ছবি: বৈশালী সরকার
যুগে যুগে নারী হেরে গেছে আজন্মলালিত সংস্কারের কাছে। লড়াই করতে করতে কখন যেন নারী নিজেই পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা কাঁধে তুলে নিয়েছে অজানতে। তার পর হাজার স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোলেও সেই বাঁধন থেকে মুক্তি নেই তাদের, হাজারে হাজারে মেয়ে রোজ পরাভূত হচ্ছে, মঞ্জীরাও কি পারল? না হলে আকাশদীপের ব্যাপারে কি মঞ্জীরা মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন নয়? আকাশদীপের শারীরিক অসুস্থতার সময়েও এক বারের জন্যও কি উদ্বেল হয়েছিল সে? আকাশদীপ যে তার ফেরার কারণ নয় তা জানে মঞ্জীরা।
অথবা সত্যিই কি জানে? নিজেকে কতটাই বা চেনে মঞ্জীরা! এই কাফের নিভু-নিভু আলোয় নিজেকে আরও এক বার অচেনা লাগছে তার। উত্তীয় মুখ খুলল বেশ অনেক ক্ষণ পরে, “চলি তা হলে মঞ্জীরা। টায়ার্ড লাগছে। মাই গড, লাইফ অব আ ব্যাঙ্কার!” মঞ্জীরা উত্তীয়র দিকে তাকাল, সন্তর্পণে বলল, “সো! আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে না তো? আমি তোমায় ছাড়া ভাবতেই পারি না উত্তীয়। বন্ধুত্বটুকু রেখো প্লিজ়। আর বাকিটুকুর জন্য আমায় পারলে ক্ষমা করে দিয়ো। প্রবলেমটা তোমার নয় উত্তীয়, প্রবলেমটা একান্তই আমার। কিন্তু তোমায় ছাড়া...”
উত্তীয় মঞ্জীরাকে কথা শেষ করতে দিল না। আড়মোড়া ভাঙছে নিরাসক্ত ভাবে, “না না, সে সব ঠিক আছে। সবচেয়ে জরুরি, আমরা খুশি থাকব কি না। যে যে ভাবে খুশি থাকে সেটাই বড় কথা। আর বন্ধুত্বের কথা বলছ? হ্যাঁ, আছি। বাকি বন্ধুরা যে ভাবে থাকে সে ভাবেই আছি। হয়তো দেখা হবে না, কালেভদ্রে কথা হবে, তবু পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকি না কেন, আমরা বন্ধুই থাকব।”
উঠে দাঁড়াল উত্তীয়। কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গেটের বাইরে।
মঞ্জীরা পতনের শব্দ শুনছিল। প্রবল ঝড়ে প্রকাণ্ড মহীরুহ সমূলে উৎপাটিত হওয়ার শব্দ। সে বুঝতে পারছে, এক আশ্চর্য নির্লিপ্তি নিয়ে চলে যাচ্ছে উত্তীয়। সে জানে মুখে যা-ই বলুক, ওই পুরুষ আর জীবনে কখনও ফিরে তাকাবে না তার দিকে। আজ এই বৃষ্টির সন্ধেটাই সম্ভবত তাদের শেষ দেখার সাক্ষী হয়ে রইল। আর একটি বারের জন্যও তাদের জীবনে এই সব আসা-যাওয়া ফিরবে না।
মঞ্জীরা দেখল, উত্তীয় এতটুকু দাঁড়াল না। কাফের কাচের দরজার বাইরে তখন চলছে এক প্রবল ধারাপাত। কাফের দরজা থেকে দমকা জোলো হাওয়ার দমকে ভরে গেল গোটা কাফে। সব পথচারীই কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিয়েছে এমন তুমুল বৃষ্টিতে, শুধু উত্তীয়ই কাফের বাহারি সিঁড়ি বেয়ে ধীর অকম্পিত পায়ে নেমে গেল আর তার পর হাঁটতে লাগল নিঝুম ফুটপাত দিয়ে।
মঞ্জীরার বুক কেঁপে উঠল সেই দৃশ্য দেখে। প্রবল ঝড় উঠেছে আর সঙ্গে এমন অঝোর বৃষ্টি, বাজ পড়ার শব্দ হচ্ছে মুহুর্মুহু। এই অবস্থায়, এমন দুর্যোগ মাথায় নিয়ে স্বপ্নোত্থিতের মতো রাস্তায় হাঁটছে মানুষটা!
মঞ্জীরার ভিতর একটা ছোট্ট মেয়ে পাশ ফিরে শুল। সেই মেয়েটা এক কালে একটুর জন্য ডিসট্রিক্ট লেভেল চারশো মিটার দৌড় চ্যাম্পিয়ন হতে হতেও হয়নি। মেয়েটা চাইছে এক ছুটে উত্তীয়কে ধরে ফেলতে। তার কপাল গাল আর ঠোঁটে বৃষ্টিকণার মতো আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে। শহরময় ভিজে হাওয়ার আঁচল বিছিয়ে দেবে সেই মেয়েটি, হাঁটুজল জমা সব ক’টা গলিপথ হবে তার বাহুডোর। কত দূর যাবে উত্তীয়? মেয়েটা তাকে ঠিক ধরে ফেলবে। মঞ্জীরা কাফের নরম সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল। এক অদ্ভুত ক্লান্তি গ্রাস করছে তাকে। তার মনে হচ্ছে আর কোনও দিনই এই সোফা ছেড়ে উঠতে পারবে না সে।
মঞ্জীরা বাড়ি ফিরল অনেক রাতে। বৃষ্টি ধরে এসেছে কিছু ক্ষণ। দরজা খুলতেই গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ডাম্বো আর মিহিকা। দিদির শরীরে এক বার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে মিহিকা বলল, “কী রে! এত রাত হল তোর? এ দিকে কী তুমুল বৃষ্টি! ফোনটা তো ধরবি অ্যাট লিস্ট!”
মঞ্জীরা উত্তর দিল না। জুতো ছেড়ে অবসন্ন ভাবে স্নানঘরে ঢুকেছে। পোশাক পাল্টেছে যন্ত্রের মতো। রাতের খাবার গরম করছে পাথরের মতো কঠিন মুখ করে।
ডাম্বো খাবার দেখে শরীর মোচড়াচ্ছে, “খাব না। আজ অমলেট, আলুভাজা কিচ্ছু নেই। রোজ রোজ এত ভেজিস ভাল লাগে না আমার।”
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠেছে মঞ্জীরা, “চুপ! একদম চুপ!”
দু’জনেই চমকে তাকিয়েছে মঞ্জীরার দিকে। মঞ্জীরা গর্জে উঠল, “যা দেওয়া হয়েছে চুপ করে খেয়ে নেবে ডাম্বো। সারা দিন কাজের পর তোমাদের জন্য পিন্ডি বানাতে ভাল লাগছে না আমার। খেলে খাও না হলে টান মেরে ফেলে দাও। কী পেয়েছিস আমাকে, তোদের দাসী বাঁদি!”
দু’জনে অবাক হয়ে দেখল, মঞ্জীরার চোখ এক অজানা আক্রোশে জ্বলছে, খাওয়া অসমাপ্ত রেখেই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে, আর তার পরেই দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে গেল মঞ্জীরা ।
মিহিকা আর ডাম্বো কথা বলতে পারছে না এতটাই অবাক হয়েছে। মঞ্জীরাকে দুজনের কেউই কখনো উঁচু স্বরে একটা কথা বলতেও শোনেনি।
আজ কী হল মঞ্জীরার!
দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ডাম্বোর চোখ জলে ভরে এসেছে। জন্মাবধি সে জানে মা অনেক হার্ডল পেরিয়েছে, ডাম্বো এমন কিছু ছোট নয় যে কিছুই বুঝতে পারবে না। কিছু হার্ডল পেরোতে মাকে সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। কিন্তু মায়ের এ রকম রূপ সে আগে দেখেনি। কিন্তু মিহিকার চোখে চোখ পড়তে ডাম্বো দেখল সে হাসছে মিটিমিটি করে। ডাম্বো বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মায়ের কী হয়েছে মিমি?”
মিহিকা বলল, “মনে হয় বুঝতে পারছি, তুই আগে খাওয়াটা শেষ কর।”
“না, আমি কিচ্ছু খাব না,” অভিমান ভরা গলায় বলল ডাম্বো।
মিহিকা ডাম্বোর থালা থেকে রুটি ছিঁড়ে তরকারি পাকিয়ে তুলে দিয়েছে ডাম্বোর মুখে, “না, ও কথা বললে তো হবে না ডাম্বো। খেয়ে তো নিতেই হবে। এখন লক্ষ্মী ছেলে হয়ে খেয়ে নাও, তার পর আমরা মায়ের খাবারটা নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকব, আর তার পর...” মিহিকা থেমে গেছে। তবে মিটিমিটি হাসিটা এখন ছড়িয়ে গেছে তার মুখময়। ডাম্বো নিতান্ত শিশু নয়, সে বিভিন্ন পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে শিখেছে। সে দেখেছে একই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মানুষ বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়, কিন্তু তার পরেও সে বুঝে উঠতে পারছে না এই মুহূর্তে এত হাসির কী হল?
তার খাওয়া থেমে গেছে, মিহিকার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ডাম্বো। মিমি কি পাগল হয়ে গেল!
১৩
মন দিয়ে ফাইলগুলো দেখছিল আকাশদীপ। গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ। খুব খুঁটিয়ে দেখতে হবে। একটু এ দিক-ও দিক হলেই বিরাট সমস্যা। কয়েক দিন ধরে যা চলছে, এর পর নতুন করে আর কোনও ঝামেলায় জড়াতে চায় না সে। গত সপ্তাহ দুয়েক তার কেটেছে ঝড়ের মতো। প্রথম পর্বে যা ঘটল তা স্বপ্নেও আশা করেনি আকাশদীপ। রুলিং পার্টির মুখপাত্র পঙ্কজ মাইতি এক সকালে হঠাৎই এসে হাজির আকাশদীপের বালিগঞ্জের বাড়িতে। ঢাকঢোল পিটিয়ে, প্রেস-সাংবাদিক নিয়ে নয়, অত্যন্ত সঙ্গোপনে একটা প্রাচীন গাড়িতে করে এসে চুপচাপ আকাশদীপের বাড়িতে সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কয়েক দিন হল আকাশদীপ কিছুটা ভাল বোধ করছে। হাতে পায়ে জোর পাচ্ছে, হাঁটতে গেলে মাথা টলছে না। এর মধ্যে এক দিন তো বাড়ির পাশের পার্কে প্রায় আধ ঘণ্টা একটানা দিব্যি হেঁটে এল সে।
সে দিন আকাশদীপ সকালে চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজটায় সবে চোখ রেখেছিল, এই অবস্থায় পঙ্কজ মাইতিকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল সে। খবরের কাগজে, নিউজ় চ্যানেলে আজকাল প্রায়ই দেখা যায় এই লোকটাকে। আকাশদীপদের পার্টি আর কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রাদ্ধ না করে জলস্পর্শ করেন না ভদ্রলোক। সেই লোক যদি সাতসকালে জুলজুল চোখে সামনে এসে দাঁড়ায় তবে বুঝতে হবে বিষয় গুরুতর।
সত্যিই গুরুতর। আকাশদীপ আর তার পার্টির মধ্যেকার সম্পর্কে ভাঙনের খবর তলে তলে পৌঁছে গেছে রুলিং পার্টির কাছে। এই অবস্থায় আকাশদীপের মতো জনপ্রিয় আর সৎ এক জন নেতা কেন যে ওই পার্টির পিছনে জীবন নষ্ট করছে, তা নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন পঙ্কজ মাইতি।
অত বড় একটি পলিটিক্যাল পার্টির মুখপাত্রের দুশ্চিন্তা বলে কথা, এ তো আর হেঁজিপেঁজি লোকের দুশ্চিন্তা নয়। সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যই চা খেতে তিনি আকাশদীপকে একটি প্রস্তাবও দিয়ে বসেছিলেন। তাঁর ধারণা, উত্তর ভারতের পার্টি বাংলার ভূমিপুত্রদের দিয়ে শুধু বেগার খাটিয়ে নেবে কিন্তু উঁচু পোস্টে নন-বেঙ্গলি পাবলিক ছাড়া কেউ জায়গা পাবে না। তিনি তো প্রথম দিন থেকেই অবাক হয়ে ভাবতেন আকাশদীপের মতো এক জন ব্রাইট, শিক্ষিত মানুষ ওই প্রিমিটিভ চিন্তাভাবনার একটা পার্টিতে কী করে টিকে আছেন!
বিনা কারণে তো আর রুলিং পার্টি পঙ্কজ মাইতিকে তাদের মুখপাত্র বানায়নি। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে যখন তিনি সে দিন বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, তত ক্ষণে আকাশদীপ গাঙ্গুলির রুলিং পার্টি যোগ দেওয়ার কথা প্রায় পাকা হয়ে গেছে।
পরের সপ্তাহে অফিশিয়ালি নতুন পার্টি জয়েন করেছে আকাশদীপ। পেয়েছে উচ্চ মর্যাদার প্রশাসনিক পোস্ট, পরের বিধানসভা ইলেকশনে পারুলগঞ্জ কেন্দ্র থেকে টিকিট পাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ব্যাপার প্রকাশ্যে আসার পরই শাসক দলের তরফ থেকে তাদের রাজ্য অফিসে এই সুসজ্জিত চেম্বারটা পেয়েছে আকাশদীপ।
শরীরের এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরনোর খবরে লোপামুদ্রা হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, আকাশদীপ পাত্তা দেয়নি। শরীরের জোরটা রোজই ফিরছে একটু একটু করে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝিমিয়ে পড়া জেদটাও। তাকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, সে এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এক-একটা অবিচারের উত্তর দেবে সে। আকাশদীপ গাঙ্গুলি কী জিনিস বুঝবে এ বার তারা। ও যখন শেষ ফাইলটার মাঝামাঝি তখন দরজা ঠেলে বেয়ারা ঘরে ঢুকল। বেয়ারা বলল, “আপনার দু’জন ভিজিটর আছে সাহেব।”
আকাশদীপ চোখ সরু করে বেয়ারার দিকে তাকাল। নতুন পার্টি জয়েন করার পর প্রচুর এলোমেলো লোকজন হঠাৎই তার সাক্ষাৎ-প্রত্যাশী হয়ে উঠেছে। বেশির ভাগই পার্টির খুচরো পার্ট টাইমার, ক্যাডার টাইপের ছেলেপুলে। অথচ এই সময়টাই একটু অন্তরালে কাটাতে চেয়েছিল আকাশদীপ। পলিটিক্স তার অস্থিমজ্জায় মিশে গেলেও এখনও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে উঠতে পারেনি সে। আগের পার্টির সঙ্গে তার চিন্তাধারার মিল ছিল, রাজনীতিটাও ভালবেসেই করেছিল আকাশদীপ। সেই পার্টি তাকে দাগা দিয়েছে। সেই জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সে বিরূদ্ধ পার্টিতে জয়েন করেছে এ কথা ঠিক, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ভোল বদল করতে সমস্যা হচ্ছে তার। সে চেয়েছিল কিছু দিন পর নতুন পার্টির হয়ে প্রকাশ্যে আসতে, কিন্তু লোকগুলো এমন হ্যাংলা হয়ে লাফিয়ে পড়েছে...
আকাশদীপ একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে বলো। কে এসেছে? ভিজ়িটিং কার্ড দেখি?”
দেখা গেল বেয়ারাও বিরক্ত কম নয়, “না না। তেমন হোমরাচোমরা কেউ নয় স্যর। এত করে বললাম স্যর এ ভাবে কারও সঙ্গে দেখা করেন না, তা দু’জনেই সমান নাছোড়বান্দা, দেখা না করে নাকি তারা যাবেই না। একটা ইয়াং মেয়ে আর একটা বাচ্চা, এই বারো-চোদ্দো বছর বয়স। ভাগিয়ে দিই, কী বলেন স্যর?”
ওরা দু’জন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। গা ঘেঁষে বসার দরকার নেই। ওরা বসে আছে প্রশস্ত নরম সোফায়। প্রচুর জায়গা। তবুও ডাম্বো মিহিকার কোলের কাছে বসে আছে। তার গায়ে
স্কুল ইউনিফর্ম, কাঁধে স্কুলব্যাগ। বোঝা যাচ্ছে স্কুল থেকে বেরিয়ে সরাসরি সে পার্টির অফিসে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু এখানে আসার পর ডাম্বো ঘাবড়ে গেছে। বাবাকে সে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল এক দিন, সে দিনই মনে হয়েছিল, বাবা আর সেই বাবা নেই। ডাম্বোর বুঝতে সময় লাগলেও শেষতক সে বুঝেছিল, বাবা অনেক পাল্টে গিয়েছে। এমন নয় যে বাবা ডাম্বোকে ভালবাসেনি বা কাছে টানেনি। বরং আগের বারের চেয়েও অনেক বেশি আঁকড়ে ধরেছিল ডাম্বোকে।
ডাম্বোই বরং একটু গুটিয়ে ছিল। পৃথিবী ঘুরছে অবিরত। দিন রাত্রি আর ঋতু পরিবর্তনের ফাঁকে ফাঁকে পাল্টে যাচ্ছে মানুষ নিজেও। ডাম্বো বুঝেছিল, বাবা যেমন আর আগের বাবা নেই তেমনি ডাম্বো নিজেও অনেক পাল্টে গিয়েছে। সে-ও আর পাঁচ বছরের বাবা-ন্যাওটা ছেলেটা নেই। বাবা যখন চোখের জল ধরে রাখতে পারছিল না, ডাম্বোকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিল, তখন বন্দি দশায় থাকা মানুষের মতো হাঁপিয়ে উঠছিল ডাম্বো। বাবার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসে যেন একটু স্বস্তি পেয়েছিল সে দিন।
বাবা বার বার বলেছে তাকে ফিরে আসতে, শুধু তাকে নয়, তার সঙ্গে মাকেও। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল ডাম্বো। তার মায়ের চোখমুখ ছিল ভাবলেশহীন। ডাম্বো সম্মতিতে মাথা নাড়তে পারেনি। সে বুঝছিল মাঝখানে একটা লম্বা সময় পেরিয়ে গিয়েছে আর অনেক কিছুই পাল্টে দিয়ে গেছে সেই সময়।
আজ এই সুসজ্জিত পার্টি অফিসে বসে ডাম্বো ভাবল, ভাগ্যিস সে ঘাড় নেড়ে আসেনি সে দিন! সত্যি কী বোকাই না ছিল ডাম্বো! এত কাছে তার চোখের সামনে তার মা একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছিল সে কেন বুঝতে পারেনি, অথচ এই মা-ই তো ডাম্বোর প্রতিটি ভাল মন্দের দিকে তাকিয়ে নিজের সব কিছু বিকিয়ে দিয়ে বসে ছিল এত দিন।মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে কয়েক রাত সে মিমির পাশে শুয়েছিল, মিমি খুব যত্নে তাকে গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছে। শুধু বুঝিয়েই দেয়নি তারা অপেক্ষায় ছিল একটা আদর্শ সময়ের।সেই রাতে মা উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করার পরেই ঘটনাটা ঘটেছিল। খাওয়া সেরে ডাম্বো মিমির সঙ্গে ঢুকেছিল মায়ের ঘরে।
“এই যে, তোমরা দু’জন! চলে এসো।
স্যর ডাকছেন...” আর্দালি বিরস বদনে তাকাল ওদের দিকে।
ঝটিতি উঠে দাঁড়িয়েছে মিহিকা, তার দেখাদেখি ডাম্বোও। দু’জনে পায়ে পায়ে ঢুকল আকাশদীপের কেবিনে। বেশ বড়সড় কেবিন পেয়েছে আকাশদীপ, এসি চলছে, ডাম্বোর ঘামে ভেজা প্যান্টের কাপড় আঁকড়ে ধরল হিম হাওয়া। ডাম্বোর আজও অবাক হওয়ার দিন। প্রথম বার অসুস্থ বাবার পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হয়েছিল ডাম্বো, আজ বাবাকে দেখে একেবারেই ভেবলে গেল সে। আশ্চর্য! এই ক’দিনে বাবা যেন আবার পাল্টে গেছে। চেনাই যাচ্ছে না।
সেই ফতুয়া পরা রুগ্ণ, ভেঙে পড়া লোকটা কোথায় গেল? তার সামনে বিশাল টেবিলের ও পারে ধোপদুরস্ত সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি শোভিত, ক্লিন শেভড লোকটাকে দেখে তার সেই ছ’বছর আগের বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। শুধু এই লোকটার ওজন বেড়েছে আগের থেকে, হাবভাবেও একটা ভারিক্কি ভাব। ডাম্বো সেই প্রকাণ্ড টেবিলের সামনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
আকাশদীপ ফাইল বন্ধ করে হাসিমুখে তাকাল, “আরে, ডাম্বোবাবু যে? কী খবর? হঠাৎ? কোনও খবর নেই কিছু নেই, এসো এসো বোসো মিহিকা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, ইউ আর কোয়াইট আ লেডি নাউ।”
মিহিকা আর ডাম্বো বসল পাশাপাশি চেয়ারে। আকাশদীপ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, তার দৃষ্টিতে আনন্দ আর বিস্ময় মাখামাখি হয়ে আছে। আকাশদীপ বলল, “সোজা স্কুল থেকে এসেছ দেখছি। কী খাবে বলো। চাউমিন আনাই? তুমি তো চাউমিন খেতে খুব ভালবাসতে।” ডাম্বো আবার অবাক হল, কস্মিনকালেও সে চাউমিনের ভক্ত নয়। এই লোক এলোমেলো কথা বলছে, তার থেকেও বড় কথা এঁকে দেখে মনে হচ্ছে মানসিক ভাবে উনি অন্য জগতে রয়েছেন। ডাম্বো ভুল ভাবেনি। আগামী কাল সন্ধেয় চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে আকাশদীপের মিটিং আছে। আগে ফোনে কথা হলেও সামনাসামনি দেখা হবে এই প্রথম। তার আগে সে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায়। অনেক ফাইল দেখতে হবে, নিজের অ্যাজেন্ডা ক্লিয়ার করতে হবে আর সবচেয়ে বড় কথা, বুঝে নিতে হবে এই অবস্থায় রুলিং পার্টির অন্দরে আকাশদীপ গাঙ্গুলির মার্কেট ভ্যালু ঠিক কতটা।
ক্রমশ