ছবি: সুব্রত চৌধুরী
নাম কী?”
“হাসু।”
“হাসু আবার কী নাম! এই নাম তোমায়
কে দিয়েছে?”
হাসু নামের লোকটি নিচু গলায় বলল, “কে দিয়েছে জানি না সার। শুনেছি, ছোটবেলায় বেশি হাসতাম। সেই থেকে নাম হাসু। কথা সত্য কি না জানি না। গাঁয়ের অনেকে ডাকে মার-হাসু বলে।”
“সবাই মার-হাসু বলে ডাকে!”
হাসু একই রকম নিচু গলায় বলল, “সবাই না, কেউ কেউ ডাকে।”
প্রলয় ভড় থমকালেন। এই লোক সম্পর্কে তিনি বড় ‘অদ্ভুত গল্প’ শুনেছেন। সাধারণ অদ্ভুত গল্প নয়, অন্য রকম অদ্ভুত গল্প। সেই কারণেই ডেকে পাঠানো। এখান থেকে দুটো গ্রাম দূরে থাকে। রাখুলি না বাঁকুলি কী যেন নাম গ্রামের। কাল খবর
পাঠানো হয়েছিল, আজ এসেছে। তবে ঠিক সময়ে আসেনি। প্রলয় ভড়ের এখন দিশাকে
নিয়ে সুইমিং পুলে নামার প্রোগ্রাম। এই রিসর্টের সুইমিং পুল প্রলয় ভড়ের পছন্দ। এক ধরনের ‘ন্যাচারাল প্রাইভেসি’ রয়েছে। গাছপালা দিয়ে ঢাকা। বন্য বন্য ভাব। দিশা সাঁতার জানে না। না জানুক। সে কোমরজলে দাঁড়িয়ে দাপাদাপি করবে।
তাতেই হবে। তার জন্য সাঁতারের পোশাক আনা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত পোশাক। সেই পোশাক পরতে দিশা লজ্জা পাচ্ছে।
“এ মা! সবার সামনে এইটা পরব?”
প্রলয় ভড় ঠান্ডা গলায় বলেছেন, “সুইমিং পুলে তো গাউন পরে নামা যায় না।”
“তা বলে এইটুকু? সবাই দেখবে যে।”
প্রলয় ভড় গলা আরও ঠান্ডা করে বলেছেন, “দিশা, এটা তোমার বাড়ির শ্যাওলা-ধরা কলতলা নয়। এটা একটা দামি জায়গা। এ সব জায়গায় কেউ কারও দিকে তাকায় না। তুমি কিছু না পরলেও তাকাবে না।”
দিশা আরও লজ্জা পেয়ে, গাল লাল করে হেসে বলেছে, “যাঃ, কী যে বলেন।”
দিশাকে প্রলয় ভড়ের পছন্দ হয়েছে। আধা জঙ্গল আর আধা টিলার মাঝখানে এই রিসর্টও তার বিশেষ পছন্দের। যেন গা-ঢাকা দিয়ে আছে। গত বার যখন এই রিসর্টে এসেছিলেন, তখন সঙ্গে ছিল কামিনী না কাঞ্চন। সেই মেয়ে ছিল উগ্র টাইপ। আড়াল-আবডাল একবারেই মানছিল না। প্রলয় ভড় বিরক্ত হচ্ছিলেন। আরে বাবা, এটা তো হংকং, ব্যাংকক নয়। তাই এ বার তিনি এজেন্সিতে ফোন করে বলেছিলেন, “একটু লজ্জাশরম আছে এমন কাউকে পাঠাবেন। বুঝেছেন?”
“বুঝেছি স্যর। খুব বুঝেছি। কোনও অসুবিধে নেই। গত বার ছিল হাই সোসাইটি। ওরা স্যর একটু তো ইয়ে হবেই। এ বার একেবারে ছা-পোষা বাড়ি থেকে যাবে। গরিব ঘর। লজ্জা ছাড়া এই সব মেয়েদের আর কিছুই থাকে না। মুখ তুলে কথা বলবে না।”
সেই মতো দিশা এসেছে। লজ্জা বেশি দেখাচ্ছে। ঘরে বাইরে দু’জায়গাতেই ‘না-না’ করছে।
ব্যবসার চাপ থেকে প্রলয় মাঝেমধ্যে ছুটি নেন। তিন-চার দিনের ছুটি। স্ত্রী কাদম্বরী জানে ‘স্বামীর অফিস ট্যুর’। অফিস জানে ‘বসের স্পট ভিজ়িট’। তবে সকলেই ‘আসল খবর’ জানে। কাদম্বরী প্রথমে মাথা ঘামাতেন, এখন ঘামান না।
প্রলয় ভড় এখন সুইমিং পুলে। ডাবে গোঁজা স্ট্রতে টান দিচ্ছেন। ডাবে বরফকুচি আর ভদকা মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিশা পুলের সিঁড়ি ধরে কোমর জলে দাঁড়িয়ে। লাজুক ভঙ্গি। প্রলয় তার দিকে ডাব এগিয়ে দিলেন।
“নাও, স্ট্রতে টান দাও।”
দিশা লজ্জা পেয়ে ফিসফিসানি গলায় বলল, “এ মা! আমি এ সব খাব? সবাই দেখবে যে।”
প্রলয় ভড় বললেন, “দেখুক। নাও ধরো।”
মোবাইল বাজল। রিসেপশন থেকে রতন ফোন করে বলল, “স্যর, লোকটা এসেছে।”
প্রলয় ভুরু কুঁচকে বললেন, “কোন লোক?”
রতন আমতা আমতা করে বলল, “ওই যে স্যর, আপনাকে বলেছিলাম না?... সেই লোক... ওই যে মার...”
প্রলয় ভড় বললেন, “গুড। সুইমিং পুলে নিয়ে আয়। এখানেই কথা বলব।”
হাসুকে দিয়ে গেল রতন। পুলের ধারে তাকে একটা বেতের মোড়া দেওয়া হয়েছে। প্রলয় ভড় অবশ্য জলে নেমে পড়েছেন। ডাবের ভদকা এবং দিশাকে নিয়ে হালকা খেলতে খেলতে কথা বলছেন।
এই লোকের ‘অদ্ভুত গল্প’ রতনই তাকে জানিয়েছে। রতন শুধু প্রলয় ভড়ের গাড়ির চালক নয়, বডিগার্ডও বটে। অতি বিশ্বস্ত। ‘অদ্ভুত গল্প’ শুনে প্রলয় বলেছিলেন, “ধুস, যত সব গাঁজাখুরি। পাড়া গাঁয়ে এ রকম গাঁজাখুরি গল্প অনেক থাকে।”
রতন উৎসাহ নিয়ে বলল, “প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয়নি স্যর। এই রিসর্টেরই এক জন স্টাফ বলছিল। আজ সকালে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, খবর সত্যি, সেই লোক আছে।”
“ওকে নিয়ে আয়। কথা বলে দেখি, গল্প গাঁজাখুরি কি না।”
এখন চেহারা দেখে প্রলয় ভড়ের মনে হচ্ছে, গল্প গাঁজাখুরি। লোকটার বয়স বোঝা মুশকিল। চল্লিশ? না কি আরও বেশি? মোড়ায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলেও বোঝা যাচ্ছে চেহারা লম্বার দিকে। অতিরিক্ত রোগা। কণ্ঠার হাড় উঁচু। হাত সরু।
লম্বাটে মুখে খোঁচা দাড়ি। চোখদুটো সাধারণ চোখের মতো নয়, বড় আর একটু যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গায়ের রং তামাটে। পায়জামার মতো ঢলঢলে একটা প্যান্ট আর গায়ে হাফশার্ট।
দুটোরই রং উঠে গিয়েছে। সব মিলিয়ে অপুষ্টি আর দারিদ্র স্পষ্ট। এই লোক যে দরিদ্র হবে সেটা আশ্চর্যের নয়, কিন্তু চেহারার যা হাল তার সঙ্গে ‘গল্প’ মেলে না। এই চেহারা নিয়ে আর যা-ই হোক, ওই কাজ করা যায় না। রতন হাবিজাবি এক জনকে ধরে এনেছে।
প্রলয় ভড় দিশার গায়ে আলতো হাতে জল ছিটিয়ে বললেন, “হাসু, এই কাজ তুমি কত দিন
ধরে করছ?”
“অনেক দিন।”
“অনেক দিন মানে? দু’বছর? তিন বছর?”
হাসু এ দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। সেটা কি দিশার কারণ? যাতে ওর পোশাকে চোখ না পড়ে? সে তাকাচ্ছে দু’পাশে। এখন যেমন তাকিয়ে রয়েছে পুলের ডান দিকে।
“তখন আমার বয়স দশ, সাড়ে দশ হবে।”
প্রলয় ভুরু কুঁচকোলেন, “সে কী! ওইটুকু বয়েস থেকে এই কাজ!”
হাসু গলা নামিয়ে বলল, “বাপে এক দিন বললে, ‘তোরে এ বার কাজ শিখতে হবে।’ আমার ভয় করল। বাপ বললে, ‘ভয় করলে হবে কেন? তোর বাপ, ঠাকুরদায় এই কাজ করেছে। বংশের একটা ধারা থাকবে না?’ তখন আমি করলাম।”
প্রলয় ভড় স্থির চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করলে?”
হাসু বলল, “বাপেই সব ব্যবস্থা করল। আমাদের গাঁয়ে ছিল নাড়ুকাকা। হাট-বাজার থেকে চুরি করে খেত। ধরা পড়লে মার। আমার বাপ তারে গিয়ে বলল, ‘নাড়ু, ক’দিন তোমায় আর চুরিচামারি করতে হবে না। আমার ছেলে হাসু তোমায় রুটি চুরি করে এনে দেবে। ধরা পড়ে যদি মারধর খায়, আট আনা করে দেবে। মারধর না খেলে কিছু দিতে হবে না।’”
হাসু চুপ করল। প্রলয় ভড় দাঁত চিপে বললেন, “তার পর?”
হাসু এ বার বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “আমি চুরি করতে পারতাম না। ধরা পড়ে কিল-চড় খেতাম। আট আনা করে পেতাম।”
প্রলয় ভড় বিড়বিড় করে বলেন, “লাগত না?”
হাসু বলল, “খুব লাগত। কাঁদতাম। বাবা আবার পাঠাত। এক-এক দিন এক-এক হাটে যেতাম। এক বার ধরে পুলিশে দিলে। পুলিশেও মারলে। লাঠি দিয়ে পাছায় মারলে। ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফেরবার পর বাবা খুশি হয়ে দুই টাকা দিলে। বলল, ‘পুলিশের মার খেয়েছিস বলে দুই টাকা।’ ”
দিশার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলেন প্রলয় ভড়। দিশার হাতে ডাব। স্ট্রতে লম্বা টান দিলেন প্রলয়। লোকটা যে ভাবে বলছে তা যদি মিথ্যে হয়, তা হলে ওকে মস্ত গল্প-বলিয়ে বলতে হবে।
“বড় হয়ে কত বার মার খেয়েছ?”
হাসু যেন ঠোঁটের কোণে হাসল। বলল, “মনে নেই। ওটাই তো আমার কাজ সার। গত মাসেও খেয়েছি। বগা দলবল নিয়ে সদরে গেল, আমারে নিয়ে গেল।”
প্রলয় বললেন, “বগা কে?”
হাসু বলল, “গাঁয়ের গুন্ডা। ওরা কাকে মারতে গেল। লাঠি, রড, চেন নিল, আমাকেও নিল। আমার কাজ ছিল, গোলমালের পর উল্টো দলের হাতে ধরা পড়া। ওরা আমাকে মারতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, সেই ফাঁকে বগা দলবল নিয়ে পালাবে। তাই হল।”
প্রলয় ভড় বুঝতে পারলেন, রোগাপাতলা চিমসে লোকটার কথায় এ বার এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। অবাকও লাগছে। এই জন্যই কি বলে দুনিয়া বড় আশ্চর্যের? দিশার শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় জল ছিটোলেন প্রলয়। দিশা লজ্জায় ফিসফিস করে বলল, “মা গো! এখানে জল
দেন কেন?”
প্রলয় সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, “তোমার রেট কেমন হাসু? কেমন টাকাপয়সা নাও।”
হাসু মাথা নামিয়ে বলল, “যে যেমন দেয়। পাড়া-গাঁয়ে মানুষের হাতে পয়সা কই? কাজ বুঝে দেয়। ওষুধ, ব্যান্ডেজের দাম আলাদা।”
প্রলয় বললেন, “শুধুই চুরিচামারি, মারদাঙ্গা? নাকি অন্য কাজও পাও?”
হাসু একটু ভেবে বলল, “ফুটবল খেলাতেও কাজ পাই।”
প্রলয় ভড় অবাক হয়ে বললেন, “ফুটবল খেলায় মার!”
}প্রথম পাতার পর
হাসু বলল, “এক গাঁয়ের সঙ্গে অন্য গাঁয়ের ফুটবল খেলায় কখনও গোল বাধে সার। তখন মার দিতে হয় যেমন, মার খেতেও হয়। মার খাওয়ার জন্য আমারে নিয়ে যায়। তবে ছেলে-ছোকরা তো, বেশি দিতে পারে না। তা-ও যাই। ঘরে বসে থাকলে চলবে কেন? পেট চালাতে হবে, বাড়িতে বৌ আছে। ছেলে-মেয়ে আছে। বৌয়ের নাম কমলা। আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকে। পাকা চাকরি নিয়ে এই কাজ ছেড়ে দিতে বলে।”
প্রলয় ভড় এ বার পুলের একেবারে পাশে এগিয়ে এলেন। বললেন, “আমার শেষ প্রশ্ন। সত্যি কথা বলবে হাসু। দুনিয়ায় নানা রকম কাজ রয়েছে। কাজ না থাকলে ভিক্ষে রয়েছে। সে সব না করে এ রকম একটা ঝুঁকির কাজ করো কেন?”
এই প্রথম বার হাসু ঠেলে বেরিয়ে আসা বড় চোখে প্রলয় ভড়ের দিকে সরাসরি তাকাল। বলল, “এটা কী বললেন সার! দুনিয়ায় এত কাজ, তার পরেও তো মানুষ মানুষরে ঠকায়। বিনা অপরাধে সাজা দেয়। বাড়িতে আগুন লাগায়, খুন করে। আমি তো সার সে সব করি না। কারোরে ঠকাই না। অন্য কাজ পারি না তেমন, মনও লাগে না। তার ওপর বাপ-ঠাকুরদার কারবার, এক বারে ছাড়তে মায়া লাগে। তবে এখন কমিয়ে দিয়েছি। বয়স বাড়ছে।”
প্রলয় চোয়াল শক্ত করে বললেন, “যদি ফট করে এক দিন মরে যাও?”
হাসু চোখ সরিয়ে বলল, “গরিব মানুষ মার খেয়ে মরে না সার। মার খাওয়া তার রক্তে থাকে।”
একটু চুপ করে থেকে প্রলয় নরম গলায় বললেন, “হাসু, যাও বাইরে রতনের কাছে গিয়ে বোসো। তুমি এখানে আজ খেয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে আরও কথা আছে।”
হাসু চলে যাওয়ার পর দিশার হাত ধরে কাছে টানলেন প্রলয় ভড়।
“কাছে এসো দিশা, চলো জলের নীচে গিয়ে তোমাকে আদর করি।”
দিশা কাছে আসতে আসতে বলে, “এই লোকটা কে? করে কী?”
প্রলয় ভড় অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, “এই লোকটা একটা বোকা মানুষ। পয়সা নিয়ে অন্যের হয়ে মার খায়। ভাড়া খাটে বলতে পারো।”
দিশা চোখ বড় করে বলে, “পয়সা নিয়ে মার খায়!”
প্রলয় ভড় মুচকি হেসে বলেন, “কেউ পয়সা নিয়ে আদর খায়, এই লোক মার খায়। কেউ পয়সা নিয়ে খুন করে, জেল খাটে... সে রকমই হবে। লোকটাকে আমার কাজে লাগবে। ওকে আমি মাইনে দিয়ে রাখব।”
দিশা অস্ফুটে বলল, “এই লোককে আপনি মাইনে দিয়ে রাখবেন! কেন?”
প্রলয় ভড় খানিকটা ঘোরে চলে যাওয়া গলায় বললেন, “আমার যা ব্যবসা, সেখানে কেড়ে নেওয়ার ব্যাপার আছে দিশা। তাই মাঝেমধ্যে মার লাগে। শক্ত মার। অসহায়, দুর্বল হয়েও কেউ কেউ কাড়তে গেলে আপত্তি করে। তাদের জন্য লাগে আরও বেশি শক্ত মার। আমার মার দেওয়ার লোক রয়েছে, মার খাওয়ার কেউ নেই। এখন ঠিক করলাম, হাসুকে রাখব। এ রকম আশ্চর্য লোক আর কখনও পাব না। নো, নেভার। নামটাও অদ্ভুত। করে মার খাওয়ার বিজ়নেস, এ দিকে নাম হাসি থেকে... হাসু।” ঘোর থেকে বেরিয়ে এ বার যেন প্রলয় ভড়ই লজ্জা পেলেন। হেসে বললেন, “বাদ দাও ও সব, এসো আমরা ডুব দিই। ওয়ান, টু, থ্রি...”
*****
এখন সন্ধে সাতটার একটু বেশি। এর মধ্যেই চারপাশ অন্ধকার আর নিঝুম। খুব জোরে গাড়ি ছুটছে। দু’পাশে কখনও জঙ্গল, কখনও ধূ ধূ খেত, কখনও আবার টিলা। মাঝেমধ্যে ক’টা টিমটিমে হ্যারিকেন, কুপি-জ্বলা দোকান-বাজার।
এমন বড় আর দামি গাড়ি চড়া তো দূরের কথা, কখনও চোখেও দেখেনি হাসু। এসির কারণে কনকনে ঠান্ডা। চালক রতনের পাশের সিটে পা তুলে এক রকম গুড়িসুড়ি মেরে বসে রয়েছে হাসু। ব্যাগ থেকে চাদর বের করে গায়ে দিয়েছে। এখন মাথাতেও মুড়িয়ে নিল। ব্যাগে রয়েছে ক’টা জামা কাপড়, একটা চাদর, একটা গামছা, এক শিশি সর্ষের তেল আর এক কৌটো মুড়ি। মুড়ির মধ্যে ভেলি গুড়ের ক’টা টুকরো। কমলা জোর করে দিয়েছে। পথে যদি খিদে পায়। পাগল মেয়ে। এদের কাছে কি খাবার নেই? প্রলয় ভড় মানুষ ভাল। তাকে সব জানিয়েছে।
“বেতন পাবে। টাকা খুব কম নয়, গ্রামে বৌয়ের কাছে পাঠিয়েও কিছুটা জমাতে পারবে। থাকবার ঘর পাবে। অফিসে বসবার চেয়ার পাবে। বছরে দু’বার নতুন জামাকাপড় পাবে। এখন বলো আমার সঙ্গে যাবে কি না?”
হাসু উৎসাহ নিয়ে বলেছিল, “কাজটা কী সার?”
প্রলয় ভড় চোখ চকচক করে চাপা গলায় বললেন, “কেন? তুমি যা পারো, সেই কাজ করবে। আমি যখন যেখানে বলব যাবে। মার খাবে। মাথা ফাটাবে, হাত ভাঙবে। তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করব, আমার লোককে মেরেছে বলে থানায় ডায়েরি করব, কাগজে ছবি বের করব, মামলা করব...। আর কাজ না থাকলে অফিসে মাথার ওপর ফ্যান চালিয়ে চেয়ারে বসে থাকবে। ব্যস। এত দিন মার খেয়ে দু’-চার টাকা পেতে, এ বার বাঁধা মাইনে পাবে। সংসারের অভাব মিটবে। যাবে?”
হাসু একটুও চিন্তা না করে মাথা নাড়ে। সে রাজি। কমলাকে সব বলেছে, শুধু কাজটুকু লুকিয়েছে। স্বামী মার খাওয়ার চাকরি পেয়েছে শুনলে ভয় পাবে।
পিছনের নরম সিট হেলানো। অন্ধকারও। সামনে থেকে কিছু দেখার উপায় নেই। প্রলয় ভড় এবং দিশা আধশোয়া। প্রলয় ভড়ের ইচ্ছেয় পোশাকের বাহুল্য অনেকটাই কমিয়েছে দিশা। তার খুব ঠান্ডা লাগছে, কিন্তু উপায় নেই। সামনের সিটে চাদর মুড়ি দেওয়া হাসু লোকটাকে হিংসে হচ্ছে।
প্রলয় ভড়ের মন খুশি। এ বারের ‘ছুটি’ ভাল কাটল। দিশা মেয়েটার নরমসরম ভাব তার ভাল লেগেছে। সবচেয়ে ভাল কথা, তিনি এক অদ্ভুত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন। দিশার গায়ে হাত রাখলেন প্রলয়। দিশা লজ্জা পাওয়া গলায় ফিসফিসিয়ে বলে, “কী করেন! ওরা যে দেখতে পাবে।”
ঠিক এমন সময় কান ফাটানো আওয়াজ। ছুটে চলা গাড়ি কিছুতে ধাক্কা মেরে ঝাঁকুনি খেয়ে থমকাল। প্রলয় ভড় নিজেকে সামলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। জঙ্গলের ধারে ছোট্ট বাজারের মতো। অল্প দোকানপাট, অল্প আলো। রতন ধাক্কা মেরেছে মানুষকে। তবে রক্ষে, বড় কিছু হয়নি। রাস্তার পাশে লোকটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে। হাত তুলে কিছু বলছেও। প্রলয় ভড় আশ্বস্ত হলেন।
কিন্তু মুহূর্তে ঘটনা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ছড়িয়ে থাকা মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির ওপর। কিল, চাপড়, লাথি শুরু হল। প্রলয় ভড় কাঁপা গলায় বললেন, “জানালার কাচ তোলো রতন। পালাতে হবে।” সে উপায় নেই। কিছু ক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে ইটপাথর, লাঠির বাড়ি পড়তে শুরু করে। পিছনের কাচে চিড় ধরল। লোক বাড়ছে। এত লোক কোথা থেকে আসছে! তেমন কিছু তো ঘটেনি। তবে কি গুজব ছড়াল? কিছু ক্ষণের মধ্যে গাড়ি ঘিরে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল।
কারা যেন ভিতরে টর্চের আলো ফেলে। দু’হাতে বুক ঢাকল দিশা। বাইরে চিৎকার উঠল।
“বার করে আন শুয়োরের বাচ্চাদের।”
“মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি বের করে দে।”
“মেয়েটাকে আগে টেনে নামা।”
দিশা ঠকঠক করে কাঁপছে। সে কাঁদছে। প্রলয় ভড় কাঁপা গলায় বললেন, “পিটিয়ে মেরে ফেলবে। গাড়ি ছুটিয়ে দে রতন। লোকগুলোর ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দে”
রতন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “পারব না। অত লোক মারতে পারব না স্যর।”
এত ক্ষণে হাসু নড়ে বসে। গায়ের চাদর খুলতে খুলতে নিচু গলায় বলল, “চিন্তা নাই। আমি নামছি। আমি নামলেই সবাই আমাকে ঘিরে ফেলবে। আমি খেপে ওঠা মানুষের মন বুঝি।”
দিশা এই প্রথম হাসুর সঙ্গে কথা বলল, “আপনি নামবেন না। আপনাকে ওরা মারবে।”
হাসু সামান্য যেন হাসল। বলল, “আমি না নামলে ওরা গাড়ির দরজা ভাঙবে। কাচ ভাঙবে। সবাইকে টেনে বের করে মারবে। আপনাকেও ছাড়বে না। সেটা বেশি চিন্তার হবে। ভিড়ে খারাপ লোক থাকে।”
প্রলয় ভড় আতঙ্কিত গলায় বললেন, “নেমো না হাসু। ওরা সবাই মারবে।”
হাসু গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, “সার, সমস্যা নাই। আমি তো মার-খাওয়া লোক। রতনদা, মন দিয়ে শোনো, আমি নেমেই পিছনে ছুট দেব, দেখবে ভিড়ও ছুটছে। তুমি তখনই ইস্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবে। একটুও দেরি করবে না। হাইওয়ে বেশি দূরে নয়।”
হাসু গাড়ি থেকে নেমে সত্যি সত্যি পিছনে দৌড় দিল। গোটা ভিড় ছুটল পিছনে।
“পালাচ্ছে...পালাচ্ছে...”
প্রলয় ভড় হিসহিসিয়ে উঠেলেন, “রতন গাড়িতে স্টার্ট দে। পালা।”
দিশা পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে রতনের কাঁধটা চেপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল, “একদম না। ওই লোককে ফেলে আমরা এখান থেকে যাব না। আমাদের নামতে হবে, ওদের বোঝাতে হবে। হাসুকে বাঁচাতে হবে।”
প্রলয় ভড় অবাক হলেন।
এই সেই লাজুক মেয়ে! তিনি দিশার হাত চেপে ধরে বললেন, “তুমি কি পাগল হয়ে গেলে দিশা?”
দিশা দাঁতে দাঁত ঘষে প্রলয় ভড়কে ধমক দিয়ে বলল, “আপনি হাত ছাড়ুন, ছাড়ুন হাত। হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। আপনার কোনও সমস্যা আছে? সরে বসুন। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।”
দিশা দরজার দিকে হাত বাড়াল।