নতুন বছরের ছোটগল্প
Short story

আশ্চর্য পিকনিক

Advertisement

প্রচেত গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:১২
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ

নীতীশবাবু বই থেকে মুখ তুলে বললেন, “‌মল্লিকা, তুমি কি কথাটা ভেবে বলছ?‌”‌

Advertisement

মল্লিকাদেবী সোয়েটার বুনছেন। উলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, “‌অবশ্যই ভেবে বলছি। আমি না ভেবে কিছু বলি না।‌”‌

নীতীশবাবু অবাক হয়ে বললেন, “‌তুমি কি বুঝতে পারছ না, এটা অসম্ভব?‌”‌

Advertisement

মল্লিকাদেবী মুখ না তুলেই বললেন, “না, বুঝতে পারছি না।‌ অসম্ভব কেন?‌”‌

নীতীশবাবু বললেন, “আচ্ছা, মেনে নিচ্ছি, অসম্ভব নয়, কিন্তু হাস্যকর তো বটেই।‌”

‌মল্লিকাদেবী শান্ত গলায় বললেন, “‌হাস্যকর হলে সমস্যা কী?‌ আমরা তো কোনও কান্নাকর কাজ করব বলে ঠিক করিনি। কেউ যদি হাসে আমাদের কী?‌”

নীতীশবাবু এ বার জোরে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “‌কান্নাকর, হাস্যকর যাই হোক, এটা হতে পারে না।”‌

মল্লিকাদেবী একই রকম শান্ত ভাবে বললেন, “এটা হতে পারে এবং হবে।”‌

এ বার ‌বছরের একেবারে শেষে এসে জোর শীত পড়েছে। এখানে এমনিতেই ঠান্ডা বেশি। অন্য জায়গার ‘‌জোর শীত’‌ মানে এখানে ‘‌বাড়াবাড়ি ধরনের জোর শীত’‌। ড্রয়িংরুমে বসে রয়েছেন শ্রীনীতীশ রায় এবং শ্রীমতী মল্লিকা রায়। তাঁদের বয়স ছেষট্টি বছরের সামান্য এ দিক-ও দিক। নীতীশবাবুর ঠান্ডা গরম দুই-ই বেশি। ঠান্ডা পড়ল কি পড়ল না, তিনি সোয়েটার বার করে ফেলেন। তার পর ধাপে ধাপে শরীরে কোট, মাফলার, মোজা, মাঙ্কি ক্যাপ চড়তে থাকে। মল্লিকাদেবী শীতে কাবু হন না, বরং উপভোগ করেন।

তবে আজ ঠান্ডা সত্যি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতে রুম হিটার চালাতে হয়েছে। দরজা, জানলা বন্ধ। প্রথমে কাচের পাল্লা, তার পরে কাঠ, শেষে ভারী পর্দা। সোনাঝুরি-‌পলাশের জঙ্গল পেরিয়ে আসা উত্তরের কনকনে হাওয়ার ঘরে ঢোকার কোনও পথ নেই। তার পরও খানিক আগে নীতীশবাবু বলেছেন, “‌কোথা থেকে হাওয়া ঢুকছে মল্লিকা?‌”‌

মল্লিকাদেবী জবাবে বলেন, “‌‌ঘরের ঘুলঘুলিতেও তো কাগজ লাগিয়েছ, হাওয়া কোথা থেকে ঢুকবে?‌ এটা তোমার মনের সমস্যা, শীতকাতুরেদের হয়। উইন্টার সিনড্রোম।”‌

নীতীশবাবু স্ত্রীর কথা মানলেন না। ঘরের এ দিক ও দিক তাকিয়ে যেন হাওয়া দেখার চেষ্টা করলেন।

“‌মনে হচ্ছে ফিনফিন করে ঢুকছে। উত্তরের হাওয়া মারাত্মক জিনিস, ফাঁকফোকর পেয়ে ঠিক সেঁধিয়ে যায়।”‌

মল্লিকাদেবী বললেন, “‌তুমি বরং এক কাজ করো, তোমার বড় ছেলেকে আমেরিকা থেকে একটা এয়ার অ্যালার্ম পাঠাতে বলো, ঘরে উত্তুরে হাওয়া ঢুকলে বেজে উঠবে।”‌

এর পরে আর কথা বাড়ানোর কোনও মানে হয় না। নীতীশবাবু চুপ করে যান। রুম হিটারের পরেও তাঁর গায়ে চাদর, পায়ে মোজা, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। সোফার পাশের টেবিলে ফ্লাস্কে কফি রাখা। ইচ্ছে করলে তিনি ঢেলে নিতে পারেন। নিচ্ছেন না। নীতীশবাবুর মনে হচ্ছে, কফি নয়, এখন তাঁর প্রয়োজন অল্প হুইস্কি। কম সোডা দিয়ে কড়া করে বানানো। ঘরে সবই রয়েছে, নিতে সাহস পাচ্ছেন না। অনেক দিনই হল মদ্যপানের ব্যাপারে তাঁর সাপ্তাহিক রেশন চালু হয়েছে। এই রেশনের ওপর স্ত্রীর কড়া নজর। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার অজুহাতে বাড়ানোর অনুমতি নেই।

সোফা থেকে অল্প দূরে ডিভানের ওপর পা গুটিয়ে বসেছেন মল্লিকাদেবী। দু’‌হাতে বোনার কাঁটা চালাতে চালাতেই তিনি ঠান্ডা ভাবে পরিকল্পনার কথা বলেছেন। পরিকল্পনা নয়, সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে এ বাড়িতে গৃহকর্ত্রীর কথাই চূড়ান্ত।

নীতীশবাবু সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছেন। স্কুলবয়স থেকে পরিচয়। সেই পরিচয় ধাপে ধাপে বন্ধুত্ব এবং এক সময়ে প্রেমে পরিণত হয়। এই রূপান্তর তাঁরা বুঝতে পারেন ভালবাসার মধ্য দিয়ে নয়, ঝগড়ার মধ্য দিয়ে। কৈশোর এবং তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে এক বার অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁদের ঝগড়া হয়েছিল। সাত দিন কথা বন্ধ থাকার পর হঠাৎ এক সন্ধের মুখে, ছাদে ওঠার সিঁড়িতে দেখা হয়ে যায় দু’‌জনের। ফের ঝগড়া করতে করতেই দু’‌জন দু’‌জনকে গভীর ভাবে চুমু খান। সেই থেকে চুমু এবং ঝগড়া দুটোই বজায় রয়ে গিয়েছে। এক সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দু’জনে বিচ্ছিন্ন হলেন, পড়া শেষে চাকরিস্থলও হল আলাদা। দু’‌-তিন মাস অন্তর দেখাসাক্ষাৎ। প্রেম ঘন হতে লাগল, দেখা হলে আদর বাড়তে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেললেন। বিয়ের কয়েক বছর পর মল্লিকাদেবী এক কাণ্ড করলেন। কলকাতা থেকে গাড়িতে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা এসে, লালমাটির পথের পাশে দুম করে কিছুটা জমি কিনে ফেলেন। পিছনে সোনাঝুরি-পলাশের বন।

মল্লিকা স্বামীকে বললেন, “‌এক দিন নিশ্চয়ই আমরা এক সঙ্গে থাকব। তখন এখানে, এই বনের ধারে, আমাদের বাড়ি হবে। এত দিন আলাদা রয়েছি, সুদে-আসলে উসুল করব তখন।”‌

নীতীশ বলেছিলেন, “চমৎকার হবে।”‌

প্রকৃতি প্রেম পছন্দ করে। মল্লিকা ‌রায়-‌নীতীশ রায়ের প্রেমও সে পছন্দ করে ফেলল। বেশ কয়েক বার কর্মক্ষেত্র বদলের পর দু’‌জনেই চেষ্টা, মেধা এবং খানিকটা কাকতালীয় ভাবে সুযোগ পেয়ে এই জায়গায় চাকরি পেয়ে গেলেন। মল্লিকাদেবী ছিলেন শিক্ষিকা, সেই পেশাতেই রইলেন, নীতীশবাবু ঘরবাড়ির হেরিটেজ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে বসলেন। ব্যস্‌, আর পায় কে? কিনে রাখা জমিতে‌ হুড়ুমদাড়ুম করে একটা ছোট বাড়ি তৈরি করে ফেলা হল। তাঁদের ছেলে দু’টি। বড় জন ঈশান আর ছোট ছেলে ঋষভ বোর্ডিংয়ে থেকে লেখাপড়া করল। এখন ঈশান আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে, ঋষভ ইনদওরে ব্যবসা করে। মেয়ে পত্রলেখা বিয়ে করে পুণেতে। সেও কর্পোরেট-চাকুরে। তিন জনই কাজ এবং সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। যে যেমন সময় পায় বাবা-মায়ের কাছে আসে। সময় না হলে আসতেও পারে না। ঈশান তো তিন বছর হল দেশে আসেনি। শুধু নিজের ইউনিভার্সিটি নয়, তাকে নানা দেশেও ক্লাস নিতে, সেমিনারে ভাষণ দিতে ছুটতে হয়। ঋষভের দেখা নেই দু’‌বছর হয়ে গেল। ব্যবসা বড় হওয়ার পর তার নাকানিচোবানি অবস্থা। ‘‌সেলস টার্গেট’ ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনও ‘‌টার্গেট’ নেই।‌ সবচেয়ে বেশি আটকেছে পত্রলেখা। তার বড় মেয়ে ক’দিন পরে স্কুলে বোর্ডের পরীক্ষা দেবে, ছোট মেয়ে ক্লাস ফোরে উঠে ঘোষণা করেছে, অনেক হয়েছে, সে আর লেখাপড়া করবে না, এ বার থেকে নামকরা ‘‌দুষ্টু মেয়ে’ হয়ে ওঠার জন্য খাটাখাটনি করবে‌। সেই মেয়েকে সামলাতে গিয়ে পত্রলেখা আজকাল তার মায়ের ফোনও ধরতে পারে না। ফোন করলেও আবহসঙ্গীতের মতো মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে ওঠে।

“‌গেল, গেল.‌.‌. ‌পড়ল, পড়ল.‌.‌. ‌ভাঙল, ভাঙল.‌.‌.‌”‌

মল্লিকাদেবী এবং নীতীশবাবু ছেলেমেয়েদের এই ব্যস্ততা, বাবা-‌মায়ের কাছে আসতে না-পারা খুশি মনে মেনে নিয়েছেন। তাঁরা দু’জনেই এক সময়ে দূরে দূরে চাকরি করেছেন। এমনকি বিয়ের পরেও পরস্পরের কাছে আসতে পারতেন না। নীতীশবাবুকে কত বার শেষ মুহূর্তে ট্রেন, প্লেনের টিকিট বাতিল করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

মল্লিকাদেবীকেও করতে হয়েছে। দুম করে পরীক্ষার খাতা এসে পড়ল, আর কলকাতায় ফেরা আটকে গেল। ছেলেমেয়ে দূরে থাকে বলে যে বাবা-মায়েরা কান্নাকাটি করে, মুখ বেজার করে থাকে, ঘ্যানঘ্যান করে, মল্লিকাদেবী তাঁদের এড়িয়ে চলেন। রাগও করেন।

“এ কেমন কথা! ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে, কাজকর্মের জন্য বাইরে যাবে না! ঘরের কোণে বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে?‌‌ যত সব আদিখ্যেতা। গোটা দুনিয়া জুড়ে এখন লেখাপড়া, কাজের সুযোগ। যেখানে ভাল মনে হবে, যেখানে সম্ভব হবে, সেখানেই যাবে। কেন চলে গেল, কেন মাসে এক বার করে বাবা-মায়ের কাছে আসে না, কেন রোজ দু’‌বেলা টেলিফোন করে না, এ সব কাঁদুনি যারা গায় তারা ছেলেমেয়ের ভাল চায় না। আবার নিজেরাও বানিয়ে দুঃখ পায়।”‌

কেউ হয়তো এই কথায় মিনমিন করে বলল, “‌কাছে থাকলে একটা সুবিধে রয়েছে, বুড়ো বয়সে অসুখবিসুখ হলে দেখতে পারে।”‌

মল্লিকাদেবী কড়া গলায় বলেন, “‌ছেলেমেয়েরা কি নার্সিংহোম?‌ না কি তারা বেডপ্যান ধরার জন্য খাটের পাশে বসে থাকবে?‌ সামর্থ্য আর ইচ্ছে থাকলে দূরে থেকেও বাবা-মায়ের ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। করেছেও তো অনেকে। ‌আবার একই ছাদের তলায় থেকে বাবা-মাকে খেতে পর্যন্ত দেয় না এমন খবরও তো খবরের কাগজে হরদম বেরোচ্ছে। হচ্ছে কি না?‌‌”‌

নীতীশবাবুরও এই বিশ্বাস। ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনির জন্য মাঝেমধ্যে মন কেমন করে ঠিকই, কিন্তু তা নিজের মধ্যেই রাখেন। তাঁর কাছে মনকেমনের থেকে অনেক বেশি ‘মন ভাল’‌র ঘটনা হল, ওরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত এবং খুশি। দু’জনে মিলে ঘুরে ঘুরে ছেলেমেয়েদের কাছে কিছু দিন করে থেকেও তো আসেন। ফলে দূরে থাকা নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

কিন্তু এ বারের ঘটনা অন্য রকম। ঘটনা গড়িয়েছে তিন বছর ধরে। তিন বছর ধরে গড়ানো ঘটনা ‘‌অন্য রকম’‌ তো হবেই।

তিন বছর ধরে ছেলেমেয়েরা ঠিক করছে, বছরের প্রথমে তারা বাড়িতে আসবে। ক’দিন এক সঙ্গে থাকা তো হবেই, এ ছাড়া এক দিন হবে পারিবারিক পিকনিক। এমনিতে পিকনিক কম হয় না। যে যেখানেই থাকুক, বছরের এক-দু’দিন দল বেঁধে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে। এমনকি নীতীশবাবু, মল্লিকাদেবীও প্রতিবেশী, সিনিয়র ক্লাবের সদস্য, গানবাজনার উৎসাহী দল, কর্মস্থলের প্রাক্তনীদের সঙ্গে শীতের সময় পিকনিক করেন। বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, রোদ পোহানো সবই হয়। কিন্তু বাড়ির সবাই মিলে মাঠে, নদীর ধারে, জঙ্গলের ভিতর অথবা গা-ছমছমে পুরনো জমিদারবাড়ির উঠোনে গিয়ে হইচই হয়নি বহু বছর। নাতিনাতনিরা জানতেও পারল না, ‘‌ফ্যামিলি পিকনিক’‌ কাকে বলে। এই কারণেই তিন বছর আগে পরিকল্পনা হয়। মূল উৎসাহ বড় ছেলের। আমেরিকা থেকেই সে ভাইবোনের সঙ্গে কথা শুরু করে। ‘‌বনভোজন’‌ নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে ফেলা হয়। ‌গ্রুপে প্রবল বেগে কথা-চালাচালি শুরু হয়ে যায়। পিকনিকের তারিখ ঠিক হল, সকালের উদ্বোধনী পকোড়া-‌কফি থেকে বিকেলের সমাপ্তি চা-কেক পর্যন্ত মেনু তৈরি হল, হাঁড়ি-‌কড়াইয়ের সঙ্গে ক্রিকেট ব্যাট, ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেট, শতরঞ্চি, গিটারের তালিকা তৈরি হল। তালিকায় নিত্য যোগ-বিয়োগ চলতে থাকে। গভীর রাত থেকে সারা দিন মোবাইল ফোন টুংটাং বাজতে থাকে।

তবে এই বাজনায় শেষ পর্যন্ত লাভ হল না। প্রথম বছরেই পিকনিক গেল ভেস্তে, কেউ আসতেই পারেনি। পরের বারও নয়। এ বারেরটা নিয়ে তৃতীয় বার পরিকল্পনা। এ বার নাকি হবেই হবে। মল্লিকাদেবী হোয়াটসঅ্যাপ কলে কনফারেন্সে বসলেন।

“‌জায়গা দেখে রাখব?‌ তোদের বাবাকে বলি?‌”‌

ঈশান বলল, “‌কখনওই নয়। গাড়িতে যেতে যেতে যে জায়গাটা পছন্দ হবে, সেখানেই নেমে পড়ব।”‌

ঋষভ বলল, “তাই ভাল। স্পন্টেনিয়াস স্পট‌ পেলে পিকনিকে একটা ন্যাচারাল টাচ থাকবে।”‌

নীতীশবাবু বললেন, “‌ও দিন কিন্তু পিকনিকের খুব ভিড় হবে। যদি চাস কারও বাগানবাড়ি ঠিক করে দিতে পারি।”‌

পত্রলেখা ‘‌হাঁ হাঁ’‌ করে উঠল, “‌একেবারেই নয়, তা হলে তো ‘‌বনভোজন’‌ না হয়ে ‘বাগানভোজন’‌ হয়ে যাবে বাবা।”‌

মল্লিকাদেবী বললেন, “মাছ, মাংস‌, আনাজপাতি, বাসনকোসনের ব্যবস্থা করে নিচ্ছি তা হলে।”‌

ঈশান বলল, “কোনও দরকার নেই। তা হলে নেমন্তন্নবাড়ি হয়ে যাবে মা। যা করার সবাই মিলে করব। এটা অনলাইনের যুগ। হাঁড়ি টু গাড়ি সব জোগাড় হয়ে যাবে।”‌

পত্রলেখা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলল, “‌দেখবি, সব দায়িত্ব আমার একার ঘাড়ে ফেলবি না।”‌

ঋষভ বলল, “একার ঘাড়ে ফেলার কী আছে, আমরা কি কম লোক?‌ আমাদের দুই বৌ, এক জামাইও রয়েছে। আবালবৃদ্ধবনিতা মিলিয়ে বারো জন তোদেখতেই পাচ্ছি।”‌

নীতীশবাবু বললেন, “‌আমাকে বৃদ্ধ‌ বললে আমি নেই।”‌

ঋষভ হেসে বলল, “উইথড্র, উইথড্র।”‌

কনফারেন্সে একটু পরে মেনু নিয়ে ভাইবোনদের ঝগড়া লেগে যায়। মল্লিকাদেবী, নীতীশবাবু সরে আসেন। তবে নিশ্চিন্ত হন, ছেলেমেয়েরা সবাই এক সঙ্গে আসছে, তারা থাকছে এবং এবার পারিবারিক পিকনিক হচ্ছেই।

না, হচ্ছে না। দু’দিন আগে ফোন করে বড় ছেলে তার মাকে জানিয়েছে, ইউনিভার্সিটির এক ইন্টারভিউ বোর্ডে তাকে এক্সপার্ট হিসেবে থাকতে হবে। হঠাৎ ঠিক হয়েছে। তিন দিন টানা কাজ চলবে। মেজ ছেলে পরশু সকালে ফোন করে। বলে, “স্যরি বাবা, আটকে গিয়েছি। ইউ কে থেকে আমাদের মোস্ট ভ্যালুয়েবল বায়ার আসছে। বুঝতেই পারছ, বিলিতি কোম্পানি। বড় অর্ডার হাতছাড়া হয়ে যাবে। এক্সট্রিমলি স্যরি।”‌

নীতীশবাবু বললেন, “‌স্যরি বলার কিছু নেই। কাজ তো করতেই হবে।”‌

পত্রলেখা আটকে গেল মেয়ের প্রজেক্ট নিয়ে। মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়লে কী হবে, ‘প্রজেক্ট’ নামক অশান্তি বাবা-মাকে নাজেহাল করে দিয়েছে। দু’জনকেই অফিস ছুটি নিতে হয়েছে। মেয়ের বাবা নেট থেকে ফোটো বের করে প্রিন্ট দিচ্ছে, মেয়ের মা মেঝেয় হুমড়ি খেয়ে খাতায় সেই ফোটো সাঁটছে। আর সেই সময় মেয়ে নতুন দুষ্টুমি হিসেবে কাচের কাপ-ডিশ নিয়ে ‘বিপজ্জনক রান্নাবাটি’‌ খেলা শুরু করেছে।

“মা রাগ কোরো না। কী করব বলো। মেয়ের প্রজেক্ট যে আমাদের ফ্যামিলি পিকনিকের প্রজেক্ট ফেল করিয়ে দেবে ভাবতেও পারিনি। স্কুল খুব স্ট্রিক্ট। এ বারও পিকনিক হল না।”

মল্লিকাদেবী বললেন, “রাগকরব ‌কেন?‌ ‌‌‌ছেলেমেয়ের স্কুল স্ট্রিক্ট হওয়াই উচিত।”‌

মল্লিকাদেবী, নীতীশবাবু এতে অভ্যস্ত। তিন বছর ধরে চলা পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া যতই ‘‌অন্য রকম’ হোক,‌ তাঁরা ঘটনা সহজ ভাবে নিয়েছেন। তবে মল্লিকাদেবী অতিরিক্ত সহজ ভাবে নিয়েছেন। এতটাই সহজ যে সন্ধেবেলা ড্রইংরুমের ডিভানে বসে উল বুনতে বুনতে একটু আগে স্বামীকে তিনি জানিয়েছেন, “‌আমরা দু’জনেই পিকনিক করব।”

নীতীশবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন ভুল শুনেছেন। তাই বললেন, “‌কিছু বললে মল্লিকা?‌”‌

মল্লিকাদেবী বলেন, “আমরাই ফ্যামিলি পিকনিক করব। শুধু আমি আর তুমি।”‌

‌নীতীশবাবু বললেন, “‌তা মন্দ নয়, বাড়িতে একটা পিকনিক হতেই পারে। ছাদে বা বাগানে চেয়ার-টেবিল পেতে দুপুরের খাওয়া সারা যাবে।”‌

মল্লিকাদেবী বললেন, “বাড়িতে নয়, পিকনিক হবে বনের ধারে, বনভোজন। যেমনটা ভাবা হয়েছে। সকালে হটকেসে খাবারদাবার ভরে, শতরঞ্চি, গার্ডেন আমব্রেলাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। ড্রাইভ আমি করব। যেখানে ইচ্ছে হবে, নেমে পড়ব। সারা দিন থাকব, জঙ্গলে ঢুকে যাব, নদী থাকলে ভাল, না হলে খুঁজব। আমি গান করব, তুমি শুনবে। তুমিও করতে পারো। সুরে না হলে অসুবিধে নেই। দু’জনে একটু ব্যাডমিন্টন খেলতে পারি। পারবে?‌ না হলে লুডো বা একহাত দাবা হবে। তুমি যদি সেরকম মনে করো হ্যামকটা নিতে পারো। গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে। ভাল হবে।‌”‌

এর পরেই নীতীশবাবু প্রায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বলেন, “এ অসম্ভব, হাস্যকর। হতেই পারে না।”

মল্লিকাদেবী ঠান্ডা গলায় জানিয়ে দেন, “হবেই।”

যে নীতীশবাবু এত ক্ষণ ঠান্ডায় কুঁকড়ে ছিলেন, স্ত্রীর কথায় তাঁর ঘাম হতে শুরু করে। আবার বোঝানোর চেষ্টা করেন।

“‌কী বলছ মল্লিকা, দুই বুড়োবুড়ি মিলে ফ্যামিলি পিকনিক!‌”‌

মল্লিকাদেবী মুখ তুলে বললেন, “‌‌কেন?‌ বয়স হয়েছে বলে কি আমরা পরিবার নই?‌ বিয়ের আগে দু’জনে মিলে কম বেড়িয়েছি?‌ পাহাড়েও চড়েছি। বিয়ের পরের কথা তো আর বলছিই না। এখন বয়স হয়েছে বলে পাহাড়ে না-হয় চড়তে পারব না, নদীর ধারে তো হাঁটতে পারব। হাড়ে জোর কমলে কী হবে, ইচ্ছের জোর তো কমেনি, ছেলেমেয়েরাও কমতে দিচ্ছে না। আমরা তো সেই মল্লিকা, সেই নীতীশই আছি। আছি কি না?‌”‌

নীতীশবাবু মাঙ্কিক্যাপ খুলতে খুলতে বললেন, “‌তুমি আগে বললে তো চাঁদা দিয়ে কোনও একটা দলের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারতাম।”‌

মল্লিকাদেবী বললেন, “‌মোটেও না। এটা আমাদের পরিবারের বনভোজন হবে, আর কেউ নট অ্যালাউড।”‌

নীতীশবাবু একটু যেন শান্ত হলেন। বললেন, “‌ছেলেমেয়েদের ওপর রাগ করে এ সব বলছ না তো?‌”‌

মল্লিকাদেবী হেসে বললেন, “একেবারেই নয়, ‌খুশি হয়ে বলছি। এ রকম একটা হইচইয়ের কথা তো ওরাই প্রথম ভেবেছে। ভাবনাটাকে দাম দিতে হবে না?‌ তাদের তো বোঝাতে হবে, আমরা চেষ্টা করেছি। তোমাদের পরিকল্পনা মতো সবটা হল না, তবে একটু হয়েছে। আগে কিছু জানাব না, ফোটো তুলে পাঠাব। ওরা খুশি হবে। আমি নিশ্চিত, তোমার ছেলেমেয়েরা এই আনন্দ ছুঁতে পারবে। পরিবার মানে কেবল হাতের মধ্যে থাকা নয়, মনের মধ্যে থাকাটাও পরিবার। এই পিকনিকে ওরা আমাদের চার পাশে থাকবে। বয়স হচ্ছে, আর সুযোগ পাব কি না জানি না। কে জানে এটাই শেষ কি না। দেখো চেনা রোদ, উত্তুরে বাতাস, নদীর জল, বনের পাতার শব্দ সব কেমন নতুন লাগবে।”‌

স্ত্রীর মুখের দিকে চুপ করে খানিকটা সময় তাকিয়ে রইলেন নীতীশবাবু। মল্লিকাদেবী হাতের সোয়েটার নামিয়ে লজ্জা পাওয়ামুখে হেসে বললেন, “‌অ্যাই, হাঁ করে কী দেখছ?”‌

নীতীশবাবু সোফা ছেড়ে উঠে হেসে বললেন, “‌তোমাকে নতুন লাগছে মল্লিকা, সুন্দরও। আমি কি একটা চুমু খাওয়ার অনুমতিপেতে পারি?‌”‌

*****

আজ নতুন ইংরেজি বছরের প্রথম দিন।

সকাল হয়েছে নরম কুয়াশা মেখে। পৃথিবী জুড়ে অজস্র পিকনিক শুরু হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। সে সবে কত আয়োজন, কত রং, কতই না কোলাহল। তবে মনে হয়, সবচেয়ে আশ্চর্য পিকনিকটি হচ্ছে সামনের ওই দিগন্তছোঁয়া মাঠে, সোনাঝুরি-পলাশ গাছের বনের ধারে। বনের ভিতর দিয়ে নদীর দিকে যাওয়ার একটা জঙ্গুলে পথ রয়েছে। কে জানে সত্যি রয়েছে কি না। মাঠের এক পাশে ঝাপসা গাছের তলায় এক দম্পতি মনোযোগ দিয়ে শতরঞ্চি পাতছেন। বয়স্ক ভদ্রলোক মাঙ্কি ক্যাপের বদলে একটা গল্ফ হ্যাট পরেছেন আজ। ঠিক হয়েছে, স্যান্ডউইচ আর কফি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে তাঁরা মাঠ পেরিয়ে বনের পথ ধরে খুঁজতে যাবেন নদী। ফিরে এসে একটু ব্যাডমিন্টন খেলা হতে পারে। তার পর মাংস, রুটি, স্যালাড দিয়ে বনের ধারে বসে ভোজন। স্ত্রীর বিশেষ অনুমতিতে ভদ্রলোক কোটের পকেটে ভদকার একটি ছোট শিশিও এনেছেন। দুপুরের খাওয়ার আগে লেবু দিয়ে একটু আয়োজন করা যাবে বলে মনে হচ্ছে। তবে আগে নদীর সন্ধান।

ওই যে পক্বকেশ দম্পতি পায়ে-চলা পথ ধরে হাঁটা শুরু করেছেন। একে অন্যের হাতও ধরেছেন যে!‌ আরে, গান শোনা যাচ্ছে না?‌ ওঁরা গানও গাইছেন না কি?‌‌

মাঠের পাশের রাস্তায় লাল ধুলো উড়িয়ে শক্তপোক্ত উঁচু গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির মাথায় হাঁড়ি, বাসন, তরিতরকারি বোঝাই ব্যাগ, তাঁবু, ছাতা, ফোল্ডিং চেয়ার, ক্রিকেট খেলার ব্যাট। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে টুপি মাথায় ঝকঝকে এক যুবক নেমে বলল, “ঋষভ, বাইনোকুলারটা তোর কাছে না?‌ এক বার দে তো।‌”‌

গাড়ি থেকে পত্রলেখা এক রকম লাফ দিয়ে নামে। বলে, “থাক না ‌দাদা,‌ ওরা ওদের মতো ঘুরে আসুক।”‌

ঈশান বলল, “‌ঠিক বলেছিস। আগে ঘুরে আসুক, তার পর সারপ্রাইজ়।”

চরাচর ভেসে যাচ্ছে মিঠে রোদে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement