Rabibasoriyo Novel

মায়াডোর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৩

“দেখ না কেমন অন্ধকার জায়গা, দূরে মেন রোডের আলো ছাড়া আর কোনও আলো নেই, আজকাল তো অন্ধকার পাওয়াই যায় না। চল না, গল্প করতে করতে হাঁটি একটু। বাইক স্টার্ট করলেই তো ইঞ্জিনের শব্দে কথাই বলা যাবে না।”

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:৩১
Share:

জীয়ন বলল, “হাঁটবি মিহিকা?”
“মানে?”
“দেখ না কেমন অন্ধকার জায়গা, দূরে মেন রোডের আলো ছাড়া আর কোনও আলো নেই, আজকাল তো অন্ধকার পাওয়াই যায় না। চল না, গল্প করতে করতে হাঁটি একটু। বাইক স্টার্ট করলেই তো ইঞ্জিনের শব্দে কথাই বলা যাবে না।”
মিহিকা অবাক হল। জীয়ন ছেলেটা ক্যাবলা টাইপ হলেও এমন কাব্যিক ভাব তার মধ্যে আগে দেখেনি মিহিকা।
ধীর পায়ে মাথা নীচু করে হাঁটছিল মিহিকা, নীরবে বাইক হাঁটিয়ে পাশে পাশে আসছে জীয়নও। তারা গল্প করবে বলে হাঁটা শুরু করেছিল অথচ কেউই কোনও কথা বলছে না।
ঘটনাটা ঘটল ঠিক তখনই।
একটা ইউ টার্নের লে আউট থেকে বাঁক নেওয়ার সময়েই একটা বাইক বিচ্ছিরি ভাবে ব্রেক কষল ওদের গায়ের ওপর এসে। অন্ধকারে আরোহী দু’জনের মুখ দেখা না গেলেও মিহিকা বুঝল দু’জনেই বেশ বড়সড় চেহারার পুরুষ।
ওদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে বাইকটা। আরোহীর সিটে বসা ছেলেটা প্রশ্ন ছুড়েছে, “কী! ফুর্তি চলছে?”
জীয়ন থতমত খেয়ে উত্তর খুঁজছে, মিহিকা বলে উঠল, “কী বাজে বকছেন? ভদ্র ভাবে কথা বলুন।”
বাইকে আরোহী দু’জন বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল, “শালা, ভদ্রতা শেখাচ্ছে! অন্ধকারে কী করতে এসেছ জানি না ভেবেছ?”
মিহিকা বুঝল সারা শরীরের রক্তস্রোত তার ব্রহ্মতালুর দিকে বইছে, সে চেঁচিয়ে উঠল, “একদম ফালতু কথা বলবেন না। যান এখান থেকে।”
বাইকের পিছনে বসা ছেলেটা নেমে এল, “ঝাঁঝ দেখেছ গুরু! এই মাল বিছানায় কী দাপাবে
বুঝতে পারছ!”
মিহিকা মেজাজ হারাল, “জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব, ছোটলোক, জানোয়ার কোথাকার!”
মিহিকার কথা শুনে রীতিমতো মারমুখী ভঙ্গিতে বাইক থেকে নেমে এসেছে অন্য জনও। ছেলে দুটো আর মিহিকার মাঝখানে এসে দাঁড়াল জীয়ন, “প্লিজ় দাদা। আমরা চলে যাচ্ছি। প্লিজ়।”
একটা ছেলে জীয়নকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। জীয়ন ছিটকে গিয়েও ফিরে এসেছে, সে হাতজোড় করে ফেলল, “প্লিজ় ঝামেলা করবেন না, আমি ওর হয়ে সরি বলছি।”
মিহিকা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কিসের সরি! কী করবেন আপনারা! আমি চেঁচিয়ে লোক ডাকব, কী পেয়েছেন কী! মগের মুলুক!”
একটা ছেলে অবলীলায় জীয়নকে তুলে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিল। আর তার পর হাতের বেড়ে মিহিকার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিয়েছে তাকে, “বহুত গরম না? আয় একটু ঠান্ডা করে দিই তোকে।”
আর একটি ছেলে শক্ত করে ধরে আছে মিহিকার হাতদুটো। সেই মুহূর্তে মিহিকা বুঝল মেজাজ হারানোটা ঠিক হয়নি। কাছাকাছি একটা জনমানব নেই কোথাও।
তখনই সামনের ছেলেটার গালে একটা প্রবল থাপ্পড় আছড়ে পড়ল, সেই অভিঘাতে প্রায় চার-পাঁচ হাত ছিটকে গেছে ছেলেটা। মিহিকা দেখল, ধুলো ঝেড়ে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে জীয়ন। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলছে হিংস্র শ্বাপদের মতো।
কয়েক মুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল ছেলে দুটো। সামলে নিয়ে মিহিকাকে ছেড়ে দু’জন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীয়নের ওপর।
এলোমেলো হাত পা চালাচ্ছে তিন জনই, মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতেই চলছে এক অসম লড়াই। মিহিকা দেখল জীয়নের ক্ষীণ অবয়বটা দুটো ভারী শরীরের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
মিহিকা দু’জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করছে সাহায্যের জন্য। মিহিকার চিল চিৎকার অন্ধকার ফালাফালা করে দিল, কাজ হয়েছে অবশেষে। দূরের চায়ের দোকান থেকে আবছা ছায়ার মতো জনা দশেক লোককে তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখল মিহিকা।
দেখেছে ছেলে দুটোও। জীয়নকে ছেড়ে বাইক স্টার্ট করেছে এক জন, আর এক জন লুটিয়ে থাকা জীয়নের পেটে শেষ লাথিটা মেরে লাফিয়ে বসেছে পিছনের সিটে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বড় রাস্তার দিকে একটা গলির ভিতর মিলিয়ে গেল বাইকটা।
লোকগুলো সবাই সেই এলাকারই বাসিন্দা। তারা ওদের নিয়ে গিয়ে চায়ের দোকানে বসাল। মিহিকার চুল এলোমেলো, আলুথালু পোশাকের অবস্থা। জীয়নের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ঝড়টা তার উপর দিয়েই গেছে। চোখের নীচে রক্ত জমাট বেঁধেছে, অঝোরে রক্ত ঝরছে ঠোঁটের কষ বেয়ে, পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উপড়ে গেছে।
স্থানীয় লোকগুলো সাধ্যমতো জীয়নের শুশ্রূষা করল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন এক জন। কী ভাবে এলাকার একটা বড় অংশ দিনের পর দিন অন্ধকারে ডুবে আছে অথচ প্রশাসন নির্বিকার, তা নিয়েও সরব হলেন এক জন। আর এক জন বয়স্ক ভদ্রলোক তো সামান্য বকেই দিলেন ওদের, এত অন্ধকারে ফাঁকা রাস্তায় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে মোটেই ঠিক কাজ করেনি জীয়ন আর মিহিকা।
মিহিকার কানে কিছু ঢুকছিল না, সে নিজেও এক মুহূর্ত চুপ করেনি। ঘটনার পর থেকে ক্রমাগত জীয়নের ওপর চেঁচিয়ে চলেছে সে, “নিজের গায়ের জোর জানিস না তুই? কী দরকার ছিল চড়টা মারার, লোক ডাকলেই তো মিটে যেত। সময়মতো এঁরা না এলে যে মরে যেতিস, সেটা জানিস!”
স্থানীয় লোকজন চলে যাওয়ার পর বাসস্ট্যান্ডে এসেও থামছিল না তার অভিযোগ। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আরও অসহ্য লাগছিল মিহিকার, সে গলা চড়িয়ে বলল, “কী রে! চুপ করে আছিস কেন? আমি লোক না ডাকলে ওরা তোকে পিটিয়ে পাউডার বানিয়ে দিত। বীরপুরুষ তুই, হ্যাঁ! বীরপুরুষ না, গাধা! ও রকম দুটো দানবের সঙ্গে একা...”
মিহিকা কথা শেষ করতে পারল না, সে অনুভব করল হঠাৎ জীয়ন তার দু’গাল ডান হাতের শক্ত পাঞ্জায় চেপে ধরেছে। জীয়নের হাতের দীর্ঘ আঙুলগুলো যেন চেপে বসছে মিহিকার গালে, মিহিকা ব্যথায় ককিয়ে উঠল।
সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠল জীয়নের গলা, “দু’জন কেন? দুশো জন এলেও একই কাজ করতাম। আমার সামনে তোর গায়ে হাত দেবে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব! কে গাধা? আমি না তুই? বুঝিস না কিছু!”
হঠাৎ মিহিকার গাল ছেড়ে দিয়েছে জীয়ন, তাচ্ছিল্যভরা স্বরে বলল, “যা, তোর বাস
এসে গেছে।”
মিইয়ে গেল মিহিকা। চলমান শবদেহের মতো বাসে উঠেছে। জানলার পাশের সিটে ছেড়ে দিয়েছে অবশ শরীর। স্তম্ভিত মিহিকার মনের ভিতরে তখন হাজার প্রশ্নের ঝড়।
কেন এত দিন ধরে নিজের অনার্সের ক্লাস ফেলে ছুটে এসেছে জীয়ন? যে ছেলেকে তার বাবা-কাকারা এক মুহূর্তের জন্যও নিজেদের ব্যবসায় বসাতে পারেনি, সে কেন দিনের পর দিন খেটে চলেছে মিহিকার কাফের পিছনে? কেন কেবল টিভির ছেলেটার নরম কথায় বিগলিত হয় সে, অথচ জীয়নের দিকে চোখ পড়ে না কোনও দিন? খুব কাছের জিনিস নাকি ভাল করে লক্ষ করে না মানুষ... এত কাছে! এতটাই কাছে ছিল জীয়ন? মিহিকার পায়ের কাছে এত দিন গুটিসুটি বসে থাকা ছেলে, তার একটা ভালবাসার দৃষ্টিপাতের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকা ছেলে, কোন মন্ত্রবলে মিহিকার গাল চেপে ধরল? জীয়নের বলা শেষ কথাগুলো কানে এক প্রচণ্ড শঙ্খধ্বনির মতো বাজতে লাগল মিহিকার— ‘বুঝিস না কিছু?’
জীবনে প্রথম বার বাসে উঠে পিছন ফিরে তাকাল মিহিকা। অন্য দিনের মতো কাঙাল চোখে দাঁড়িয়ে নেই জীয়ন, অল্প খুঁড়িয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের বাইকের কাছে।
মিহিকা জানলায় মাথা রাখল। আজীবন পুরুষসঙ্গ বরদাস্ত করতে পারে না সে। আজ তো শারীরিক ভাবে বেশ কিছুটা ঝড়ঝাপটাও সামলে উঠেছে, এই অবস্থায় একটা সাধারণ মেয়ের বিধ্বস্ত বোধ করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মিহিকা বুঝল তার ততটাও খারাপ লাগছে না, বরং তার বেশ ভাল লাগছে। খুব ভাল লাগছে।
কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে এসে থমকে গেল। পিছনের জানলার পাশে বসা সুন্দর দেখতে মেয়েটা জানলায় মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মের সান্ধ্য হাওয়ায় এলোমেলো উড়ছে মেয়েটির কাঁধ ছাপানো চুল।
ঘুমন্ত মেয়েটির ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেশ, শুধু তার চোখ থেকে ক্ষীণ জলের ধারা নেমে আসছে।

Advertisement

একের পর এক শর্ট অব দ্য লেংথ বল ছোবল মারছে ডাম্বোর পাঁজরের উচ্চতায়। অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় সেগুলোকে পোষ মানা বিড়ালছানার মতো নিজের পায়ের কাছে নামিয়ে আনছে ডাম্বো।
কোনও বোলার সচরাচর ব্যাটসম্যানের দিকে পরের পর একই রকম ডেলিভারি ছুড়ে যায় না। এ ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে, তার কারণ টুটুল স্যর।
ডাম্বোর শর্ট বল খেলার দুর্বলতা সবার আগে চোখে পড়েছে তাঁর। আর তার পর থেকেই এই সমস্যা সমাধানে উঠে পড়ে লেগেছেন টুটুল স্যর।
ফল পেতে দেরি হয়নি। ডাম্বোর জন্য বিশেষ সুখবর অপেক্ষা করছিল। তরফদার অ্যান্ড তরফদার মেমোরিয়াল কাপে নির্বাচিত তেরো জনের দলে জায়গাটা পেয়েই গেছে ডাম্বো।
জাগরণী ক্লাবে এখন সাজো সাজো রব। প্রতি বছরই হয়। এ বার শোরগোল আরও বেশি কারণ এ বার পোক্ত খেলুড়েরা অনুপস্থিত, তাদের জায়গায় কচিকাঁচারা লড়তে যাবে। তাদের উৎসাহও চোখে পড়ার মতো। উন্মাদনায় পিছিয়ে নেই ইয়ং বেঙ্গলও।
উৎসাহের আতিশয্যে অবশ্য কিছু কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগের কথা। ডাম্বোদের আবাসনের কাছাকাছি থাকে আবেশ শ্রীবাস্তব। আবেশদের বড়বাজারে ড্রাই ফ্রুটের ব্যবসা, খুব ছোটবেলা থেকে আবেশ ইয়ং বেঙ্গলে ট্রেনিং করছে। বয়সে ডাম্বোর থেকে বছর দুয়েকের বড়ই হবে আবেশ, কিন্তু তাকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই।
সে প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। আশা করা গিয়েছিল আবেশ ফাস্ট বোলিংয়ে মন দেবে। ইয়ং বেঙ্গলের কোচরা বেশ আশাবাদী ছিল আবেশকে নিয়ে। কিন্তু এক বার তার গোড়ালিতে এমন মোচড় এল যে আবেশের খেলার মোড়ই ঘুরে গেল। হাজার চেষ্টায় ব্যথা কিছুটা কমল, কিন্তু নির্মূল হল না পুরোপুরি।
আবেশ অফ স্পিনার হয়ে গেল, এক বারে নয়, ধাপে ধাপে। প্রথম ধাপে বলের স্পিড কমল, দ্বিতীয় ধাপে কমল রান-আপ আর তৃতীয় ধাপে আঙুলের মোচড়ে বল ঘুরতে লাগল অফ স্টাম্প থেকে ব্যাটসম্যানের শরীরের দিকে। তবে পারফরম্যান্স অবশ্য আবেশ খারাপ করেনি। চোদ্দোয় পা দেওয়ার আগেই আবেশ ইয়ং বেঙ্গল টিমের নিয়মিত সদস্য।
সেই আবেশ সে দিন বিকেলের দিকে ধরে ফেলল ডাম্বোকে, “আরে ইয়ার দর্পণ, একটু শুনে তো যা, কহাঁ ভাগ রহা হ্যায়?”
ডাম্বো আবেশকে বিশেষ পছন্দ করে না, সে অনিচ্ছুক ভাবে এগিয়ে গেল। আবেশ তার ক্রিকেট কিটব্যাগের চেনে হাত লাগাল, ছিটকে সরে
গেল ডাম্বো।
আবেশ তবু তার কিটব্যাগ খুলেই নিল, “আরে রুক তো সহি। এক বার দেখতে তো দে, কোন ব্যাটে খেলিস তুই। কোন ব্যাটে তরফদার ট্রফিতে সেঞ্চুরি মারেগা তু বেটা দর্পণ!”
হাসতে হাসতেই ডাম্বোর ব্যাট বার করেছিল আবেশ। ডাম্বোর প্যাড, গ্লাভস তত ক্ষণে ধুলোয় লুটোপুটি। আবেশের বড়সড় চেহারা, ভয়ে ভয়ে কিছু বলতেও পারেনি ডাম্বো।
কিছু ক্ষণ ডাম্বোর ব্যাট নেড়েচেড়ে দেখে আবেশ বলেছিল, “নেহি রে ভাই। অ্যায়সে নহি হোগা। ইতনা দুবলা ব্যাট লেকে ক্যায়সে খেলেগা বাচ্চু? শুনেছি প্লেয়িং ইলেভেনে নাকি তোকে জায়গা দেয় না জাগরণী! এই কথাটা কি ঠিক আছে বেটা দর্পণ?”
সে দিন কিছু না বলেই ধুলোয় পড়ে থাকা প্যাড গ্লাভস গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল ডাম্বো, কিন্তু মনে মনে একটা জেদ জন্মেছিল তার। আবেশের সঙ্গে বোঝাপড়াটা বাকি থেকে গিয়েছে।
সেই বোঝাপড়ার প্রথম ধাপটা পেরিয়ে এসেছে ডাম্বো। জাগরণীর প্রথম একাদশে ডাম্বোর জায়গা প্রায় পাকা। এই উত্তরণ সহজে হয়নি। টুটুল স্যরের কথা মতো মাঠে আর নেটে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে ডাম্বো, নিজের দুর্বলতাগুলোর চোখে চোখ রেখেছে।
তারই ফলস্বরূপ দল নির্বাচনের ট্রায়ালে এক রকম হাসতে হাসতে উতরে গেছিল ডাম্বো। এগজ়িবিশন অব শটস দেখিয়েছিল ও ট্রায়ালের দিন। ক্লাবের সিনিয়র মেম্বাররা পর্যন্ত ডাম্বোর অন ড্রাইভ দেখে হাততালি দিয়ে উঠেছিল।
তবে টুটুল স্যরকে খুশি করতে আরও বেগ পেতে হয়েছিল ডাম্বোকে। গম্ভীর মুখে টুটুল স্যর বলেছিলেন, “যে প্লেয়ার স্টেপ আউট করতে ভয় পায়, যে প্লেয়ার রিভার্স সুইপ মারে না, প্রয়োজনে যে সুইচ হিট করতে পারে না, এমন প্লেয়ারকে আমি কমপ্লিট ব্যাটসম্যান মনেই করি না দর্পণ।”
সদ্য টিমে সিলেক্ট হয়ে যাওয়া প্লেয়ার ডাম্বো ঘাবড়ে গিয়েছিল। সে বুঝেছিল, জাগরণীর টিমে বছর বছর চান্স পেলেও যত দিন না ওই মানুষটার চোখে তার জন্য গর্ব দেখবে, তত দিন পুরোপুরি শান্তি পাবে না ডাম্বো।

Advertisement

লেগ আম্পায়ার অফ সাইডে দাঁড়ালে যে রকম জায়গায় দাঁড়াতেন, ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শ্যেনদৃষ্টিতে ডাম্বোর ব্যাটিং দেখছিলেন টুটুল স্যর।
তাঁর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি। ডাম্বো পাল্টে গিয়েছে। কখনও লেগ স্পিনের বিষ ঝেড়ে সুইপ করছে হাঁটু গেড়ে বসে, একশো তিরিশ কিলোমিটার পেসের বলে মাথা নিচু করে স্কুপ শট মারছে, অবলীলায় স্টেপ আউট করে যাচ্ছে বোলার বল ছাড়ার আগেই।
গত মাস তিনেকে তিনি এই ছেলের অনেক ভুলত্রুটি শুধরে দিয়েছেন। প্রথম থেকেই বোলার বল করার আগেই অফ স্টাম্পের দিকে সরে আসার প্রবণতা ছিল ডাম্বোর। এই অস্বাভাবিক মুভমেন্টের কারণ আছে। ডাম্বো অন সাইডে সাংঘাতিক শক্তিশালী, অথচ অফ সাইডে শট একটু নড়বড়ে লেগেছিল টুটুল স্যরের।
কিন্তু তা বললে তো চলবে না, সার্কিটে এই টেকনিক নিয়ে দুটো তিনটে সিরিজ় চালিয়ে নেওয়া যাবে, কিন্তু আজকাল সবার হাতে হাতে ব্যাটিং- বোলিং কাটাছেঁড়া করার যন্ত্র। যে মুহূর্তে ডাম্বো নাম করতে শুরু করবে, ক্ষুরধার মস্তিষ্করা বসে যাবে তার ব্যাটিংয়ের ডিসেকশন করতে আর সেই সময় যদি অফ সাইডের দুর্বলতা তাদের চোখে পড়ে যায়, তো হয়েই গেল। বোলারদের কাছে সটান পৌঁছে যাবে ডাম্বোর দুর্বলতার ব্লুপ্রিন্ট। তখন এঁটে উঠতে পারবে তো ডাম্বো!
দেরি করেনি ডাম্বোও। লেগে পড়ে থেকে, টুটুল স্যরের প্রতিটি কথা বেদবাক্য বানিয়ে ফেলে নিজেকে নাগাড়ে রগড়ে গেছে সে। সময় বাড়িয়েছে ট্রেনিংয়ের। আগে ক্লাবের মাঠ দশ বার জগ করতে হবে ভাবলে গায়ে জ্বর আসত তার। আজ সে এতটাই পাল্টে গেছে যে, বারো বার মাঠ চক্কর দেওয়ার পর আগ্রাসী ভাবে স্ট্রেচিং সেশনে ঢুকে পড়ে। টুটুল স্যরের মত এখানেও পরিষ্কার, শুধু ট্যালেন্ট এক জন ক্রিকেটারকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারে না, যদি না সে প্র্যাকটিস সেশনে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়।
কত, কত মানুষের সাকসেস স্টোরি শোনায় তাকে একান্তে টুটুল স্যর। যে ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেই ঘর থেকে উঠে এসে সাফল্যের পাদপ্রদীপের আলোয় দাঁড়ানো জাদুকরী অলরাউন্ডারের গল্প, বুকের মধ্যে ক্যাম্বিস বলের সাইজ়ের ক্যান্সার গ্রোথ চেপে রেখে, ক্রমাগত রক্তবমি করতে করতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে দেশকে বিশ্বজয়ী করার গল্প। অথবা ষোলো বছরের সেই মরাঠি ছেলেটার গল্প, পৃথিবীর দ্রুততম পেসারের বল লেগে নাক ফেটে গেছে, সবাই বলছে ড্রেসিংরুমে ফিরে যেতে, কিন্তু নাকে ব্যান্ডেজ নিয়ে ছোটখাটো চেহারার ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়েছে, আম্পায়ারের চোখে চোখ রেখে দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠেছে— ম্যায় খেলেগা।
এ সবই ক্রিকেটের লোকগাথা হয়ে ওঠা গল্প।
ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement