,০২৮ ফুট (৮,৮৪৮ মিটার) উচ্চতায় পৌঁছে গেলেন তাঁরা, গর্বিত হল ভারত। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উড়ল ভারতের জাতীয় পতাকা। সেই প্রথম সাফল্যের ৭০তম বর্ষ পূর্ণ হবে আগামী কাল।

রথীন্দ্রনাথ মিত্র নামে এক বঙ্গসন্তানের ভূমিকাও আছে এর পিছনে। তিনি তেনজিং-এর ইংরেজি কথোপকথন শিক্ষার মাস্টারমশাই ছিলেন। ১৯৩৮-এ তেনজিং যখন তিব্বত থেকে নেপাল হয়ে দার্জিলিং আসেন, তখন তিনি বুঝেছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ইংরেজিতে কথা বলা। তখনই তিনি দার্জিলিংবাসী রথীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে যান ইংরেজিতে সাবলীল ভাবে কথা বলা শেখার জন্য। মিত্রবাবুর দার্জিলিং-এ দর্জির ব্যবসা ছিল। তিনি নিজের হাতে একটি জাতীয় পতাকা তৈরি করে তেনজিং-এর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ভারতমাতার সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই বঙ্গসন্তানের কৃতিত্বের কথা অনেকেই জানেন না।

১৯৫৩ সালে প্রথম সাফল্যের পর, দার্জিলিং-এ তেনজিং-এর বাড়িতে ১৯৫৪ সালের ৪ নভেম্বর হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্থাপিত হল। এটি ভারতের প্রথম পর্বতারোহণ প্রতিষ্ঠান। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় মহাশয়দের তত্ত্বাবধানে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বর্তমানে আনুমানিক ৫০,০০০ ভারতীয় ও বিদেশি শিক্ষার্থী এই পর্বতারোহণ সংস্থার মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করেছেন।

এই পর্বতারোহণ সংস্থার প্রাক্তন প্রধান কিউরেটর হিসাবে অনুভব করেছি যে, বহু পর্বতারোহী মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছনোর সাফল্য অর্জন করেছেন, অনেকে সাফল্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে— প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে শিখরে পৌঁছনোর চেষ্টা না করাই ভাল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুব কল্যাণ দফতর বর্তমান প্রজন্মের পর্বতারোহীদের সতর্কবার্তা পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছু হঠকারী পদক্ষেপের ফলে শিখরে পৌঁছনোর আগে বা ফিরে আসার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে অনেকের। শেরপারা যে ভাবে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে সম্মান জানিয়ে অভিযানের পথে হাঁটলে ঝুঁকির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার সঙ্গে কর্মসূত্রে বহু বিশিষ্ট শেরপা পর্বতারোহীদের পরিবারের বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যেমন তেনজিং নোরগে, নোয়াং গোম্বু, দর্জি লাহাটু, কুশাং শেরপা প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেও জেনেছি, সকলের একই মত।

১৯৫২ সালে সুইস মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের সময় রেমন্ড লেম্বার্ডকে তেনজিং অনুরোধ করেছিলেন, আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে সর্বশেষ ক্যাম্প থেকে তাড়াহুড়ো করে না বেরোনোই উচিত। তেনজিং-এর কথায় লেম্বার্ডকে অভিযান অসম্পূর্ণ রেখে ফিরে আসতে হয়েছিল, এভারেস্ট-এর মাত্র ৮০০ মিটার নীচ থেকে। কারণ চার দিন অপেক্ষা করার পরও আবহাওয়া অনুকূল হয়নি। তাঁরাও প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করার চেষ্টা করেননি। ফলে বিপদেও পড়েননি। বর্তমানে পর্বতারোহণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রগুলির উচিত শিক্ষার্থীদের টিম স্পিরিট, নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া। শুধু পর্বতারোহণ শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, এই গুণগুলি আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও

বিশেষ প্রয়োজন।

সারা বিশ্বে এই দিনটিতে এভারেস্ট দিবস বা তেনজিং-এর জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। তেনজিং তাঁর জন্মদিন ঠিকমতো না জানার ফলে স্যর এডমন্ড হিলারি ২৯ মে এই দিনটিকেই তাঁর জন্মদিন হিসাবে কাগজে কলমে নথিভুক্ত করেন— তাঁর কৃতিত্বের কথা মাথায় রেখে।

এই প্রসঙ্গেই একটা কথা মনে পড়ে যায়। ১৯৫৩ সালের সেই প্রথম সাফল্যের মুহূর্তে তেনজিং নোরগে রাষ্ট্রের সম্মানে চারটি পতাকা (ইউনাইটেড নেশনস, গ্রেট ব্রিটেন, নেপাল এবং ভারতের জাতীয় পতাকা) এভারেস্টের চূড়ায় উত্তোলন করেছিলেন। সেই পরিচিত ছবি বা ভাস্কর্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাই। মাউন্টেনিয়ারিং মিউজ়িয়ামে সেই চারটি পতাকার মধ্যে তিনটি সংরক্ষিত আছে, কারণ ইউনাইটেড নেশনস তাদের পতাকাটি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়। কিন্তু তেনজিং-এর বাসস্থান দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে, শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে তেনজিং-এর যে ভাস্কর্যটি আজও দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তেনজিং-এর হাতে মাত্র তিনটি পতাকাকে দেখানো হয়েছে। ইতিহাসের এই ভ্রান্তি কবে সংশোধন হবে, তার অপেক্ষায় আজও সচেতন জনগণ দিন গুনছেন উন্মুখ হয়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement