মিনার বিজলী ছবিঘর

১৯৭৫। উজ্জ্বলা সিনেমা হল-এ প্রিমিয়ার শো। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। এমন সময় ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে উপস্থিত হলেন স্বয়ং মহানায়ক। ভিড় কি আর বাঁধ মানে? হামলে পড়ল সকলে। প্রত্যেকেই এক বারটি ছুঁয়ে দেখতে চায়। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামতে নামতে, গালে টোল-ফেলা সেই অসামান্য হাসিটি হাসলেন।

Advertisement

অময় দেব রায়

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

‘সিনেমাওয়ালা’ ছবির দৃশ্য। আগেকার দিনের সিনেমাহলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়েই এই ফিল্ম।

১৯৭৫। উজ্জ্বলা সিনেমা হল-এ প্রিমিয়ার শো। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। এমন সময় ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে উপস্থিত হলেন স্বয়ং মহানায়ক। ভিড় কি আর বাঁধ মানে? হামলে পড়ল সকলে। প্রত্যেকেই এক বারটি ছুঁয়ে দেখতে চায়। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামতে নামতে, গালে টোল-ফেলা সেই অসামান্য হাসিটি হাসলেন। তার পর রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটা লাগালেন হলের দিকে। ছবির নাম ‘সন্ন্যাসী রাজা’। তখন প্রিমিয়ারে হামেশাই এমনটা হয়ে থাকত।

Advertisement

বলছিলেন মিনার হলের ম্যানেজার স্বপন কর্মকার। ছোটবেলা থেকে সিনেমা-পাগল। ‘গুরু’র ছবি রিলিজ করলেই হল। কলেজের বন্ধুরা মিলে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে ছুটতেন। কী সব দিনকাল ছিল! পকেটে দু’টাকা থাকলেই উঠতি যুবকেরা নিজেদের রাজা মনে করত। ৭০ পয়সায় ব্যালকনিতে বসে সিনেমা দেখা, তার পর হইহই করতে করতে ‘মিত্র কাফে’-র ৪০ পয়সার হাফ ডিমের ডেভিল— এই ছিল স্বপনবাবুদের বাঁধা রুটিন।

ছুটির দিনেও হাতিবাগান চত্বর গমগম করত। মিনার, মিত্রা, দর্পণা— একটু এগিয়ে পূর্ণ, বীণা, খান্না, সঙ্গে স্টার, রূপবাণী, রংমহলের মতো একাধিক থিয়েটার হল। অল্প জায়গার মধ্যে সিনেমা-থিয়েটারের হাজারও আসর, তবু সব ক’টা হল হাউসফুল। সন্ধের সময় এক-একটা শো যখন ভাঙত, হাতিবাগানে তিলধারণের জায়গা নেই। কেউ সিনেমা দেখে সোজা কাপড়ের দোকানে ঢুকেছে, কেউ ছুটেছে ফ্রেন্ডস কেবিন। ভিড়ের মাঝে একটু আড়াল খুঁজে খুনসুটি সেরে নিত বিয়ের পর প্রথম সিনেমা দেখতে আসা নবদম্পতি। স্বপনবাবু বললেন, ‘গাড়ির একটা চাকা ঘুরলে যেমন সবগুলো ঘুরতে শুরু করে, হাতিবাগান চত্বরটা ছিল ঠিক সেই রকম। লোকে সিনেমা দেখতে আসা মানে শুধু হল-মালিকের ব্যবসা নয়। জামাকাপড় কেনা, খাওয়াদাওয়া, কত কী!’

Advertisement

এখন হাতিবাগানের সবই আছে, শুধু একে একে মুছে গেছে সিনেমা হলের অস্তিত্ব। যে দু-একটা এখনও টিকে আছে, সেখানেও চূড়ান্ত অবহেলা। তেমনই একটি হল এই মিনার। লম্বা-লম্বা থাম, দেওয়ালে চৌকো কাচ বসানো পুরনো ডিজাইন। বাবার তৈরি করা সাধের মিনার-কে যতটা সম্ভব অক্ষত রেখেছেন সোমনাথ পাল। অতীত তাঁকে বড্ড নাড়া দেয়। ফাঁক পেলেই কর্মচারীদের সঙ্গে গল্প করতে বসে যান। তাঁর মনে পড়ে যায় ১৯৪৭-এর ২৩ জানুয়ারি। তখন সোমনাথবাবু খুব ছোট। দিনটা ছিল নেতাজির জন্মদিবস। সমর ঘোষের ‘দেশের দাবি’ ছবির বিশেষ প্রদর্শনী হল মিনারে। কে আসেননি সে দিন— শরৎবাবু, হবিবুর রহমান, কালিকা মুখোপাধ্যায়, এমন হাজারও নেতাজি অনুগামী। বিশেষ প্রদর্শনী হলে কী হবে, আটকে রাখা গেল না সাধারণ মানুষকে। গেট ভেঙে স্রোতের মতো লোক ঢুকতে শুরু করল। মুহূর্তে কানায়-কানায় ভরে উঠল হল।

আসলে প্রতিষ্ঠাতা হরিপ্রিয় পালের কাছে সিনেমা মানে শুধুই বিনোদন নয়, সিনেমা ছিল তাঁর প্যাশন। দেশপ্রেম, প্রতিবাদ, ভালবাসা— সবটাই সিনেমাকে ঘিরে। সাদা ধুতি আর ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে বিধান সরণি ধরে হাঁটতে শুরু করলে লোক জমে যেত। তখন সিনেমাওয়ালাদের কদরই ছিল আলাদা। আর কদর হবে না-ই বা কেন? কত লোকের যে কাজ জুগিয়েছেন হরিপ্রিয়! তাদের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ ঈশ্বর।

বলতে বলতে ঝাপসা হয়ে ওঠে স্বপনবাবুর চোখ। তখন এক-একটা ছবি হেসেখেলে বহু সপ্তাহ পাড়ি দিত। হাউসফুল বোর্ড, ব্ল্যাকারদের দৌরাত্ম্য, টিকিটের হাহাকার। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘একান্ত আপন’, ‘বৌমা’— রিলিজ করা মাত্র অভূতপূর্ব সাড়া। লোকের ঢল নামত। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক এসেছিল। এক চান্সে অনেকেই টিকিট পায়নি। কিন্তু কেউই ফিরে যেতে রাজি নয়। অগত্যা হলের পিছনে এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় তাঁবু ফেলা হল। কেউ এক রাত, কেউ বা দু’রাত কাটিয়ে সিনেমা দেখে তবে বাড়ি ফিরল!

নব্বইয়ের দশক থেকে ঘরে ঘরে টিভি ঢুকতে শুরু করল। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে উঠল ফ্ল্যাট কালচারে। ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে লাগল শপিং মল। চপ-মুড়ির স্বাদ ভুলে, স্যান্ডউইচ আর পপকর্নপিয়াসী হল বাঙালি। এখন বাঙালির বিনোদন মানে দু’দিনের আউটিং-এ চাঁদিপুর কিংবা ফাইভ স্টার হোটেলে পুলপার্টি।

বলতে বলতে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন স্বপনবাবু— এই তো কিছু দিন আগে ‘পূরবী’ বন্ধ হয়ে গেল! কর্মীদের প্ল্যাকার্ড-পোস্টার কোনও কিছুতেই রোখা গেল না। কে-ই বা রুখবে! দশ জন দর্শক নিয়ে কি আর হল চলে? মিনার-ই বা আর কদ্দিন! নিজেই দেখালেন, নোটিস ঝুলছে— ‘রিনোভেশনের জন্য হল বন্ধ থাকবে’। বললাম, এ তো সাময়িক। শুনে মুচকি হাসলেন। সাময়িকটাই চিরস্থায়ী হয়ে যাবে না তো? বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে মিনার।

সন্ধের বাহারি আলোয় ফ্যাকাশে হয়ে আসে মুখ। বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম আর যা-ই করুক, যেন সিনেমার ব্যবসায় না আসে। কত দিন আর মৃতদেহ আগলে থাকা যায়! সময় থাকতে আমাদেরও মায়া কাটিয়ে ফেলাই ভাল।’

৪ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড। বাসস্টপের নাম পূর্ণ। পান-বিড়ির দোকানের নাম ‘পূর্ণ ভাণ্ডার’। কিন্তু সেই পূর্ণ সিনেমা হলটাই বন্ধ। কোলাপসিব্‌ল গেটে ঝুলছে অনেকগুলো মোটাসোটা তালা। দারোয়ানকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে ভেতরে ঢোকা গেল। পুরনো গন্ধ, রংচটা দেয়াল, চারিদিকে নোংরা। উলটেপালটে পড়ে আছে সিনেমা হলের চেয়ার। দেয়ালে ‘চল পাল্টাই’-এর একখানি ছেঁড়া পোস্টার। দারোয়ান জানালেন কিছু দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে। পূর্ণ ভেঙে গড়ে উঠবে ঝাঁ-চকচকে শপিং মল। নতুন মালিক ও-সব সিনেমা-টিনেমা পছন্দ করেন না!

শুরুতে পূর্ণ ছিল থিয়েটার হল। নাম তখন রমা থিয়েটার। ছবি বিশ্বাসের রোজ যাতায়াত। শুধু কি নাটক? মন ভাল নেই, প্রাণখুলে খোশগল্প করার লোক চাই ছবি বিশ্বাসের। ছুটলেন পূর্ণ-তে। দু’-চার ঘণ্টা কাটিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরলেন। পূর্ণ-র মালিক তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায় আর ছবি বিশ্বাসের হৃদ্যতা ছিল ঈর্ষা করার মতো।

বলছিলেন, এন. কে. ব্যানার্জি বুকশপের ধূর্জটিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। পূর্ণ হলের কাছেই তাঁদের বহু পুরনো দোকান। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে হলের সঙ্গে। ১৯৭০-এ পূর্ণতে রিলিজ করে ‘অভিশপ্ত চম্বল’। ‘এ’ মার্কা ছবি। ধূর্জটিবাবু তখন সবে স্কুলপড়ুয়া। দ্বিগুণ উৎসাহে হাজির হন সিনেমা হলে। পূর্ণ-র ম্যানেজার ছিলেন শিশির বটব্যাল, তখনকার দিনে সিনেমা-থিয়েটারের পরিচিত মুখ। ধূর্জটিকে দেখেই পাকড়াও করলেন শিশিরবাবু, ‘তোমার এ ছবি দেখার বয়স হয়নি খোকা। চুপচাপ কেটে পড়ো।’ হতোদ্যম হয়ে বাড়ি ফিরতে হল ধূর্জটিবাবুকে।

পূর্ণ সিনেমার উলটো ফুটেই খবরের কাগজ নিয়ে বসেন হেমন্ত প্রধান। এক সময় পূর্ণতে ইন্টারভ্যাল টাইমে চিপ্‌স-পপকর্ন ফেরি করে বেড়াতেন। মাঝেমধ্যে টিকিট ব্ল্যাক করে কিছু উপরি কামাইও হয়ে যেত। কুড়ি বছর করেছেন এই কাজ। তুলসীবাবুর সঙ্গে ভালই যোগাযোগ ছিল। হলের সঙ্গে যুক্ত সবার খোঁজখবর রাখতেন উনি। তখন পূর্ণ মানেই রোজ বিরাট লাইন। দুজন পুলিশের পার্মানেন্ট পোস্টিং ছিল হলের সামনে। ‘শোলে’ রিলিজের দিন তো ধুন্ধুমার কাণ্ড। হাজারে হাজারে লোক ভিড় করতে শুরু করে হলের সামনে। হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দুজন পুলিশে সে দিন আর সামলানো যায়নি। এক্সট্রা ফোর্স আসে ভবানীপুর থানা থেকে। লাঠিচার্জ পর্যন্ত হয়েছিল। এক ঘা পড়ে হেমন্তবাবুর পিঠেও।

যত দিন তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন, পূর্ণর বাজার ছিল রমরমা। পরবর্তী প্রজন্ম সিনেমা হল নিয়ে আর তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তবু খানিকটা চেষ্টা করেছিলেন ছোট ছেলে সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে চেষ্টাই সার। শরিকি বিবাদে শেষমেশ হলটাই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন। এখন এই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বাসস্থান কেয়াতলা রোডে, লেক গার্লস স্কুলের গা-ঘেঁষা বাড়িতে। ওই পরিবারের এক জনের সঙ্গে একটু কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পূর্ণর কথা বলতেই তাঁর চোখে-মুখে সন্দেহ আর অস্বস্তি, ‘ওই হল তো আর আমাদের নয়। ও-সব নিয়ে কোনও প্রশ্ন করবেন না। সব ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গিয়েছে।’ দড়াম করে বন্ধ করলেন দরজা।

নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল শামশের মহাবীর রানা ছিলেন ‘হুমায়ুন প্রপার্টিজ লিমিটেড’-এর মালিক। কলকাতায় তাঁর প্রচুর জমি-জায়গা। হগ সাহেবের বাজার এলাকাতেও ছিল বেশ খানিকটা জমি। সেখানে একটা থিয়েটার হল গড়ার ইচ্ছে হয় শামশের রানার। ইউরোপ থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসেন সে সময়ের এক বিখ্যাত আর্কিটেক্ট-কে। ১৯২৭-এ গড়ে ওঠে নিউ এম্পায়ার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে তাঁরই নির্দেশনায় ‘নটীর পূজা’র অভিনয় হয় নিউ এম্পায়ারে। নাটক শেষে রবীন্দ্রনাথ নাকি জড়িয়ে ধরেছিলেন মহাবীর রানাকে। তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে এমন উন্নত পরিকাঠামোর হল মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। কিছু দিনের মধ্যেই উৎসাহিত হয়ে মহাবীর রানা খুলে বসেন আর একটি হল। নিউ এম্পায়ারের পাশের জমিতেই তৈরি হয় লাইটহাউস।

কথা হচ্ছিল নিউ এম্পায়ারের বর্তমান ম্যানেজার অমিত সেনগুপ্তের সঙ্গে। উনিই বললেন সব গল্প। পি সি সরকার (সিনিয়র) তখন ম্যাজিক দেখাবেন বলে হন্যে হয়ে হল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোথাও সুযোগ পাচ্ছেন না। তাঁকে ডেকে নিলেন নিউ এম্পায়ারের তখনকার ম্যানেজার বিনয় কুমার চৌধুরী। কোনও এক রবিবার সকালবেলা তাঁর জন্য ঘণ্টা দুয়েক সময় বের করা হল। লোক হল না তেমন একটা। তবে কী ভাবে যেন খবর ছড়িয়ে পড়ল চার দিকে। মানুষ ভ্যানিশের খেলা দেখানো হয় নিউ এম্পায়ারে। আর একটা সুযোগ দিলেন বি কে চৌধুরী। এ বার হামলে পড়ল দর্শক। ঠিক হল, এক দিন নয়, শো চলবে টানা সাত দিন। সে বার নিউ এম্পায়ারের চার ধারে তৃতীয় দিন থেকে মেলা বসে গিয়েছিল।

১৯৬৯ সালে নিউ এম্পায়ার আর লাইটহাউস লিজ নেয় ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’। তখন থেকে শুধুমাত্র ইংরেজি ছবিই দেখানো হত। ছবি দেখতে আসতেন আমেরিকান সৈন্যরা। তাদের জন্য মাঝেমধ্যে স্ট্রিপটিজ ডান্স-এর আসর বসত নিউ এম্পায়ারে। বম্বে থেকে উড়িয়ে আনা হত এক-এক জন ‘সেক্স বম্ব’ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডান্সারদের। স্ট্রিপটিজের স্বাদ নিতে মাঝেমধ্যে ফাঁক গলে ঢুকে পড়তেন বাঙালি বাবুরাও। এক বার অ্যালফ্রেড হিচকক এলেন কলকাতায়। আমেরিকায় বসে তিনি নাকি কলকাতার নিউ এম্পায়ার, লাইটহাউসের কথা অনেক শুনেছেন। নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। নিউ এম্পায়ারে বসে নিজের তৈরি ‘সাইকো’ দেখলেন হিচকক। হলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গেল তাঁর মুখে!

১৯৮৯-তে লিজ ছেড়ে দেয় ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’। ফের দায়িত্বে আসে ‘হুমায়ুন প্রপার্টিজ লিমিটেড’। তত দিনে অমিতবাবু হলের ম্যানেজার। মালিক ম্যান্টোস সাহেব। বহু দিন ইংরেজি ছবি চলেছে রমরমিয়ে। তবে নব্বইয়ের শেষের দিকে ক্রমশ বাজার ছেয়ে গেল ডিভিডি-তে। তখন হলে এসে ইংরেজি ছবি দেখা মানে সময় নষ্ট। বদলাতে হল স্ট্র্যাটেজি। শুরু হল নতুন হিন্দি ছবি দেখানো। লোক হল ঠিকই, কিন্তু আগের মতো নয়।

২০০০ সাল থেকেই সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। আগুন লাগে লাইটহাউসে, পুড়ে যায় অনেকটা অংশ। তবু সামলে নিয়েছিলেন ম্যান্টোস। ২০০২-এ আসে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা। লাইটহাউসের লাইসেন্স বাতিল করে দেয় কলকাতা পুলিশ। দীর্ঘ দিন চলে আইনি লড়াই। শেষমেশ ম্যান্টোসের হাতছাড়া হয় লাইটহাউস। ভেঙে পড়েছিলেন ম্যান্টোস। ভেবেছিলেন, সিনেমা হলের ব্যবসাটাই তুলে দেবেন! এখনও যে নিউ এম্পায়ার চলছে, সেটাই অনেক।

বদলে ফেলা হয়েছে অনেক কিছুই। নীচতলায় এখন কেএফসি, ডোমিনোজ, বারিস্তার ফাস্ট ফুডের স্টল। পাশের লাইটহাউস এখন সিটিমার্ট শপিং মল। নিউ এম্পায়ার-এ বসেছে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি। আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, প্রোজেক্টর। শুধু চেয়ারগুলো ফাঁকা! আগে হল-এ রোজই আসতেন ম্যান্টোস সাহেব। এখন আসেন খুব কম। প্রিয়জনকে এ অবস্থায় আর দেখতে পারেন না!

বসুশ্রীতে তখন একটা সাদামাটা ছবির হোর্ডিং লাগানো হচ্ছে। উলটো দিকে দাঁড়িয়ে লাজুক দৃষ্টিতে সেটাই দেখছিলেন লম্বা এক ভদ্রলোক। মন্টুবাবু দেখতেই ছুটে গেলেন ও-পারে— ‘আরে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে! ভেতরে আসুন।’ ‘না না, ঠিক আছি। আমার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না।’ হোর্ডিংটি ছিল ‘পথের পাঁচালী’র। লোকটির নাম সত্যজিৎ রায়। ‘পথের পাঁচালী’ রিলিজ করে বসুশ্রীতে। তার পর তো ইতিহাস।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বিধানচন্দ্র রায়। এসেছিলেন জওহরলাল নেহরুও। সে অনুষ্ঠান হয় বীণা সিনেমা হলে। বিদেশি ছবি দেখতে অভ্যস্ত নেহরু ‘পথের পাঁচালী’ দেখে চমকে গিয়েছিলেন। ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে এমন অসামান্য ছবি তৈরি হতে পারে তা ছিল নেহরুর ধারণার বাইরে, বলছিলেন বসুশ্রী ও বীণা-র কর্ণধার দেবজীবন বসু।

শুরু ১৯৪৭-এর ১৯ ডিসেম্বর। দেবজীবনবাবুর প্রিয় মেজদা, মন্টু বসুর হাত ধরে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মন্টু বসুর সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন বম্বেতে। মন্টু বসুকে ডেকে বললেন, ‘অনেক দিন দেশে যাওয়া হয়নি। একটা অনুষ্ঠান কর। চুটিয়ে গান গাওয়া যাবে। এক ফাঁকে বাবা-মা’কেও দেখে আসব।’ সেটা ১৯৫০-এর পয়লা বৈশাখ। ভারতবর্ষে প্রথম রাতভর জলসার আয়োজন করল বসুশ্রী। তার পর যত দিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেঁচে ছিলেন, প্রত্যেক বার নিয়ম করে পয়লা বৈশাখে জলসা বসেছে বসুশ্রীতে। শচীন দেববর্মন, মান্না দে, মুকেশ কিংবা বাপ্পি লাহিড়ী— কে আসেননি সেই জলসায়!

মন্টুবাবু নিজেও ছিলেন গানপাগল মানুষ। বৈশাখী জলসার পাশাপাশি পৌষ সংক্রান্তিতে আর একটি ক্লাসিকাল গানের আসর শুরু করলেন। ওস্তাদ আলি আকবর খান, রবিশংকর, বিলায়েত খানদের সুরে বিভোর হয়ে থাকত সে-সব শীতের রাত। অনুষ্ঠানের টিকিট পেতে মাস দুয়েক আগে থেকেই খোঁজখবর শুরু হয়ে যেত।

তখন সিনেমা রিলিজের ধরনটা ছিল অন্য রকম। এখন এক জন নায়কের একসঙ্গে খুব বেশি হলে দুটো ছবি রিলিজ করে। তখন পুজোতে অনেক সময় উত্তমকুমারের চার-পাঁচটা ছবিও রিলিজ করত। সদ্যযুবক দেবজীবন বসু আগে থেকেই ডায়েরিতে লিস্ট করে রাখতেন। সপ্তমীতে নতুন বান্ধবীর সঙ্গে ভারতী হলে ‘শঙ্খবেলা’। তার পর বাবা-মার সঙ্গে অষ্টমীতে উজ্জ্বলায় বসে ‘কখনও মেঘ’। আর নবমীতে অবশ্যই বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে বসুশ্রীতে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’। ঠাকুর দেখার চেয়ে হলে ঘুরে ঘুরে সিনেমা দেখাটাই ছিল পুজোর আনন্দ। শুধু দেবজীবনবাবু নয়, তখন অনেক বাঙালিই পুজোর ছুটি কাটাতেন বাংলা ‘বই’ দেখে।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ বিহ্বল হয়ে পড়লেন দেবজীবন বসু— ‘বড় আপশোস হয়, জানেন। দিনগুলো তো আর ফিরে আসবে না। পাবলিককে দোষ দিয়ে কী লাভ! একটা উত্তমকুমার বানিয়ে দেখান তো। লোক হল-এ ফিরতে বাধ্য।’

মন্টু বসু নেই। একা কাঁধে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন দেবজীবনবাবু। ডিস্ট্রিবিউটর, প্রোডিউসার সবার সঙ্গেই বন্ধুতার সম্পর্ক। এই বাজারেও মাঝেমধ্যে দু’-একটা শো হাউসফুল যায়। এক সময় মেট্রো, লাইটহাউস, এলিটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইংরেজি ছবির মর্নিং শো চলত। সে সব বন্ধ হয়েছে বহু কাল। তবে হাল ছাড়েননি।

সদ্য চুক্তি হয়েছে ফ্রান্সের এক ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে। পরীক্ষামূলক ভাবে প্রত্যেক রবিবার দেখানো হচ্ছে ফরাসি ছবি। আজও সিনেমা হল ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারে না বসু পরিবার।

amaydebroy@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement