বিশ্বনাগরিক: কলকাতার ময়দানে রাজা রামমোহন রায়ের পূর্ণাবয়ব মূর্তি
সাগরপারে চললেন রাজা রামমোহন রায়। যাত্রা শুরু ১৮৩০-এর ১৫ নভেম্বর, সোমবার। ইচ্ছে, ইংল্যান্ড ইউরোপের আচার-ব্যবহার, ধর্ম এবং রাজনৈতিক অবস্থাগুলো নেড়েচেড়ে দেখা, প্রত্যক্ষ ভাবে জানা। জাহাজে সঙ্গী, দু’টি গাভী, পালিত পুত্র রাজারাম, রামরত্ন মুখোপাধ্যায় এবং রামহরি দাস। এক দিন উত্তমাশা অন্তরীপে রামমোহনের ‘আলবিয়ান’ জাহাজ নোঙর ফেলল। পড়ে গিয়ে পা ভাঙল তাঁর। কিন্তু ওই অবস্থাতেও অদম্য। অদূরেই যে নোঙর ফেলেছে দু’টি ফরাসি জাহাজ। সে দু’টির মাথায় উড়ছে দ্রোহের নিশান। তা দেখলেন আমাদের রামমোহন। জাহাজ ছাড়ছে, চিৎকার করে বললেন— ‘গ্লোরি, গ্লোরি, গ্লোরি টু ফ্রান্স’। তত দিনে, জুলাই বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলি যে রামমোহনকেও নাড়া দিয়ে গিয়েছে। শোনা যায়, ফরাসি দেশের বিপ্লব-উদ্যাপনে কলকাতায় নাকি ভোজসভার আয়োজন করেন রামমোহন। কলকাতার টাউন হলে একই কাণ্ড করেন স্পেনে সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরেও।
এগুলি হয়তো কয়েকটি ঘটনা মাত্র। কিন্তু এগুলির সূত্রে আমরা খুঁজে দেখতে পারি রাষ্ট্র-দার্শনিক রামমোহনকে। আন্তর্জাতিকতা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন, অর্থনীতি, দেশের আইন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা-সহ আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার নানা ইট-পাথর-সুরকি দিয়েই রামমোহন তাঁর রাষ্ট্র-ভাবনার সাতমহলা প্রাসাদটি খাড়া করেছেন।
সে প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে রয়েছে, রামমোহনের নিজস্ব পাঠ ও অভিজ্ঞতা। এই ভাবনা-গঠনটির কথা বললে, ফিরে তাকাতে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি-রাজস্ব বিভাগের কর্মী রামমোহনের দিনগুলির দিকে। রংপুরে রয়েছেন। উইলিয়াম ডিগবির সান্নিধ্যে পরিচয় হচ্ছে পশ্চিমের রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে। সেখানেই থরে-থরে সাজানো পত্রপত্রিকা। নিবিড় পাঠক রামমোহন। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লবের খবরগুলির দিকেই তাঁর বেশি নজর। যদিও, এর আগেই ফরাসি চিন্তাবিদ আঁতোয়া কঁদরসে-এর সঙ্গে পত্রালাপ ঘটেছে তাঁর, জানাচ্ছেন ইতিহাসবিদ কে এম পানিক্কর। পাশাপাশি রামমোহনকে বিশেষ ভাবে সঙ্গত দেয়, জেরেমি বেন্থাম ও মন্তেস্ক্যুর দর্শনও।
পূবের মানুষের সঙ্গে পশ্চিমের এমন আলাপ অকস্মাৎ নয়। বরং, এ যেন রামমোহন মননের অনিবার্যতা। তাই, ১৮৩২-এ প্রাক্তন ফরাসি বিদেশমন্ত্রী ও ইংল্যান্ডে ফরাসি রাষ্ট্রদূত তালেরাঁকে একটি চিঠি লেখেন রামমোহন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রামমোহন কোনও কিছু নিয়ে বিবদমান দু’দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিচ্ছেন। সে সঙ্গে লিখছেন “...সমস্ত মানবজাতিই এক বিরাট পরিবার, যার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা হল বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী।” বিভিন্ন দেশের মানুষ যাতে অবাধে যাতায়াত করতে পারেন, তা নিয়েও সওয়াল করেন রামমোহন।
দুয়ার পেরিয়ে বিশ্বের দরজায় দাঁড়াতে চাওয়া এই অবাধ্য মনটিকে তাই কখনও বিচলিত করে ইটালির মুক্তি সংগ্রাম, আয়ারল্যান্ডের আন্দোলন, আমেরিকার দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলন।
আবার এক বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলেও রামমোহন বাড়ির বাইরে বেরোবেন না ঠিক করলেন। কারণ, বড়ই মনখারাপ। নেপলস্বাসীর পরাজয়ের কথাটা সে দিনই শুনেছেন যে। বলে ওঠেন, “নেপলস্বাসীর দুর্দশা আমারও দুর্দশা, তাদের শত্রু আমারও শত্রু!”— আসলে ঔপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক এমন এক বিশ্ব-মানচিত্রে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাগরিকটি আমাদের বোঝাতে শেখালেন, বিভিন্ন দেশের ‘মুক্তির অনিবার্যতা’। সে কথা বলেনও ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এর সম্পাদক জেমস সিল্ক বাকিংহামকে।
এখান থেকেই যেন সূত্রপাত রামমোহনের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি আগ্রহের দিকটি। আর তাই রামমোহন ভিক্তর জাকমোঁকে জানাচ্ছেন, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী বিষয় নয়। ভারতবর্ষ তার হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধারের দাবিও জানাবে।
এই দাবিদাওয়া জানানো বা আদায় করার ক্ষেত্রে বিদ্রোহের সম্ভাবনাটি অবশ্যম্ভাবী। জন অ্যাডামের অর্ডিন্যান্স বেরিয়েছে। বড়লাটের অনুমতি ছাড়া পত্রপত্রিকা প্রকাশ করা চলবে না। অর্থাৎ, ব্যবস্থা হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়ার। গর্জে উঠলেন রামমোহন। ১৮২৩-এ অন্যদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জর্জের কাছে পাঠালেন আবেদনপত্র। লাভ হল না। প্রতিবাদে তাঁর ফার্সি পত্রিকা ‘মিরাৎ-উল্-আখ্বার’ সংবাদপত্রের প্রকাশই বন্ধ করে দেন রামমোহন।
আসলে, এই পত্রিকার ‘প্রকাশ বন্ধ করা’-র মধ্যে দিয়েই রামমোহন ভারতবাসীকে শিক্ষকের মতো ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তার ‘দ্রোহের অধিকার’ কতখানি। ধর্ম, পরিবার, রাজনীতির যা কিছু পচনশীল, তার বিরুদ্ধে দ্রোহ করাটাই যে সঙ্গত, এমনটা রামমোহন জানাচ্ছেন ‘ফাইনাল অ্যাপিল টু দি ক্রিস্টান পাবলিক ইন ডিফেন্স অব দ্য প্রিসেপ্টস অব জেসাস’-এর ভূমিকায়।
এই আপত্তি, ক্ষোভ, বিদ্রোহের কথা সংবাদপত্রটিতেও লিখেছেন রামমোহন। এক বার জন হেজ় নামে কুমিল্লার এক বিচারকের আদেশে প্রতাপনারায়ণ দাস নামে এক ব্যক্তিকে চাবুক মারা হয়। তার পরে, যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, দেখা যায় প্রতাপনারায়ণ ‘নিহত’। ওই বিচারকের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়। এই ঘটনায় শাণিত ভাষায় সম্পাদকীয় লিখেছিলেন রামমোহন।
কিন্তু শুধু বিদ্রোহ ঘোষণা করলেই হয় না, প্রকৃত রাষ্ট্র-দার্শনিক সব সময় নিয়োজিত থাকেন এক বিকল্পের সন্ধানে। এ ক্ষেত্রেই রামমোহন অন্যদের থেকে আলাদা। বিষয়টি তাঁর অর্থনীতি সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার দিকে তাকালে যেন আরও পরিষ্কার হয়। ঘটনাচক্রে, অর্থনীতি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনা রামমোহন রায়ের আগে বাংলা তথা ভারতে খুব একটা হয়নি। একমাত্র ‘সমাচার দর্পণ’-এ অর্থনীতি বিষয়ে প্রবন্ধ ছাপা হত। তাই বোধহয় ভবতোষ দত্ত বলেছেন, “অর্থনৈতিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত আলোচনায় রামমোহনের কোনো ভারতীয় পূর্বসূরী ছিলেন না...।” রামমোহনের অর্থনীতি সংক্রান্ত লেখাপত্রগুলির সময়পর্ব মূলত ১৮৩১-এর অগস্ট থেকে ১৮৩২-এর জুলাই। ১৮৩৩-এ নতুন চার্টার আইন পাস করার আগে পার্লামেন্ট থেকে একটি সিলেক্ট কমিটি নিয়োগ করা হয়। সে কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য রামমোহন আমন্ত্রিত। ওই কমিটির পাঠানো প্রশ্নাবলির উত্তর এবং কয়েকটি পরিশিষ্ট প্রবন্ধ (মূলত সাতটি বিষয়ে) রামমোহনের অর্থনীতি সংক্রান্ত ধারণাটি বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।
তবে সে দিকে তাকানোর আগে, রামমোহনের অর্থনৈতিক ভাবনার প্রস্তুতি-পর্ব, তাঁর সময়ের আধারটি দেখা দরকার। তখন দেশের কুটিরশিল্পগুলির ঝাঁপ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ডে জাঁকিয়ে বসেছে শিল্প বিপ্লব। ল্যাঙ্কাশায়ারের কাপড় দেশ-বিদেশের বাজারে একচেটিয়া প্রাধান্য পাচ্ছে। ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসা করে বাংলা ও ভারতে গজিয়ে উঠছে এক দল নব্য ভারতীয় বণিক শ্রেণি। তৈরি হয়ে গিয়েছে, ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’, ‘ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল’। উল্টো দিকে, সনাতনী শিল্প আঁকড়ে থাকা দেশের শ্রমিকের অবস্থা তখন শোচনীয়। রামমোহন একটি হিসাব দিয়ে জানাচ্ছেন, কলকাতায় মিস্ত্রি-জাতীয় শ্রমিকদের আয় ছিল মাসে ১০-১২ টাকা। সাধারণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার টাকা। রামমোহনের অভিজ্ঞতা, বাংলার গরিব মানুষের পাতে ভাত এবং নুন, এই দু’টি বাদে আর কিছুই থাকে না! শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ তখন কার্যত দিবাস্বপ্ন।
ততোধিক খারাপ পরিস্থিতি কৃষকেরও। দেশের খেতে-খামারে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাপাদাপি। পায়ের উপর পা তুলে আংশিক অধিকার ভোগ করছেন দেশের জমিদারেরাও। রামমোহন দেখাচ্ছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রজার থেকে খাজনা আদায়ের জন্য জমিদার কী ভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছেন। প্রজা খাজনা দিতে কোনও কারণে দেরি করলে, তাঁর স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি জমিদারেরা করায়ত্ত করতে বিশেষ সময় নেন না। উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণেও চাষির অধিকার সে ভাবে নেই। আশা করা হয়েছিল, এই বন্দোবস্তে জমিদারেরা পতিত জমিতে চাষ করে উৎপদন বাড়িয়ে নিজেরা লাভবান হবেন এবং দ্বিতীয়ত যে সব জমিতে চাষ হচ্ছিল, সেগুলিরও উন্নতি হবে। কিন্তু রামমোহন উদাহরণ-সহ আমাদের দেখাচ্ছেন, এই বন্দোবস্তের দু’টি মৌল উদ্দেশ্যই কী ভাবে সমূলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
এমন একটি আবহে দাঁড়িয়ে রামমোহনের অর্থনৈতিক ভাবনা-চিন্তা জুড়ে রইল কৃষি, ভূমি রাজস্ব ও চাষিদের কথা। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির অধীনে মুনশি, সেরেস্তাদার, দেওয়ান হিসেবে রামগড়, ভাগলপুর, রংপুরে প্রায় বছর দশেক কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিশেষ কাজে লাগে রামমোহনের। সম্ভবত নাড়া দিয়ে গিয়েছে অ্যাডাম স্মিথের ‘দি ওয়েলথ অব নেশনস’, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর ‘অন দ্য প্রিন্সিপালস অব পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যান্ড ট্যাক্সেশন’ শীর্ষক বই দু’টিও। কারণ, তাঁর লেখায় বার বার ফিরে আসছে, শিল্পজ্ঞানে সমৃদ্ধ ইংল্যান্ড এবং মূলধনের অংশভাগী হয়ে উত্তর-আমেরিকার উন্নতির প্রসঙ্গ।
রামমোহন চাইলেন, তাঁর দেশের ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থায় সরকার, জমিদার এবং চাষি, এই তিন পক্ষের অধিকার থাকবে। রাজস্বপ্রাপ্তিতে সরকারের অধিকার, জমিদারের খাজনা আদায়ের অধিকার এবং চাষির উৎপাদিত ফসলের লভ্যাংশে অধিকার— এই তিনটি তাঁর কাঙ্ক্ষিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে চাষির অধিকার স্বীকৃত হয়নি।
আর একটি বিষয় রামমোহন চেয়েছেন। তা হল, জমিদারদের খাজনা বাড়ানোর অধিকার যেন না থাকে। জমিদারদের উপরে থাকা কর কমানোর কথাও বলেন। কারণ, এটা হলে জনসাধারণ উপকৃত হবেন। কিন্তু এর ফলে, সরকারি কোষাগারে টান পড়তে পারে। তা যাতে না হয়, সে জন্য তিনটি প্রস্তাব দিলেন রামমোহন—১। বিলাসদ্রব্য এবং অত্যাবশ্যকীয় নয়, এমন জিনিসপত্রে বেশি করে কর আরোপ। এই প্রস্তাবটি সম্ভবত ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস চর্চায় এর আগে অশ্রুতপূর্ব। ২। রাজস্ব বিভাগের ব্যায়-সঙ্কোচন। দেড় হাজার টাকা বেতনের ইংরেজ ও ইউরোপীয় কালেক্টরের তুলনায় তিন-চারশো টাকা বেতনের ভারতীয় কালেক্টর নিয়োগ করা দরকার। ঘটনাচক্রে, প্রশাসনের অন্দরমহলে ‘ভারতীয়করণ’-এর এমন প্রস্তাব, বহুকাল পরে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনেরও অন্যতম দাবি হয়ে ওঠে। ৩। স্থায়ী সেনাবাহিনীর বদলে স্থানিক রক্ষীদলের ব্যবস্থা করা।
আদতে, রামমোহন এ সব প্রস্তাবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির পরিসরটিকেই বদলে ফেলতে চান। সে সঙ্গে, আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি আমাদের দেখিয়েছেন। ‘অন কলোনিয়াল পলিসি অ্যাজ় অ্যাপ্লিকেবল টু দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ শীর্ষক নিবন্ধে দেখানো হয়েছে, ভারত থেকে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছে।
সম্পদের এমন বহির্গমন রুখতে গিয়ে রামমোহন ইংরেজ তথা ইউরোপীয়দের ভারতেই বসবাসের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন ১৮২৯-এ। বিষয়টি নিয়ে সে সময় তুমুল সমালোচনাও হয়। কিন্তু, রামমোহনের চাওয়াটা ছিল, শিক্ষিত, শিল্পজ্ঞান ও মূলধনে সমৃদ্ধ ইংরেজ বা ইউরোপীয়রা দেশে থাকুন। তা হলে, এক দিকে দেশের সম্পদ বেহাত হবে না। অন্য দিকে, কৃষি ও শিল্পেরও উন্নতি হবে। পাশাপাশি, চাইলেন ‘অবাধ বাণিজ্য’-এর প্রসারও।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দিকগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রের নীতি, শাসন-ব্যবস্থার একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়েও ভেবেছেন রামমোহন। রামমোহনের সমসময়ে, এক দল মনে করতেন ভারতবর্ষের প্রশাসন-ব্যবস্থাটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধীনে থাকলেই ভাল। রামমোহনও তাই ভেবেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ভারতের গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। পাশাপাশি, দেশের আইন প্রণয়নের দায়িত্বে ভারতে বসবাসকারী আমলারা থাকলে, রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোতেই সমস্যা তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি অ্যাডামের প্রেস অর্ডিন্যান্সের উদাহরণ টেনে আনেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের আইন রচনার পটভূমিতে তিনটি দিক খেয়াল রাখার প্রস্তাব দিলেন তিনি— ১। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ২। বিভিন্ন প্রয়োজনে কমিটি ও কমিশন গঠন। ৩। ভারতের প্রভাবশালী কয়েক জনের উল্লেখ করে প্রশাসন সম্পর্কে তাঁদের পরামর্শ মানা যেতে পারে।
পূর্বে উল্লিখিত যে, রামমোহন বেন্থাম ও মন্তেস্কুর দর্শনের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত। বেন্থামের রচনার জন্যই হয়তো রামমোহন আইন ও নৈতিকতা, এই দু’টি বিষয়কে আলাদা করে দেখেছেন। আবার ‘ক্ষমতার পৃথকীকরণ’ ও ‘আইনের শাসন’-এর ভাবনাটি এসেছিল মন্তেস্কুর প্রভাবে। কিন্তু প্রভাব থাকলেও, অনুকরণ নেই রামমোহনের ভাবনায়। বেন্থাম মনে করতেন, বিশ্ব সংসারের সব মানুষকে একটি আইনদ্বারাই পরিচালনা করা সম্ভব। কিন্তু রামমোহন চেয়েছেন, আইন রচনা হবে সংশ্লিষ্ট দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি অনুযায়ী।
আসলে রামমোহন বুঝতে চেয়েছিলেন মানুষকে। তাই তাঁর সব ভাবনারই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে দেশের জনতা। ব্রাহ্মসমাজ-গৃহ তৈরির সময়ে, সেটির ন্যাস-পত্রেও তাই লিখেছেন, ‘যে কোন প্রকার লোক হউক না কেন...তাহারদের সমাগমের জন্য এই সমাজ-গৃহ সংস্থাপিত হইল।’
এক কথায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের থেকে ঋণ নিয়ে বলতে হয়, রামমোহন চেয়েছিলেন যুক্তিবাদী নবভারতের নির্মাণ। চেয়েছিলেন বাঙালি তথা ভারতীয়দের একটি রাজনৈতিক দর্শন দিতে।
তথ্যসূত্র: ‘রামমোহন গ্রন্থাবলী’, ‘রামমোহন-স্মরণ’, ‘বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা’: সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ‘রামমোহন রায় অন ইন্ডিয়ান ইকনমি’ (সম্পাদনা: সুশোভন সরকার)