Rabindranath Tagore

প্রিয় কবির কাছেই লঘুপাপে গুরুদণ্ড

দু’জন নিম্নশ্রেণির পুরুষ বা মেয়েমানুষ রাস্তায় ঝগড়া করছে দেখলে উনি দাঁড়িয়ে পড়ে যত ক্ষণ সম্ভব ওই ঝগড়া শুনতেন। এ ভাবেই জোগাড় হত তাঁর গল্প-উপন্যাসের রসদ।

Advertisement

শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২১ ০৭:৫৫
Share:

সমালোচক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ডান দিকে, কবির সমালোচিত ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাসের লেখক জগদীশচন্দ্র গুপ্ত

রবীন্দ্রনাথ তখন সত্তরের আশপাশে। শারীরিক ও মানসিক ভাবে পরিশ্রান্ত। চার দিকে নব্য রিয়ালিজ়মের ধুয়ো তুলে রবীন্দ্র-বিরোধিতার ঢেউ। সকলকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করতে তিনি সামনে রাখলেন জগদীশচন্দ্র গুপ্ত-র উপন্যাস। এ শাস্তি রবীন্দ্রভক্ত অন্তর্মুখী মানুষটির প্রাপ্য ছিল না।

Advertisement

মাঝখানে দু’-তিন কিলোমিটারের ব্যবধান। এক দিকে শান্তিনিকেতন আশ্রম, অন্য দিকে বোলপুর কোর্ট। এক দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অপর দিকে জগদীশচন্দ্র গুপ্ত। মানুষের লুকনো বাঘনখ আর প্রবৃত্তির রকমফেরই জগদীশের রচনার বিষয়। ১৮৮৬ সালে কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায় জন্মেছেন, আদি ভিটে ফরিদপুরের মেঘচুম্বী। গড়াই নদীতে সাঁতরে ছেলেবেলা কেটেছে। এর পর কলকাতায় পড়তে আসা। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলেজে পড়াশোনা, তার পর স্টেনোগ্রাফি ও টাইপিং, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সিউড়ি, সম্বলপুর, কটক, পটনা ঘুরে বোলপুর চৌকি আদালতে জব টাইপিস্ট হয়ে আসেন ১৯২৭ সালে। সতেরো বছর ধরে একটানা বোলপুরেই থাকা।

Advertisement

১৯২৭ সালেই ‘কালিকলম’ আর ‘কল্লোল’-এ তেরোটি গল্প বেরল। বোলপুরের বন্ধু কানুবাবু বা ব্রজজনবল্লভ বসুর আগ্রহেই ‘বিনোদিনী’ নামে প্রথম ছোটগল্পের সঙ্কলনও এই বছরেই প্রকাশিত। তখনকার যৌনতানির্ভর ‘বস্তি সাহিত্যের বাড়াবাড়ি’-র সময়েও নিজের অননুকরণীয় স্টাইলে মানুষের মনের অন্দরমহলের আলোআঁধারি নিয়ে লেখা জগদীশের ‘বিনোদিনী’র গল্পগুলি পাঠকের শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রম আদায় করে নিল।

ঘরকুনো জগদীশ বোলপুর ছেড়ে পারতপক্ষে কোথাও বেরোতেন না। আদালতে সারা দিন পরিশ্রমের পর বোলপুরের হরিসভায় বেহালা বা এস্রাজে রবিঠাকুরের গানের রেওয়াজ করে অথবা বাঁশিতে সুর তুলে বা কখনও হারমোনিয়ামে সঙ্গত করে রাত করে বাসায় ফিরতেন। নেশা বলতে ছিল ঘন ঘন চা আর তামাক। আর গল্প লেখার নেশা।

বোলপুরের গায়েই শান্তিনিকেতন। সারা পৃথিবী পরিক্রমা করে রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতন আশ্রমের ভরকেন্দ্রে, কীর্তিভারে, বর্ণচ্ছটায় বিশ্বকবি হিসেবে মহিমান্বিত। রবীন্দ্রভক্ত জগদীশচন্দ্রের তবু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে ছিল মহা সঙ্কোচ। দু’পা হেঁটে শান্তিনিকেতনে যেতে সরে না তাঁর মন। অবশ্য সব দ্বিধা কাটিয়ে নিজে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে এক দিন দিয়ে এলেন তাঁর প্রথম লগ্নের বইটি। ‘বিনোদিনী’ পড়ে কবিও চিঠিতে তাঁকে লেখেন, ‘ছোটগল্পের বিশেষ রূপ ও রস তোমার লেখায় পরিস্ফুট দেখিয়া সুখী হইলাম।’

কালিকলম-এর সম্পাদক মুরলীধর বসু শান্তিনিকেতনে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে এলে কখনও সেখানে আড্ডা দিতে যেতেন জগদীশ। মুরলীধরের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথকে এক দিন ‘লঘু-গুরু’ বইটি পাঠিয়ে দিলেন কুণ্ঠিত জগদীশ।

১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাসের নায়ক বিশ্বম্ভর এক ব্যভিচারী মানুষ। সে তার স্ত্রীকে অত্যাচার করে মেরে ফেলে। তার পর নৌকোয় হঠাৎ দেখা হওয়া এক বারবধূ উত্তমকে স্ত্রীর পরিচয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। উত্তম নিজের পুরনো পরিচয় ভুলে প্রগাঢ় মাতৃস্নেহে বিশ্বম্ভরের শিশুকন্যা টুকিকে বড় করে তোলে। কিন্তু পাষণ্ড বাবা বিশ্বম্ভর টাকার লোভে টুকিকে এক দিন বৃদ্ধ পরিতোষের সঙ্গে বিয়ে দেয়। বৃদ্ধের রক্ষিতা সুন্দরী যথাসময়ে টুকিকে বেশ্যাবৃত্তিতে নামানোর উপক্রম করে। টুকি বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় নিরাপদ সংসার থেকে অন্ধকার রাস্তায়। এই ছিল উপন্যাসের কাঠামো।

রবীন্দ্রনাথ পড়লেন এই উপন্যাস। তাঁর মতামতও জানালেন। ‘পরিচয়’ (কার্তিক, ১৩৩৮) পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন তাঁর জীবনের দীর্ঘতম সমালোচনাটি। লিখলেন, ‘এই উপন্যাসে যে লোকযাত্রার বর্ণনা আছে আমি একেবারেই তার কিছু জানিনে। সেটা যদি আমারই ত্রুটি হয় তবু আমি নাচার।... দূর থেকেও আমার চোখে পড়ে না। লেখক নিজেও হয়তো বা অনতিপরিচিতের সন্ধানে রাস্তা ছেড়ে কাঁটাবন পেরিয়ে ও জায়গায় উঁকি মেরে এসেচেন।’

‘উত্তম’ চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি, ‘...বেশ্যাবৃত্তিতে যে মেয়ে অভ্যস্ত সেও একদা যে কোনো ঘরে ঢুকেই সদ্গৃহিনীর জায়গা নিতে পারে এই কথাটাকে স্বীকার করিয়ে নেবার ভার লেখক নিয়েচেন।... কারণ আধুনিক রিয়ালিজমের সেন্টিমেন্টালিটিতে এই কথাটির বাজার দাম বাঁধা হয়ে গেছে।’ রিয়ালিজ়ম নিয়ে তিনি আরও বললেন, ‘...পতিতা নারীর মধ্যেও সতীত্বের উপাদান অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে এই তত্ত্বটাকে একটা চমক লাগানো অলঙ্কারের মতোই ব্যবহার করা হয়েচে। সাধুতাকে ভাবরসের বর্ণবাহুল্যে অতিমাত্র রাঙিয়ে তোলায় যত বড়ো অবাস্তবতা, লোকে যেটাকে অসাধু বলে তাকে সেন্টিমেন্টের রসপ্রলেপে অত্যন্ত নিষ্কলঙ্ক উজ্জ্বল করে তুললে অবাস্তবতা তার চেয়ে বেশি বই কম হয় না। অথচ শেষোক্তটাকে রিয়ালিজম নাম দিয়ে একালের সৌখীন আধুনিকতাকে খুসি করা অত্যন্ত সহজ। যেটা সহজ সেই তো আর্টের বিপদ ঘটায়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যজীবনে কোনও একটি গ্রন্থ সম্পর্কে এত দীর্ঘ সমালোচনা আর কোথাও লেখেননি। যা পছন্দ হত না তাকে তিনি বরাবর এড়িয়ে যেতেই চাইতেন। এ লেখা যেন তার ব্যতিক্রম। সমালোচক রবীন্দ্রনাথকে এখানে বেশ অচেনা লাগে। রবীন্দ্রনাথ তখন মানসিক ও শারীরিক ভাবে পরিশ্রান্ত। শেষ কয়েক বছর এ দেশে খুবই কম থাকতে পেরেছেন তিনি, সত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথের মাথায় তখন সৃজনের নানা মানচিত্র। সময় কমে আসছে। এ দিকে এক দল নব্য লেখক রবীন্দ্র-বিরোধিতার নাম করে রিয়ালিজ়মের ধুয়ো তুলে নানা ভাবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন তাঁর চিন্তাভাবনার। কল্লোল গোষ্ঠীর অনেকেই তাঁদের মধ্যে পড়েন। একবাক্যে সবাইকে ভাল শংসাপত্র লিখে দিতে যিনি অভ্যস্ত, সেই রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ বদলে ফেললেন চরিত্র। আঘাত করে বসলেন এমন এক জনকে যিনি নিজেকে কখনও কোনও গোষ্ঠীর লেখক বলে মনে করেননি। ‘কল্লোল’ বা ‘কালিকলম’-এর অফিসে পর্যন্ত যাননি কোনও দিন। যাঁর হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ সদা বিরাজমান। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে যিনি ১৯৩১ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় নিজের কবিতায় জানিয়েছেন ‘গুরুপ্রণাম’, পরের বছর ‘দীপিকা’য় লিখেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ’।

সে যুগের ‘সৌখিন আধুনিকতা’র বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের সত্য আর সাধারণ সত্য নিয়ে তাঁর নির্দিষ্ট ধারণা ছিল এই যে, সাধারণ সত্যে বাছবিচার নেই, কিন্তু সাহিত্যের সত্যকে হতে হবে বাছাই করা। ‘পরিচয়’-এর মতো সম্ভ্রান্ত পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত জগদীশচন্দ্রকে উপলক্ষ করে লিখে সমসাময়িক সব লেখকদের উদ্দেশেই নিজের বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে এই চিঠিতেই বলতে শুনি, ‘...রিয়ালিজম নিয়ে যে কথাটা উঠে পড়ল তার সমস্তটা লঘু-গুরু বইটি সম্বন্ধে খাটে না। এই উপাখ্যানের বিষয়টি সামাজিক কলুষঘটিত বটে তবুও কলুষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার উৎসাহ এর মধ্যে নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাই হোক একথা মানতে হবে রচনা-নৈপুণ্য লেখকের আছে।’ তাঁর সন্দেহ, যে লোকযাত্রার বিবরণ এই উপন্যাসে আছে তা অসত্য, অবিশ্বাস্য। তাই তিনি বলেন, ‘পূর্বেই বলেচি যে, গল্পের চেহারাটি নিঃসন্দিগ্ধ সত্যের মতো দেখাচ্চে না এইটেতেই, আমার আপত্তি।’

এই সমালোচনায় ব্যথিত হয়ে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ১৮ চৈত্র বোলপুর থেকে জগদীশচন্দ্র এক চিঠিতে লেখেন, “আমার লঘু-গুরু বইখান সম্বন্ধে ‘জজিয়তী’ করিতে বসিয়া জজগণ যে রায় দিয়েছেন তাহার মধ্যে ‘পরিচয়’-এ প্রকাশিত রায়টিই প্রধান, কারণ, তাহার ঘোষক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ; এবং এর দ্বিতীয় কারণ, বিচার্য্য বিষয় ছাড়িয়া তাহা বিপথগামী হইয়াছে, ... লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে এতকাল আমাকে কাটাইতে হইয়াছে সেখানে ‘স্বভাবসিদ্ধ ইতর’ এবং ‘কোমর বাঁধা শয়তান’ নিশ্চয়ই আছে, এবং বোলপুরের টাউন-প্ল্যানিং এর দোষে যাতায়াতের সময় উঁকি মারিতে হয় নাই, ‘ও জায়গা’ আপনি চোখে পড়িয়াছে। কিন্তু তথাপি আমার আপত্তি এই যে, পুস্তকের পরিচয় দিতে বসিয়া লেখকের জীবনকথা না তুললেই ভাল হইত, কারণ উহা সমালোচকের ‘অবশ্য দায়িত্বের বাইরে’ এবং তাহার ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ’ ছিল না।”

জগদীশ গুপ্তর স্ত্রী শ্রীমতী চারুবালা দেবী জানিয়েছিলেন, ‘আমার মনে হয় আদালতের নথিপত্র নিয়ে কাজ করার সময় তিনি এই সব লোকেদের খোঁজ পেয়ে থাকবেন।’ তিনি আরও জানান, তাঁর শ্বশুর বাড়ির কাছেই ছিল একটা পতিতাপল্লী, ... ‘খুব ছোট বয়সে, অন্তত ৩/৪ বৎসর বয়স পর্যন্ত এই পতিতাদের কেউ কেউ তাঁকে খুব আদর যত্ন করে সারাদিন কাছে রেখে দিত। এক বার ঐ ছোটবেলায় উনি ড্রেনের মধ্যে পড়ে যান। ওরাই ওঁকে ড্রেন থেকে তুলে বাঁচায়। ছোট বয়সের দেখা এই পতিতারা ওঁর শিশুমনে হয়তো
কোন ছাপ ফেলেছিল যা পরেও ওঁর সাহিত্যিক জীবনে কাজ করেছে।’ তাঁর কথাতেই জানতে পারি, দু’জন নিম্নশ্রেণির পুরুষ বা মেয়েমানুষ রাস্তায় ঝগড়া করছে দেখলে উনি দাঁড়িয়ে পড়ে যত ক্ষণ সম্ভব ওই ঝগড়া শুনতেন। এ ভাবেই জোগাড় হত তাঁর গল্প-উপন্যাসের রসদ। তাই তারা একেবারে অবিশ্বাস্য বা অসত্য এ কথা বলা যায় কি?

নিয়তিবাদী জগদীশের নিজের নিয়তি বোধ হয় খারাপই ছিল, তাই তাঁকে রবীন্দ্রনাথের এই দীর্ঘ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। নব্য-আধুনিকতার অন্তঃসারশূন্যতার সমালোচনা করতে গিয়ে, তথাকথিত নব্য লেখকদের সমালোচনায় ব্যতিব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ হয়তো একটু বেশিই কঠোর হয়েছিলেন অন্তর্মুখী লেখক জগদীশের প্রতি। তবে সে আঘাত বড় বেদনার মতো বেজেছিল স্বভাবলাজুক, রবীন্দ্রভক্ত, অন্তর্মুখী মানুষটির মনে। লঘু পাপে তাঁর গুরু দণ্ড হয়ে গেল। এমন ঘটনা সাহিত্যের ইতিহাসে বাঞ্ছিত ছিল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement