খাবারের পিছনে সংসার খরচের পরিমাণ কমিয়েছে দেশের আমজনতা। পাশাপাশি, অন্য খাতে বেড়েছে ব্যয়। গত ১২ বছরে খাদ্য সামগ্রী এবং অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ভারতীয় পরিবারগুলিতে এসেছে বড় পরিবর্তন। সম্প্রতি এমনই চাঞ্চল্যকর সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই)।
রিপোর্টে আরও গভীরে গিয়ে দেশবাসীর খাদ্যাভাসে বদলের ব্যাপারটি তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে, শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় ডাল ও দানা শস্যের ব্যবহার পাঁচ শতাংশের বেশি কমেছে। শুধু তা-ই নয়, দেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে একাধিক বড় বদল এসেছে। এই পরিবর্তন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বলে সমীক্ষা রিপোর্টে স্পষ্ট করেছে এসবিআই।
স্টেট ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ২০১১-’১২ আর্থিক বছরে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলি খাবারের পিছনে ৫২.৯ শতাংশ খরচ করত। অন্য দিকে খাবার ব্যতীত অন্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪৭.১ শতাংশ। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে খাবারের পিছনে সংসার খরচ ৪৭.০৪ শতাংশে নেমে আসে। খাবার ব্যতীত অন্য খাতে ব্যয়ের মাত্রা ৫২.৯৬ শতাংশ পৌঁছে যায়। অর্থাৎ গ্রামীণ এলাকায় খাবারের পিছনে সংসার খরচ কমেছে ৫.৮৬ শতাংশ।
অন্য দিকে ২০১১-’১২ সালে শহরাঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারগুলি খাবারের পিছনে সংসার খরচের ৪২.৬২ শতাংশ খরচ করত। খাবার বাদ দিয়ে অন্য খাতে তাঁদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫৭.৩৮ শতাংশ। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে এই অঙ্ক বদলে গিয়ে যথাক্রমে ৩৯.৬৮ এবং ৬০.৩২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ খাবারের পিছনে শহরের বাসিন্দাদের ব্যয়ের পরিমাণ কমেছে ২.৯৪ শতাংশ। আর অন্য খাতে ২.৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যয়।
সমীক্ষকরা জানিয়েছেন, গ্রামীণ এলাকা এবং টিয়ার ২ ও টিয়ার ৩ শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্রমাগত খাবার বাদ দিয়ে অন্য ধরনের সামগ্রী কেনার প্রবণতা বাড়ছে। এর নেপথ্যে আর্থিক সমৃদ্ধি, সরকারি নীতি এবং জীবনযাত্রা শৈলীর পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন তাঁরা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য খাতে ভারতীয়রা খরচ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
উদাহরণ হিসাবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের কথা বলেছে এসবিআই। এতে শহর হোক বা গ্রাম সর্বত্র বাড়িতে শৌচালয় তৈরির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছেন সাধারণ মানুষ। গত ১২ বছরে এর পিছনে খরচের মাত্রা বেড়েছে। বর্তমানে গ্রাম-শহর নির্বিশেষ অধিকাংশ বাড়িতে শৌচালয় রয়েছে বলে সমীক্ষায় স্পষ্ট করা হয়েছে।
খাবার ছাড়া অন্য সামগ্রীর পিছনে সংসার খরচ বৃদ্ধি নেপথ্যে দ্বিতীয় কারণ হিসাবে নব্বইয়ের দশকের ‘উদার অর্থনীতি’র কথা বলেছেন সমীক্ষকরা। এর ফলে ভারত থেকে অন্য দেশে গিয়ে কাজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরির জন্য এক রাজ্য থেকে অন্যত্র যাচ্ছেন বাসিন্দারা। এর ফলে পশ্চিমী সংস্কৃতির সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হয়েছেন ভারতীয়রা। পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও এই সাংস্কৃতিক মেলবদ্ধনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উল্লেখ্য, গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের আগে গ্রামীণ এলাকায় সংসার খরচের ৭০ শতাংশই ব্যয় হত খাবারের পিছনে। শহরাঞ্চলে এই পরিমাণ ছিল ৫৫ শতাংশ। অন্য দিকে খাবার বাদ দিয়ে অন্য খাতে ভারতীয় পরিবারগুলি খরচ করত যথাক্রমে ৩২ এবং ৩৮ শতাংশ। ‘উদার অর্থনীতি’ আসার পর যত সময় গড়িয়েছে, ততই আর্থিক সমৃদ্ধির খোঁজে বিভিন্ন ধরনের কাজের দিকে ঝুঁকেছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। ফলে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন হয়েছে তাঁদের।
তা ছাড়া ৯০-এর দশকের আগে কর্মক্ষেত্রে এ দেশের মহিলাদের সে ভাবে দেখা মিলত না। কিন্তু ‘উদার অর্থনীতি’ এই চিন্তা ভাবনাকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি বৃদ্ধির জেরে গৃহস্থালীর কাজে বেশ কিছু পণ্যের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী হয়ে গিয়েছে। এসবিআইয়ের সমীক্ষকদের দাবি, বর্তমানে ফুড ডেলিভারি অ্যাপ বা রেডি টু ইট ধরনের খাবার বেশি পরিমাণে খাচ্ছেন ভারতীয় পরিবারের সদস্যরা।
পাশাপাশি, সময়ের অভাবে ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কেনার পরিমাণ এ দেশের নাগরিকদের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে বলে জানা গিয়েছে। একটা সময়ে এ দেশে ওয়াশিং মেশিন বা রেফ্রিজেটারের মতো সামগ্রীগুলি আর্থিক সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। কিন্তু বর্তমানে কর্ম ব্যস্ত জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এই ধরনের পণ্য ভারতীয় পরিবারগুলিতে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
২০১৭ সালে পণ্য এবং পরিষেবা কর (গুডস্ অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি) চালু করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। কেনা-কাটার ক্ষেত্রে এটিও ভারতীয় সমাজে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন এসবিআইয়ের সমীক্ষকরা। খাদ্য শস্য থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলিতে জিএসটির মাত্রা মাত্র পাঁচ থেকে ১২ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। ফলে এক ধাক্কায় কমেছে বেশ কিছু পণ্যের দাম। সেই সঙ্গে বেড়েছে সেগুলির বিক্রি।
বিদ্যুৎ পরিষেবার উন্নতি ভারতীয় সমাজে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। একটা সময়ে এ দেশের বহু গ্রাম ছিল বিদ্যুৎ বিহীন। কিন্তু বর্তমানে সেই ছবির আমূল বদল ঘটেছে। দেশের প্রায় প্রতিটা কোণায় বিদ্যুৎ নিয়ে গিয়েছে সরকার। এর জেরে বৈদ্যুতিন পণ্য কেনার পরিমাণ হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্টেট ব্যাঙ্কের সমীক্ষকরা জানিয়েছেন, গ্রাম বা শহরে কেনাকাটায় পরিবর্তনের নেপথ্যে আরও একটি বড় ভূমিকা পালন সরকারের রেশনিং ব্যবস্থা। এতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলি ভর্তুকিতে ভাল খাদ্য দ্রব্য কিনতে পারছেন। ফলে বেঁচে যাচ্ছে সংসার খরচের কিছু টাকা। সেই অর্থ পরবর্তীতে খাবার বাদ দিয়ে গৃহস্থালির অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার পিছনে খরচ করছেন তাঁরা।
একুশ শতকের গোড়াতেও এ দেশের অর্থনীতি ছিল মূলত টাকা নির্ভর। ঋণ নেওয়াকে ভাল চোখে দেখত না ভারতীয় পরিবার। সেখানে বর্তমানে ডিজিটাল অর্থনীতি চলে আসায় এই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। এ দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার। নতুন প্রজন্ম প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে ধার নিতে একেবারেই পিছু পা হয় না। উল্লেখ্য ২০১৪ সালে এ দেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র দু’কোটি। ২০২৩ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে ১০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এর পাশাপাশি ডিজ়িটাইলাইজেশনের দিকে সরকারের বেশি করে নজর দেওয়াকেও উল্লেখ করেছেন এসবিআইয়ের সমীক্ষকরা। আগে বেশ কিছু পণ্য কেনার ক্ষেত্রে গ্রাম বা আধা শহরের বাসিন্দাদের অনেকটা দূরে যেতে হত। বর্তমানে মোবাইল ফোনের একটা ক্লিকে বাড়িতেই পৌঁছে যাচ্ছে পণ্য। এই প্রযুক্তি গত পরিবর্তন কেনাকাটার দুনিয়ায় বড় পরিবর্তন এনেছে।
স্টেট ব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতীয় পরিবারগুলি উল্লেখ্যযোগ্য হারে বাড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাতের খরচ। নিজেদের সুস্থ রাখতে যোগ এবং জিমের পিছনে ব্যয় করছে জ়েন জ়ি। পাশাপাশি, এ দেশে গাড়ি কেনার প্রবণতা বেড়েছে বলেও সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
নব্বইয়ের দশক বা তার আগে তামাক জাত নেশার দ্রব্য কেনার পিছনে বিপুল খরচ করতেন এদেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশ। সেই দিকেও বড় পরিবর্তনের উল্লেখ করেছে এসবিআইয়ের সমীক্ষা। শহর এবং গ্রামাঞ্চলে দামি মদ কেনার প্রবণতা বেড়ছে বলে জানিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক।
সব শেষে বিদেশ যাত্রার পিছনে ভারতীয়দের খরচ বৃদ্ধির কথা বলেছে এসবিআইয়ের সমীক্ষকরা। তাঁদের দাবি, ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে বিদেশে পর্যটনের জন্য এদেশের নাগরিকরা খরচ করেছেন ১,৭০০ কোটি টাকা। এর সূচক ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।