ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
বাড়ি কোথায় আপনার?” জিজ্ঞেস করি আমি। “রানাঘাট দাদা, চেনেন?” হেসে উত্তর দেয় সঞ্জিত। ডাউকিতে কর্মরত বিএসএফ জওয়ান।
“হ্যাঁ, চিনি। আমার মাসির বাড়ি ওখানে। তা কত দিন হল এখানে?”
“এই দাদা, বছর দেড়েক।”
এ বার শীতে উত্তর-পূর্ব ভারত ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছেছি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এই লেকের ধারে। ও দিকের পাখি উড়ে আসছে এ দিকে, এ দিকের জল বয়ে যাচ্ছে সীমানার ও পারে। কিন্তু এ দেশের মানুষ ভুলবশত ও পারে পা রেখে ফেললে এ দিকে শোনা যাচ্ছে “সাব, উস তরফ বাংলাদেশ হ্যায়, মত যাও” আর ও দিকে শোনা যাচ্ছে, “জনাব, ও দিক পানে জায়েন না, ওটা ইন্ডিয়া।”
এই বিভাজনের তদারকিতে নিযুক্ত এ পারের সঞ্জিত পাল বা ও পারের ইসমাইল।
ডাউকি লেকে নৌকোবিহারের পর আমি, আমার স্ত্রী আর কন্যা ওখানেই ঘোরাঘুরি করছিলাম, ছবি তুলছিলাম। ঠিক তখনই সীমান্তের ও পার থেকে চিৎকার, “সঞ্জিতভাই, জামিরমিয়াঁ আসতাসে।”
বললেন ও পারের ইসমাইল।
“কেন ভাই, তোমার ডিউটি শেষ?” জানতে চায় সঞ্জিত।
“হ্যাঁ ভাই। এ বার মিয়াঁর ডিউটি শুরু। সামলাও...” বলেই প্রহরীটি হেসে চলে যায় তাদের ছাউনির দিকে। তার জায়গায় যে মানুষটি উপস্থিত হন, তিনি সঞ্জিতের চেয়ে বয়সে বেশ খানিকটা বড়ই। কঠিন মুখ, সুঠাম চেহারা, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বুকের বাঁ দিকে পকেটের ওপর নাম লেখা। জামির হোসেন।
“সুপ্রভাত, জামিরভাই!” বলে তার দিকে তাকিয়ে হাসে সঞ্জিত।
“সুপ্রভাত,” গম্ভীর গলায় উত্তর দেয় জামির।
“কী ব্যাপার জামিরভাই? বড় গম্ভীর দেখছি?”
“নিজের চরকায় তেল দেও দেখি! আমার কথা ভাবতা হইব না!” তিরিক্ষি উত্তর জামিরের।
কথার ধরন শুনে অবাক হলাম। জামির সরে যেতেই তাকালাম সঞ্জিতের দিকে, “কী ব্যাপার? উনি রেগে আছেন কেন? কিছু হয়েছে?”
“না দাদা, তেমন ব্যাপার নয়. খুব ভাল মনের মানুষ এই জামিরভাই।”
আমার তেমন মনে হল না। যেমন বাজখাঁই গলা, তেমনই মেজাজ। দুই দেশের মধ্যে অনুপ্রবেশ সমস্যা আছে বলেই হয়তো অতি সাবধানী, কে জানে! মাথা না ঘামিয়ে সঞ্জিতের সঙ্গেই গল্প জুড়লাম।
গল্প করতে করতেই সঞ্জিত মাঝে মাঝে সীমানা বরাবর এক বার করে হেঁটে আসছে। খেয়াল রাখছে, যাতে কেউ সীমান্তের ও পারে পা না দিয়ে ফেলে। এমন সময় ঝামেলা করল আমার মেয়ে ঐন্দ্রিলা। তার হঠাৎ ঝালমুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে হল। কিন্তু সমস্যা হল, এ দেশের ভূখণ্ডে কোনও মুড়িওয়ালা নেই। চার জন মুড়িওয়ালাই সীমান্তের ওপারে।
ঐন্দ্রিলা সঞ্জিতের কাছে পৌঁছে বলল, “কাকু, মুড়ি আনতে ও দিকে যেতে পারি কি?”
সঞ্জিত ঘাড় নাড়ল, “না মা, ও দিকে তো যাওয়া যাবে না।”
এর মধ্যে যে কখন জামিরমিয়াঁ আবার এসে দাঁড়িয়েছে, লক্ষ করিনি। খেয়াল হল ওঁর গলার আওয়াজে, “তুমি কে হে মানা করার? ওরে মানা করো ক্যান? ভাবো কী নিজেরে?”
“না মানে, ও দিকে যাবে কী করে...” মিনমিন করে বলে সঞ্জিত।
“থামো তুমি!” বলেই আমার মেয়ের দিকে তাকায় জামির, “তুই আয় তো মা। আয় আমার লগে। দেখি কে আটকায়। একটু মুড়িই তো খাইতে চায়, তা উনি আইন দেখাইছেন!”
সঞ্জিত হেসে তাকায় আমার মেয়ের দিকে। ইশারা করে জামিরমিয়াঁর সঙ্গে যেতে। আমার মেয়েও নাচতে নাচতে চলে যায় সীমানা পেরিয়ে মুড়ি আনতে। অবাক লাগে আমার। কী রকম মানুষ এই জামির কে জানে! সীমানার কাছাকাছি কেউ ভুল করে এসে পড়লে তাকে ধমক দিচ্ছে, এ দিকে নিজেই উপযাচক হয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে গেল সীমানার ও ধারে।
আমার মেয়ের তো খুব আনন্দ। ধন্যবাদ জানিয়ে এ দিকে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে মুড়ি খেতে লাগল।
“জামিরভাই, বড় বেআইন করলে তুমি!” হেসে খোঁচা দেয় সঞ্জিত। ব্যস, আর যায় কোথায়! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে জামির, “বেশি ডিউটি দেখাইও না পালভাই! তোমার কিত্তি আমার জানতে বাকি নাই। তোমার কিত্তি শুনলে না, সকলে ছ্যা ছ্যা করবে, বুঝলা। আবার কথা কও! শরম লাগে না তোমার?”
এই চিৎকার দু’পাশের বহু পর্যটকের কানেই পৌঁছেছিল। তারাও অবাক হয়ে তাকাল। সেই দেখেই বোধহয় জামির হোসেন গলা নামিয়ে ফেলল। সকলেই ভেবেছিলেন হয়তো ঝগড়া হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ সব কিছু থেমে যেতে কেউ আর মাথা ঘামাল না। কিন্তু আমার কৌতূহলটা রয়েই গেল। সঞ্জিত পাল কী এমন করেছে, যা জানলে সকলে ছি ছি করবে?
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যাই সঞ্জিতের দিকে, “কী ব্যাপার সঞ্জিতভাই? উনি কী বলছেন?” জিজ্ঞেস করি আমি।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই মুখ খোলে সামনে দাঁড়ানো জামির হোসেন, “ও কী কইবে আপনারে? কওনের মুখ আছে ওর?”
আমি আবারও অবাক হই। ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হয় না। যুগপৎ এক বার সঞ্জিতের দিকে, আর একবার জামিরের দিকে তাকালাম।
“আপনি জানেন স্যর ওর কিত্তি?” বলে ওঠে জামির।
“কী কীর্তির কথা বলছেন জামিরমিয়াঁ?” জানতে চাই আমি।
“আর কী কই আপনারে? জানেন স্যর, ঘরে ওর ছোট বোন আছে। বিয়ার ঠিক করনের লগে ওর মা চিঠি দিছিল সঞ্জিতরে। তা ও গেলই না। ডিউটি দেখায়! কী দায়িত্ববোধ ভাবেন এক বার! বোনের বিয়া ঠিক করতে বড়ভাই যাবে না? বলেন তো!”
আমি সঞ্জিতের দিকে তাকাই।
“আসলে দাদা ছুটি...” কিছু বলতে চায় সঞ্জিত। মাঝপথেই তাকে কথা থামাতে হয় জামিরের ধমকে।
“বেশি কাজ দেখাইও না পালভাই। তাও আসল কথা জানাই নাই স্যররে। শরম লাগে না তোমার?”
আমার স্ত্রী, মেয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেখলাম সঞ্জিতের মুখটা একটু মলিন।
“কত বড় বদমায়েশ ওই পাল, আপনি জানেন স্যর? কইব না কি পালভাই? আসল কথা কইব?” বলে ওঠে জামিরমিয়াঁ।
“কী ব্যাপার জামিরমিয়াঁ? কী বলবে?” জানতে চাই আমি।
“আর কন ক্যান স্যর! বোনের বিয়া ঠিক করনের লগে তো গেল না। ওর বয়স্ক মা-বাপরেই করতে হল সব। এ দিকে পরশু ওর বোনের বিয়া। ছুটির দরখাস্ত করে নাই, জানেন? জিগাইলে কয়, ‘এই সবে ছয় মাস আগে ছুটি নিলাম আবার ছুটি লইব কী কইর্যা।’ ইদিকে সবার আড়ালে বোনের লগে চোখের পানি ফেলে। ডিউটি দেখায়। আপনিই কন স্যর এইটা কি ঠিক করতাসে?”
আমরা সবাই হতবাক। সঞ্জিতের বোনের বিয়ে, কিন্তু সে এখানে। শত শত মাইল দূরে! সঞ্জিতের মুখটা দেখে বড়ই মায়া হল। কিন্তু কী বলেই বা সান্ত্বনা দেব! মিনিট পাঁচেক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই। ঠিক সেই সময় আমাদের অবাক করে দিয়ে ডাউকির বিএসএফ ক্যাম্পের চিফ অনিল দাস সেখানে এলেন।
“সঞ্জিত!”
“হ্যাঁ, স্যর।”
“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। তোমার সাত দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। বোনের বিয়ে, ঘুরে এস।”
“কিন্তু স্যর, আমি তো...”
“আমাদের তো তুমি বলোনি। কয়েক দিন আগে জামিরমিয়াঁ আমাকে বলেছিল কথাটা। নাও তোমার ফ্লাইট টিকিট।”
হতবাক সঞ্জিত নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বিস্ফারিত নেত্রে তাকায় জামিরের দিকে।
“খাড়াও পালভাই, খাড়াও...” বলেই জামিরমিয়াঁ ছুটল ক্যাম্পের দিকে। দু’মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল। হাতে একটা পিচবোর্ডের প্যাকেট।
“পালভাই, এটা তোমার বোনরে দিয়ো। ওরে বোলো, ওর এক ভাই সীমান্তের এ পারেও আছে।”
“জামিরভাই, তুমি আমার ছুটি...”
“তুমি তো জানো পালভাই, আমার বোন সুলতানার শাদির সব ঠিক ছিল। কত আশা ছিল ওর শাদি নিয়ে। কিন্তু আল্লার মনে কী ছিল কে জানে! না হলে শাদির আগে কেন মাত্র দু’দিনের জ্বরে বোনটা আমার চলে গিয়েছিল বলতে পারো পালভাই? বোনের বিয়া না দিতে পারার দুঃখু কী তা আমি বুঝি গো। এটা তোমার বোনরে দিয়ো। দিবে তো পালভাই?”
প্যাকেটের খুলতেই বেরিয়ে এল একটা লাল টুকটুকে শাড়ি। সঞ্জিতের চোখে জল। শুধু এক বার অস্ফুটস্বরে বলল, “জামিরভাই!”
গলা ধরে আসে সঞ্জিতের। সীমান্তের দু’পারের দুই রক্ষী একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে। দু’জনের চোখেই জল। সঞ্জিত বলে, “এই শাড়ি পরেই আমার মানসীর বিয়ে হবে জামিরভাই, এই শাড়ি পরেই...”
দু’পারের লোক অবাক বিস্ময়ে দেখছে দুই সৈনিকের আলিঙ্গন।
আমি অনিলবাবুর দিকে তাকাই, “কী ব্যাপার মিস্টার দাস?”
“কী জানি দাদা! এদের যত ভাব তত ঝগড়া। যে দিন থেকে সঞ্জিত এসেছে, এই দেখে আসছি। অদ্ভুত টান এদের দু’জনের।”
আমাদের সকলের চোখই আবার ঘুরে যায় ওদের দিকে।
“এখন আমি যাই, জামিরভাই?”
“যাই বলতে নাই, বলো আসি। আর একখান আর্জি আছে পালভাই।”
“বলো।”
“তুমি তো বোনের কাছে যাচ্ছ। আমার তো উপায় নাই। তোমার বোনের ছবিটা আমারে দিবা? বিয়ার দিন ছবিতেই মানসীরে দেখুম।”
“এই নাও,” বলে পকেট থেকে বোনের ছবি বার করে জামিরের হাতে দেয় সঞ্জিত, “আসি জামিরভাই।”
“এস পালভাই। সাবধানে যাইও। মানসীরে আমার ভালবাসা দিয়ো। আল্লা ওরে সুখী করুন। আগাও ভাই, আর দেরি কইরো না।”
ফৌজি জিপে চড়ে হাত নাড়ে সঞ্জিত। আমরাও প্রত্যুত্তর দিই। জিপ স্টার্ট দেয় আর পাহাড়ি পথ পেরিয়ে চলতে থাকে।
“জামিরমিয়াঁ,” ডেকে ওঠেন অনিলবাবু, “বোনের ছবিটা একটু আমাদের দেখাও। তোমাদের বোনকে আমরাও একটু দেখি,” পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করেন অনিলবাবু।
“হ্যাঁ, হুজুর দেখেন,” মানসীর দুটো ছবি আমাদের দু’জনের হাতে দেয় জামির। আমরা অবাক হই। মানসীর একটা ছবি আগে থেকেই জামিরের কাছে ছিল, তাও আবার সঞ্জিতের কাছ থেকে আর একটা ছবি চাইল জামির। কেন? আমি আর অনিলবাবু পরস্পরের দিকে তাকাই।
“কী ব্যাপার মিয়াঁ, দুটো ছবি?” প্রশ্ন করেন অনিলবাবু।
“হুজুর, আপনার হাতের ছবিতে ও মানসী নয়, ও আমার বোন সুলতানা, হুজুর।”
বিস্ময়ের শেষ থাকে না আমাদের। অবিকল এক চোখ, এক নাক, এক মুখ। হাসিটিও এক। কে বলবে দুটি ছবিতে দুটি আলাদা মেয়ে!
আমার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে উত্তেজনায় বলে ওঠে, “বাবা, এ তো সেপারেটেড বাই বার্থ!”
হঠাৎ আমার স্ত্রীর মোবাইলে কারও একটা ফোন আসে। রিংটোন বেজে ওঠে। ‘তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় নাকো কভু...”
জামির তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পাহাড়ি পথ দিয়ে চলতে থাকা ফৌজি জিপটার দিকে। তার দু’গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে। মুখে পরম প্রশান্তি। আর দু’দিন বাদে ও দেশে তার বোনের বিয়ে। মানসীর মধ্যে সে তার হারিয়ে যাওয়া বোন সুলতানাকে খুঁজে পেয়েছে।