Hrishikesh Mukherjee

নিখাদ বাঙালির আনন্দ থেকে অভিমান

ধরা পড়েছিল তাঁর পরিচালনায়। তাঁর বাড়ি থেকেই অমিতাভ-জয়ার সম্পর্ক। সেখানেই বিশ্রাম নিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক। গানের আলোচনায় মেতেছেন শচীনকর্তা। ডিভিডি, টিভিতে তাঁর ছবি এখনও মনের ওষুধ।

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার 

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:৪২
Share:

নির্দেশক: হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। বরাবর জীবন থেকেই সংগ্রহ করেছেন চরিত্র ও কাহিনি

সত্তরের দশক তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আর ভারতীয় সিনেমার মুঠোয় সদ্য এসেছে তার প্রথম সুপারস্টার। ‘আরাধনা’, ‘দ্য ট্রেন’, ‘সচ্চা ঝুঠা’, ‘আন মিলো সজনা’, ‘কাটি পতঙ্গ’— একটা করে সিনেমা আসছে আর আরও বড়, আরও বৃহত্তর তারকা হয়ে উঠছেন রাজেশ খন্না। সে সময়ই এক সন্ধেয় রাজেশের বাড়িতে এলেন গুলজ়ার। সুপারস্টারকে বললেন, “আমার এক দাদা একটা সিনেমা ভেবেছিলেন রাজ কপূরকে নিয়ে। ছবিটা ফ্লোরে নামার সময় কেবলই পিছিয়েছে। এখন রাজ কপূরকে আর এত তরুণ চরিত্রে মানাবে না। আমার দাদাকে গিয়ে বলো যে চরিত্রটা তুমি করবে। এক জন মরণাপন্ন রোগীকে নিয়ে গল্প।”

Advertisement

রাজেশ কিছুটা শুনেই লাফিয়ে উঠলেন, “আমি করবই এ সিনেমা।” প্রথমে তিনি পরিচালককে তিন মাসের মধ্যে কুড়ি দিন ডেট বার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিন শুটিংয়ের পর চরিত্রে এমন বুঁদ হয়ে গেলেন যে, রোজই পরিচালককে বলেন, “দাদা কাল শুটিং করতে চান? আমি চলে আসব।” শেষে, এমন দাঁড়াল, যে-অভিনেতার ডেট পেতে নির্মাতাদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়, সেই লোককে দেখলেই পরিচালক তাঁর ইউনিটের লোকজনকে বলতেন, “পালাও, রাজেশ ডেট দিতে আসছে!” কী করেন! তিনি নিজে তখন আরও দুটো ছবি তুলছেন, ‘বুডঢা মিল গয়া’ আর ‘গুড্ডি’। রাজেশ অন্য প্রযোজকের ক্ষতি করে তাঁকে সময় দিন— এই বাঙালি ভদ্রলোক তাও চাইতে পারেন না।

সেই ছবির নাম ‘আনন্দ’। আর পরিচালক হলেন আমাদের এই কলকাতার ভবানীপুরে রূপচাঁদ মুখার্জি লেনের সাত পুরুষের বাসিন্দা, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। একশো বছর আগে, ১৯২২-এর ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। দিনটা ছিল বিজয়াদশমী। পুজোর চার দিন চিরকালই তিনি কলকাতার পিতৃভিটেতে কাটতেন। আর বম্বেতে কার্টার রোডে ‘অনুপমা’ নামে তাঁর বিশাল বাড়িটা ফিল্মমহলে ‘বেঙ্গল লজ’ বলে খ্যাত ছিল। বাংলা থেকে যে শিল্পীই বম্বে যেতেন সবাইকে নাকি কড়া করে বলা ছিল, সোজা তাঁর বাড়িতেই উঠতে হবে। সেখানে গেলে দেখা যেত অমিতাভ বচ্চন জয়া ভাদুড়ি বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত, একটু বাদেই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন শচীন দেব বর্মণ। ফিল্ম সমালোচকেরা এখানে এসে চক্ষুস্থির হয়ে আবিষ্কার করতেন সোফায় আধশোওয়া ঋত্বিক ঘটককে। আবার সেই একই জায়গায় মনমোহন দেশাইকে দেখেও হতভম্ব হয়ে যেতেন তাঁরা। ঋত্বিক-হৃষীকেশ মিলে গল্প লিখছেন, মনজি’র সিনেমা হৃষীদা এডিট করে দিচ্ছেন! ঠিক তাঁর চলচ্চিত্রের মতো, দুই বিপরীত মেরুর ব্যক্তিত্বের মধ্যেও হৃষীদা সেতু বেঁধে রেখেছিলেন। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মিডল অব দ্য রোড’ সিনেমার অবস্থান ছিল নিউ ওয়েভ সিনেমা বা আর্ট ফিল্ম আর ভিলেন, মারপিট, নাচাগানার মশলাদার বাণিজ্যিক সিনেমার মাঝামাঝি। এই গোত্রের চল্লিশেরও বেশি সিনেমা তৈরি করেছেন তিনি, তার ত্রিশটাই দুর্দান্ত জনপ্রিয়। যেখানে চলচ্চিত্র সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছে। এ সবের পরেও অবশ্য হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় নিজের বিষয়ে বলতেন, “আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাধর মানুষ আছেন ফিল্মলাইনে। তাঁদের থেকে শেখো। রিয়্যালিস্টিক ছবি আমার চেয়ে বাসু চট্টোপাধ্যায়, সাই পরাঞ্জপেরা বেশি ভাল করছে। ম্যায়নে কেয়া তির মারা হ্যায়?” তার পর মিষ্টিমুখ করিয়ে সাক্ষাৎপ্রার্থী সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করতেন, বাড়ি চিনতে অসুবিধা হয়েছে কি না। তার পর বয়স্ক মানুষটি নিজেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, “হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি জিজ্ঞেস করলে কি আর লোকে এখন চিনবে? হৃষীদার বাড়ি বলতে হত, কেশ তো আর নেই।” বলে, নিজের মাথাটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করতেন!

Advertisement

এই বাড়িটিকে কিন্তু আমরাও দেখেছি। তাঁর বহু ছবির বিনিপয়সার লোকেশন। বাতের বেদনায় পঙ্গু মানুষটি আউটডোরে যেতে কষ্ট পেতেন, তাই নিজের বাড়িতেই শুটিং সারতেন। এটিই ‘খুবসুরত’-এর রাকেশ রোশনদের বাংলো। তারই দোতলা ‘গোলমাল’-এ ভবানীশঙ্করের বাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত, এক তলায় রামপ্রসাদ-রত্নাদের ছোট্ট সংসার। ‘কিসিসে না কহেনা’-র বাগানের দৃশ্যে পরিচালকের আদুরে সারমেয় ব্যাকগ্রাউন্ডে ঢুকে লেজও নেড়ে গিয়েছে। হৃষীকেশী সম্মোহনে মজে গিয়ে সে দিকে কারওই চোখ যায়নি।

আসলে সাউথ সাবার্বান স্কুলের এই মেধাবী ছাত্র বহু গুণে ধনী। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্নেহধন্য; সাহিত্যচেতনা পেয়েছেন তাঁর অধ্যাপক সাহিত্যিক মনোজ বসুর কাছে। নারায়ণ সান্যাল, তপন সিংহ তাঁর বন্ধু। তিনি আশুতোষ কলেজে রসায়ন নিয়ে স্নাতক, বায়োকেমিস্ট হওয়ার ইচ্ছে ছিল। অর্থনীতিতে আগ্রহ জন্মানোয় বি কমও পড়েছেন, তবে দাঙ্গার কারণে পরীক্ষা দেওয়া যায়নি। কিছু দিন স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা করেছেন। স্নাতক হওয়ার পর নিউ থিয়েটার্সে ল্যাবরেটরির কাজে যোগ দিয়ে বিমল রায়ের সংস্পর্শে আসেন। বিমল রায় তাঁকে ‘তথাপি’ ছবিটা সম্পাদনার ভার দিলেন। এ সময়ে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত হাজরার প্যারাডাইস কাফেতে। সেখানে তাঁর আড্ডাবান্ধবরা ছিলেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বিজন ভট্টাচার্য। আসতেন উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী। ১৯৫০ সাল নাগাদ বিমল রায় তাঁকে কাজ করতে নিয়ে গেলেন বম্বে। কিছু দিনেই সম্পাদনায় সম্ভবত ভারতসেরা হয়ে উঠলেন হৃষীকেশ।

জিনা ইসি কা নাম হ্যায়

‘দেবদাস’ সিনেমার ট্রেনের সেই দৃশ্য মনে পড়ে? স্টিম ইঞ্জিনে কয়লা ঢালা হচ্ছে, আর দেবদাসবেশী দিলীপকুমার জঠরে ঢালছেন তরল গরল। ট্রেনও ছুটছে, নায়কও উল্কাগতিতে অকালমৃত্যুর দিকে ছুটছে। এডিটিংয়ের গুণে এই দৃশ্য হৃষীকেশ এমনই সাজিয়েছিলেন যে, আজও তার অভিঘাত দর্শকের মনে গেঁথে রয়েছে। দিলীপসাব তখনই বন্ধুটিকে বলেছিলেন, “গল্প এত ভাল সাজিয়ে দিস, ছবি পরিচালনা করছিস না কেন?” বন্ধুকে তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে হৃষীকেশ কথাটা পাড়লেন। “এই যে বাড়ির দেওয়ালটা, এ কত স্মৃতির সাক্ষী। কত জনেই না জানি এখানে থেকে গিয়েছে। কেউ প্রেমে পড়েছে, কারও জন্ম হয়েছে, কেউ মারা গিয়েছে।— এই থিম নিয়ে ছবি করলে হয় না?” দিলীপ বললেন, “তুই মরবি। তাও ছবিটা কর। আমি বিনি পয়সায় কাজ করব।” তিনটি ছোট গল্প জুড়ে তৈরি হল তাঁর প্রথম ছবি ‘মুসাফির’। হৃষীদা ছবি বানাচ্ছেন শুনে নিজের খরচে বম্বে-কলকাতা যাতায়াত করে ছবিতে কাজ করলেন সুচিত্রা সেন। একটি গল্পে অসুস্থ ভবঘুরে গায়কের চরিত্রে ছিলেন দিলীপকুমার, আর এক গল্পে অভিনয় করতে এসে প্রায় ঝুলিয়ে দিচ্ছিলেন কিশোরকুমার। অন্য এক প্রযোজককে শাস্তি দিতে গিয়ে, তিনি ‘মুসাফির’-এর শুটিংয়ের মাঝপথে নেড়া হয়ে গিয়েছিলেন। হৃষীদা বিলকুল না ঘাবড়ে কিশোরকে পরচুলা পরিয়ে বাকি শুটিং মিটিয়ে নিলেন। ছবিটা চলল না। তবে, সমঝদারদের নজর কাড়ল। পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট’স সার্টিফিকেট এল। এ তো হওয়ারই কথা। ভারতে এর আগে তিনটি গল্প জুড়ে আর একটি ছবিই নাকি হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’।

অদ্ভুত একটা সময়, সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে অত্যাশ্চর্য সব সমীকরণ। বিমল রায়ের পাশাপাশি, মাত্র বছরখানেকের বড় সত্যজিৎ রায়কেও গুরু মানতেন হৃষীকেশ। একদা তাঁকে অ্যাসিস্ট করতেও চেয়েছিলেন। সত্যজিৎ অবাক, “বম্বেতে পঁচিশটা ছবি ডিরেক্ট করে ফেলেছেন, এত নামডাক! আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে চান!” হৃষীকেশই দিলীপসাবকে বলেছিলেন, আমার দ্বিতীয় ছবিটায় রাজ কপূরকে বেশি মানাবে। শুনে দিলীপ আবার নিজেই রাজকে কথাটা জানাতে গেলেন!

রাজ কপূরকে নিয়ে দ্বিতীয় ছবি ‘আনাড়ি’, বলরাজ সাহনি লীলা নায়ডুকে নিয়ে তৈরি ‘অনুরাধা’ (শচীন ভৌমিকের গল্প) সুপারহিট তো হলই, তার সঙ্গে পুরস্কার এল অনেক। তাঁর প্রথম দিকের সিনেমাগুলি স্পষ্ট সোশ্যালিস্ট। স্বাধীনতার সময়ে দেখা স্বপ্নগুলো কী ভাবে ভেঙে যাচ্ছে, দুর্নীতি কী ভাবে সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে— সেই সব হৃদয়স্পর্শী কাহিনি শোনায়। ‘মুসাফির’-এ কিশোর অভিনীত চরিত্রটি বিষ খেয়েও বেঁচে যায়, কারণ বিষে ভেজাল ছিল। ‘আনাড়ি’-তে গরিব রাজু ভাতের হোটেলে চাকরি পেয়েছে, সেখানে ডালে আরশোলা ভাসছে। সে চিৎকার করে গ্রাহকদের সাবধান করতে গিয়ে চাকরিটি খোয়াল। এ সময় থেকেই হৃষীকেশের ছবিতে একই ধরনের চরিত্র বা থিমের যাওয়া-আসা। ধনী সন্তান হাঁপ ছেড়ে বাঁচছে হতদরিদ্রের কুটিরে (‘আসলি নকলি’, ‘আশীর্বাদ’, ‘আলাপ’), ডাক্তারি পেশার মধ্যে ঢুকে পড়ছে অর্থগৃধ্নুতা (‘আনাড়ি’, ‘আনন্দ’, ‘বেমিসাল’, ‘খুবসুরত’-এ মার্সিডিজ়-চাপা ডাক্তার ওম শিবপুরীর টুকরো অংশ), কঠিন খোলসে নরম হৃদয় লুকিয়ে রাখা খ্রিস্টান প্রৌঢ়া (‘আনাড়ি’, ‘আনন্দ’, ‘মেমদিদি’)। কয়েকটিতে থিম মিউজ়িক, গানও এক (‘সুন সুন দিদি’ আর ‘এক বাত সুনি হ্যায় চাচাজি’)। পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও আমজনতা আর ফিল্মদুনিয়া সে সব সিনেমা সাদরে বরণ করে নিল। তার কারণ বোধহয়, এই সব সিনেমা হৃষীদা তৈরি করতেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার থেকে রত্ন সেঁচে তুলে আর তাতে মিশিয়ে দিতেন নিজের অনুভব, অভিজ্ঞতা। হয়তো সেটাই বহুচর্চিত ‘হৃষীদা টাচ’। বিষয়টা হাতেকলমে বোঝার জন্য দুটো সিনেমা দেখা যেতে পারে। ‘আসলি-নকলি’ আর ‘মায়া’। একই সময়ে একই ধরনের গল্পে তৈরি দুটো সিনেমা দেব আনন্দ কেন সাইন করেছিলেন কে জানে! কিন্তু, সিনেমা দুটোয় একটা তীব্র তফাত রয়েছে। প্রথমটায় হৃষীকেশ আছেন, দ্বিতীয়টায় নেই।

রঙ্গমঞ্চের কাঠপুতলিয়াঁ

তাঁর বহু সিনেমারই উৎস তাঁর নিজের জীবনে দেখা কোনও মানুষ, ঘটনা। ‘মুসাফির’-এ দিলীপকুমারের চরিত্রের নাম পাগলাবাবু। কিশোরকুমারকে স্নেহভরে এই নামেই তো ডাকতেন হৃষীদা। গানের অনুষ্ঠান হলেই কিশোর বায়না করতেন, আসতেই হবে হৃষীদা। পরিচালক বলতেন, “পাগলাবাবু, আমি তো কোথাও যাই না বাবা।” ‘আনন্দ’ ছবিটা আসলে রাজ কপূর আর তাঁর নিজের বন্ধুত্বের কাহিনি। রাজ কপূর তাঁকে বাবুমশাই বলে ডাকতেন, বাতের ব্যথা বাড়লে নিজে হাতে হৃষীদার পায়ে তেল মালিশ করতে বসতেন। আনন্দ প্রথম যে ছেলেটাকে ‘মুরারীলাল’ বলে ডাক দেয়, সে পেশাদার অভিনেতাই নয়, হৃষীদার দাবা খেলার সঙ্গী। আর ‘মুরারীলাল’ ডাক শুনে আনন্দকে ‘জয়চন্দ’ ডেকে পাল্টা চমক দেন জনি ওয়াকার। জানা যায়, তাঁর আসল নাম ইশাভাই সুরাতওয়ালা। বাস্তবে তা হৃষীদার সাউন্ড-ইন-চার্জের নাম! ফিল্ম সমালোচক সদানন্দ মেননের সঙ্গে হৃষীদার আলাপ হল। পরের সিনেমা এল ‘অভিমান’। সমালোচক হল-এ গিয়ে খুঁজছিলেন, কিশোরকুমার-রুমা গুহঠাকুরতা, নাকি রবিশঙ্কর-অন্নপূর্ণা দেবীর অপূর্ণ দাম্পত্যের প্রতিফলন ঘটেছে পর্দায়? কিন্তু নোট-পেন হাতে হাঁ হয়ে বসে রইলেন। নায়িকার বাবা এ কে হাঙ্গলের নাম সদানন্দ কেন রেখেছেন বাঙালিবাবু?

‘গুড্ডি’-র ভাবনা এসেছিল দু’ভাবে। নূতন-তনুজার বোন চতুরা ছিলেন বিমানসেবিকা। একটি উড়ানে হৃষীকেশকে দেখেই তিনি দু’মিনিট অন্তর এসে রাজেশ খন্নাকে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন জুড়ছিলেন। হৃষীদা অমনি তারকার ক্যারিশমা নিয়ে একটা গল্প ভেঁজে ফেললেন। অন্য দিকে, পশুপ্রেমী হৃষীদার বাড়িতে একটি কুকুরের নাম ছিল ডিম্পল। তার আগের মালিকের মেয়ে সারমেয়টিকে এই নাম দিয়েছিল। কারণ, সেই কিশোরী ছিল রাজেশ অনুরাগিণী, নায়কের বিয়ের পর ডিম্পল কাপাডিয়ার উপর সে রাগে ফুঁসছিল। তপন সিংহের থেকে ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার স্বত্ব কিনে ‘বাওয়র্চি’ তৈরি করেন পরিচালক। তিনি বলেছেন, দুটো সিনেমাই আসলে তাঁর নিজের বাবা শীতলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গল্প। পড়াশোনা, গানবাজনায় তুখড়। দক্ষ রসায়নবিদ, বাড়িতে প্রসাধনী তৈরি করতেন। জীবন থেকে জ্ঞান আহরণ করে জীবনকে ভালবাসতে শেখাতেন। তবে, পরিচালকের প্রিয়তম ছবি ছিল নারায়ণ সান্যালের গল্প আশ্রিত ‘সত্যকাম’। সত্যকাম (ধর্মেন্দ্র) আর নরেন (সঞ্জীবকুমার) নাকি তাঁর আর বন্ধু নারায়ণ সান্যালের জীবনেরই অভিজ্ঞতা। তাঁর কথায়, “দেশ স্বাধীন হতে জোচ্চুরি, দুর্নীতি সে সব দশগুণ বেড়ে গেল। সে সবই সত্যকামে তুলে ধরেছি।” এই সিনেমা হয়তো ধর্মেন্দ্রর কেরিয়ারেরও সেরা ছবি।

ধর্মেন্দ্র আর অমিতাভ বচ্চন এই বৃদ্ধ বয়সেও বলেন, পাঁচ-ছয় দশকের কেরিয়ারে এক জন পরিচালককেই ভয় পেয়েছেন। হৃষীদা। দুর্ধর্ষ এডিটর ছিলেন, একটু বেগড়বাঁই করলেই তাঁর অংশটুকু ঘ্যাঁচ করে কেটে দিতেন। অমিতাভ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন, এই বাঙালিই তাঁর গডফাদার। ‘মজলি দিদি’, ‘অনুপমা’, ‘গুড্ডি’, ‘চুপকে চুপকে’-য় প্রমাণিত, ভারতীয় সিনেপর্দায় সবচেয়ে ভুল ভাবে ব্যবহৃত অভিনেতার নাম ধর্মেন্দ্র। এক সুপারস্টারের নির্গমন আর পরের সুপারস্টারের রাজ্যাভিষেক ফ্রেম বাই ফ্রেম বন্দি ‘আনন্দ’ থেকে ‘অভিমান-এ। পরিচালকের কাছে দু’জনেই অত্যন্ত স্নেহের। রাজেশ তাঁর পিন্টুবাবা, অমিতাভ মহারাজ। জয়া ভাদুড়িকে সর্বভারতীয় দর্শকের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন তাঁর এই ‘কাকু’ই। প্রচলিত নায়িকার ধারণা ভেঙে গঠন করেন জয়ার ‘গার্ল নেক্সট ডোর’ ভাবমূর্তি। জয়াকে তিনি মেজ মেয়ে বলতেন, রেখাকে ছোট মেয়ে, ডাকতেন চিন্নপুন্নু বলে। আশির দশকে কিছু সিরিয়াল করার পর, ‘গোলমাল ট্রিলজি’-র ও নিজের জীবনের শেষ সিনেমা, বিমল করের ‘ঘুঘু’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘ঝুট বোলে কৌয়া কাটে’ নিয়ে ফেরেন হৃষীদা। পরিচালকের নামের ভারে তটস্থ জুহি চাওলাকে বলতেন, “আমি তোর ঠাকুরদার মতো রে।”

পিন্টুবাবার মধ্যে তিনি উত্তমকুমারের ছটা দেখেছিলেন, তাঁকে সতর্কও করেছিলেন সময়ানুবর্তিতা আর পেশাদারিত্ব নিয়ে। শেষোক্ত দু’টি গুণ তিনি পেয়েছিলেন মহারাজের মধ্যে। রাজেশকে বলতেন, “সিনেমা সিনেমা করে বৌ-বাচ্চাকে ভুলে যেয়ো না পিন্টুবাবা। কখনও সানরাইজ়, সানসেট দেখেছ?” অমিতাভ সকাল সাতটায় ঢুকলেই বলতেন, “মহারাজ, ও ঘরে বসে সিনটা পড়ে নে।” কখনও বলতেন, “মানিকবাবুর সঙ্গে দেখা কর, বল আমাকে কাজ দিন।” কেরিয়ারে প্রথম বার কোনও শিল্পীকে চিত্রনাট্য পড়তে দিয়েছিলেন। তা পড়ে ‘আনন্দ’-এর শেষ দৃশ্যে ঢুকেই খুব কান্নাকাটি করলেন অমিতাভ। হৃষীদা হেসে খুন। “ওরে রাগ দেখা! বল, ছ’মাস ধরে আমার মাথা খেয়েছ। এ বার কথা বলো। বলো কথা!”

‘নমক হারাম’-এর সময়েই স্টার ভ্যালুতে দু’জনের দাঁড়িপাল্লা সমান সমান হয়ে গিয়েছিল। রাজেশ অভিযোগ আনলেন, “আপনি অমিতাভকে বেশি মাইলেজ দিচ্ছেন।” হৃষীদা বললেন “না, আনন্দ-এ তুই এক্সট্রোভার্ট, ও ছিল ইন্ট্রোভার্ট। এখানে সেটা উল্টে দিয়েছি।” আর কখনও নেব না বলেও রাজেশকে বছর কয়েক বাদেই ‘নৌকরি’ সিনেমায় সুযোগ দিয়েছিলেন। দেখেছিলেন, সেই ঔজ্জ্বল্য আর নেই।

যে রুচিশীলতা, সংস্কৃতিপরায়ণতা, ‘ইনটেনসিটি’র জন্য অমিতাভ আজও সুবিদিত, তার অনেকখানিই ঘষেমেজে দিয়েছেন হৃষীদা। ‘গুড্ডি’-তে জয়ার বিপরীতে অমিতাভই ছিলেন, তাঁকে বাদ দেন। তার একটা কারণ ডেট নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, আর অন্যটা হল ‘আনন্দ’-এ তাঁকে দেখেই পরিচালক বোঝেন এর ভবিষ্যৎ বিরাট। ‘গুড্ডি’তে সাধারণের চরিত্র করলে ছেলেটার ইমেজের ক্ষতি হবে। রিল নষ্ট না করে পয়সা, সময় বাঁচিয়ে ছবি তোলাই হৃষীদার টেকনিক। তিনিই নিজের লোকসান করে শমিত ভঞ্জকে দিয়ে আবার নতুন করে সিনেমা তুললেন। আটটা সিনেমা করেছেন অমিতাভ পরিচালকের ছত্রচ্ছায়ায়। ‘চুপকে চুপকে’-তে তাঁর করোলা নিয়ে হড়বড়ে বকবক থেকেই অনুপ্রাণিত অ্যান্টনি গঞ্জালভেসের তড়বড়ে কমেডি। ‘নমক হারাম’-এর নেশাগ্রস্ত ভিকি নসিবের বিখ্যাত ‘খুশিমে দারু পিনেওয়ালা’ জনির পূর্বসূরি। ‘মিলি’-তে কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়া বচ্চন, কিন্তু অমিতাভের ‘রাগী যুবক’ সিনেমাগ্রাফেও অ্যাকশনহীন ছবিটি ভীষণ উল্লেখযোগ্য।

লতা আগে, না কিশোর?

‘গাঙ্গুলিসাহেব’-এর দাদামণি হয়ে ওঠার নেপথ্য কারিগরও হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। ষাট বছরের অশোককুমারকে নায়ক করে ‘আশীর্বাদ’ তৈরি করলেন। সিনেমার পর সিনেমায় হৃষীদা দাদামণির অভিনয় ক্ষমতার প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি করেছেন, বহু যুগ পরে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর গায়কিটিকেও। হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অশোককুমারের গাওয়া ‘রেলগাড়ি’ গানকে অনেকেই বিশ্বসঙ্গীতেরই প্রথম র‌্যাপ বলে মনে করেন। এই ‘আশীর্বাদ’-এই কবির লড়াইয়ের ঢঙে নর্তকীদের সঙ্গে যোগী ঠাকুর অশোককুমারের গানের তরজা এক বার শুনলেই ভোলা যায় না। ‘খুবসুরত’-এ হৃষীদার বাড়ির ছাদে ‘পিয়া বাওয়রি’ গানে রেখার নৃত্যছন্দ, আর আশা ভোঁসলের সুরেলা জাদুতে কণ্ঠে-তবলা বোলে অসামান্য অশোককুমার।

কিন্তু, হৃষীদা সিনেমায় সঙ্গীতের প্রয়োগ পছন্দই করতেন না। বাহুল্য মনে করতেন। অথচ তাঁর গানের দৃশ্যায়নের খ্যাতিই আলাদা। রবিশঙ্কর, সলিল চৌধুরী, শচীন-রাহুল, হেমন্ত— বাঙালিরা উজাড় করে সুর ঢেলেছেন তাঁর ছবিগুলিতে। ‘নদিয়া সে দরিয়া’ ছাড়া ‘নমক হারাম’, ‘কহি দূর যব’ বিনা ‘আনন্দ’, ‘আনেওয়ালা পল’ ব্যতিরেকে ‘গোলমাল’, ‘এ রি পবন/ ঢুন্‌ঢে কিসে তেরা মন’ বাদ দিয়ে ‘বেমিসাল’ কি কল্পনাও করা যায়? অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় সেতার বাজিয়েছেন হৃষীদা, দু’-দু’টো ছবি সঙ্গীতনির্ভর ছবি বানিয়েছেন— ‘অভিমান’, ‘আলাপ’। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে বসে তাঁর উচ্চমার্গের সাঙ্গীতিক আলোচনার মর্মার্থ কেউই বুঝত না। কে জানে দুই হুজুরে ‘অভিমান’-এর সাউন্ডট্র্যাকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম জটিল সব ধাঁধা ভরে রেখেছেন কি না! সেখানে নায়কের গলায় কখনও কিশোর, কখনও রফি, কখনও মনোহর উদাস। সূক্ষ্ম ভাবে তার কেরিয়ারের শীর্ষ, একটু দুর্বল অবস্থান বোঝাতে বিভিন্ন গায়ক? কিন্তু, নায়িকার কণ্ঠ শুধু এবং শুধুই লতা মঙ্গেশকর। যে ডুয়েটের পর ডেভিড বলবেন স্ত্রী বেশি প্রতিভাধর, সেখানে লতার সঙ্গে অন্য গায়ক থাকলেও, যে গানে দম্পতি ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আবার জুড়ছেন, শুধুমাত্র সেই পবিত্রতম ডুয়েটেই লতার পাশে কিশোর। ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে রৈনা’। সেই গানেরই আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘যদি তারে নাই চিনি গো সে কি’ থেকে সরাসরি অনুপ্রাণিত। কোন কোন সওয়াল-জবাব মিলিয়ে গিয়েছেন হৃষীদা

আর শচীনকর্তা?

সব গোলমাল হ্যায়...

অমোল পালেকর ধরিয়ে দিয়েছেন, ‘গোলমাল’-এ তাঁর ট্রিপল রোল। সত্যিকারের রামপ্রসাদ, ভবানীশঙ্করের মনের মতো রামপ্রসাদ আর লাকি। সত্তরের দশকে শুদ্ধ হিন্দি সংক্রান্ত সরকারি অনুশাসন নিয়ে ঠাট্টা, মার্ক্সীয় সাম্যবাদী চিন্তাধারা প্রচ্ছন্ন ‘চুপকে চুপকে’-য়। যা প্রকট করে দেখিয়েছেন ‘নমক হারাম’-এ। কমেডির পোশাকে ‘গোলমাল’-এ বেকারত্বের সমস্যা, ‘খুবসুরত’-এ জরুরি অবস্থা নিয়ে মজা। ফিল্ম-গবেষকেরা বলেছেন তাঁর সিনেমার শক্তি ছক-ভাঙা চরিত্রাভিনেতারা। এই দুনিয়ায় আসরানি এক বারও ‘আহা’ করে ওঠেন না, বরং তাঁকে সুটেড-বুটেড দেখে আঁতকে ওঠেন ‘বাহনচালক’-বেশী ধর্মেন্দ্র। পরভিন বাবি আটপৌরে গৃহবধূ, অথচ দীপ্তি নাভাল অত্যাধুনিকা তরুণী! ললিতা পাওয়ার, শশীকলা, বিন্দু ভ্যাম্প নন। স্নেহশীলা জননী, দিদি-বৌদি, পরোপকারী বন্ধু! এমনকি হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের পৃথিবীতে রঞ্জিত পর্যন্ত অনিতা রাজের মামা হন! আর বয়স্ক মানুষ এখানে দু’রকমের হয়। ডেভিড বা অশোককুমারের মতো বন্ধুভাবাপন্ন। নয়তো পুরাতনি খেয়ালের কট্টর পিতৃতান্ত্রিক। এমন চরিত্রের গোঁফ থাকে, আর মিষ্টি বুড়ো লোকদের গোঁফ থাকে না। গুড্ডির মামাজি আর ‘গোলমাল’-এর ভবানীশঙ্করের ভূমিকায় উৎপল দত্তের মতো।

পরিচালক জানিয়েছেন, সর্বভারতীয় দর্শককে উৎপল দত্তের অভিনয়ের স্বাদ দিতেই তিনি স্ল্যাপস্টিক কমেডিগুলি তৈরি করেছেন। খাড়া চুল নিয়ে গেঞ্জি-পাজামা পরে রামপ্রসাদকে তাড়া করা কালিন্দীর দাদার ‘ইস্‌স্’-স্পেশ্যাল উদ্ভুট্টি চরিত্রটি উৎপল দত্তের পক্ষেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল। মাত্র আধঘণ্টার উপস্থিতিতে ‘রঙ্গবিরঙ্গি’র মতো দুর্বল সিনেমাকে স্মরণীয় করে ফেলতেও তাঁর জুড়ি নেই! শুধু ডায়লগ থ্রো-গুণেই সিনেপর্দার অন্যতম চকচকে শেষ সংলাপ হয়ে উঠেছিল ‘বি আর চোপড়াকো পকড়কে লাও!’ কিন্তু, পরিচালকের ইঙ্গিত মতো, এই সব নানা কিসিমের অভিভাবক চরিত্রে কি কোথাও তিনি নিজেই লুকিয়ে আছেন? কোন জন? তিনি কি ডেভিডের মতো কাহিনির সূত্রধর মাত্র? ওমপ্রকাশের মতো ভোলাভালা মানুষ? নাকি শৃঙ্খলাপরায়ণ গোলমেলে ভবানীশঙ্কর? যিনি নিজের স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের এই গ্ল্যামার-জগতের চেয়ে অনেক দূরে রেখেছেন বরাবর? পরিচালক নিজেই তো গুম্ফধারী!

হয়তো দুটোই। কিংবা ‘আশীর্বাদ’-এর যোগী ঠাকুরই আসলে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। বাঁদরের মুখোশ পরে ‘নীনা কি নানি কি নাও’ গেয়ে মনোরঞ্জন করেন, আদতে কবিতা রচেন সেলুলয়েডে। আর ২০০৬ সালে জীবনাবসানের আগেই বোঝেন, তাঁর স্মৃতিতে কতখানি বুঁদ নতুন প্রজন্মও। ডিভিডি, টিভিতে তাঁর ছবি এখনও মনের ওষুধ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নাম আর ছাঁচ নিয়ে তৈরি হয়েই চলেছে সিনেমা ও রিমেক। অতঃপর, না-ই বা হল তাঁর শতবর্ষে হইচই। নিজেকে ঘিরে নৈঃশব্দ্যই তো চেয়েছিলেন। বহু বিখ্যাত বাংলা ও হিন্দি ছবি সম্পাদনা, এমনকি ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’-র পরিচালনাও অনেকখানি সামলে দিয়েছেন স্বীকৃতির দাবি ছাড়াই। সালতারিখ তিথিনক্ষত্র নিয়েও মাথা ঘামাননি। তাই মহরৎ রাখতেনই না সিনেমার। শুধু শুটিংয়ের সময় মেহমুদ এসে চেঁচিয়ে যেতেন। “যাচ্ছেতাই হচ্ছে। ফালতু সিনেমা। ফ্লপ হবেই।”

ওটাই ছিল পিকচার সুপারহিট হওয়ার

অব্যর্থ টোটকা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement