ভরসা: বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস
বিধানসভা নির্বাচনের উত্তাপে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। ফুটছে কলকাতা। দিন কয়েক আগেই পোস্তায় উড়ালপুল ভেঙে মৃত্যু মিছিল দেখেছে শহর। দেখেছে লাশের গায়ে জমাট বাঁধা রক্তে রাজনীতির রং লাগতে। তবু সে সব ভুলে গোটা শহর ভেঙে পড়েছে ইডেন গার্ডেনসে।
তারিখটা ৩ এপ্রিল ২০১৬। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে কলকাতায়। ভারত নেই। তবু দর্শকাসন কানায় কানায় ভরা। এক দিকে সেই বছরই অনূর্ধ্ব উনিশ এবং কিছু ক্ষণ আগে মহিলাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বসেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অন্য দিকে জেন্টল ম্যান স্পোর্টসের উদ্ভাবক এবং সে দিন পর্যন্ত এক বারও বিশ্বসেরা হওয়ার স্বাদ না পাওয়া ইংল্যান্ড।
মোটের উপর ব্যাটিং সহায়ক পিচে সে দিন প্রথম ব্যাট করে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ৯ উইকেটে ১৫৫। রান তাড়া করতে নেমে মার্লন স্যামুয়েলস একা কুম্ভ হয়ে ৮৫ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেললেও ইংল্যান্ডের আঁটোসাঁটো বোলিংয়ের বিরুদ্ধে বাকি ব্যাটাররা ছিল যথেষ্ট ফিকে। শেষ ওভারে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ছিল ১৯ রান। কিন্তু বিপক্ষ দলের ৫৫ নম্বর লাল জার্সির লোকটির প্রথম চারটি বলই বাউন্ডারির ও পারে ফেলে দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্লোস ব্র্যাথওয়েট। কৃত্রিম আলোয় মায়াবী ইডেনের ক্যারিবিয়ান ক্যালিপসোর আসরেও বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল মাঝ পিচে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদতে থাকা নিউজ়িল্যান্ডে জন্ম নেওয়া বছর ২৫-এর এক ইংরেজ অলরাউন্ডারের ছবি।
সে দিনের পর ক্রিকেটীয় এনসাইক্লোপিডিয়ায় ভিলেনের তকমা নিয়ে ইতিহাস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস নামেই ওই ক্রিকেট প্রতিভার। আর লয়েড, রিচার্ডসদের উত্তরসূরি হিসেবে ডানা মেলার কথা ছিল চার ছক্কার মালিক ব্র্যাথওয়েটের। কিন্তু ক্রিকেট-দেবতা বোধহয় গল্পটা অন্য ভাবেই লিখতে চেয়েছিলেন।
কালের নিয়মে এবং ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের চিরকালীন উচ্ছৃঙ্খলতার উত্তরাধিকার বহন করে এক সময় হারিয়ে গেলেন কার্লোস ব্র্যাথওয়েট। কিছু দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ ছাড়া দেশের জার্সিতে খুব একটা দেখা মেলে না তাঁর। কিন্তু উল্টো দিকের মানুষটা রইলেন। ভীষণ ভাবে রয়ে গেলেন ক্রিকেটের মূল স্রোতে।
সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়াল ১৪ জুলাই ২০১৯। লর্ডসের ময়দানে এ বার এক দিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল। এ বারও ফাইনালে ইংল্যান্ড। বিপক্ষে স্টোকসের জন্মভূমি। ইংরেজ মনসুনে বোলারদের স্বর্গরাজ্য লর্ডস। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া আর দু’প্রান্ত থেকে সুইং। সব মিলিয়ে নিউজ়িল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করে ২৪১ রানের বেশি তুলতে পারেনি। তুলনামূলক কম লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যাটিং করতে নেমেও সেমি ফাইনালে এই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই ম্যানচেস্টারে পরাজিত হতে হয়েছিল ভারতকে।
ফাইনালে ম্যাট হেনরি, জিমি নিশাম, লকি ফার্গুসনের দাপটে একই অবস্থা হতে চলেছিল ইংল্যান্ডের। কিন্তু বাটলারকে সঙ্গী করে একার কাঁধে ম্যাচটাকে শেষ বল পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন সেই ৫৫ নম্বর জার্সি। অপরাজিত ৮৪ রানের ইনিংস খেলে দলের রানকে বিপক্ষের সমান সমান করলেন। সুপার ওভারেও বজায় রাখলেন দাপট। শেষ পর্যন্ত নিয়মের গেরোয় জিতলেও ইংল্যান্ডকে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ যদি কেউ দিয়ে থাকেন, তাঁর নাম অবশ্যই বেন। এক ফাইনালের বিভীষিকা ভুলে অপর ফাইনালে দলকে শুধু জেতালেন না, হলেন ম্যাচের সেরা। ইংরেজ ক্রিকেট ভক্তদের প্রিয় স্টোকসি সে দিন থেকে হয়ে গেলেন বিগ বেন।
সেই বছরেরই ২৫ অগস্ট। ঐতিহ্যবাহী অ্যাশেজ় সিরিজ়ের গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় টেস্ট। ঘাসে ভরা পিচে জস হ্যাজ়লউডের দাপটে প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষ হয়েছিল মাত্র ৬৭ রানে। প্রথম ইনিংসের ১৭৯ ও দ্বিতীয় ইনিংসের ২৪৬ রানের সুবাদে অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডকে জয়ের জন্য ৩৫৯ রানের টার্গেট দিয়েছিল। ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের মতে, ইংল্যান্ডের পক্ষে সে ম্যাচ জেতা ছিল অসম্ভব। কার্যত সেই পূর্বাভাসকে সত্যি করেই ইংল্যান্ড একের পর এক উইকেট হারাচ্ছিল নিয়মিত ব্যবধানে। কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন ক্যাপ্টেন জো রুট। তবে কাজ হয়নি। ১৪১ রানে যখন ৩ উইকেট পড়ে গিয়েছে, ক্রিজে এলেন সেই বিগ বেন। উল্টো দিকে যখন নিয়মিত উইকেট পড়ছে তখন পাল্টা মারের ইশতেহার রচনা করলেন। স্টোকসের প্রতি আক্রমণের সামনে সেই প্রথম দিশেহারা দেখাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ার আগুনখোর বোলিং লাইনআপকে। কিন্তু একা আর কত ক্ষণ?
জেতার জন্য তখনও ৭৩ রান বাকি ইংল্যান্ডের। তখনই নবম উইকেটের পতন। ম্যাচ জেতার দুরাশা ছেড়ে যখন অন্তত ম্যাচ বাঁচানোর প্রার্থনায় বুঁদ গোটা ইংল্যান্ড, তখন বোধহয় মাথায় অন্য কিছু চলছিল বিগ বেনের। জ্যাক লিচের সঙ্গে শেষ উইকেটের জুটিতে তুললেন বাকি রানটুকু। যেখানে লিচের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ ১ রান। বাকিটুকু? শুধুই বিগ বেন। বল হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে অপরাজিত থাকলেন ১৩৫ রানে। অস্ট্রেলীয় দম্ভ গুঁড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন, একা কুম্ভই যথেষ্ট নকল বুঁদিগড় রক্ষায়। সাদা বলের নায়কের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল ইজ্জতের লাল বল ক্রিকেটে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আবারও এক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত ফয়সালার আসর। এ বার ফাইনালে ইংল্যান্ড। এক যুগ পর ফের এই ফরম্যাটে বিশ্বজয়ের হাতছানি। প্রতিপক্ষে পাকিস্তান। ১৯৯২-এর রূপকথাকে মিথে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর তারা। প্রতিযোগিতার শুরুতে খুব একটা গোছানো ক্রিকেট খেলেনি, তবু পাক-দলে বাবর আজ়ম, মহম্মদ রিজ়ওয়ানের মতো ব্যাটার। বোলিং বিভাগকে নেতৃত্ব দিতে তৈরি শাহিন শাহ আফ্রিদি। সঙ্গে নাসিম শাহ, হ্যারিস রউফ, শাদাব খানেরা। ইংল্যান্ড দলে গভীরতা থাকলেও লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠা চরিত্র কোথায়? পিটারসেন, কলিংউড, ফ্লিন্টফরা অবসরে। নিদেন পক্ষে একটা ইয়ন মর্গ্যানও নেই দলে। নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে পাকিস্তানকে ১৩৭ রানের মধ্যে আটকে না হয় রাখা গেল। এ বার? পাকিস্তানি বোলিংয়ের সামনে প্রথম ছ’ওভারেই তিন উইকেটের পতন এবং ক্রিজে আবারও সেই বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস।
দিনের শেষে যখন ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয় বার এই ফরম্যাটে বিশ্বজয়ের স্বাদ দিয়ে মাঠ ছাড়ছেন বিগ বেন তখন তাঁর সংগ্রহে ৫২ রান। বল খেলেছেন ৪৯টি, যা কখনওই টি টোয়েন্টি সুলভ নয়। কিন্তু মারকাটারি ক্রিকেটেও যে সাফল্য হাসিল করতে উইকেটে টিকে থাকতে হয়, বিগ বেন সে দিন তামাম বিশ্বকে সম্ভবত এই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন। বাটলারদের ধামাকা শুরুয়াত যখন একের পর এক শাহী বোলিংয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন ধৈর্য ধরে, উইকেটে পড়ে থেকে দলকে জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন। শান্ত মাথা, যথাসম্ভব ক্রিকেটীয় শট, তীব্র বোলিং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেনসিবল ক্রিকেট। অর্ধযুগের অভিশাপ মুক্তি। ইডেনের কান্না বদলে গেল মেলবোর্নের উচ্ছ্বাসে। খলনায়ক থেকে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন আগেই, ইংরেজ ক্রিকেটের অন্যতম প্রধান চরিত্র হয়ে যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন স্টোকস।
চারটে ভুল ডেলিভারি, সাফল্যের রাজপথ থেকে যতটা দূরে সরিয়ে দিয়েছিল স্টোকসকে, উইলো হাতে ঠিক ততটাই আলোয় ফিরলেন বিগ বেন। মাঝে মানসিক অবসাদের কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ক্লান্তির কারণে অবসর নিয়েছিলেন এক দিনের ক্রিকেট থেকে। বহু দিন ব্যাটে রান ছিল না, বলে ছিল না বৈচিত্র। তবু দেশ ভরসা করে তাঁকে লাল বলের ক্রিকেটে অধিনায়ক করেছে। বিশ্বকাপ দলে সুযোগ দিয়েছে।
আর ওস্তাদ? শেষ রাতের মারে প্রমাণ করলেন, ওই ক্লিশে প্রবাদ ‘...ক্লাস ইজ় পার্মানেন্ট’। জন্ম দিলেন নতুন থিয়োরির, ফরম্যাট যা-ই হোক না কেন, দেশ বিপদে মানেই আরও বিগ, বেনের ব্যাট।