ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
একটু থেমে মহিলা ফের বলতে শুরু করলেন, ‘‘পনেরো বছর বয়সে আমি একটা প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ নিই। দমদম ক্যান্টনমেন্টে ছিল ওদের কারখানা। ট্রেনে করে আসতাম। তখনও ফ্রক পরতাম। ট্রেনেই আলাপ হয় ওর সঙ্গে। ভোরবেলা ফুল নিয়ে শিয়ালদা যেত ওরা। আরও কয়েক জন ছিল। কিন্তু ওর মতো কেউ ছিল না। মাথা তুলে তাকাতই না। সবাই বিড়ি-সিগারেট খেত। মুখ খিস্তি করত। কিন্তু ও একদম ও সব কিছু করত না। শুধু আমি নেমে যাওয়ার আগে এক বার চোখ তুলে তাকাত। কী বড় চোখ ওর! আমার যে কী লজ্জা করত! আর কী যে ভাল লাগত! সারা দিন ওই বড় বড় চোখ দু’টোকে মনে করে দিন কাটত আমার। নিজের মনে হাসতাম। গুনগুন করে গান গাইতাম। সবাই ভাবত এই হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও মেয়েটা এত ফুর্তিতে থাকে কী করে!
‘‘আমার মনে আছে, ষোলো বছর হওয়ার পর এক দিন আমিই সাহস করলাম। তত দিনে বুঝেছি এর ভরসায় থাকলে কিছুই হবে না। তা আমি এক দিন ট্রেন থেকে নামার আগে বললাম, আমার নাম বিপাশা। ষোলো বছর হয়ে গিয়েছে আমার। ও কী বলবে বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। কয়েক দিন পরে নিজেই কথা বলেছিল তার পর। একটা শাড়ির প্যাকেট সবার আড়ালে আমায় দিয়ে বলেছিল, ‘দু’টো ফ্রকই পরো সারা ক্ষণ। এক দিন এটাও পরবে?’
‘‘পরের বছর বাড়িতে এসেছিল ও। মাকে বলেছিল বিয়ে করতে চায়। মা খুশি হয়েছিল। কিন্তু জানত বাবা রাগ করবে। তাই মা-ই আমায় বলেছিল পালিয়ে যেতে। অঘ্রানের প্রথমে ওর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। বিয়ে করেছিলাম আমরা। তার পর দেখো, আঠাশ বছর হয়ে গেল! ওর মতো এত ভাল মানুষ আমি দেখিনি। বাবা-মা যত দিন বেঁচেছিল, ও প্রতি মাসে টাকা দিত। দু’টো ভাইয়ের একটা আমাদের ফুলের ব্যবসাতেই কাজ করে। খারাপ কিছু হয় না। দিব্যি চলে যায়। আমরা টোনাটুনি সুখে দুঃখে এক সঙ্গে আছি বেশ। কষ্ট একটাই, ছেলেটা অকালে চলে গেল! তার পর থেকে দুগ্গাপুজো এলেই আমার এত কষ্ট হয়!’’
একটানা কথা বলে বিপাশাদি একটু থামলেন। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। বিকেলের আলো ট্রেনের দরজা দিয়ে এসে পড়ছে বিপাশাদির মুখে। লালচে চুল উড়ছে। চোখের জলে সূর্য তার দু’ফোঁটা রং মিশিয়ে দিয়েছে। কেমন একটা কমলা রঙের বিন্দু যেন! আমি বুঝলাম চোখের জলেরও রং হয়। ভালবাসা আর মনখারাপ মেশানো চোখের জলের রং কমলা!
‘‘দেখো তো, আমি কী সব বকে যাচ্ছি! দাঁড়াও একটা জিনিস দিই!’’ বিপাশাদি সামনের পোঁটলাটা থেকে একটা চকচকে স্টিলের কৌটো বার করল। তার পর সেটার ঢাকনা খুলে আমার হাতে দিল দু’টো নাড়ু। গুড়ের তৈরি নারকেলের নাড়ু।
আমি বললাম, ‘‘এ বাবা এটা দিলেন কেন! কারও জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তো?’’
বিপাশাদি হাসলেন, ‘‘আরে ওর বেডের পাশে একটা কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে ভর্তি আছে। পায়ে অপারেশন হয়েছে। ফুটবল খেলে। বাড়ি থেকে সে রকম কেউ আসে না। আমি যেটুকু পারি নিয়ে যাই। ও নাকি নাড়ু খেতে ভালবাসে। তাই নিয়ে যাচ্ছি। এই দেখো, এক কৌটো আছে, তোমায় তো মোটে দু’টো দিলাম! তবে অসুবিধে হলে... মানে ইয়ে, খেতে অসুবিধে নেই তো?’’
আমি হাসলাম। দু’টো নাড়ু খেতে বেশি সময় লাগল না। খুব একটা মিহি নারকোল নয়। তাই আমার খেতে বেশি ভাল লাগল। আর কত্তদিন পরে গুড় খেলাম! মনে হল যদি আর দু’টো পেতাম, তা হলে পুঁটির জন্য নিয়ে যেতাম!
কথাটা মনে পড়ায় আবার ছেলেটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে দিন অফিসে আমায় দেখে এমন করে তাকিয়েছিল, যেন আমায় ঠিক চিনতে পারছে না।
লামাদাদুর বাড়িতে চুরি হয়েছিল তার আগের রাতে। সেই খবরটা লামাদাদু দেয়নি আমায়। দিয়েছিল জগন্নাথদা। তাই সকালবেলাতেই চলে গিয়েছিলাম আমি।
তার পর ওখান থেকেই পুঁটিকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম খবরটা দেব বলে। কারণ পুঁটিও আমার সঙ্গে লামাদাদুর কাছে যায়। আর লামাদাদুর ছাদে যে পাখিদের বসার জায়গা, সেটাও তো পুঁটির নিজের হাতে তৈরি!
হ্যাঁ পুঁটি কারপেন্ট্রি জানে। বলা যায়, ওটা একটা শখ ওর। ওদের বড় বাড়ির ছাদের ঘরে নিজের ছোট্ট একটা ওয়র্কশপ মতো বানিয়েছে ছেলেটা। তাতে কাঠের নানা জিনিস তৈরি করে ও। লামাদাদুর ছাদে পাখিদের বসার জন্য নানা রকমের দাঁড় বানিয়ে দিয়েছিল পুঁটিই। সেগুলো ওই চোরেরা ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। সেটা জানাতেই ওর মোবাইলে ফোন করেছিলাম। কিন্তু পাইনি। সুইচ্ড অফ।
ও তো কখনও ফোন সুইচ অফ করে না! তা হলে? আমার চিন্তা হয়েছিল। কিন্তু তখন আর
কল না করে আবার ঘণ্টাখানেক পরে চেষ্টা করেছিলাম। এ বারও সেই এক ব্যাপার। ভেবেছিলাম, আবার হারাল নাকি মোবাইলটা! যা ভুলো মন, ওকে বিশ্বাস নেই।
আমি আর সময় নষ্ট না করে সোজা স্কুটি নিয়ে নরেন্দ্রপুর থেকে হাজির হয়েছিলাম পণ্ডিতিয়ায় ওর অফিসে।
না। পুঁটির থেকে আমি কয়েকটা লাইনের বেশি কথা বের করতে পারিনি। খুব জোরাজুরি করায় ও বলেছিল, ‘‘আমি কার জন্য ফোন রাখব? কারও কেউ নই আমি। সব শেষ।’’
আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম পুঁটির দিকে।
রিজু পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ওর কথা শুনে ফুট কেটেছিল, ‘‘একটু সুর করে বল, ‘কারো কেউ নইকো আমি/ কেউ আমার নয়’... ড্যানির মতো লাগবে!’’
পুঁটি অসাড় চোখ তুলে তাকিয়েছিল রিজুর দিকে। তার পর আবার মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। আর সেই যে নামিয়েছিল মাথা, আর তোলেনি।
আমার রাগ হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল দিই ব্যাটাকে কয়েক ঘা। নাটক দেখে আর বাঁচি না খোকার! একটা মেয়ে কী বলেছে তাতে হেদিয়ে হেদুয়া হয়ে যাচ্ছে! কী এমন মেয়ে এনা! স্নব একটা! নিজের ইচ্ছের সামনে অন্যের মূল্য নেই! আমি তো প্রথম থেকে জানতাম পুঁটির ঝুঁটি ধরে ওই মেয়ে নাচাবে। কিন্তু বলিনি আমি। পুঁটি কী ভাববে কে জানে!
আমি আর দাঁড়াইনি সে দিন। শুধু ‘‘কিছু দরকার হলে বলিস,’’ বলে চলে এসেছিলাম।
তাতে পুঁটি, পৃথিবী থেকে চাঁদ অবধি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘‘নাঃ, আমার সব শেষ। কিছুই লাগবে না।’’
রিজু আবার ফিরছিল সেই সময়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘‘আমার লাগবে। শোন না, সামনেই ইডেনে অস্ট্রেলিয়া-ইন্ডিয়ার টি-টোয়েন্টি আছে। দু’টো টিকিট জোগাড় করে দিবি?’’
ট্রেন থেকে নামার সময়ে আমি বিপাশাদির মোবাইল নাম্বারটা চেয়ে নিলাম।
বিপাশাদি বলল, ‘‘যাঃ, তোমার নামটাই তো জানা হয়নি!’’
আমি বললাম, ‘‘সর্বোত্তমা মিত্র। সাবু, আপনি সাবু বলবেন।’’
বিপাশাদিই হেসে আমার থুতনি ধরে বলল, ‘‘চুলটা বড় রাখলে তোমায় যে কী সুন্দর দেখাবে! যোগাযোগ রেখো কিন্তু।’’
আমি বললাম, ‘‘নিশ্চয়ই। বাগানের ব্যাপারটাও কিন্তু মনে রাখবেন।’’
আসলে কথায় কথায় আমি জেনেছি যে, বিপাশাদি আর ওর স্বামী দু’জনেই নাকি খুব ভাল বাগানের কাজ জানে। লামাদাদুর বাড়ির সামনে বাগানটা কেমন যেন আগাছায় ছেয়ে, এমনি পড়ে আছে। বিপাশাদিকে বলেছি যে ওরা যদি এক দিন সময় করে এসে বাগানটা গুছিয়ে দিয়ে যান... লামাদাদু আপত্তি করবে না আমি জানি।
লামাদাদু আমার কথায় একটুও আপত্তি করে না। লোকটা যেন আমার জীবনের ছোঁয়াছুয়ি খেলার বুড়ি। হাঁপিয়ে গেলেই ধরে দাঁড়িয়ে পড়ি।
আমাদের বাড়িতে জন্ম থেকেই লামাদাদুকে আসতে দেখি আমি। আমার ঠাকুমার বন্ধু ছিল দাদু। তবে আমার মনে হয়, কেসটা শুধু বন্ধুত্ব নয়। কিন্তু আমি কোনও দিন লামাদাদুকে বা আর কাউকে এই নিয়ে কিছু বলতে দেখিনি। দাদু এমনি এসে আমাদের সবার সঙ্গেই গল্প করত। ঠাকুমার কাছেও যে খুব একটা যেত তা নয়। এমনি আর পাঁচটা লোকের মতোই থাকত। বাবার সঙ্গে বসে দাবা খেলত।
শুধু ঠাকুমা যে দিন মারা গেল, সে দিন দেখেছিলাম, এক বার মাত্র ঠাকুমার নিথর হাতটা ছুঁয়েছিল দাদু। তার পর সারা দিন চুপ করে বসেছিল। কারও সঙ্গে কোনও কথা বলেনি।
এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় আর নিয়মিত আমাদের বাড়িতে আসতে পারে না লামাদাদু।
কিন্তু আমি যাই। লামাদাদুর বাড়িটা কতকটা যেন আমারই বাড়ি।
আমি ট্রেন থেকে নেমে ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে পাঁচটা বাজে। এ বার বাড়ি ফিরব। কাল অফিসে যাব না-হয়। এই ছেঁড়া জুতো নিয়ে পা ঘষটে ঘোরা সম্ভব নয়।
দমদম স্টেশনে খুব ভিড়। বিকেলের দিকে এমনটা থাকেই। আমি দেখলাম টিকিট কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের লাইন এঁকেবেঁকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। আমাদের দেশটায় এত বেশি লোকজন যে, খুব ছোট কোনও পুজো প্যান্ডেলেও খিচুড়ির লাইনে দু’শো জন মানুষ ইজ়ি পাওয়া যায়।
সত্যি, যৌনতাকে কলঙ্কের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া একটা দেশে এ এক চূড়ান্ত অক্সিমোরোন।
আমায় ও লাইনে দাঁড়াতে হবে না। কারণ আমার কার্ড আছে।
আমি বড় ব্যাগ থেকে টাকার ছোট পার্সটা বের করলাম। এর মধ্যেই কার্ড থাকে। আর ঠিক তখনই মোবাইলটা বাজল। এখন আবার কে? নেপালদা না কি? মা কেমন আছে জানতে কি ফোন করল?
আমি জিন্সের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। আর চমকে উঠলাম নামটা দেখে। ‘এনা’। এনা আমায় ফোন করছে, কেন? ও তো কথাই বলত না আমার সঙ্গে আগে। এমনকি পুঁটি যে কথা বলত, তাতেও নানা বাঁকা কথা শোনাত। তা হলে এখন কেন?
আমি চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইলাম স্ক্রিনের দিকে। ফোনটা বেজেই চলেছে। যেন রাত দু’টোয় ঘুম থেকে জেগে গিয়ে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করা দশ মাসের বাচ্চা।
শালার যন্ত্র হয়েছে এক! মনে হল আমিও পুঁটির মতো ঘোষণা করে দিই, মোবাইল ব্যবহার করব না। তখন দেখি কোন এনা আমায় ফোনে পায়!
আমি চোয়াল শক্ত করে স্ক্রিনে আঙুল ঘষে কলটা রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগালাম। মনে হল দু’শো কেজির চালের বস্তা তুললাম যেন!
এনাকে আমি এত অপছন্দ করি! আগে তো এতটা বুঝিনি! আমার নিজেরই অবাক লাগল নিজের ব্যবহারে!
৩
পুঁটি (দিন : সাত)
আচ্ছা, আপনাদের যখন তখন ঘুম পায় না? আমার তো পায়, সারা ক্ষণ ঘুম পায়! স্নান করতে করতে। খেতে বসে। ট্রামে করে অফিস যেতে যেতে। অফিসে কাজ করতে করতে। বই পড়তে বসে। ঘুম আসে, শুধু ঘুম! আর মনে হয় বাটির মতো কলকাতায় কেউ একটা ঘন তরল ঢেলে দিয়েছে। আর তার মধ্য দিয়ে আমি স্লো মোশনে হেঁটে চলেছি। সবই করছি কিন্তু কেমন যেন আন্দাজে আন্দাজে। কিছু কানে ঢুকছে না। চোখের সামনে সব ঝাপসা। কোনও ঘটনাই রেজিস্টার করছে না মাথায়। আর মাঝে মাঝেই প্রবল ঘুম পাচ্ছে। আমার সময় গুলিয়ে যাচ্ছে। কলকাতার সব কিছু কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে দিনকে দিন... এনা আমায় এ কেমন শহরে রেখে চলে গেল!
‘‘তুই কোনও দিন ক্যালানি খাসনি, না?’’ পাশ থেকে আমায় খোঁচা দিল রিজু।
‘‘কী বললি?’’ ওর দিকে তাকাতে গিয়ে মনে হল আমার চোখের পাতায় কেউ যেন কুড়ি কেজির বাটখারা চাপিয়ে রেখেছে।
‘‘বলছি,’’ রিজু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘‘ক্যালানি। ধোলাই। প্যাঁদানি। খাসনি, না কোনও দিন? কাকিমা তো মাটির মানুষ। কাকুও কাজ নিয়ে পড়ে থাকে। জেঠু ভালবাসে খুব। আর ছোটকার তো ফেভারিট তুই। বাড়িতে কেউ নেই যে তোকে ক্যালাবে! ঠিক না?’’
‘‘কেন, মারবে কেন?’’ আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম রিজুর দিকে।
‘‘এই যে সাত দিন ধরে দেখছি ঢ্যামনামো করে যাচ্ছিস, সেটা হত না যদি ছোটবেলায় নিয়ম করে ক্যালানি খেতিস।’’
আমি দেখলাম আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। মেট্রোয় আছি আমরা। ভিড় বেশ। এসি মেট্রো নয়। গরম আর আওয়াজে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। তার মধ্যে ওই ভীষণ আওয়াজের উপর গলা তুলে কথাটা এমন করে বলেছে রিজু, যে সবাই তাকাচ্ছে!
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘‘চুপ কর।’’
(ক্রমশ)