জনজোয়ার: প্যারিসের রাস্তায় ব্যরিকেডের বিরুদ্ধে ছাত্ররা।
সময়টা ১৯৬৮। প্যারিসে ছাত্র আন্দোলন তখন মধ্যগগনে। প্রতিদিন রাস্তায় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের খন্ডযুদ্ধ চলছে। এরকম এক সন্ধেবেলায় রাজপথে তৈরি করা অস্থায়ী ব্যারিকেডের উপর দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সামনে ধর্মঘটের সপক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন বেলজিয়ামের মার্ক্সবাদী দার্শনিক আর্নেস্ট ম্যান্ডেল। বক্তৃতা শেষ করে নেমে এসেই তিনি দেখতে পেলেন সামনে একটি গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ওই রাজপথেই শিশুর মতো আনন্দে নেচে উঠে চেঁচাতে লাগলেন ম্যান্ডেল, “কী অপূর্ব! কী সুন্দর! বিপ্লব তা হলে এসেই গেছে।” যারা দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল, তাদের মধ্যে হাতেগোনা ওঁর কিছু ছাত্র ছিল। এক মাত্র তারাই জানত—ওই গাড়িটা ছিল প্রফেসর ম্যান্ডেলের নিজের!
আজ, প্যারিসের ছাত্র আন্দোলনের অর্ধশতবর্ষ পূর্তিতে ফিরে দেখতে গেলে উপরের ঘটনাটির থেকে বেশি ব্যঞ্জনাময় গল্প আর কিছু হতেই পারে না। নিজের গাড়ি পুড়তে দেখে আনন্দে নাচার যাদুবাস্তবতা তো আসলে একটা অভ্যুত্থানের আকাশ ছুঁতে চাইবার রূপক মাত্র। কে না জানে, আন্দোলনরত প্যারিসের দেওয়ালে তখন সবচেয়ে বেশি যে স্লোগানটা চোখে পড়ত তা হল, ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি করো’!
অসম্ভবের দাবি ফিরে ফিরে আসে। বহু বছর পরে যখন ‘হোক কলরব’ স্লোগানে কলকাতা কেঁপে উঠবে, যখন কানহাইয়াকুমার, উমর খালিদদের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সমগ্র ভারত জুড়ে ছাত্রসমাজ আন্দোলনে নামবে, অথবা যখন সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে ছাত্রছাত্রীদের অভিন্ন আবাসনের দাবিতে গর্জে উঠবে ক্যাম্পাস, তখন কি নেপথ্যে থেকে অট্টহাসি হাসবে ৬৮’র মে মাস? সেই ধর্মঘটও তো শুরু হয়েছিল গ্রেফতার হওয়া ছাত্রনেতাদের মুক্তির জন্যই। আর আন্দোলনের সূত্রপাত কী থেকে হয়েছিল? নঁতের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের আবাসনে ছেলেদের ইচ্ছে মতো রাত্রিযাপনের অনুমোদনের দাবিতে। আজ যখন ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলগুলি বিদ্রোহী প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুরকে চিহ্নিত করে দেয় নেশা ও যৌনতার আখড়া হিসেবে, তখন অবধারিতভাবেই তাই স্মৃতিতে উঁকি মারেন ১৯৬৮-র ফরাসি প্রধানমন্ত্রী পঁপিদ্যু। যিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের অভিহিত করেছিলেন ‘নৈরাজ্যবাদী, যৌনবিকৃতির ধ্বজাধারী’ আখ্যায়।
বস্তুত, নাগরিক অধিকারের আন্দোলন কীভাবে রাজনৈতিক রূপ পেয়ে যায় তার একটা উদাহরণ হতে পারে ’৬৮-র প্যারিস। ছাত্রী-আবাসনে অবাধ প্রবেশের দাবিতে বিক্ষোভ চলছিলই। ১৯৬৮-র মার্চ মাসে এই বিক্ষোভে যোগ দিল অন্যান্য বামপন্থী ছাত্ররা, স্লোগান তুলল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। মে মাসের শুরুতে নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিল প্রশাসন। বিদ্রোহী ছাত্ররা প্যারিসের প্রাণকেন্দ্র লাতিন কোয়ার্টারে অবস্থিত সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘাঁটি গাড়ল। প্রতিদিন ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ মুখরিত হতে থাকল স্লোগান, কবিতা, গানে। প্রমাদ গুণে কর্তৃপক্ষ এবার পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলেন। দাবি, বহিরাগতদের হটিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। হোক কলরবের সময়কালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্ভবত এই ইতিহাস জানতেন না। ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকালে তার পরিণতি কতদূর অবধি যেতে পারে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছে সরবোন।
মঞ্চের কাছে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় ফ্রাঁসোয়ার। দেখেন, জনগণের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে সেই সৌম্য মূর্তি অধ্যাপক অগ্নিবর্ষী বক্তব্য রাখছেন! অধ্যাপকের নাম জাক দেরিদা!
৩ মে পুলিশ আসবার পরেই সমগ্র লাতিন কোয়ার্টার রণক্ষেত্রের চেহারা নিল। পুলিশকে লক্ষ করে বৃষ্টির মতো উড়ে আসতে থাকল পাথর। পুলিশ প্রত্যুত্তর দিল কাঁদানে গ্যাস, নির্মম প্রহার এবং নির্বিচারে গ্রেফতারের মাধ্যমে। পাল্টা জবাবে ৬ থেকে ১০ মে-র মধ্যে পরপর ধর্মঘটে অচল হয়ে গেল প্যারিস। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়ে ছাত্ররা ঘোষণা করল এবার থেকে এটি হবে জনগণের শিক্ষাক্ষেত্র। অলিতে গলিতে খাড়া করা হল ছোটবড় ব্যারিকেড। টানা কয়েকদিন পুলিশ বনাম ছাত্রদের খণ্ডযুদ্ধ চলল। দেওয়ালগুলি ভরে উঠল অসংখ্য বাঙ্ময় স্লোগান এবং গ্রাফিতিতে। ‘ব্যারিকেডে অবরোধ হয় রাস্তা, খুলে যায় পথ।’ ‘আমরা ভিক্ষা করি না, দখল করি।’ ‘বিপ্লব অবিশ্বাস্য, কারণ তা বাস্তব।’ স্লোগান আর কবিতা যেন করমর্দন করল একে অন্যের! কেউ লিখলেন, ‘ওঠো, জাগো, বিশ্ববিদ্যালয়ের হা-ঘরেরা।’ কেউ বা আরও স্পষ্ট: ‘পরীক্ষার খাতায় উত্তর দিয়ো প্রশ্নে প্রশ্নে।’ চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’-এর নামকরণ করলেন এরকমই এক দেওয়াল লিখন থেকে। জীবন আর সাহিত্য যেখানে মিলেমিশে যায়, সেটাই হয়ত বিপ্লব!
৫ মে থেকেই শহরের সিনেমা হল এবং নাট্যশালাগুলিকে ছাত্ররা দখল করে জনসমাবেশ করছিল। এরকমই একটি সভায় এক মাওবাদী নেতা তাঁর রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতায় বললেন, ‘দ্য গলের (তৎকালীন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট) স্বৈরাচার জনগণের সংসদকে বুর্জোয়া নাট্যশালায় পরিণত করেছে।’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে ছাত্রনেতা ওয়ালি রোজেল বলে উঠলেন, ‘‘আর ঠিক এই কারণেই বুর্জোয়া নাট্যশালাগুলোকে দখল করে তাদের আমরা জনগণের সংসদে পরিণত করব।’’ সরকার আন্দোলনকে দাগিয়ে দিল মাওবাদী ষড়যন্ত্র হিসেবে। দেশকাল নির্বিশেষে রাষ্ট্রক্ষমতা সম্ভবত একই রকমের ভূত দেখে!
স্লোগানে, প্রতিবাদে মুখরিত ছাত্রছাত্রীরা। মে, ১৯৬৮।
সমাবেশগুলি থেকে দাবি উঠল লিঙ্গ সাম্যের। দাবি উঠল, শিক্ষা ব্যবস্থাকে শোষিত জনগণের পাঠশালায় রূপান্তরিত করতে হবে। অবাধ চিন্তার স্বাধীনতা চাই। যৌনতা হোক মুক্ত। রক্ষণশীল দ্য গলের পতন হোক। সনাতনপন্থীরা তো বটেই, ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিও ঢোঁক গিলল এবার। এই বিদ্রোহ এতই নতুন ধাঁচের যে চিরাচরিত মাকর্সবাদ দিয়ে ঠিক মেলানো যাচ্ছিল না। বিদ্রোহীদের নতুন আইকন এখন চে গেভারা, হারবার্ট মারক্যুস, মাও জে দং। তাদের দাবি যত না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নে। ফলে এক সময়ে দ্বন্দ্বটা শুধু নতুন বনাম সনাতনী সমাজ নয়, নতুন বনাম পুরনো বামপন্থার রূপও নিয়ে নিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়ার ব্যাঙ্গাত্মক আহ্বান, ‘ঢোকার সময় যেমন ভেবেছিলেন, ছাড়ার সময়ও তেমন সাফসুতরো রাখুন কমিউনিস্ট পার্টিকে’। অবশেষে সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে কয়েকদিন পরে কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া নিয়ে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াল। শ্রমিকেরা দখল নিয়ে নিলেন একাধিক কারখানার। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক কোটি শ্রমিকের ধর্মঘটে ফ্রান্স স্তব্ধ হয়ে গেল।
ব্যাপক সংখ্যায় মানুষ, গায়ক, কবি, অধ্যাপক এবার আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। রেনো কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্র-শ্রমিক সংহতির পক্ষে দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্র প্রকাশ্যে বিলি করলেন নিষিদ্ধ মাওবাদী পত্রিকা। তখন কান চলচ্চিত্র উৎসব চলছিল। মঞ্চে উঠে চলচ্চিত্রকার জঁ লুক গদার আন্দোলনরত ছাত্রদের প্রতি সহমর্মিতা জানালেন। প্রতিবাদে আইরিশ চিত্রপরিচালক পিটার লেনন চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘‘আমার ফিল্ম প্রদর্শনের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আপনাদের বিপ্লব শুরু হতে হল?’’ সপাটে জবাব দিলেন গদার, ‘‘আমরা বিপ্লব নিয়ে কথা বলছি। আর আপনি এখনও ক্লোজ আপ আর ট্র্যাকিং শট নিয়ে কচকচি চালিয়ে যাচ্ছেন। তফাতটা বুঝুন।’’ উৎসব বন্ধ হয়ে গেল।
তত দিনে ফ্রান্সের সরকার প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ—সব কিছুরই দখল সাধারণ মানুষের হাতে। এবার চার্লস দ্য গল যেটা করলেন সেটা প্রায় অভাবনীয়। মন্ত্রিসভাকে অন্ধকারে রেখে দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলেন। যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীকে বলে গেলেন, ‘‘আমার দিন শেষ’’। সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ ফেটে পড়ল প্রবল উল্লাসে। অভ্যুত্থানের ভয়ে প্রেসিডেন্ট ভাগলবা হয়েছেন! কয়েকদিন বাদে অবশ্য ফিরেও এলেন। নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হল রাজবন্দিদের। জুন মাসে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। এরপর আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসল অভ্যুত্থান। কিন্তু দ্য গল আর কখনও তাঁর হৃত জনপ্রিয়তা ফিরে পাননি। নির্বাচনে জয়লাভ করা সত্বেও ১৯৬৯ সালে পদত্যাগ করেন তিনি।
আর্নেস্ট ম্যান্ডেল ভুল ভেবেছিলেন। বিপ্লব আসেনি। প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন এক সময়ে স্তিমিত হয়ে নিভে গিয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের থেকেও বেশি বিপজ্জনক হল বিপ্লবের ভূত, যা ভবিষ্যতের পৃথিবীকে তাড়া করে বেড়ায়। নতুন রূপে ফিরে আসে বারবার। জেএনইউ থেকে যাদবপুর, তাহিরির স্কোয়ার, শাহবাগ, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট... বিপ্লব মানেই তো সমগ্র পৃথিবীর মানুষের ভোজসভা!
এই ভোজসভায় সার্বিক সমাজের যোগদানের রূপ কেমন হতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন ফ্রাঁসোয়া লেনার্ড। ফ্রাঁসোয়া ’৬৮-র ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন, বর্তমানে পেশাদার ফটোগ্রাফার। প্যারিস রিভিউ-তে ’৬৮-র স্মৃতিচারণে ফ্রাঁসোয়া লিখেছিলেন, ইকোল নর্মাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁদের গ্রিক দর্শন পড়াতেন এক সুদর্শন শান্তস্বভাবের অধ্যাপক। ছাত্রবিক্ষোভে যোগ দেওয়ার জন্য এক দিন তাঁর ক্লাস কেটেছিলেন ফ্রাঁসোয়া। একটি অধিকৃত নাট্যশালায় পিছনের দরজা দিয়ে ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করেছিলেন, যাতে আসবার পথে ক্লাসের কারোর চোখে না পড়ে যান। কিন্তু মঞ্চের কাছে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় ফ্রাঁসোয়ার। দেখেন, জনগণের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে সেই সৌম্য মূর্তি অধ্যাপক অগ্নিবর্ষী বক্তব্য রাখছেন! অধ্যাপকের নাম জাক দেরিদা!