শিক্ষাগুরু: ব্রহ্মচর্যাশ্রমে পাঠদান করছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাসই ছিল বিশ্বভারতীর প্রথম সোপান
জীবদ্দশায় আশঙ্কা জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং। শান্তিনিকেতন ছিল খোলা আকাশের নীচে, প্রকৃতির কোলে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি। কিন্তু বিশ্বভারতীর উদ্দেশ্য আরও বড়। জাতি, ধর্মের বিভেদ ভুলে বিশ্বজনীন জ্ঞানচর্চা। চেয়েছিলেন, ভবিষ্যতে প্রাক্তনীরাও যেন সেই আদর্শে নিষ্ঠা রেখে চলেন। রবীন্দ্রনাথের সেই স্বপ্নসাধনা এ বার শতবর্ষে।
শান্তিনিকেতন আম্রকুঞ্জে ৮ পৌষ ১৩২৮ (২৩ ডিসেম্বর ১৯২১) বিশ্বভারতী-পরিষদের উদ্বোধন সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন : “এই বিশ্বভারতী ভারতবর্ষের জিনিস হলেও একে সমস্ত মানবের তপস্যার ক্ষেত্র করতে হবে।” বিশ্বভারতীর সমস্ত সদস্য ও হিতৈষী বন্ধুদের হাতে বিশ্বভারতীকে তুলে দেবার ইচ্ছা জানালেন কবি : “বিশ্বভারতীর যাঁরা হিতৈষীবৃন্দ ভারতের সর্বত্র ও ভারতের বাইরে আছেন, এর ভাবের সঙ্গে যাঁদের মনের মিল আছে, যাঁরা একে গ্রহণ করতে দ্বিধা করবেন না, তাঁদের হাতে আজ একে সমর্পণ করে দেব।” গঠিত হল বিশ্বভারতী পরিষদ ও বিশ্বভারতী পরিচালনার কার্যকরী সমিতি বা ‘সংসদ’; গৃহীত হল বিশ্বভারতীর সংবিধান বা কনস্টিট্যুশন। সভাপতির ভাষণে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ‘বিশ্বভারতী’ নামের তাৎপর্য
ব্যাখ্যা করলেন :
“আজ এখানে বিশ্বভারতীর অভ্যুদয়ের দিন। বিশ্বভারতীর কোষানুযায়িক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝি যে, যে ‘ভারতী’ এতদিন অলক্ষিত হয়ে কাজ করছিলেন, আজ তিনি প্রকট হলেন। কিন্তু এর মধ্যে আর-একটি ধ্বনিগত অর্থও আছে— বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌঁছবে, সেই বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে, ভারতের মহাপ্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থিত করব। সেই ভাবেই বিশ্বভারতী নামের সার্থকতা আছে।”
আনুষ্ঠানিক ভাবে এই দিনটিই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাদিবসরূপে স্বীকৃত। (১৬ মে ১৯২২ রেজিস্টার্ড সংবিধানে অবশ্য এই তারিখটি ঘোষিত হয়েছে ৭ পৌষ ১৩২৮।) কিন্তু কবির মনে বহু দিন ধরে বিশ্বভারতীর কল্পনা একটু একটু করে অঙ্কুরিত হয়ে উঠছিল, জানিয়েছেন তিনি: “বিশ্বভারতী সম্বন্ধে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, আমার মনে এর ভাবটি সংকল্পটি কোনো একটি বিশেষ সময়ে যে ভেবেচিন্তে উদিত হয়েছে এমন নয়। এই সংকল্পের বীজ আমার মগ্ন চৈতন্যের মধ্যে নিহিত ছিল, তা ক্রমে অগোচরে অঙ্কুরিত হয়ে জেগে উঠেছে।... বাল্যকাল থেকে আমি যে জীবন অতিবাহিত করে এসেছি তার ভিতর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের আদর্শটি জাগ্রত হয়ে উঠেছে।”
১১ অক্টোবর ১৯১৬ লস এঞ্জেলেস থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে, ওইখানে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। স্বাজাতিক সঙ্কীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে, “ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে। ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমার মনে আছে— সর্বমানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে।”
১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে খোলা আকাশের তলায়, বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, গাছের ছায়ায় বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে কবি ছেলেদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। আর বিশ্বভারতীর পরিকল্পনাপর্বে তাঁর মনে হয়েছে শুধু প্রকৃতির সঙ্গে নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসাধন করতে হবে। দেশ জাতি ধর্ম ভাষার বিভেদমুক্ত এক উদার মিলনক্ষেত্রের স্বপ্ন ছিল তাঁর, যেখানে সব জাতির আত্মদানের আলোয় জ্বলে উঠবে জ্ঞানের দীপমালা।
৮ পৌষ ১৩২৫ (১৯১৮) শান্তিনিকেতনে ভিত্তিস্থাপন হয় বিশ্বভারতীর। বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের পর ভিত্তির গর্তে কবি আতপচাল জল ফুল কুশ নিক্ষেপ করেন এবং বিভিন্ন দেশের পুরুষ-মহিলারা বিশ্বমানবের প্রতিনিধিরূপে গর্তে মৃত্তিকা দেন। পরবর্তী আষাঢ় (১৩২৬) থেকে শুরু হয় বিশ্বভারতীর পঠনপাঠন। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক আর আশ্রমের পুরুষ-মহিলারাই তখন ছাত্রছাত্রী। এমনকি কোনও কোনও আলোচনায় রবীন্দ্রনাথও উপস্থিত থাকতেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি এক চিঠিতে লেখেন: “এখানে আজকাল অধ্যয়ন অধ্যাপনার খুব ধুম পড়ে গেছে। পালি প্রাকৃত সংস্কৃত সিংহলী বাংলা ইংরেজি দর্শন ব্যাকরণ অলঙ্কার ইত্যাদি চলচে। ছবি ও গানও
জমে উঠেছে।”
একে একে অধ্যাপকদের আসনগুলি ভরে উঠেছে। সংস্কৃত পালি প্রাকৃত ও শাস্ত্র অধ্যাপনার দায়িত্ব নিয়েছেন বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেন, বৌদ্ধ দর্শন আলোচনা করছেন সিংহলের রাজগুরু মহাস্থবির, ইংরেজি সাহিত্য পড়াচ্ছেন সি এফ এন্ড্রুজ, পাশাপাশি সঙ্গীতশিক্ষার ভার নিয়েছেন ভীমরাও শাস্ত্রী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নকুলেশ্বর গোস্বামী, চিত্রকলার শিক্ষকতা করছেন সুরেন্দ্রনাথ কর, অসিতকুমার হালদার ও নন্দলাল বসু। স্বয়ং কবিও যোগ দিয়েছেন অধ্যাপনার কাজে।
মনে রাখা ভাল, শুধু বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চাই শিক্ষার বাহন হবে, ভাবেননি কবি, তার সঙ্গে ছবি আর গানকেও তিনি যুক্ত করেছেন প্রথমাবধি। জ্ঞান ও কলার সমন্বয়ে মনুষ্যত্বের এক পূর্ণ রূপের ভাবনা তাঁর মনে কাজ করছিল। বিশ্বভারতী সূচনার সময়ই তিনি সংকল্প করেছিলেন, বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, ভারতীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলা তার প্রধান অঙ্গ হবে। প্রথম অবস্থায় দু’টি মিলিত ছিল ‘কলাভবন’ নামে, দুই সহজাত শিল্পের দীপায়ন, একের ইশারায় অন্যের উদ্ভাসন যেন। পরে এগুলি স্বতন্ত্র ‘ভবনে’ পরিণত হয়, কলাভবন ও সঙ্গীতভবন।
প্রতিষ্ঠালগ্নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কবির অনুরোধে প্রাচ্যতত্ত্ববিদ ফরাসি পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির আগমন। বিশ্বভারতীতে তিনিই প্রথম বিদেশি অতিথি-অধ্যাপক। প্রাচীন ভারতের সঙ্গে বহির্জগতের সম্বন্ধের ইতিহাস, বৌদ্ধ দর্শন, ফরাসি চিনা তিব্বতি ভাষা প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের অধ্যাপনা করেছেন। এখানে তিনি অনেক
যোগ্য ছাত্র পেয়েছিলেন এমন নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধায় অক্ষুণ্ণ ছিল তাঁর কর্মগৌরব।
এখানকার বিদ্যাচর্চায় কবি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সেই মনীষীদের আহ্বান করতে চেয়েছিলেন যাঁরা নিজেদের শক্তি ও সাধনা দিয়ে অনুসন্ধান আবিষ্কার ও সৃষ্টির কাজে মগ্ন আছেন। তাঁদের সম্মিলনে স্বভাবতই জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হবে, প্রতিষ্ঠা হবে সত্য বিশ্ববিদ্যালয়। সেই প্রতিষ্ঠান কোনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নকল হবে না। অন্য দিকে, এই বিশ্ববিদ্যালয় উৎকৃষ্ট আদর্শে চাষ করবে, গো-পালন করবে, কাপড় বুনবে এবং নিজের আর্থিক সম্বললাভের জন্য সমবায় প্রণালী অবলম্বন করে ছাত্র শিক্ষক ও চারদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হবে। এক উন্মুক্ত সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাক্ষেত্র গড়ে তোলা ছিল কবির অভিপ্রায়; “এইরূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি ‘বিশ্বভারতী’ নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।”
শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার
পরের বছর পল্লি পুনর্গঠন বা গ্রামোন্নয়নের পরিকল্পনায় নিকটবর্তী সুরুল গ্রামে স্থাপিত হয় বিশ্বভারতীর অন্য শাখা শ্রীনিকেতন (১৯২২)। এই কাজে কবির প্রধান সহায় ছিলেন ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী লেনার্ড এলমহার্স্ট। কবির গ্রামোন্নয়ন ভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে শ্রীনিকেতনের দায়িত্ব নেন এবং বিশ্বভারতীর আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথা জেনে নিজেই অর্থ সংগ্রহ করেন। বিশ্বভারতীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনসাধনে যদি জ্ঞানচর্চার প্রথম প্রতিনিধি হন সিলভ্যাঁ লেভি, তা হলে ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রথম প্রতিনিধি লেনার্ড এলমহার্স্ট।
এখন এখানে বহু ছাত্র, বহু বিভাগ, কিন্তু সবই বিচ্ছিন্ন, সব বিভাগ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সচেষ্ট। পারস্পরিক সহযোগিতায়, আদান-প্রদানে বিশ্বভারতীর যে ঐক্যময় রূপ প্রত্যাশিত ছিল, তা যেন লক্ষ করা যাচ্ছে না। গভীর উদ্বেগে কবি বলেছিলেন, “আমি যতদিন আছি ততদিন হয়তো এ বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারি, কিন্তু আমার অবর্তমানে কার আদর্শে চলবে?... দৃঢ় নিষ্ঠায় সকলে একত্র হয়ে যেন আমরা আদর্শের বিশুদ্ধি রক্ষা করি, বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য বিস্মৃত না হই।” তিনি আশা করেছিলেন বিশ্বভারতীকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায় হবেন প্রাক্তনীরাও। তাঁদের কাছে তিনি অর্থ প্রত্যাশা করেননি; শুধু বলেছিলেন: “ভবিষ্যতে যদি আদর্শের প্রবলতা ক্ষীণ হয়ে আসে তবে পূর্বতনেরা যেন এর প্রাণধারাকে সঞ্জীবিত রাখেন, নিষ্ঠা দ্বারা শ্রদ্ধা দ্বারা এর কর্মকে সফল করেন— এই আশ্বাস পেলেই আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারি।”
বিশ্বভারতীর আদর্শ রক্ষার ভাবনার সঙ্গে অর্থদৈন্য তাঁকে প্রতিনিয়ত ক্লিষ্ট করছিল। বাইরে থেকে অনুরাগী মানুষরা অর্থানুকূল্য করলেও প্রয়োজনের পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না। বৃদ্ধ কবি অর্থের জন্য অভিনয়ের দল নিয়ে দেশে দেশে ভ্রমণ করছিলেন। এই রকমই এক ভ্রমণে (দিল্লি, ১৯৩৬) গাঁধীজি তাঁর কোনও ভক্তের কাছ থেকে সংগৃহীত ষাট হাজার টাকার চেক কবির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, এই বয়সে অর্থের জন্য ঘুরে বেড়ানো কবির পক্ষে সমীচীন নয়। গাঁধীজিকে বরাবরই বিশ্বভারতীর শুভানুধ্যায়ী বলে জেনেছেন রবীন্দ্রনাথ।
কবির প্রয়াণের এক বছর আগে, ১৯৪০ সালে শেষ যে বার গাঁধীজি শান্তিনিকেতনে আসেন, বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ নিয়ে দু’জনের মধ্যে আলোচনা হয়। গাঁধীজির বিদায় নেওয়ার দিন (১৯ ফেব্রুয়ারি) কবি এক চিঠিতে অনুরোধ জানান, তাঁর অবর্তমানে গাঁধীজি যেন বিশ্বভারতীর প্রতি দৃষ্টি রাখেন; পত্রোত্তরে যথাসাধ্য সাহায্য করার আশ্বাস দেন গাঁধীজি। কবির চিঠিটি তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে দেখান এবং স্বাধীন ভারতে মৌলানা আজাদ যখন শিক্ষামন্ত্রী, তাঁকে আবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সূত্রে ও কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের আন্তরিক আগ্রহে ১৯৫১ সালে ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেল বিশ্বভারতী; আচার্য হলেন জওহরলাল নেহরু, উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আচার্য হওয়ায় আর্থিক সমস্যার সমাধানও অনেক সহজ হয়ে এল।
নতুন সমস্যাও যে কিছু হল না তা নয়। ১৯৫৩ সালে রথীন্দ্রনাথ উপাচার্যের পদ পরিত্যাগ করে একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে লেখেন: “আমি নিজেই চেয়েছিলাম সরকার অনুমোদিত বিধিবদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বভারতী স্বীকৃতি
পাক। কিন্তু এটা হওয়ার পর
থেকেই আমি খুব অনুতাপ করেছি। প্রতিষ্ঠানের চরিত্রটাই পাল্টাতে শুরু করল...”। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতেও রবীন্দ্রনাথের আদর্শে প্রাণিত শিক্ষক-কর্মীরা বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ও আদর্শকে রক্ষা
করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতীর
আয়োজনে এক বছরব্যাপী মহাসমারোহে উদ্যাপিত হল রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষের জন্মোৎসব। আচার্য নেহরু শিলান্যাস করলেন ‘বিচিত্রা’ নামে রবীন্দ্রভবনগৃহের, যা অদূর ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে রবীন্দ্রসংগ্রহশালা ও অভিলেখাগারের মতো উজ্জ্বল সম্পদ, এর অধিকাংশই রথীন্দ্রনাথের দান।
সময়ের সঙ্গে বিশ্বভারতীর আকৃতি-প্রকৃতির বদল হয়েছে। বিশ্বভারতী সূচনাকালে যেমন ছিল, ভবিষ্যতে যে তেমনই থাকবে না কিংবা এক দিন যে-সঙ্কল্প নিয়ে সূচনা হয়েছিল, আগামী কালেও তার অবিকল পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়, বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বার বার বলেছেন, বাইরের প্রতিকূলতা বা পরিবর্তন যেন মূল লক্ষ্যকে আচ্ছন্ন না করে। ভারতবর্ষে নানা জাতির খণ্ড খণ্ড পরিচয়ের মধ্যে তার সমগ্রতার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটিই তার আত্মপরিচয়। সেই পরিচয় শুধু হিন্দুচিত্তকে স্বীকার করে নয়; ভারতের সাহিত্য শিল্পকলা স্থপতিবিজ্ঞান প্রভৃতিতে হিন্দু-মুসলমানের সংমিশ্রণে যে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে তার পরিচয়ই ভারতবর্ষীয়ের পূর্ণ পরিচয়। ভারতবর্ষের শিক্ষায় তার সম্পূর্ণ আত্মপরিচয় উপলব্ধির জন্য কোনও একটি জায়গায় সাধনা দরকার, সেই সাধনাস্থল হোক বিশ্বভারতী, আকাঙ্ক্ষা ছিল কবির। বিশ্বের কাছে ভারতের আমন্ত্রণবাণী ঘোষণা করুক বিশ্বভারতী; যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্: এই মন্ত্র হোক বিশ্বভারতীর পরিচয়।
এক সময় শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতী ছিল একসূত্রে বাঁধা, পরস্পরের পরিপূরক। বিশ্বভারতীর সমস্ত কর্মকাণ্ডে শান্তিনিকেতনের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল। ক্রমশ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়ে ওঠার তাগিদে দু’টিকে এখন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন মনে হয়। বিশ্বভারতীকে একটি প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়মাত্র গড়ে তোলা কোনও দিনই প্রতিষ্ঠাতার কাম্য ছিল না; মনে রাখতে হবে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মান-নির্ণয়ের প্রতিযোগিতায় তার সার্থকতা নয়। বিশ্বভারতী
একটি আইডিয়া, আপন বিশেষত্বে বিশ্বের মধ্যে এক ও অনন্য, এই তার গৌরব। শতবর্ষের প্রার্থনা, সেই গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখার সঙ্কল্পে ব্রতী থাকুক বিশ্বভারতী।
শুভার্থী: গাঁধীজির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (শান্তিনিকেতন, ১৯৪০)
পরবর্তী কালে পল্লি-সংক্রান্ত কাজের পাশে স্থাপিত হয় দুঃস্থ গ্রামীণ ছাত্রদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয় ‘শিক্ষাসত্র’, বর্তমানে যেটি অভিন্ন পঠনপাঠনে শান্তিনিকেতন পাঠভবনের সমান্তরাল একটি ইস্কুল; স্থাপিত হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ‘শিক্ষাচর্চা’ ও দূরশিক্ষা কেন্দ্র ‘লোকশিক্ষা সংসদ’।
ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিশ্বভারতী, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ হয়েছে আত্মিক সম্পদে। কিন্তু ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অর্থাভাব তাড়না করে চলেছে বিশ্বভারতীকেও। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কেনা শান্তিনিকেতনের মূল কুড়ি বিঘে জমি ছাড়া কবির সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও তাঁর বাংলা বইয়ের লভ্যাংশ বিশ্বভারতীকে উৎসর্গ করলেও অর্থসঙ্কট মেটেনি। দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করে বক্তৃতা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন তিনি। কবির ভাষায়: “ভিক্ষাবৃত্তির ঘূর্ণি হাওয়ায় আমাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরপাক খাইয়ে বেড়াচ্ছে।” নিরন্তর ভ্রমণ তাঁকে পরিশ্রান্ত করছিল, তারই মধ্যে সান্ত্বনা পেয়েছেন এই ভেবে যে বিশ্বভারতীর অন্তরের কথা তিনি নানা জায়গায় বলতে পারছেন; জানাতে পারছেন বিশ্বভারতী সব জাতি-ধর্ম-ভাষার মিলনকেন্দ্র হবে, এই তার উদ্দেশ্য।
বিশ্বভারতীর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য দ্বিতীয় বছরে স্থানিক-সভা, ন্যাসিক-সভা, শিক্ষাসমিতি, কর্মসমিতি প্রভৃতি গঠিত হয়। উল্লেখযোগ্য, এই সব সভা-সমিতির সদস্য শুধু এখানকার অধ্যাপক-কর্মীরাই নন, বিশ্বভারতীর শুভার্থী প্রাচ্য-প্রতীচ্যের নানা গুণিজনকেও বিভিন্ন সদস্যপদে আহ্বান করা হয়। ছোট সীমানা পেরিয়ে বিশ্বভারতীর আমন্ত্রণ ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত বিশ্বে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে ক্রমে বিশ্বভারতীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কবির যোগাযোগ হয়, যাঁদের অনেকেই পরে বিশ্বভারতীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ভিন্টারনিৎস, লেসনি, বগদানভ, মার্ক কলিন্স প্রমুখ। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইটজ়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, চিন, জাপান থেকে উপহার আসে অজস্র বই ও পত্রিকা, ভরে ওঠে বিশ্বভারতী গ্রন্থাগার।
১ বৈশাখ ১৩৩০ (১৯২৩) নববর্ষের ভাষণে কবি বলেন: “আমরা এখানে কোন্ মন্ত্রের রূপ দেখব বলে নিয়ত প্রত্যাশা করব। সে মন্ত্র হচ্ছে এই যে— ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্।’ ... পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই আশ্রম এমন-একটি জায়গা হয়ে উঠুক যেখানে ধর্ম ভাষা এবং জাতিগত সকল প্রকার পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা মানুষকে তার বাহ্যভেদমুক্তরূপে মানুষ বলে দেখতে পাই।... সেই দেখতে পাওয়া থেকেই যেন মনের মধ্যে শ্রদ্ধা করতে পারি যে, মানবের ইতিহাসে নবযুগের অরুণোদয় আরম্ভ হয়েছে।” সর্বজাতিক সম্মিলনে সেই নবযুগের বার্তা আনবে বিশ্বভারতী।
১৯২৮ সালে চিন থেকে আসেন তরুণ তান-য়ুন-শান, মূলত যাঁর চেষ্টায় চিনাদের অর্থে বিশ্বভারতীতে স্থাপিত হবে চিন-ভারত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চীনাভবন (১৯৩৭)।
রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, বিশ্বভারতী দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরীক্ষা পাশের পাঠ্যবিধির মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না; বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শাসনের বাইরে মুক্তভাবে হয়ে উঠবে সর্ববিদ্যার মিলনতীর্থ। বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনের ছাত্ররা ভবিষ্যতে এর ভার নেবে, এই আশায় ছাত্রদের জন্য তিনি যে শিক্ষাক্রম প্রস্তাব করেছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গতি লক্ষ করা যায় কয়েকবছর আগে তাঁর পরিকল্পনার: বিশ্বভারতীতে বৈদিক পৌরাণিক বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতি সমস্ত ভারতীয় বিদ্যার যুগোপযোগী ভাবে সমবেত চর্চা হবে এবং আনুষঙ্গিক ভাবে স্থান দিতে হবে ইউরোপীয় বিদ্যাকে। আমাদের দেশের শিক্ষাকে মূল আশ্রয় করে তার উপর অন্য সব শিক্ষার পত্তন হলে তবেই শিক্ষা সত্য ও সম্পূর্ণ হবে। এই ভাবনার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে। এরই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন সব রকম সাংস্কৃতিক অনুশীলনের কেন্দ্র হবে বিশ্বভারতী। চিত্তের পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে “সকল রকম কারুকার্য শিল্পকলা নৃত্যগীতবাদ্য নাট্যাভিনয় এবং পল্লীহিতসাধনের জন্য যে-সকল শিক্ষা ও চর্চার প্রয়োজন সমস্তই এই সংস্কৃতির অন্তর্গত বলে স্বীকার করব,” বলেছিলেন কবি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করবে বিশ্বভারতী।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিশ্বভারতী তথা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক স্মরণীয় পদক্ষেপ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ‘নটীর পূজা’-র অভিনয়। এত দিন এখানকার ছাত্রীদের নৃত্য বা নৃত্যাভিনয় ছিল শান্তিনিকেতনের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ; এই প্রথম প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে কোনও ভদ্র পরিবারের মেয়ের নাচ দেখা গেল। বিশ্বভারতীর সাহায্যার্থে অভিনীত এই নাট্যে নটীর ভূমিকায় নন্দলালের কিশোরী কন্যা গৌরী বসুর নৃত্যাভিনয় দেখে অভিনন্দন জানালেন মুগ্ধ দর্শকমণ্ডলী।
বিশ্বভারতীর আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে অধ্যাপক-কর্মীরা এসেছেন, এসেছেন বহু ছাত্রছাত্রী। এই প্রথম পাওয়া গিয়েছিল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে এক সঙ্গে ছিল ইস্কুল (পূর্ব বিভাগ) থেকে স্নাতক স্তর (উত্তর বিভাগ) পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। চূড়ান্ত পরীক্ষা হত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ও পরীক্ষাবিধি মান্য করে। সমাজের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই আপস কবিকে করতেই হয়েছে, পরীক্ষার নির্দিষ্ট পাঠক্রমের পাশাপাশি চলেছে নানা বিদ্যার আয়োজন। কিন্তু এখনকার পরিচালন পদ্ধতি কবিকে সর্বদা তৃপ্ত করতে পারছে না :
“আমার কবিপ্রকৃতি বলেই হয়তো, কনস্টিট্যুশন, নিয়মের কাঠামো— যাতে প্রাণধর্মের চেয়ে কৃত্রিম উপায়ের উপর বেশি জোর, তা আমি বুঝতে পারি নে; সৃষ্টির কার্যে এটা বাধা দেয় বলেই আমার মনে হয়।... এ বিদ্যালয়ের কোনো বিশেষত্ব যদি অবশিষ্ট না থাকে তাহলে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়।... বিদ্যালয় যদি একটা হাই-ইস্কুলে মাত্র পর্যবসিত হয় তবে বলতে হবে ঠকলুম।” বিশ্বভারতী তাঁর কাছে একটি প্রতিষ্ঠানমাত্র ছিল না, ছিল সৃষ্টি, সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি।