অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ
বিদ্যাসাগর নামটা শুনলেই যাঁর কথা মনে পড়ে যায়, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তেমনই ‘বিদ্যাভূষণ’ বললে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ-সহ অনেক বিদ্যাভূষণের আসরে মনে পড়ে এক জনকেই— অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে যেমন তাঁর ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ পদবিটা তেমন মনে পড়ে না, ঠিক তেমনই, অমূল্যচরণও যে ‘ঘোষ’, তা আমাদের মনে থাকে না। তাঁর পদবি যে আসলে ঘোষ মজুমদার, তা-ই বা ক’জন জানেন? এমনকি তিনি যে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখেই জন্মেছিলেন, তা নিয়েও বহু জনের সংশয়। ভাগ্যিস তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন যে তিনি এই তারিখেই জন্মেছিলেন! না হলে ধন্দ কাটত না।
সাধারণ মানুষ জানেন, তিনি বিডন স্ট্রিটের নামী ঘোষ পরিবারের (আদতে ঘোষ মজুমদার বাড়ির) ছেলে। তবে এও তেমন প্রচারিত নয়। কলকাতা-জীবনের আদ্যযুগে তিনি বিডন স্ট্রিটের ৫২/২ নম্বরের বাসিন্দা হলেও, বহু বার ঠিকানা বদল করেছেন। তাঁর বাবা উদয়চন্দ্র ঘোষ মজুমদার আদতে এখনকার উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির বাসিন্দা ছিলেন। মা যাদুমণি দেবীর তিনি দ্বিতীয় পুত্র, আগে-পিছে দুই ভাই চণ্ডীচরণ ও বীরেন্দ্রনাথ, সহোদরার সংখ্যা তিন। অমূল্যচরণের জন্ম ওই বিডন স্ট্রিটের ঠিকানাতেই, পড়াশোনার শুরু কেশব অ্যাকাডেমিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮৮ সালের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন এই স্কুল থেকেই, পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। সিলেবাসের পড়াশোনা তাঁর ভাল লাগত না, বাইরের বই-ই বেশি পড়তেন। স্কুলে পড়ার সময়েই তাঁর চৈতন্য লাইব্রেরির বেশির ভাগ বই পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল!
বিদ্যালয় শেষে কলেজে। পাশের পাড়াতেই এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজ, তখন নাম ছিল জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ় ইনস্টিটিউশন। ভর্তি হলেন এফএ ক্লাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেন্ট জ়েভিয়ার্সে ভর্তি হয়েছিলেন, ছেলে হিসেবে নিন্দের ছিলেন না, তবু কলেজের ডিগ্রি পাননি, কারণ ওই বাইরের লেখাপড়ার টান! আঠেরো বছর বয়সে অমূল্যচরণও পড়াশোনা নিয়ে এমন কাণ্ড করে বসলেন যে পড়াশোনা শিকেয় উঠল। চৈতন্য লাইব্রেরির প্রায় সব বই যাঁর পড়া, তাঁর যদি শিরঃপীড়া না হয় তো কার হবে! অক্ষয়কুমার দত্ত— বিদ্যাসাগরের বয়সি— তাঁরও তো ওই রোগ, পড়াশোনা। তবে তাঁর একটা মজা ছিল। মাথাব্যথা যত বাড়ে, পড়াশোনার বহরও সেই অনুপাতে বেড়ে যেত।
মাসকয়েক পরে বাঁধাধরা বিদ্যাচর্চায় ইতি। অমূল্যচরণ বরং সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য ভাল ভাবে রপ্ত করার জন্য কাশী চলে গেলেন। সেখানে কাশী-নরেশের চতুষ্পাঠীতে পড়ে, তাঁর বিখ্যাত উপাধিটি অর্জন করলেন, হয়ে উঠলেন ‘বিদ্যাভূষণ মশাই’। কলকাতায় ফিরে এলেন জ্ঞানের খিদে বহু পরিমাণে বাড়িয়ে। একের পর এক ভাষা শিখতে লাগলেন। শুধু কি শেখা? শেখাতেও লাগলেন। বাড়িতে শেখান, শেখানোর জন্য ইস্কুলও করেন। সাধারণ ছেলেদের মধ্যে থেকে বাছাই করে এক অসাধারণ স্কুল— ভাষা শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল। আরও জানতে-চিনতে এবং কাজে লাগাতে চান যাঁরা, তাঁদের জন্য খুললেন কলকাতায় প্রথম অনুবাদের স্কুল— ‘ট্রানস্লেটিং ব্যুরো’— ১৮৯৭ সালে। তাঁর বয়স তখন আঠেরো! স্কুলটা ছিল সেই পুরনো কেশব অ্যাকাডেমির বাড়িতেই। অমূল্যভূষণের স্কুলে কাজ হত ভারতের ভাষা আর ভারতে চলিত ভাষা— বাংলা, সংস্কৃত, ওড়িয়া, তামিল, হিন্দি, তেলুগু, উর্দু, আরবি, ফারসি, অসমিয়া নিয়ে। এ ছাড়া ছিল ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, পর্তুগিজ, জার্মান, এমনকি পালি ও প্রাকৃতও। আরও কয়েকটা ভাষা জানতেন, সব মিলিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ছাব্বিশে। হরিনাথ দে মশাই জানতেন চৌত্রিশটি ভাষা। তাঁর পরেই তালিকায় সম্ভবত দ্বিতীয় অমূল্যচরণ।
এই সব ভাষা পড়ানোর জন্য ওই কেশব অ্যাকাডেমিতেই তাঁর গ্রিক ভাষার শিক্ষক এডওয়ার্ডের নামে অমূল্যচরণ ‘এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন’ নামে একটা আলাদা স্কুলই খুলেছিলেন। এতে উপার্জন বেড়ে গিয়েছিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান অমূল্যচরণ হঠাৎ রোজগারের আর একটা সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন। কোহেন নামে এক সাহেব এর-ওর কাছে জানতে পেরেছিলেন, অমূল্যচরণ সংস্কৃত ভাষার জাহাজ। নিজের ছেলেকে ভাল করে সংস্কৃত শেখাতে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে তাঁকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন সাহেব। বাবার ছিল সামান্য কেরানির চাকরি, সহোদর দুই ভাই স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি! সেই বংশের ছেলে বিদ্যাভূষণ কিনা পঞ্চাশ টাকা পাচ্ছেন মাসে! সঙ্গে চিঠি, বইপত্র অনুবাদ করে ও করিয়ে ট্রান্সলেটিং ব্যুরো থেকেও রোজগার।
কিন্তু বিলাসিতা কী, বিদ্যাভূষণ জানতেন না। বই কেনা আর ভাষা শেখানোর কাজেই অর্থ ব্যয় করেন। বিয়ে করেছিলেন যাঁকে উনিশ বছর বয়সে, সেই সুহাসিনী দেবী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে মারা যান। তত দিনে বাবাও মারা গিয়েছেন। সংসার চালায় কে, তাঁর তো বিদ্যাচর্চাতেই সময় যায়। কোলের ছেলেকে মানুষই বা করে কে? কয়েক মাস পরে তাই আবার বিয়ে করলেন— সরসীবালাকে। পাঁচ পুত্র আর তিন কন্যার জন্ম দিলেন তিনি। সংসার চলে আপন গতিতে। অমূল্যভূষণ ক্রমে বড় মেয়ে হেমলতার বিয়ে দিলেন তাঁর একদা-সহকর্মী, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের পুত্র অজয়কুমারের সঙ্গে।
সংসার ও দায়দায়িত্ব, দুই-ই বেড়ে চলল ক্রমশ। বড় ভগ্নীপতি মারা যেতে বড়দিদি তাঁর সাতটি সন্তানকে নিয়ে ভাইয়ের সংসারে এলেন। বালবিধবা মেজদি বিধবা হওয়া ইস্তক আগেই এসেছিলেন। পিতা প্রয়াত, দাদা সামান্য বেতনের কর্মী। বিরাট সংসারের বিপুল বোঝা অমূল্যচরণের ঘাড়েই। এই গুরুভারও ভুলে থাকেন, সময় কেটে যায় ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষণে, বই লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রবন্ধ রচনায়, নানান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগে।
সেই কবে থেকে ভাষা শিখছেন! জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ়ের বুড়ো মাস্টারমশাই এডওয়ার্ড সাহেবের কাছে গ্রিক, বাড়িতে মৌলভি সাহেবের কাছে ফারসি আর উর্দু ভাষা। এ সবের জন্যে তো খরচ লাগেই। তাই পিটারসন সাহেবকে প্রথমে গ্রিক, পরে সংস্কৃত ভাষাও শেখান।
কেশব অ্যাকাডেমির ঠিকানা থেকে জায়গা বদল করে এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন পরে উঠে আসে এখনকার ৫৮ বিধান সরণির ঠিকানায়। কিছু দিনের মধ্যেই এখানে ভাষাশিক্ষা ছাড়াও একটি সাধারণ বিদ্যালয়ও খোলা হল। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ নিজে এই স্কুলের অধ্যক্ষ হয়ে রইলেন, তবে প্রধান শিক্ষক হলেন বিডন স্ট্রিটেরই চারুচন্দ্র মিত্র। আরও যাঁরা পড়াতে এলেন, তাঁরাও কম নামকরা ছিলেন না— পণ্ডিত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি, কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ। স্কুলের মান বেশ উন্নত ছিল। সে সময় যিনি বঙ্গের শিক্ষা অধিকর্তা ছিলেন, সেই স্যর আলেকজ়ান্ডার পেডলার এই বিদ্যালয়টি সম্পর্কে বাহবা জানিয়েছিলেন, ‘দ্য লাস্ট স্কুল ইন ক্যালকাটা মেনটেন্ড বাই প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ়।’ টানা পনেরো বছর দিব্যি চলেছিল এই বিদ্যালয়।
এক জন মানুষ একই সঙ্গে যে কতগুলি প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেন, তার অভূতপূর্ব উদাহরণ বিদ্যাভূষণ ও তাঁর শিক্ষকজীবন। মোটর নেই, নেই দ্রুতগামী যাতায়াতের সুব্যবস্থা, অথচ সেই ১৯০৫ সালে অমূল্যচরণ বিডন স্ট্রিট থেকে যাদবপুর যাচ্ছেন। নগেন্দ্রনাথ ঘোষ এক দিন বললেন, ‘‘আপনি মেট্রোপলিটনে যোগ দিন।’’ তা-ই হল। আমৃত্যু এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই কিছু কাল পড়িয়েছেন ডাভটন কলেজ নামের এক মিশনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ধরলেন, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন-এ পড়াতে হবে ভাষাশিক্ষার ক্লাসে। অমূল্যচরণ রাজি হলেন, পড়ালেন পালি, জার্মান, ফরাসি। তখন সেখানে ইতিহাস পড়াতেন অরবিন্দ ঘোষ। মানিকতলা বোমার মামলায় জড়িয়ে পড়ায় পড়ানোর কাজটা চালানো গেল না। তাঁর ক্লাসটাও করছেন বিদ্যাভূষণ মশাই নিজেই। এ সময়ে ছাত্র হিসেবে এখানে পেলেন পরবর্তী কালে বিখ্যাত বিনয়কুমার সরকারকে।
বিদ্যাভূষণের খ্যাতিতে ত্রিপুরা সরকার মুগ্ধ। এমন লোককে তাঁদের পেতেই হবে। তাঁকে নিয়োগ করা হল ‘রাজ ঐতিহাসিক’ পদে। অন্য সব কাজ সব সরিয়ে রেখে, অনেক দিন ধরে সেখানে পুরাতাত্ত্বিক কাজে লেগে রইলেন তিনি। উদ্ধার করলেন প্রাচীন মুদ্রার পাঠ। তবে বর্মার কাঠের বাড়িতে আগুন লেগে যেমন শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’-এর পাণ্ডুলিপি পুড়ে গিয়েছিল, তেমনই আগুন লেগে ত্রিপুরায় অমূল্যচরণের সব লেখা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
তাঁকে কাছ থেকে দেখেছিলেন বহুদর্শী হেমেন্দ্রকুমার রায়। তিনি অনেক কথাই লিখেছেন ‘যাঁদের দেখেছি’ লেখার দ্বিতীয় পর্বের স্মৃতিচারণে— ‘অমূল্যচরণের অগাধ জ্ঞানভাণ্ডারের রত্ন সংগ্রহ করবার জন্য এসেছেন কত শ্রেণীর কত অনুসন্ধিৎসু লোক। কেউ সাধারণ প্রবন্ধ লেখক, কেউ ঐতিহাসিক, কেউ প্রত্নতাত্ত্বিক। অমূল্যচরণ ছিলেন যেন মূর্তিমান বিশ্বকোষ।’ এই শেষ কথাটি প্রবাদপ্রতিম। তিনি বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন, তার চেয়ে বহুগুণে সত্য এই যে, তিনি নিজেই ছিলেন বিশ্বকোষ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁকে লিখেছিলেন— ‘তোমার ত সব নখদর্পণে। এক লাইন লিখিয়া তোমার মতামত জানাইবে।’ এর পরে আর কী কথা! তাঁর ‘প্রতাপাদিত্য’ গ্রন্থের ভূমিকায় ইতিহাসবিদ নিখিলনাথ রায়ের কৃতার্থতা প্রকাশের ভাষা ছিল এই রকম— ‘নানা ভাষাবিদ ও ঐতিহাসিক তত্ত্বজ্ঞ সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ ঘোষ বিদ্যাভূষণ এই গ্রন্থ সম্পাদনে যেরূপ সাহায্য করিয়াছেন, তাহা আমরা কদাচ বিস্মৃত হইব না।’ ‘চণ্ডীমঙ্গল’ সম্পাদনার পর চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতশির স্বীকৃতি— ‘আমি নিতান্ত অকিঞ্চন, আপনার সাহায্য ব্যতীত আমি কবিকঙ্কণ সম্পাদনের দুরূহ ব্রত উদযাপন করিতে পারিতাম না। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’ শিক্ষক অমূল্যচরণের প্রতি সকলেই আনত, বিনত।
অমূল্যচরণের জীবন বিচিত্র কর্মগাথায় গ্রথিত। তিনি কখনও সম্পাদক, কখনও লেখক, কখনও বিশ্বকোষ প্রণেতা। বেদ-পুরাণ-ধর্মশাস্ত্র, ইতিহাস-ভূগোল-আয়ুর্বেদ এবং কামশাস্ত্র, জাতি ব্যবস্থা, নৃতত্ত্ব এবং সমাজ, প্রত্নতত্ত্ব-আবিষ্কার-বিজ্ঞান— জ্ঞানক্ষেত্রে এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যার চর্চা তিনি করেননি।
সম্পাদক হিসেবে সামলেছিলেন ‘বাণী’, ‘ভারতবর্ষ’ (জলধর সেনের সঙ্গে), ‘সংকল্প’, ‘সাপ্তাহিক মর্মবাণী’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সেবক’, ‘কায়স্থ পত্রিকা’ এবং ‘শ্রীভারতী’র মতো পত্রিকার দায়িত্ব। এই পত্রিকাগুলির সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে যে লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, অমূল্যভূষণ তার সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় বারবার এগিয়ে এসেছেন। কালিদাস রায়ের স্মৃতিচারণে আছে, ‘অমূল্যচরণ নিজে কোন দলের ছিলেন না। সেইজন্য তাঁর আসরে আসবার পথ ছিল সকলেরই কাছে খোলা। অক্ষয়কুমার বড়াল আর মোহিতলাল মজুমদারের পাশাপাশি বসায় কোনও নিষেধবাণী ছিল না, বনোয়ারিলাল গোস্বামী আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থীরা একই সঙ্গে হাস্য-পরিহাসে মত্ত হতেন।’
কালিদাস রায় এবং তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার প্রকাশ-কাহিনি তাঁর বয়ানে এ রকম: ‘‘যখন ষষ্ঠবার্ষিক শ্রেণীতে পড়ি, তখন একদিন কলেজের পথে ‘বাণী’ পত্রিকা অফিসে গেলাম। সেখানে ছিলেন কবি করুণানিধান, অমূল্য বিদ্যাভূষণ, চারুচন্দ্র মিত্র, ব্রজেন বাড়ুজ্যে প্রভৃতি। কবিতাটি শোনাইলাম। তাঁদের সকলেরই কবিতাটি ভাল লাগিল। অমূল্যবাবু কবিতাটি একরূপ কাড়িয়া লইলেন ‘বাণী’তে ছাপিবেন বলিয়া। ‘বাণী’ উঠিয়া গেল। অল্পদিন পরে অমূল্যবাবু ‘ভারতবর্ষ’র সম্পাদক হইলেন। ‘ভারতবর্ষ’র দ্বিতীয় সংখ্যায় ইহা প্রকাশিত হইল।’’ বিখ্যাত সেই কবিতাটি— ‘নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার!...’
অনেকগুলি বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, সম্পাদনা করেছেন অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। ‘শিক্ষাকোষ’, ‘শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃতম’, ‘শ্রীকৃষ্ণবিলাস’, ‘বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ তৃতীয় খণ্ড, ১ম ও ২য় সংখ্যা, ‘শ্রীশ্রীসংকীর্তনামৃত’, ‘বিদ্যাপতি’ দুই খণ্ডে— এগুলি সবই সম্পাদিত। রচিত বইয়ের মধ্যে বিদ্যালয়পাঠ্য পুস্তক ছাড়া খুব আদরণীয় হয়েছিল ‘সরস্বতী’, ‘মহাভারতের কথা’, ‘প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি ও সাহিত্য’, ‘লক্ষ্মী ও গণেশ’, ‘ভারত-সংস্কৃতির উৎসধারা’ প্রভৃতি। পরে প্রকাশ পায় ‘বাংলার প্রথম’।
কিন্তু যে কারণে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হল তাঁর ‘বঙ্গীয় মহাকোষ’, যার মাত্র দু’টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর জন্ম ও বিকাশের পরম সাক্ষী। ১৩৪১ বঙ্গাব্দে পরিষৎ মন্দিরে এর প্রতিষ্ঠা উৎসব উদ্যাপিত হয়।
ঠিক হয়েছিল, চল্লিশ পৃষ্ঠার ২৪টি সংখ্যা দিয়ে এই মহাকোষের একটি খণ্ড নির্মিত হবে। চল্লিশ পৃষ্ঠার সংখ্যার দাম আট আনা। প্রতি খণ্ড এগারো টাকা। প্রতিষ্ঠাতা-গ্রাহক অগ্রিম দেবেন ৩৭৫ টাকা। এটি প্রকাশিত হবে যে প্রতিষ্ঠানের নামে, তার নাম স্থির হয় ‘ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ পায় দুই দিকপালের স্নেহস্পর্শে—আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৩৪১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংক্রান্তিতে শান্তিনিকেতনে বসে লেখা স্বস্তিবাচনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বঙ্গসাহিত্যের যে পরিমাণ উৎকর্ষ ও বিস্তার হইলে বঙ্গীয় মহাকোষ প্রকাশের সংকল্প রূপগ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইতে পারে তাহা আমাদের গৌরবের বিষয়। এই মহাকোষ সম্পূর্ণ হইলে বাংলাদেশের শিক্ষার পথ প্রশস্ত করিতে পারিবে কল্পনা করিয়া উৎসাহ বোধ করিতেছি। শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের নেতৃত্বে এই মহদনুষ্ঠান সিদ্ধিলাভ করিবে আশা করিয়া একান্ত মনে ইহার সফলতা কামনা ও সম্পাদকের প্রতি বঙ্গদেশের নামে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।’
ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়েন অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। এক দিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ গৃহেই আলোচনারত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর নিকট সম্পর্ক ছিল— এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে পাড়ার ক্লাব পর্যন্ত। কিন্তু সাহিত্য পরিষৎ তাঁর কাছে ছিল মায়ের মতো। অসুস্থ হওয়ার পরেও তিনি চার বছর বেঁচে ছিলেন। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন ঘাটশিলায়, সেখানেই ১৯৪০ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যু হয় তাঁর।
হরিনাথ দে-র মহাপ্রয়াণে যে কবিতাটি লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সেখানে তাঁর চিতাগ্নিতে ৩৪টি ভাষার দহনের কথা বলেছিলেন তিনি। কে জানে, ১৯৪০ সালে বিদ্যাভূষণের তিরোধানের সময় উপস্থিত থাকলে হয়তো আর একটি কবিতা রচনা করতেন সত্যেন্দ্রনাথ!
ঋণ: দেবজ্যোতি দাশ, দেবীপদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ রচনাবলী’