ছবি: বৈশালী সরকার।
শেষ জানুয়ারির এক মধ্যরাত। এক যুবক পা টিপে টিপে জানলার শিক গলে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকল। সাংহাই মেডিক্যাল কলেজের এই রিডিং রুম তার হাতের তালুর মতো চেনা। ক’মাস আগেও তো এখানকারই ছাত্র ছিল সে। বই ধার নেওয়া ছাত্রদের আইডি কার্ড কোথায় রাখা হয়, বিলক্ষণ জানা আছে তার। চটপট চারটে কার্ড তুলে নেওয়া গেল। আগের বার পরিচয়পত্রের অভাবেই সব ভেস্তে গিয়েছিল। লেবার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সাংহাই অবধি এসেও পুলিশের হাতে পড়তে হয়েছিল। এ বার আর সেই ভুল করা চলবে না।
পঞ্চাশের দশকের চিন। প্রবল প্রতাপান্বিত মাও জে দং-এর শাসন। প্রতি পদে সেখানে নথিপত্র দেখাতে হয়। কোথা থেকে এসেছ, কোথায় যাচ্ছ, পারমিট দেখাও... পাঁচশো জেরা লেগেই আছে। তার ওপর ১৯৫৭ সাল থেকে পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়েছে দক্ষিণপন্থী-হঠাও অভিযান। যাদেরই গলা একটু বেসুরো ঠেকছে, যারাই বড্ড বেশি প্রশ্ন করে বলে মনে হচ্ছে, পার্টি তাদের চিহ্নিত করছে। এলাকা-প্রতি কারা কত জন এমন বেয়াড়া খুঁজে বের করতে পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে পঞ্চাশের দশকের শুরুর বছরগুলোর মতো ‘বিপ্লবের শত্রু’ দেখলেই খতম করার লাইন এখন নয়। এ বারের লক্ষ্য, সংস্কার। মানে, চিহ্নিত দক্ষিণীকে সালিশি সভায় বসানো হবে। তার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ তাকে শোনানো হবে। তার পর তাকে পাঠানো হবে লেবার ক্যাম্পে। স্তালিনের যেমন ‘গুলাগ’, মাও-এর তেমন ‘লাওগাই’। এই লাওগাই-তে বন্দি থেকে সকলকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হবে। তারই মধ্যে দফায় দফায় চলবে চরিত্র সংশোধন পর্ব।
এই যুবকটির নাম, শু হংচাই। নিবেদিতপ্রাণ পার্টিকর্মী, কিন্তু অচিরেই প্রতিবিপ্লবীর তকমা লাগল গায়ে। সহপাঠীরা জোরদার সাক্ষ্য দিল। কলেজের দেয়াল-পত্রিকায় তার উৎসাহে পার্টির কাজকর্ম নিয়ে কত রকম প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার হাতেগরম প্রমাণও মিলল। তার প্রেমিকা পর্যন্ত বলল, শু বড় বিপজ্জনক। ‘ইতিহাস বিচার করবে মাও ঠিক নাকি আমরা’— এমন কথাও কোনও এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে সে বলেছে! চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ওকে টুকরো টুকরো করে ফেলা উচিত। শু টুকরো হয়নি। পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক ডাক্তারি পড়া অসমাপ্ত রেখে ‘হোয়াইট গ্রাস রিজ’ শিবিরে জন খাটতে চলে গিয়েছিল।
১৯৫৭-৫৮ সালের ওই পর্বে চিনে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ এ ভাবে আটক হন। কেউ কেউ বলেন, সংখ্যাটা ৩০ লক্ষ। শু তাঁদেরই এক জন। কিন্তু তিনিই এক এবং খুব সম্ভবত এক মাত্র জন, যে বহু বছরের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পালাতে পেরেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’টা অত্যাশ্চর্য জেল-পালানোর ঘটনা আছে, শু-এর কাহিনি তার প্রথম সারিতে। সেই অনুপুঙ্খ বর্ণনা পরবর্তী কালে তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন। উপন্যাসকে হার মানানো সে বইয়ের নাম ‘নো ওয়াল টু হাই’— টপকানো যায় না এমন দেওয়াল নেই।
সম্প্রতি প্লেনাম ডেকে পার্টির সর্বময় কর্তৃত্বের মেয়াদ নিজের জন্য আরও বাড়িয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেললেন শি চিনফিং। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছরের ইতিহাসে তিনি এখন মাও জে দং আর দেং জিয়াওপিং-এর সমতুল্য প্রায়। মাও থেকে শি, প্রতিবিপ্লব শব্দটাই শুধু তামাদি হয়েছে চিনে। কণ্ঠরোধের তাগিদ এবং বন্দিশালার অর্গল, আলগা হয়নি কোনওটাই। শি-র আমলেই তৈরি হয়েছে ন্যাশনাল সুপারভাইসরি কমিশন, যারা চাইলে যে কাউকে বিনা বিচারে ছ’মাস পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। উত্তর পশ্চিমের শিনজিয়াং অঞ্চলে ছড়ানো রয়েছে অজস্র ডিটেনশন শিবির। এরই মধ্যে এক কোটি ৩০ লক্ষের বেশি সংখ্যালঘুর উপরে দমন ও পীড়নের জোয়াল চেপে বসেছে। শুধু সংখ্যালঘুই বা কেন? মানবাধিকারকর্মী কুইন ইয়ংমিন ১৯৭০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ওই ৪৩ বছরে ৩৯ বার গ্রেফতার বা আটক হয়েছেন, ২২ বছরেরও বেশি কাটিয়েছেন গারদে। হংকংয়ের গণতন্ত্রের সপক্ষে কথা বলার জন্য ২০১৮ সালে ফের তাঁকে ১৩ বছরের জন্য জেলে পোরা হয়েছে। এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, অসংখ্য কাহিনির একটি মাত্র।
মুক্তিকামী: শু হংচাই। মনোবল হারাননি বারংবার ব্যর্থতা সত্ত্বেও।
দেং জিয়াওপিং-এর আমলে তিয়েনআনমেন বিদ্রোহ এবং তিব্বত আন্দোলন— দুয়েরই মোকাবিলা কোন পদ্ধতিতে হয়েছিল, অজানা নয় কারও। ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়ানো সেই যুবকের কী হল, জানা যায়নি আজও। তিয়েনআনমেনে ট্যাঙ্ক ঢোকার দিন দশেক আগে, ১৯৮৯-এর ২৩ মে হুনান এলাকায় মাওয়ের ছবিতে কালি ছিটিয়েছিল তিন যুবক। কমপক্ষে ১৬ বছর কারাবাসের একটা বড় অংশ তাদের কাটাতে হয়েছিল দুই বর্গ মিটার মাপের এক একটি সেলে।
একা, আলোহীন, বাতাসহীন। তিব্বতি সন্ন্যাসিনী নগাওয়াং সিংদ্রোল বন্দি ছিলেন ১৮ বছর। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম বার গ্রেফতার হন। জেলে গিয়েও স্বাধীনতার গান গাওয়া বন্ধ করেননি। ফলে ধাপে ধাপে সাজার মেয়াদ বাড়তেই থাকে। লাসার কুখ্যাত দ্রাপচি জেলেও ছিলেন বেশ কয়েক বছর। কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া, নগ্ন করে ঝুলিয়ে রাখা, বিদ্যুতের শক দেওয়া— অত্যাচারের ল্যাবরেটরি হয়ে উঠেছিল নগাওয়াং আর তাঁর সহ-বন্দিনীদের শরীর।
তিব্বতের আর এক সন্ন্যাসী, পাল্ডেন গ্যাতসো-র (১৯৩৩-২০১৮) বই ‘ফায়ার আন্ডার দ্য স্নো’ নথিবদ্ধ করে রেখেছে নগাওয়াং-এর আগের প্রজন্মের দ্রাপচি-বাসের কাহিনি। ৩৩ বছর জেলে থাকার পর পাল্ডেন মুক্তি পান ১৯৯২-এ, নগাওয়াং-এর কারাবাস তখন সবে শুরু হচ্ছে।
এই সব ক’টি কাহিনির মধ্যেই একটা জায়গায় খুব মিল। বাইশ বছর জেল খাটার পরেও নিজের বিশ্বাসের কথা বলতে ভয় পাননি কুইন ইয়ংমিন। তাই আবার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। জেলে গিয়েও মুক্তির গান থামাননি নগাওয়াং সিংদ্রোল, শাস্তির তীব্রতা তাঁর মনের জোর ভাঙতে পারেনি। পাল্ডেন ৩৩ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন ভারতে। দ্রাপচির কাহিনি বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তখন তাঁর ব্রত। এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে প্রমাণ করেছেন, এমন কোনও দেয়াল নেই যা টপকানো যায় না। কেউ দেয়াল ভাঙেন মনে মনে, কেউ হাতেকলমে। যেমন ভেঙেছিলেন শু হংচাই, পাল্ডেন বন্দি হওয়ার এক বছর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। বছরের পর বছর নিরন্তর চেষ্টায় রাষ্ট্রের লৌহকপাট ডিঙোতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। সেই কাহিনিতেই ফিরব। ফিরব মাওয়ের চিনে।
অর্ধাহারে শীর্ণ, পরনে পোকা ধরা জামাকাপড়, অমানুষিক পরিশ্রমে চিমড়ে শরীর, লাগাতার নির্যাতন আর রাজনৈতিক চক্রান্ত— লাওগাইয়ের এই জীবন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না, বারবার নিজেকে বলত শু। পালানোর প্রথম সুযোগ এল ১৯৫৮-র ডিসেম্বরে। সঙ্গী শিয়াংজাই নামে আর এক বন্দি। খুপরি সেলের ছোট্ট জানলা দিয়ে ব্যাগপত্র ফেলে দেওয়া হল নীচে। সবার সঙ্গে প্রাতরাশও সারা হল। মাঠে কাজ করতে যাওয়ার আগে জমায়েতের জন্য যেই বাঁশি বেজেছে, সকলের আগে বেরিয়ে ওরা দু’জন উঠোনে না গিয়ে চলে গেল জানলার পিছনে। ব্যাগগুলো কুড়িয়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দে ছুট। নাগাড়ে পঁয়তাল্লিশ মাইল হেঁটে সিয়ান শহর। সেখান থেকে বাস ধরে জিয়াশিং। তার পর ট্রেনে সাংহাই।
এই অবধি ঠিকই ছিল। কিন্তু সঙ্গে বৈধ কাগজপত্র কই? রাতটা স্টেশনে কাটাতে গিয়ে পুলিশের খপ্পরে পড়তে হল। সেখান থেকেও সটকানো গিয়েছিল। কিন্তু বিপদ হল মা-র সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে। পার্টির অতন্দ্র প্রহরী পাবলিক স্ক্রুটিনি বুরোর লোকজন তত ক্ষণে মায়ের পিছু নিয়েছে। সহজেই ওরা শু আর তার বন্ধুকে ধরে ফেলতে পারল। প্রথমে ক’দিন কারাবাস, তার পর আবার ক্যাম্পে ফেরা। পালানোর কী শাস্তি হবে, সেটাই স্থির করার প্রক্রিয়া চলতে থাকল।
শু ছটফট করছিল মনে মনে। রেডিয়োর খবরে বলল, ফিদেল কাস্ত্রোর বাহিনী হাভানায় ঢুকে পড়েছে। কিউবায় পালাতে পারলে কী ভালই না হত! আর একটা সুযোগ কি আসবে না? ২৭ জানুয়ারি ১৯৫৯ শু একটা চিরকুট পেল শিয়াংজাইয়ের কাছ থেকে— ‘তুমি আগে পালাও। তোমার পিছনে আমি। হাংতৌ-এ আমার মাসির বাড়ি। দেখা হবে।’
ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে শু জামাজুতো পরেই শুয়ে পড়ল। ভোর তখন চারটে। কুপি জ্বালিয়ে রক্ষীরা দাবা খেলছে। শু এগিয়ে এসে বলল, পায়খানা পেয়েছে। অনুমতি মিলল। চাঁদের দেখা নেই, চারদিক নিকষ কালো। শৌচাগারের ছাদ থেকে লাফিয়ে নেমে স্রেফ অন্ধকারে মিশে গেল শু। একটু ঘুরপথে দক্ষিণ-পশ্চিমে উওহু শহরে গিয়ে
সেখান থেকে ইয়াংসি নদীর ফেরি বেয়ে সাংহাই।
ছাত্রদের আইডি কার্ডগুলো হাতে নিয়ে বাকি কাজগুলো সারতে হল। মাকে খবর পাঠিয়ে কিছু টাকা জোগাড় করা, শিয়াংজাইয়ের সঙ্গে দেখা করা, দু’জনের ছবি তোলা। সেই ছবি আইডিতে সেঁটে সিলমোহরের ছাপ নকল করে নেওয়া। ওরা ঠিক করেছে, তিব্বতের মধ্যে দিয়ে ভারতে চলে যাবে।
কিন্তু সে আর হল কোথায়! চেংডু অবধি গিয়ে শিয়াংজাইয়ের উদ্যম গেল ফুরিয়ে। সে আর নড়তে চায় না। অগত্যা ক’দিন দেখে শু একাই তিব্বতি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গারজে-র উদ্দেশে রওনা হল। বাসটা যখন লং মার্চের স্মৃতিজড়িত সেই বিখ্যাত লুডিং চেন সেতুর ওপর দিয়ে যাচ্ছে, শু-র মনে হল, হায় রে! নিজেকে গিলে খাওয়াই কি তা হলে বিপ্লবের নিয়তি! গারজে পৌঁছতেই জানা গেল, তিব্বতের বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছে। লাসা অবধি যাওয়া মুশকিল হবে। শু তাও কিছু দূর এগোয়। কিন্তু অচিরেই তাকে ফের চেংডু ফিরতে হয়। ইউনান-এর মধ্যে দিয়ে হংকং যাওয়ার চেষ্টা করা ঝুঁকি হয়ে যাবে। শু ঠিক করে, এই অবস্থায় বর্মা সীমান্তের দিকে যাওয়া ছাড়া গতি নেই।
বর্মা রোড ধরে অতএব প্রথমে শিয়াগুয়ান পৌঁছনো গেল। শু-র ধারণা ছিল, সেখানে থেকে উত্তর-পশ্চিমে এগোলে সীমান্তে পা দেওয়া যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, ওই রকম কোনও রাস্তা নেই। শু অতএব আবার ফিরে এসে সোজা পশ্চিমে কালো ড্রাগন পাহাড়কে সামনে
রেখে এগোতে থাকল। পকেটে টাকাপয়সা খুবই কমে এসেছে। মানচিত্র দেখে দেখে হাঁটাই একমাত্র উপায়। টানা চার দিন হেঁটে শু চলে এল লুশুই-এ। বর্মা (মায়ানমার) সীমান্ত থেকে খুব দূরে নয়, তবে মানচিত্র বলছে জায়গাটা নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে। নিশ্চিন্ত মনে একটা ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়া সেরে শু একটা সেলুনে ঢুকল চুল কাটতে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে বেশ কিছু লোক তাকে ঘিরে ধরল। পুরনো মানচিত্র ঠিক তথ্য দেয়নি। লুশুই নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেই পড়ে। বিশেষ পারমিট ছাড়াই সেখানে এসেছ, অতএব ঢোকো গারদে!
আবার তীরে এসে তরী ডুবল! শু মরিয়া হয়ে যায়। প্রশাসন যদি সাংহাই মেডিক্যাল কলেজে খোঁজ করে, তা হলেই আরও সব বেড়াল বেরিয়ে পড়বে। তার আগেই পালাতে হবে। লুশুই জেলে সেলের দেওয়ালটা পুরু মাটির। পাছে কেউ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার চেষ্টা করে, তাই দেওয়াল বেড় দিয়ে বড় বড় খুঁটি পোঁতা। কিন্তু দ্বিতীয় আর তৃতীয় খুঁটির মাঝে যা ফাঁক, তাই দিয়ে গলে যাওয়া যাবে। অন্তত শু এমনটাই ভাবে। একটা স্টিলের চামচ দিয়ে নাগাড়ে দেওয়াল খোঁড়া শুরু করে। চার দিনের দিন সকালে দেওয়াল ভেদ করা গেল। কিন্তু অতি উত্তেজনায় গর্তটা একটু বেশিই বড় করে ফেলেছিল শু। পালানোর চেষ্টা করার আগেই ধরা পড়ে গেল সব। সেই যে ধরা পড়ল, পরের তেরো বছরে আর পালানোর সুযোগ মিলল না।
কেন?
নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢোকার অপরাধে শু-র প্রথমে ছ’বছরের জেল হয়েছিল। তার আসল পরিচয়ও প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল। দ্রুত উন্নয়নের মস্ত লাফ দিতে গিয়ে চিন তখন নারকীয় দুর্ভিক্ষের কবলে। জেলে থেকে শু-কে ডাক্তারি করতে হল বেশ কিছু দিন। মেয়াদ শেষ হলে ওকে ‘মুক্তিপ্রাপ্ত ডিটেনি’ হিসেবে ধরে রাখা হল। বন্দিদশাই। তবে খাওয়াদাওয়া, বিছানা-বালিশের ব্যবস্থা তুলনায় পদের, এই যা। বইপত্র চাইলে মাও বাদে শুধু মার্ক্স-এঙ্গেলস পড়ার অনুমতি ছিল। যদিও সেগুলো পড়ে শু আরওই নিশ্চিত হল, মার্ক্স-এঙ্গেলস যা বলেছেন আর মাও যা করছেন, তার কোনও মিল নেই। এ বাদে শু নিজের উৎসাহে খানিক ইংরেজি পড়ছিল। সেটা যদিও ভাল চোখে দেখা হয়নি।
১৯৬৬ সালে মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিলেন। সেই সুবাদে প্রতিবিপ্লবী খুঁজে বের করার হিড়িক আবার বিকট রকম বেড়ে গেল। শু-কেও নতুন করে কাঠগড়ায় তোলা হল। বলা হল, এ ছেলের ভাবগতিক বরাবরই বুর্জোয়া ইন্টেলেকচুয়াল মার্কা। বারবার জেল পালানোর চেষ্টা করেছে। মাওয়ের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। বন্দি অবস্থাতেও আচার-আচরণ সব সময়েই সন্দেহজনক। একে আবার কুড়ি বছরের জন্য জেলে পোরা হোক। শু লিখেছে, মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলেও সে এতটা ভেঙে পড়ত না। কারণ তাতে একটা বুলেট সহ্য করতে হত। কিন্তু কুড়ি বছর ধরে দগ্ধে মরবে কী করে?
ডিটেনি অবস্থায় শু প্রায়ই মানচিত্র দেখত খুঁটিয়ে। নকল কাগজপত্র তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছিল। একটা ছোট্ট পেনসিল কাটা ছুরি দিয়ে কাঠের টুকরো কুঁদে কুঁদে ব্লক বানিয়ে রাখছিল, যাতে নামধাম-গন্তব্য-যাত্রাপথ লিখে নকল সিলমোহর বসানো যায়। ভেবে রেখেছিল, মঙ্গোলিয়া যাবে। কিন্তু পালিয়ে ওঠার আগেই যে নতুন কারাদণ্ড নেমে আসবে, সেটা জানা ছিল না!
লিজিয়াং-এর যে জেলে এখন তাকে রাখা হল, সেখান থেকে কেউ কোনও দিন পালাতে পারেনি। দশ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর তিরিশ ইঞ্চি করে বিদ্যুতের তার বসানো। আর কয়েদিদের ওয়ার্ডের গায়ে তিরিশ ফুট উঁচু থামে জোরালো আলো লাগানো আছে। সেটা দিন-রাতের তফাত ঘুচিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে জনা পঞ্চাশ রক্ষী সর্বক্ষণ কুকুর নিয়ে টহল দিচ্ছে। কিন্তু ১৯৭২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এই জেল থেকেই শেষ অবধি পালায় শু।
সেদিন সকাল দশটা থেকে কারেন্ট নেই। জানা গেল, পরদিন ভোরের আগে আসবেও না। শু নানা মাপের দড়ি, বাঁশ, চেলাকাঠ জড়ো করে একটা জঞ্জালের গাদায় রেখে দিল। রাত ন’টার সময় রোল কল। শু সেল থেকে বেরনোর আগে কিছু জামাকাপড় কম্বলে ঢাকা দিয়ে বাঙ্কে রাখল, মশারিও ফেলে দিল। ঠিক যেন একটা লোক শুয়ে আছে। যেন কিছু আনতে যাচ্ছে, এমনই ভাব দেখিয়ে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল সে। পিছনে ডালিয়া গাছের ঝোপের মধ্যে বসে রইল লুকিয়ে। চার দিক
শান্ত হলে জঞ্জালের গাদায় গিয়ে চটপট বানিয়ে ফেলল একটা মই। মই বেয়ে প্রথমে ডিটেনিদের ওয়ার্ড। সেখান থেকে আরও খানকতক দেয়াল টপকে তবে মূল পাঁচিল। শু যখন শেষ পর্যন্ত তার চেনা উইলো গাছটা আঁকড়ে জেলের বাইরে লাফিয়ে নামছে, তখন রাত সাড়ে এগারোটা। নামতেই একেবারে টহলদার ভ্যানের ফ্ল্যাশলাইটের মুখোমুখি। ভাগ্য ভাল, শু তার কয়েদির পোশাক বদলে নিয়েছিল আগেই। একটুও বিচলিত ভাব না দেখিয়ে সে গ্যারেজের দিকে হাঁটতে লাগল। ভ্যান ভেবে নিল, জেলেরই কোনও কর্মী হবে!
ভ্যান সরে যেতেই গতি বাড়াল শু। গ্রামের মধ্যে একটা বাড়ি থেকে সিনেমার সংলাপ ভেসে আসছিল। সেই অবস্থাতেও কান খাড়া করে শু চিনতে পারল, কোরীয় ছবি ‘আ টাইম টু পিক অ্যাপলস’! শু-কে নিশ্চয়ই তখনও কেউ বলেনি, তার নিজের জীবনের কাছে কোথায় লাগে সিনেমা, কোথায় লাগে উপন্যাস!
শু-এর ইতিহাসখ্যাত এই জেল-পালানোর শিহরন-জাগানো ঘটনা তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন। উপন্যাসকে হার মানানো সে বইয়ের নাম ‘নো ওয়াল টু হাই’।
এ বার কোনও ভুল নয়। সটান মঙ্গোলিয়াতেই গিয়েছিল শু। লুশুই-এর মতো কাণ্ড আর যাতে না হয়, তাই সীমান্ত স্টেশন এরেনহর্ট অবধি না গিয়ে আগের স্টেশনে নেমেছিল। তার পর গোবি মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ৭৫ মাইল হেঁটে সীমান্ত পেরিয়েছিল। বেআইনি অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে অবশ্য মঙ্গোলিয়াতেও দু’বছর জেল খাটতে হয়। কিন্তু কুড়ি বছরের তুলনায় সে আর কী? সব মিলিয়ে মোট ষোলো বছর পরেতার (১৯৫৮-১৯৭৪) মুক্তি হল। মঙ্গোলিয়াতেই সংসার পাতল শু।
আর কী আশ্চর্য! আশির দশকের শুরুতেই চিন বেমালুম স্বীকার করে নিল— শু হংচাইয়ের সব শাস্তি মকুব! সে নাকি মোটেই দক্ষিণপন্থী ছিলই না! প্রতিবিপ্লবীও নয়! মিসটেক, মিসটেক!