মঞ্চে রবিশঙ্কর থেকে জোয়ান বায়েজ

এই ছেলেমেয়েগুলি উচ্ছৃঙ্খল। গাঁজা টানে, হিপি গোছের। নিজের দেশ আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলে। এরা করবে গানমেলা? প্রশাসন থেকে সংবাদমাধ্যম সবাই ওদের বিরুদ্ধে। শেষ অবধি একটা ডেয়ারি ফার্মে জায়গা মিলল। সেই উডস্টক গানমেলার এ বারেই পঞ্চাশ বছর। দ্বৈপায়ন মজুমদার তেমন বড় কোনও বিপর্যয় কিন্তু হয়নি উডস্টকের এই তিন দিনে। বরং মারিজুয়ানার নেশা যে প্রজন্মকে ধ্বংস করেছে বলে প্রবল অভিযোগ ছিল, তারা হাসতে হাসতে ভালবেসে এক সঙ্গে কাটিয়েছে এতটা সময়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

গানওয়ালা: উডস্টক ফেস্টিভ্যালের প্রথম দিনে মঞ্চে ডেভিড ব্রাউন।

সালটা ১৯৬৯। নিউইয়র্ক শহর থেকে একটু দূরে বেথেলের মাঠে বসেছে জমজমাট গানের আসর। জায়গাটা উডস্টকের কাছেই। একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা অর্থাৎ তিনটে দিন তিনটে রাত জুড়ে চলছে গানমেলা। যেমন তেমন মেলা নয়, এই মেলা শান্তির জন্য সঙ্গীতের উৎসব। খোলা আকাশের নীচে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গানের নেশায় ডুব দিয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। সারা পৃথিবীকে বিস্মিত করছে উডস্টকের এই গানমেলা।

Advertisement

মাইকেল ল্যাং, জোয়েল রসেনম্যান, জন রবার্টস এবং আর্টি কর্নফিল্ড— এই চার জন মূল উদ্যোক্তা উডস্টকের সঙ্গীত উৎসবের। সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপনে মাইকেলরা জানিয়েছিলেন তিন দিন ধরে চলবে শান্তি আর গানের উডস্টক উৎসব। বিজ্ঞাপনে অবশ্য একটা জব্বর ক্যাপশন দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা— ‘অ্যান অ্যাকুয়ারিয়ান এক্সপোজ়িশন : থ্রি ডেজ় পিস অ্যান্ড মিউজিক’। ব্যস, প্রচার বলতে এইটুকুই। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম তখন অন্য গ্রহের জিনিস।

শুরুর দিকে আর পাঁচটা অনুষ্ঠানের মতোই গান ঘিরে উডস্টকের এই উৎসবের উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায়িক। তবে দিন-রাতের টানা অনুষ্ঠানের জন্য প্রথম সমস্যা ছিল জায়গার অভাব। উদ্যোক্তারা তখন একাধিক জায়গায় অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলেন, সফল হলেন না। বরং জায়গা মিললেও অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিল হয়। এতে অবশ্য এক দিক দিয়ে লাভ হয়। অনুষ্ঠান নিয়ে কৌতূহল বাড়তে থাকে। অবশেষে ম্যাক্স ইয়াসগারের ডেয়ারি ফার্মের জমিতে মেলে অনুষ্ঠানের জায়গা। অবশ্য তাতেও প্রতিবাদ শুরু হয় শহরবাসীর। দাবি ওঠে, ম্যাক্সের ডেয়ারি থেকে কেউ দুধ কিনবে না, বন্ধ হোক এই হিপি সংস্কৃতি।

Advertisement

প্রথমে বিশেষ কেউ আগ্রহ দেখাননি এই উৎসবে আসার জন্য। ‘ক্রেডেন্স ক্লিয়ারওয়াটার রিভাইভ্যাল’ ছিল প্রথম নামকরা ব্যান্ড যাদের সঙ্গে চুক্তি হয় উদ্যোক্তাদের। ক্রেডেন্স-এর পর অবশ্য অনেকেই অনুষ্ঠান করতে রাজি হন। একের পর এক বাধা পেরিয়ে দিন যত এগোল, উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। এই বিশাল উদ্দীপনা তাঁদের কল্পনার বাইরে। টিকিট বিক্রি পরের কথা, এত লোক সামলাবেন কী করে? আগাম টিকিট বিক্রি দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এত মানুষ হাজির হলেন এই গানের উৎসবে যে এটা প্রায় বিনামূল্যের অনুষ্ঠানে পরিণত হলো। এমনিতেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বিশ্ব জুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তখন গানের ভাষা বদলে দিয়েছে। আমাদের দেশেও আছড়ে পড়ছে অতি-বাম আন্দোলনের ঢেউ। তৈরি হচ্ছে অসংখ্য নতুন গান। জোয়ান বায়েজ-এর মতো শিল্পীদের গানের চাহিদা মার্কিন মুলুকে তখন তুঙ্গে। কিন্তু এ সবেরও বাইরে অন্য কিছু চাইছে মানুষ। কোথাও গিয়ে যেন পথ হারাচ্ছেন অনেকেই। সামগ্রিক হতাশা চেপে বসছে একটা গোটা প্রজন্মের উপর।

বেশ কিছু মানুষ তখন প্রাচ্যের অধ্যাত্মবাদে খুঁজে যাচ্ছেন মুক্তির দিশা। অনেকের মনেই শুরু হয়েছে নিজেকে জানার চেষ্টা। কে আমি? কেন আমি? আত্ম-অন্বেষণের প্রবণতা। বিশ্বমানবতার টান অনুভব করছে সমগ্র প্রজন্ম। তাই শুধু কান্ট্রি সং, যুদ্ধবিরোধী গান দিয়ে এত মানুষের শান্তির খোঁজ প্রায় অসম্ভব। উডস্টকের শিল্পীদের তালিকাও ছিল বেশ চমকে দেবার মতো। আসলে বিভিন্ন ধারার, বিভিন্ন চিন্তার গানের একটা সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন মাইকেলরা। আর তাই কোনও খামতি ছিল না আয়োজনের। গানের শব্দ ঠিক ভাবে এই বিপুল সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বিল হেনলি-র তত্ত্বাবধানে সংলগ্ন পাহাড়ে বসেছিল বিশেষ স্পিকার।

প্রথম দিনের শুরুতেই চমক। অন্য পাঁচটা অনুষ্ঠানের মতো নয়, শুরু হল আধ্যাত্মিক যোগগুরু স্বামী সচ্চিদানন্দের ভাষণে। শুরুতেই অন্য তারে বাঁধা হল অনুষ্ঠান। তার পর চলতেই থাকল ভালবাসার এই উৎসব। প্রথম দিনের শেষের দিকে স্টেজে এলেন এমন এক জন, যিনি তখন প্রতিবাদের মুখ। তাঁর গান তখন ছড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের আগুন। দিনশেষে মঞ্চে জোয়ান বায়েজ মানেই বাড়তি পাওনা।

কত লোক এল এই ভালবাসা আর শান্তির আহ্বানে? আনুমানিক প্রায় চার লাখেরও বেশি। ব্রিগেডে দলের সভায় বাস ভরিয়ে স্লোগান দিয়ে নেতা-নেত্রীর বক্তব্য শেষ হয়ে গেলেই কোনও মতে কেটে পড়া ভিড় নয়, বরং তিন-তিনটে দিন আর রাত বৃষ্টিমুখর পরিবেশে খোলা আকাশের তলায় লাখ লাখ লোক। বৃষ্টির মধ্যেই ১৫ থেকে ১৭ অগস্ট ১৯৬৯, অনুষ্ঠিত হল শান্তির জন্য গানের এই উৎসব। আরও ভাল ভাবে বলতে গেলে, নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে অনুষ্ঠান ছাপিয়ে যায় ১৮ অগস্ট সকাল পর্যন্ত।

তেমন বড় কোনও বিপর্যয় কিন্তু হয়নি উডস্টকের এই তিন দিনে। বরং মারিজুয়ানার নেশা যে প্রজন্মকে ধ্বংস করেছে বলে প্রবল অভিযোগ ছিল, তারা হাসতে হাসতে ভালবেসে এক সঙ্গে কাটিয়েছে এতটা সময়। কোনও ঝামেলা নেই, হাতাহাতি নেই, নেই মারামারি। বরং ওই পরিবেশেই জন্মেছিল শিশু। ভিড় দেখে নিউইয়র্কের তৎকালীন গভর্নর বন্দোবস্ত করলেন বিশাল সুরক্ষা বাহিনীর। কিন্তু উদ্যোক্তারা তাঁকে বলেন, গানের মাধ্যমে শান্তির আহ্বানের অনুষ্ঠানে এই সুরক্ষা বলয় অপ্রয়োজনীয়। এতে অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হবে। দুটো দুর্ঘটনা অবশ্য হয়েছিল। ইনসুলিন ওভারডোজ়ে এক জন মারা যান আর এই গান মেলার কাছেই ট্রাক্টরের নীচে চাপা পড়ে আর এক জনের মৃত্যু হয় বলে খবর ছিল।

কে না ছিলেন শিল্পীদের তালিকায়! জোয়ান বায়েজ থেকে শুরু করে সান্টানা, রবিশঙ্কর থেকে জিমি হেনড্রিক্স। তিন দিনে একটানা তিরিশের বেশি পারফরম্যান্স হয়েছিল এই সঙ্গীত উৎসবে। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেও খালি হয়ে যায়নি মাঠ। অনুষ্ঠান শেষ হয় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক অনেক পরে। তৃতীয় রাত টপকে চতুর্থ দিন সোমবার সকালেও শেষ গায়ক জিমি হেনড্রিক্সের গান গাওয়ার সময় মাঠে অসংখ্য মানুষ। প্রায় তিরিশ হাজার শ্রোতা!

বেশ কিছু শিল্পী অবশ্য এই অনুষ্ঠানে আসেননি বা আসতে চাননি। সেই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী বব ডিলান তার মধ্যে অন্যতম। যদিও অনুষ্ঠান থেকে খুব একটা দূরে ছিল না ডিলানের আস্তানা। কিন্তু তিনি ব্যস্ত ছিলেন ইংল্যান্ডের এক অনুষ্ঠান নিয়ে। আবার ‘দ্য ডোর্স’-এর মতো জনপ্রিয় ব্যান্ড অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা আন্দাজ করতে না পেরে প্রস্তাব ফিরিয়েছিল। পরে ব্যান্ডের এক সদস্য স্বীকার করেন, উৎসবের এই ব্যাপকতা তাঁরা আন্দাজ করতে পারেননি।

তবে বেশির ভাগ সংবাদপত্রের প্রাথমিক প্রতিক্রয়া খুব ভাল কিছু ছিল না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মতো সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয় কলমে এই গান মেলাকে হিপিদের ‘মারিজুয়ানা সংস্কৃতির উচ্ছৃঙ্খলতার প্রকাশ’ বলে মনে করে। একই সুরে কথা বলে যানবাহন পরিষেবার অসুবিধের কথা তুলে ধরে ‘ডেলি নিউজ়’। তবে ‘টাইমস হেরাল্ড রেকর্ড’ শুরু থেকেই অনুষ্ঠানের কথা লিখে গিয়েছে। এমনকি প্রথম দিকে অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিলের বিপক্ষ সুরও ছিল তাদের পাতায়। অবশ্য উৎসবের কিছু দিন পরেই নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাতাতেও ছিল প্রশংসা।

উডস্টকের গান-উৎসব শেষে মাইকেল ল্যাংদের ভাল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সামনে পড়তে হয়। অবশ্য পরের বছর এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং থেকে তৈরি হওয়া তথ্যচিত্রের পথ ধরে আসে ব্যবসায়িক সাফল্যও। উদ্যোক্তারা ক্ষতির ধাক্কা সামলে দেখতে পান লাভের মুখ। কিন্তু নিছক ব্যবসায়িক লাভক্ষতি দিয়ে উডস্টককে মাপতে যাওয়া বিরাট ভুল। উডস্টক নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রের পরে সম্মানমুকুটে যোগ হয় অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের পালকও। ২০০৯ সালে উডস্টকের চল্লিশ বছর উপলক্ষে তৈরি হয় ‘টেকিং উডস্টক’ নামের আর একটি তথ্যচিত্র। নিউইয়র্কের নিউলেবানন অঞ্চল ভাড়া নেওয়া হয় এই কাজের জন্য। স্থানীয় মানুষের অভূতপূর্ব সহযোগিতা পান নির্মাতার।

এতগুলো বছর আগে, যখন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো প্রচারের হাতিয়ার ছিল না, প্রচার বলতে খবরের কাগজে কিছু বিজ্ঞাপন আর লোকমুখের ভরসা, সেখানে এত জনসমাগম হল কোন ম্যাজিকে? কোন চুম্বক ছিল ওই উডস্টকে? কী এমন টান, যেখানে খোলা আকাশের নীচে তিন দিন তিন রাত কাটাতে এতগুলো মানুষ ছুটে এল? এই প্রচারসর্বস্ব যুগে অনেক রকম সুবিধা দিয়েও রাজনৈতিক দলকে ব্রিগেডে লোকসমাগম করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। সেখানে আজ থেকে অর্ধশতক আগে, টিকিট কেটে গান শুনতে হবে জেনেও প্রথম বিশ্বের এক দেশে সব কাজ ফেলে অসংখ্য মানুষ জড়ো হল কেন? কেনই বা দরকার হল প্রাচ্যের অধ্যাত্মচর্চা, রাগসঙ্গীত?

হয়তো এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে উত্তর। আসলে একটা বিধ্বস্ত সময় থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিল অনেক মানুষ। হিপি কালচার তখন আমেরিকার সীমানা টপকে সারা দুনিয়াতে পাড়ি জমাচ্ছে। কাজ একটাই, ভালবাসা আর শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। ওই সময় একটা অন্য পথের সন্ধানে ছিলেন অনেকেই। বিটলস-এর জর্জ হ্যারিসনের কথা হয়তো মনে পড়তে পারে। খ্যাতির শিখর থেকে হঠাৎ মানুষটা প্রাচ্য সঙ্গীত, আধ্যাত্মিকতায় মন দিলেন। কেন? কারণ হয়তো আত্ম অন্বেষণ। অনুষ্ঠানের জমির মালিক ম্যাক্স ইয়াসগার-এর কথায়, উডস্টকের ওই তিন দিন ছিল শান্তি আর ভালবাসার বিজয়ের দিন।

পঞ্চাশ বছর পরেও উডস্টক গানের উৎসব তাই আজও এক বিস্ময়। যুদ্ধবিধস্ত দুনিয়াতে প্রথম বিশ্বের এতগুলো মানুষ এক সঙ্গে ভিজতে ভিজতে খোলা আকাশের নীচে কাটিয়েছিল, ভালবাসায় আর গানে। আজ যখন বিদ্বেষের অস্থিরতায়, ধর্মের লড়াইয়ে ক্লান্ত এই পৃথিবী, তখন উডস্টকের মতো গান মেলার অভাব বড্ড বুকে বাজে। এখনও শিল্পীরা রয়েছেন, অসংখ্য গানও তৈরি হচ্ছে। তবুও কেন হয় না আর একটা উডস্টক?

একটা চেষ্টা অবশ্য হয়েছিল পঞ্চাশ বছরে উডস্টক গানমেলাকে ফিরিয়ে আনার। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও। কাজও এগিয়েছিল। কিন্তু এই বছর জুলাই শেষে জানা গিয়েছিল, ফিরছে না উডস্টক গানমেলা। নীরবেই পেরিয়ে গেল চিরস্মরণীয় সঙ্গীত উৎসবের পঞ্চাশ বছর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement