কুরুক্ষেত্রে: যুদ্ধবিমুখ বিষণ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন সারথি শ্রীকৃষ্ণ। চিত্র: গণেশ পাইন
হেলিয়োডোরাস গ্রিক রাজা আন্টিয়ালকিডাসের দূত হিসাবে শুঙ্গ রাজসভায় এসেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। অথচ, এ দেশের এক দেবতার প্রতি এমন আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন তিনি, যে বিদিশা শহরে নির্মাণ করালেন তাঁর মন্দির। সেই মন্দির আজ না থাকলেও, টিকে আছে তার সামনে থাকা একটি স্তম্ভ, যার গায়ে উৎকীর্ণ হেলিয়োডোরাসের লেখ সাক্ষ্য দেয় যে, এই মন্দিরের উদ্দিষ্ট দেবতা ছিলেন ‘দেবদেব বাসুদেব’। বাসুদেব কৃষ্ণের উপাসনার এই পাথুরে প্রমাণের অনেক আগেই অবশ্য ঘটে গেছে তাঁর দেবতায়ন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই বৈয়াকরণ পাণিনি বাসুদেবের উপাসক ‘বাসুদেবক’ সম্প্রদায়ের উল্লেখ করেছেন। তার পাশাপাশি অর্জুন-উপাসক সম্প্রদায়ের উল্লেখ স্পষ্ট করে দেয়, এই বাসুদেব মহাভারত-খ্যাত বাসুদেব কৃষ্ণই। অথচ কৃষ্ণ শুধু এক জন দেবতা নন। মহাভারতীয় আখ্যানের অধিকাংশ জুড়ে তাঁর বিচরণ এক দক্ষ কূটনীতিবিদ, যাদব-বৃষ্ণি গণসঙ্ঘের অন্যতম নেতা, পাণ্ডবদের আত্মীয় ও পরামর্শদাতা এবং অর্জুনের সারথি হিসাবে। তবে কি কৃষ্ণ এক সাহিত্যের চরিত্র, না কি এক আধা-ঐতিহাসিক কিংবদন্তির নায়ক? অন্যতম প্রাচীন উপনিষদ ‘ছান্দোগ্য’ আবার দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে মনে রেখেছে কোনও দেবতা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রূপে নয়, ঔপনিষদিক দর্শনের ছাত্র হিসাবে। ইতিহাসবিদ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী দেখিয়েছিলেন, ছান্দোগ্য উপনিষদে ঘোর আঙ্গিরসের কাছে কৃষ্ণকে যে তত্ত্বগুলি শিখতে দেখা যায়, তা অনেকাংশেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে ‘ভগবদ্গীতা’-র কিছু শ্লোকে। বৌদ্ধ-জৈন পরম্পরায় কৃষ্ণ দেবতা নন। কিন্তু অন্ধক-বৃষ্ণি গোষ্ঠীর নেতা বাসুদেব কন্হ-র কিংবদন্তি কথিত হয়েছে ‘ঘট জাতক’-এ, অন্ত্যজ জাম্ববতীর সঙ্গে দ্বারাবতী (দ্বারকা)-র বাসুদেবের বিবাহের উল্লেখ রয়েছে ‘মহাউম্মগ জাতক’-এও। জৈন পরম্পরায় আবার ‘বাসুদেব’ পরিচয়টি বিশদে আলোচিত। বাসুদেব বলতে সেখানে বসুদেবের পুত্র বোঝায় না, বোঝায় নিবৃত্তিধর্মী জৈন পরম্পরায় স্বীকৃত এমন নায়কদের, যাঁরা প্রবৃত্তিধর্মী কর্মময় জীবনে চরম সফল। তবে সেই সাফল্য ‘চক্রবর্তী’ (আদর্শ সার্বভৌম শাসক)-দের মতো একচ্ছত্র নয়, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ‘প্রতিবাসুদেব’-কে পরাস্ত ও হত্যা করে অর্জিত। মহাভারতে কৃষ্ণের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী জরাসন্ধই জৈন পরম্পরায় বাসুদেব কৃষ্ণের প্রতিবাসুদেব। ‘বাসুদেব’ অভিধা যে সম্ভবত পদবাচক, এ ইঙ্গিত অবশ্য মহাভারত-পুরাণেও রয়েছে, যেখানে জরাসন্ধ-পক্ষীয় এক পুণ্ড্ররাজ কৃষ্ণের প্রতিস্পর্ধী হয়ে নিজেকে বাসুদেব বলে দাবি করেন এবং কৃষ্ণের হাতে নিহত হন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠত্বের অর্ঘ্যদান কি এই বাসুদেবত্বের স্বীকৃতি, এক গণসঙ্ঘের (এক ধরনের অ-রাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা যাদব-বৃষ্ণি সহ প্রাচীন ভারতের বহু গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ছিল) নেতাকে এই স্বীকৃতিপ্রদানেই কি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন শিশুপাল ও অন্য রাজারা? কৃষ্ণ, ভীষ্ম ও পাণ্ডবদের আক্রমণ করে বলা শিশুপালের বক্তৃতায় এই প্রশ্ন উঠেছে, যদিও কৃষ্ণের হাতে শিশুপালের মৃত্যু থামিয়ে দেয় এই বিতর্ক। কৃষ্ণ কি শূরসেন জনপদের (মথুরা ও সংলগ্ন অঞ্চল) যাদব-বৃষ্ণি গণসঙ্ঘের এক রাজনৈতিক নায়ক ও দার্শনিক চিন্তক, যাঁর বাসুদেবত্ব তাঁর দেবতায়ন ঘটিয়েছে? তাই কি পাণিনির বিবরণে বা হেলিয়োডোরাসের লেখতে তাঁর ‘বাসুদেব’ পরিচয়ই উল্লিখিত?
উপনিষদ-মহাভারত-বৌদ্ধ জাতক কিংবা জৈন পরম্পরার এই বৃষ্ণিনায়ক কৃষ্ণ আর কাহিনি-কিংবদন্তির গোপবালক কৃষ্ণ অভিন্ন, না কি পশুপালক আভির গোষ্ঠীর কোনও দেবতার কিংবদন্তি আরোপিত হয়েছে বৃষ্ণি বীর কৃষ্ণের উপর, এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক আছে, তাতে যাওয়ার অবকাশ এই প্রবন্ধে নেই। তবে গোপাল কৃষ্ণের কিংবদন্তিগুলিও যে শুধু হরিবংশ ও পরবর্তী কালের পুরাণগুলির উদ্ভাবন নয়, তার বিক্ষিপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় নানা সূত্রে। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে ও মহাভারতে কংসবধের উল্লেখ আছে। শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দার মধ্যেও গোপাল কৃষ্ণের বাল্যলীলার কিছু কিছু কিংবদন্তির প্রতি বক্রোক্তি শোনা যায়। প্রাচীন তামিল সঙ্গম সাহিত্য ও মহাকাব্য ‘শিলপ্পদিকারম’-এ পশুপালকদের উপাস্য দেবতা ‘মায়োন’, তামিল ভাষার এই নামটি কৃষ্ণ নামের সমার্থক। মায়োন-পিন্নাইয়ের প্রেমকাহিনিতে পরবর্তী কালের জনপ্রিয় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের পূর্বাভাস যেমন পাওয়া যায়, তেমনই কৃষ্ণের কৈশোরলীলার, এমনকি রাধিকা নামটিরও, উল্লেখ মেলে প্রাচীন প্রাকৃত কাব্যসঙ্কলন ‘গাথাসতসই’-এর কয়েকটি কবিতাংশে। মহাভারত-সঙ্কলনের অন্তিম পর্যায় ও প্রাচীনতম পুরাণগুলিরও আগের, সম্ভবতঃ খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের নাট্যকার ভাসের ‘বালচরিত’ নাটকের বিষয়বস্তু গোপাল কৃষ্ণের কিংবদন্তি, যদিও ভাসের ‘দূতবাক্য’-সহ বেশ কয়েকটি নাটকে কৃষ্ণের মহাভারতীয় কার্যকলাপ উল্লিখিত। মহাভারত-এর কৃষ্ণের নিজস্ব বিশ্বস্ত বাহিনী ‘নারায়ণী সেনা’ যে আসলে গোপেদের নিয়ে গঠিত (৫.৭.১৮), এই তথ্যও হয়তো গোপনায়ক গোপাল কৃষ্ণকে এনে দেয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাঙ্গনে। কিন্তু, এই প্রবন্ধে আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বাসুদেব কৃষ্ণের মহাভারতীয় ভূমিকাই।
কৃষ্ণের দেবতায়ন ও উপাসনার শুরু যে তাঁর নিজের গোষ্ঠীর মধ্যেই, এ কথা অনস্বীকার্য। যাদব-বৃষ্ণিরা তাঁদের বিখ্যাত পূর্বজদের ‘বৃষ্ণি বীর’ নামে উপাসনা করতেন, যাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বাসুদেব কৃষ্ণ ও তাঁর অগ্রজ সঙ্কর্ষণ বলরাম। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মেগাস্থিনিস আয়োবেরিস (অংশুবতী/অংশুমতী, যা যমুনার একটি নাম) নদীর তীরের সৌরসেনয় (শৌরসেনী) জনগোষ্ঠীর মেথোরা (মথুরা) ও ক্লিজোবোরা (কৃষ্ণপুর?) শহরে পূজিত যে বীরকে হেরাক্লিস ভেবে ভুল করেছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে কৃষ্ণ। কিন্তু কালক্রমে মহাভারতের জনপ্রিয় নায়ক কৃষ্ণের উপাসনা শুধু শূরসেনঅঞ্চলে সীমিত থাকেনি। সুদূর আফগানিস্তানের আই-খানুম থেকে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের গোড়ার ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজা আগাথোক্লিসের মুদ্রায় উৎকীর্ণ আছে বাসুদেব ও সঙ্কর্ষণের প্রতিকৃতি। কৃষ্ণের এই প্রসারিত হতে থাকা জনপ্রিয়তার প্রধান বাহক অবশ্যই ছিল মহাভারত। আজকের মহাভারত তার লিখিতরূপ পেয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর অন্তত হাজার বছরের সঙ্কলন-সংযোজন-পরিমার্জনের মধ্যে দিয়ে, এ ধারণা সুপরিচিত হলেও, রোমিলা থাপার, রামশরণ শর্মা, জে এ বি ভ্যান বয়টেন, কেভিন ম্যাকগ্রার কাজে দেখা গেছে মহাভারত-এর মূল আখ্যানভাগের ঐতিহাসিক পটভূমি আরও প্রাচীন। পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রথম দিকে (খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে অষ্টম শতক), যাযাবর বৈদিক আর্যদের স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক জীবন গ্রহণে সূচিত পরিবর্তনের ফলে যে ‘জনপদ’গুলি গড়ে ওঠে, তার প্রধান কুরু (ও তার প্রতিবেশী পাঞ্চাল)-র কৌম-রাজনীতির আখ্যান, রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ‘সূত’ নামক চারণকবিদের রচনায় গ্রথিত হয়ে সম্ভবত মহাভারত-এর জন্ম দেয়। এই মৌখিক রচনাপরম্পরার প্রথাগত নাম ইতিহাস, যা কিন্তু ইংরেজি ‘হিস্ট্রি’-র সমার্থক নয়। ‘হিস্ট্রি’ যেখানে নির্ভরযোগ্য উপাদানের ভিত্তিতে অতীতের কালানুক্রমিক তথ্যভিত্তিক পুনর্নির্মাণ করে, ইতিহাস-পরম্পরার কাজ সেখানে কোনও অতীত সময়ের সামাজিক নীতিবোধ (ধর্ম), রাজনীতি ও অর্থনীতি (অর্থ), ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিনোদন (কাম) এবং আধ্যাত্মিক মুক্তিচিন্তা (মোক্ষ)-র সামগ্রিক ছবি তুলে ধরে উপদেশ প্রদান (ধর্মার্থকামমোক্ষাণামুপদেশসমন্বিতম্্/ পুরাবৃত্ত কথাযুক্তমিতিহাসং প্রচক্ষতে)। তথ্যপ্রমাণের নিশ্চয়তা নয়, আদর্শগত সামগ্রিকতাই তার উদ্দেশ্য। তাই মহাভারত-এর প্রাচীনতর মূল আখ্যান নিশ্চিত প্রামাণ্য ঘটনার ‘হিস্ট্রি’ নয়। যদিও কোনও ঐতিহাসিক ঘটনাকে (যেমন কুরুরাজ্যের উত্তরাধিকারের লড়াই বা কুরু-পাঞ্চালের যুদ্ধ) কেন্দ্র করে এর আখ্যান-কাঠামো নির্মিত হয়ে থাকা সম্ভব, কারণ শান্তনু, ধৃতরাষ্ট্র বৈচিত্রবীর্য, পরীক্ষিৎ, জনমেজয়ের মতো কুরুরাজদের উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়; জনমেজয়ের যজ্ঞে মহাভারত-কথক হিসাবে উল্লিখিত বৈশম্পায়ন শুধু পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পরিচিত নামই নন, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে মহাভারত-এর আচার্য হিসাবেও স্বীকৃত। এই আখ্যান তুলে ধরে পরবর্তী বৈদিক যুগের টালমাটাল সময়কে। স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক জনপদ গঠন, জমির বংশানুক্রমিক হস্তান্তর থেকে ক্রমশ বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে অভ্যস্ত হতে থাকা রাষ্ট্রের আভাস ও জন্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থার উন্মেষ সমাজকে কিছু জটিল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। মানুষের সামাজিক অবস্থানের প্রধান নির্ধারক কী? জন্মগত বংশপরিচয় না নিজের পছন্দ ও দক্ষতা? নতুন বর্ণাশ্রমভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিধি মেনে জন্ম থেকে নির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা পালনই কি ধর্ম, না কর্মের বন্ধন বিচ্ছিন্ন করে নিবৃত্তিপন্থী সন্ন্যাসধর্মী প্রতিবাদী ধর্মের পথে যাওয়াই শ্রেয়? মৌখিক পরম্পরায় ‘সূত’রা মহাভারত-এর প্রাচীন, মূল আখ্যানে হয়তো তুলে ধরেছিলেন এই সংশয়দীর্ণ ‘যুগান্তের’ পরম্পরাগত ইতিহাস। পরবর্তী কালে অবশ্য তা ব্রাহ্মণদের হাতে লিখিত রূপ পেয়েছে বহু সংযোজন-পরিমার্জনের মধ্যে দিয়ে, অনেকটাই ব্রাহ্মণ্য, বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থের আকারে— অন্তত ভি এস সুকথঙ্কর, রবার্ট গোল্ডম্যানদের গবেষণা সে রকমই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু, পরবর্তী কালে সংযোজিত, ‘শান্তিপর্ব’ বা ‘অনুশাসনপর্ব’-এর মতো উপদেশাত্মক অংশগুলিকে বাদ দিয়ে ভাবলেও, এই ইতিহাস-এর মূল আখ্যানের কেন্দ্রস্থল যেখানে কুরু-পাঞ্চাল জনপদের রাজপরিবারগুলি, সেখানে অখ্যাত অরাজতান্ত্রিক বৃষ্ণিদের নায়ক কৃষ্ণ কী করে হয়ে উঠলেন মহাভারত-এর অন্যতম বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক নায়ক?
কোনও কোনও পণ্ডিত একদা কৃষ্ণচরিত্রটিকেই মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত বলে ধরে নিয়ে কৃষ্ণবিহীন ‘মূল মহাভারত’ নির্মাণের চেষ্টা করলেও সফল হননি। কৃষ্ণভক্তির বৈষ্ণবায়িত অংশগুলি মহাভারত-এর ব্রাহ্মণায়ন প্রক্রিয়ায় সংযোজিত হয়ে থাকলেও বৃষ্ণিনায়ক কৃষ্ণ মহাভারত-আখ্যানের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য চরিত্র। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে যোদ্ধা কৃষ্ণের এক বিশেষ ধরনের কৃতিত্ব চোখে পড়ে। গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের নতুন কৃষিভিত্তিক স্থিতিশীল সমাজের অন্যতম আশঙ্কা ছিল বহিরাগত লুণ্ঠনজীবী গোষ্ঠীগুলির আক্রমণ। একশো জন বন্দি রাজার নরবলিদানে উন্মুখ মগধরাজ জরাসন্ধ, কুখ্যাত ধনসম্পদ ও নারীলুণ্ঠনকারী আসামের নরক, যাযাবর শাল্ব গোষ্ঠী, উত্তরবঙ্গের পৌণ্ড্রক বাসুদেব— কৃষ্ণের সামরিক সাফল্যের খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীরা কি এই গোষ্ঠীগুলিরই প্রতিভূ? তাঁদের, বিশেষত জরাসন্ধের বিরুদ্ধে সাফল্য কৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বাসুদেবত্বে, আর মহাভারতে বাসুদেব কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন এই যুগান্তকারী ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এক নতুন রাজনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা। মহাভারতের অন্যতম নায়ক কৃষ্ণের এই অভিনব জীবনদর্শন ও রাজনীতির শ্রেষ্ঠ প্রতিফলন ঘটেছে উদ্যোগপর্বে, যে বিষয়ে দু’-চার কথা বলে এই আলোচনায় দাঁড়ি টানব।
প্রাচীন ভারত-গ্রিস-রোমের বহু বীরত্বব্যঞ্জক মহাকাব্যের পাশে মহাভারত এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম, যেখানে যুদ্ধবীরদের কীর্তিকাহিনি থাকলেও সামরিক বীরত্বের গৌরব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। বনবাস ও অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে আসা পাণ্ডবেরা দাবি করেছেন তাঁদের হৃত রাজ্যাংশ। কিন্তু, দুর্যোধন যদি তা ফিরিয়ে দিতে রাজি না হন, তা হলে কোন পথ সঠিক? রাজ্যলোভে স্বজনঘাতী যুদ্ধ কি কাম্য? শান্তিকামনায় বিনা প্রতিরোধে অন্যায় মেনে নেওয়া কি কাপুরুষতা নয়? বর্ণবিভক্ত সমাজে যুদ্ধ তো ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, কিন্তু অহিংসা কি পরম ধর্ম নয়? রাজ্যলোভে যুদ্ধ যদি অবাঞ্ছিতও হয়, দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধের কী হবে? হিংসাত্মক প্রতিশোধে কি আদৌ ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়? এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক রয়েছে মহাভারত-এর ‘উদ্যোগপর্বে’। এই বিতর্কের এক প্রান্তে রয়েছেন দুর্যোধন— জ্যেষ্ঠপুত্রের জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ার নিরিখে যিনি কুরু সিংহাসনের দাবিদার। বৈদিক বংশানুক্রমিক বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী দুর্যোধনের কাছে যুদ্ধই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, বিনা যুদ্ধে কণামাত্র রাজ্যাংশ ছেড়ে দেওয়া অগৌরবের। পাণ্ডবদের যু্দ্ধবিমুখতা তাঁর কাছে পৌরুষের অভাব (৫.১৫৮.৯)। অন্য প্রান্তে রয়েছেন বর্ণাশ্রমে সন্দিহান, পূর্ণ অহিংসায় না হলেও সার্বিক সমানুভূতি এবং অ-নৃশংসতায় বিশ্বাসী যুধিষ্ঠির, যাঁর কাছে যুদ্ধবাদী ক্ষাত্রধর্ম গৌরবের নয়, বরং তা মাংসখণ্ডের জন্য দুই কুকুরের লড়াই এবং শক্তিশালী কুকুরের জয়লাভের সমতুল্য। যুদ্ধ সর্বদা পরিত্যজ্য, কারণ যুদ্ধ সৃষ্টি করে হত্যা ও প্রতিঘাতের এক চক্র, আর মৃতের এবং স্বজনহারার কাছে জয়-পরাজয় সমতুল্য (সর্বথা বৃজিনং যুদ্ধং কো ঘ্নন ন প্রতিহন্যতে।/ হতস্য চ হৃষিকেশ সমৌ জয়পরাজয়ৌ॥)। যুদ্ধজয় সৃষ্টি করে নতুন শত্রুতা, পরাজয় নিয়ে আসে দুঃখ, তাই জয়পরাজয়ের যুদ্ধোন্মাদনা ত্যাগী, শান্তিপ্রিয় মানুষই সুখী (জয়ো বৈরং প্রসৃজতি দুঃখমাস্তে পরাজয়ম্।/ সুখং প্রশান্তঃ স্বপীতি হিত্বা জয়পরাজয়ৌ)। কুকুরের মাধ্যমে কুকুরের, মাছের মাধ্যমে মাছের, বা ক্ষত্রিয়ের হাতে ক্ষত্রিয়ের হত্যায় গৌরব খুঁজে পাননি যুধিষ্ঠির, বীরত্বের নেশা তাঁর মতে এক ধরনের অসুস্থতা (৫.৭০.৪০-৭৪)। আশ্চর্জনক ভাবে, যুধিষ্ঠিরের সমর্থনে শোনা গেছে দুর্যোধনের মা গান্ধারীর কণ্ঠ, যখন দুর্যোধনের মত প্রতিধ্বনিত হয়েছে যুধিষ্ঠিরের গর্ভধারিণী কুন্তীর এই বিশ্বাসে যে, ক্ষত্রিয়ের জন্ম যুদ্ধের জন্যই, যুদ্ধবিমুখতা কাপুরুষতা। কী ভাবে আদর্শ ক্ষত্রিয় মা বিদুরা তাঁর অলস, যুদ্ধবিমুখ পুত্র সঞ্জয়কে যুদ্ধে প্ররোচিত করে হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করিয়েছিলেন, সেই কাহিনি শুনিয়ে যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধে উৎসাহ দিয়েছেন কুন্তী (৫.১৩০-১৩২)। যে কোনও মূল্যে নিজের অপমানের প্রতিশোধের জন্য যুদ্ধ চেয়েছেন দ্রৌপদী, যে বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন সহদেব (৫.৭৯-৮০)। এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ‘উদ্যোগপর্বের’ নায়ক কৃষ্ণের অবস্থান কী?
কৃষ্ণের কথায় বার বার উঠে আসে একমাত্রিক নৈতিকতার বদলে রাজনৈতিক ও দার্শনিক বহুত্ববাদ। প্রত্যেক অনমনীয় অবস্থানকেই তিনি শোনান ভিন্ন স্বরের সম্ভাবনা। যুধিষ্ঠিরের শান্তিপ্রিয়তার বিপরীতে তিনি শুধু ক্ষাত্রধর্মের বাঁধা বুলিতে সীমাবদ্ধ থাকেননি, মনে করিয়ে দিয়েছেন কখন প্রতিরোধ নৈতিক প্রয়োজন: “ধর্মরাজ অধর্মের পথে দেবলোকের রাজত্বও আকাঙ্ক্ষা করেন না, কিন্তু ধর্ম ও অর্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে একটি গ্রামের অধিকারের জন্যও সচেষ্ট হবেন (৫.১.১৪)”। এই ধর্ম শাসকের ধর্ম, যে ধর্ম পেশিশক্তি বা ছাতির মাপের গরিমায় উগ্র রাষ্ট্রবাদী আগ্রাসনের চেয়ে অনেক আলাদা। ধৃতরাষ্ট্রের দূত সঞ্জয়ের অন্তঃসারশূন্য শান্তিপ্রস্তাবে যুধিষ্ঠিরের জন্য যুদ্ধবিরোধী উপদেশ থাকলেও ছিল না দুর্যোধনের তরফে কোনও প্রতিশ্রুতি। এর উত্তরে তাই কৃষ্ণ বলেন, “চোর সবার অলক্ষে অন্যের সম্পদ হরণ করে, অন্যরা (আগ্রাসী শাসক) সর্বসমক্ষে, বলপূর্বক তা-ই করে। উভয়েই অপরাধী। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আলাদা কী করে? (৫.২৯.২৮)” আবার যুদ্ধোন্মুখ দুর্যোধনের সামনে কৃষ্ণ জোর দেন শান্তি ও অহিংসার সাধারণধর্মে, ক্ষত্রিয়ের বর্ণধর্মে নয়।
কৃষ্ণ বর্ণধর্মের বিরোধিতা করেননি। কিন্তু, গীতায় শোনা যায় চাতুর্বর্ণ্যের ভিত্তি জন্ম নয়, গুণ ও কর্মের বিভাজন (৬.২৬.১৩)। গীতায় গুণ বলতে বোঝায় সাত্ত্বিক (সদাচার), রাজসিক (কর্মৎপরতা) ও তামসিক (অকর্মণ্যতা), সাংখ্যদর্শনে কথিত প্রকৃতিজাত এই তিন প্রবণতা, যাদের ভারসাম্য নির্ধারণ করে কোনও মানুষের ‘স্বভাব’ আর এই স্বভাব থেকেই নির্দিষ্ট হয় ‘স্বধর্ম’। এই স্বধর্মপালন সমাজের অংশ হিসাবেই প্রত্যেকের কর্তব্য, কোনও স্বার্থসিদ্ধি বা স্বর্গলাভের আশায় নয়। যেমন কোনও ফলের প্রত্যাশা ছাড়াই সূর্য-চন্দ্র তাদের ভূমিকা পালন করে, নদী বয়ে যায়, পৃথিবী আশ্রয় দেয় জীবজগৎকে, বিশ্বসংসারে নিজের অংশটুকু সে ভাবে পালনই কর্মের উদ্দেশ্য (৫.২৯.৬-১৪)। ‘উদ্যোগপর্ব’-এর এই অবস্থানই আরও বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হবে গীতা-য়, যখন সন্ন্যাসপন্থী নিবৃত্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ কর্মত্যাগকে অসম্ভব বলে নস্যাৎ করে দেওয়ার পাশাপাশি (৬.২৫.৫), স্বর্গলাভের কামনায় বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানকেও কঠোর সমালোচনা করবেন কৃষ্ণ (৬.২৪.৪২-৪৪), ঘোষণা করবেন, মানুষের অধিকার তার কর্তব্য কর্মেই, কাঙ্ক্ষিত ফলে নয়, কর্মবিমুখতায় তো নয়ই: “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন/ মা কর্মফলহেতুর্ভুর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি (৬.২৪.৪৭)। ‘নিষ্কাম কর্ম’-এর এই তত্ত্বের কারণেই স্বভাবযোদ্ধা ভীমের মুখে হঠাৎ শান্তির বাণীকে কৃষ্ণ সাময়িক ভীরুতা হিসাবে উপহাস করেছেন, ক্রমাগত বিদ্রুপে উদ্বুদ্ধ করেছেন স্বধর্মপালনে (৫.৭৩.১৫-২৩)। আজীবন যুদ্ধ করে আসা অর্জুন শুধু দুই পক্ষেই স্বজনহানির আশঙ্কা ও কুলক্ষয়ের আশঙ্কা দেখে যুদ্ধবিমুখ হলে, কৃষ্ণের তা মনে হয়েছে পরিত্যজ্য হৃদয়-দুর্বলতা (৬.২৪.৩)। যাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু মামা কংসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে, শেষ তাঁরই শক্তিতে বলীয়ান উদ্ধত যাদবদের ধ্বংসে, তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে স্বজনপোষণের স্থান নেই, কর্তব্যের স্থানই সর্বোচ্চ। বৌদ্ধ ‘ঘট জাতক’-এ ঘটপণ্ডিত, জৈন পরম্পরায় তীর্থঙ্কর নেমিনাথ কৃষ্ণের কর্মযোগী দর্শনের বিপরীতে নিবৃত্তির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন। ‘বুদ্ধচরিত’-এ দুঃখনিবৃত্তির উপায়ের খোঁজে দৃঢ়সঙ্কল্প সিদ্ধার্থকে প্রলুব্ধ করে জাগতিক কর্মে ফেরাতে চাওয়া ‘মার’-এর মুখে তো প্রায় সরাসরি গীতা-র উক্তি বসিয়েছেন অশ্বঘোষ। কিন্তু, উল্লেখযোগ্য ভাবে সমস্ত পরম্পরাতেই কৃষ্ণের কর্মযোগী সত্তা স্বীকৃত। এই দর্শনে স্বভাব ও স্বধর্মের বহুমুখিনতা প্রতিষ্ঠিত, তাই একান্ত জরুরি ভিন্ন স্বরের প্রতি সম্মান। ভীম-অর্জুনের সাময়িক স্বভাববিরোধী যুদ্ধবিমুখতাকে সাময়িক দুর্বলতা বলে চিনলেও, স্বভাবগত ভাবে অনৃশংস যুধিষ্ঠিরের শান্তিকামনার প্রতি সশ্রদ্ধ কৃষ্ণ তাই শান্তিদূত হিসাবে যাত্রা করেন হস্তিনাপুরে। কর্ণ যে কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র, এই সত্য জানিয়ে কর্ণকে পাণ্ডবশিবিরে যোগদান ও রাজপদ-গ্রহণের প্রস্তাব দেন। তার পরেও কর্ণ যখন বেছে নেন তাঁর সামাজিক অবস্থানের বদলে দক্ষতাকে মর্যাদা দেওয়া দুর্যোধনের আস্থা ও বিশ্বস্ততা রক্ষার জন্য মৃত্যুবরণ, কৃষ্ণ তাঁকে অভিনন্দন জানান (৫.১৩৯)।
এই বিভিন্ন মত, নানা স্বধর্মের মধ্যে ভারসাম্যরক্ষাকারী কৃষ্ণের স্বধর্ম কি? এর ধারণাও পাওয়া যায় ‘উদ্যোগপর্বে’। কৃষ্ণ জানতেন তাঁর দৌত্য ব্যর্থ হবে। নিশ্চিত যুদ্ধের মুখে শান্তিদূত হিসাবে শত্রুশিবিরে যাওয়া বিপজ্জনকও বটে। তবুও কেন কৃষ্ণের দৌত্য? বিদুরের প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণ জানান, “ক্ষত্তা, আমি নিশ্চিত যদি কেউ নিজের সর্বাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ধর্মসাধনে ব্যর্থ হয়, তবুও সে ধর্মপালনের পুণ্যলাভ করে… তাই আমিও কোনও ভণিতা ছাড়াই ধ্বংসের মুখে যাওয়া কুরু ও সৃঞ্জয়দের (পাঞ্চালদের) মধ্যে যুদ্ধ থামিয়ে শান্তিস্থাপন করতে চেষ্টা করব… প্রাজ্ঞজনে জানেন, সঙ্কটাপন্ন বন্ধুকে রক্ষা করতে যে ছুটে যায় না, তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে না, সে নিষ্ঠুরতার দোষে দোষী। বরং তুমি যদি চুলের মুঠি ধরেও কোনও বন্ধুকে অপরাধ করা থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করো, তোমায় কেউ দোষ দিতে পারবে না, কারণ তুমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছ (৫.৯১.৫-১১)”। যা সর্বৈব নির্ভুল, যেমন যুদ্ধপ্রতিরোধ ও শান্তিস্থাপনে, তা প্রতিষ্ঠায় আপ্রাণ চেষ্টাই কৃষ্ণের দর্শনের ভিত্তি, তার ফল সার্থক হোক বা ব্যর্থ। তাই কৃষ্ণের রাজনৈতিক দর্শনে সততা অপরিহার্য। ধৃতরাষ্ট্রে হস্তিনাপুরে কৃষ্ণকে স্বাগত জানাতে বিপুল ধনসম্পদ, বিলাসসামগ্রী, গণিকাদের সম্ভারের আয়োজন করলেও, কৃষ্ণ তা প্রত্যাখ্যান তো করেনই (৫.৮৩-8), দুর্যোধনের নিমন্ত্রণ গ্রহণেও অসম্মত হন তিনি। কারণ জানান, দৌত্যকর্ম সফল হলে তবেই দূত আতিথ্যগ্রহণ করতে পারেন, তার আগে নয়। তার পরেও অন্তত নিমন্ত্রণ গ্রহণের জন্য দুর্যোধনের পীড়াপীড়ির উত্তরে তিনি জানিয়ে দেন, খাদ্যগ্রহণ করা যায় হয় প্রীতির সম্পর্কে, নয় বিপদে। কিন্তু দুর্যোধনের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রীতির সম্পর্কও নয়, আর তিনি বিপদেও পড়েননি (৫.৮৯.১৮-২৫)। অথচ, এই দুর্যোধনের নেতৃত্বাধীন কুরুরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার জন্য প্রতিবেশী পাঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদের অতিরিক্ত উৎসাহকেও কিন্তু ভাল চোখে দেখেননি কৃষ্ণ। বলেছেন, সমস্ত শান্তিপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তবেই যুদ্ধের সম্ভাবনা বিচার্য। মনে করিয়ে দিয়েছেন, কৌরব ও পাণ্ডবদের প্রতি সমদৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা (৫.৫.১-১০)। দ্রুপদকে দেওয়া উপদেশ কৃষ্ণকেও পালন করতে দেখা যায় যখন সাহায্যপ্রার্থী দুর্যোধনকেও ফিরিয়ে দেন না তিনি, তাঁর হাতে তুলে দেন তাঁর ‘নারায়ণী সেনা’। কৃষ্ণের রাজনৈতিক দর্শনে সততার ভিত্তি সম্ভবত প্রতিষ্ঠিত এই সমতার আদর্শেই। তাই গীতা-য় শোনা যায় সম-দৃষ্টি পণ্ডিতের লক্ষ্মণ (৬.২৭.১৮), শত্রু-মিত্র, নিন্দা-প্রশংসা, মান-অপমান নির্বিশেষে এই সমতার অভ্যাসই করণীয় (৬.৩৬.২৪-২৫)। বস্তুত, কৃষ্ণের দৃষ্টিতে, সমতার অনুশীলনই যোগ: সমত্বং যোগ উচ্যতে (৬.২৪.৪৮)।
রামায়ণ-মহাভারত এবং সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে বাজার গরম করা রাজনীতির এখন অভাব নেই। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ, স্বার্থসর্বস্ব নীতিহীনতা, প্রতিপক্ষীয় নেতাদের মধ্যে গোপন ‘সেটিং’, ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, বহুত্বকে মুছে একীকরণের চেষ্টা, আগ্রাসী হিংস্র উগ্র রাষ্ট্রবাদ যখন বার বার উঠে আসে আলোচনায়, প্রশ্ন জাগে, মহাভারত-এ এক অন্য রকম রাজনীতির প্রবক্তা বাসুদেব কৃষ্ণকে আমরা মনে রেখেছি কি?
(বন্ধনীভুক্ত সংখ্যাগুলি পুণার ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত মহাভারত-এর ক্রিটিকাল এডিশনে পর্ব, অধ্যায়, ও শ্লোকসংখ্যার নির্দেশক।)