কলমের মন: সাবিত্রী রায়। ছবি ‘সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা-সংকলন’ (দে’জ) থেকে।
মিঠিসোনা, তুমি যখন বড় হ’য়ে স্কুলে পড়বে, ঐ ভিখিরী শিশুদের চাইতে নিজেকে বড় মনে করো না। যারা বাড়ীর আবর্জনা থেকে ছেঁড়া পুরানো কাগজ কুড়িয়ে নিচ্ছে একাগ্রমনে, কেউবা বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে শুকনো ডালপালা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, শীতের রাতে ওদের শীর্ণ কঙ্কাল হাতগুলি গরম করবে বলে, আর ওদের মায়েরা রুটি সেঁকবে সে ধোঁয়াটে আগুনে তিন ইটের উনুনে খোলা প্ল্যাটফর্মের এক কোণে।...এমন দিন যদি কখনও আসে, ওদের সঙ্গে মানবতার প্রতিযোগিতায় (যার নাম প্রগতি) নামতে হয়েছে তোমাকে পৃথিবীর ময়দানে, হয়তো দেখবে, তুমি পিছিয়ে আছ অনেক পিছনে। ওদের চোখে জয়ের স্নিগ্ধ হাসি।’
আদরের নাতিকে চিঠি লিখেছিলেন সাবিত্রী রায়। ‘নীল চিঠির ঝাঁপি’ নামের সেই চিঠির বইয়ের পাতায় পাতায় স্নেহময়ী দিদিমার মনের কথা, কবিতার টুকরো, রোজনামচা। আছে ভবিষ্যতের প্রতি দিক্নির্দেশ, নিজে যে বিক্ষুব্ধ রক্তাক্ত অতীত পেরিয়ে এসেছেন তার ইঙ্গিতও— শিশুমনের যতটুকু প্রয়োজন। ইতিহাসে কিছু মানুষ শুধু জমি তৈরি করে আর তার ফসল তোলে আর একটি প্রজন্ম, এই সারসত্য মনে রাখার আর মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটুকু জীবনসায়াহ্নেও ভোলেননি ‘স্বরলিপি’, ‘পাকা ধানের গান’, ‘মেঘনা পদ্মা’ উপন্যাসের লেখিকা।
কিন্তু কে চেনে আজ তাঁকে? যে দলের মতাদর্শের প্রতি তাঁর আজীবন প্রতীতি, সেই কমিউনিস্ট পার্টিই তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাঁর লেখা থেকে! ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরকার দ্বন্দ্ব থেকে একটু উপরের তলার নেতাদের দ্বিচারিতা— সোজাসাপটা লিখেছিলেন তিনি। সেই বই নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল, নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তার পাঠ। নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার ‘আদেশ’, স্বামী শান্তিময় রায়কে পার্টি থেকে বহিষ্কার, কোনও কিছুই সাবিত্রীকে দমাতে পারেনি। থামাতে পারেনি তাঁর কলমও।
‘স্বরলিপি’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। সেটা তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। তার পরেই তিনি লিখেছেন তাঁর দুই ম্যাগনাম ওপাস— তিন খণ্ডে ‘পাকা ধানের গান’, দু’খণ্ডে ‘মেঘনা পদ্মা’ (তার তৃতীয় খণ্ড আবার ‘সমুদ্রের ঢেউ’ নামে আলাদা উপন্যাস হিসেবে)। চল্লিশের দশকের জটিল ও রক্তাক্ত রাজনীতি— বিয়াল্লিশের অগস্ট আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, দেশভাগ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা— তাঁর উপন্যাসে শুধু উঠে এসেছে বলাটা ভুল, সমসময় ও সাহিত্য সেখানে একে অন্যের আয়না। এই সমস্তই তিনি দেখছেন, লিখছেন— কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি অটল কিন্তু নির্মোহ থেকে। লেখক তো দ্রষ্টা, ব্যক্তিগত দেখাটাও তাঁকে করে তুলতে হয় নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু দল তা মানবে কেন? সে তো বোঝে কেবল ‘পার্টি লাইন’, দাবি করে মনোযোগ আর আনুগত্যের সবটুকু। সমালোচনা দূরস্থান, মতামতে যে মতের পাশাপাশি অমতও থাকতে পারে, ‘পার্টি’ তা বুঝেও বোঝে না। এই সিদ্ধান্তটা ভুল হচ্ছে, ওই কাজটা করা উচিত নয়— বললে নেমে আসে ‘সংস্কারবাদী’ তকমা, বহিষ্কারের ফতোয়া, একঘরে করার হুমকি। সাবিত্রীর নিজের জীবন আর তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের জীবন তাই দিনশেষে এক ও অকৃত্রিম হয়ে ধরা দেয়।
১৯১৮-র ২৮ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম সাবিত্রীর। শৈশব কেটেছে ফরিদপুরের গ্রামে। পিতার পদবি সেন। বাবা-মা ছাড়াও দশের কাজে এগিয়ে-আসা পিসির প্রভাব পড়েছিল তাঁর জীবনে। বেথুন কলেজ থেকে বিএ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিটি পাশ করা মেয়েটি নিজের বিপ্লবী দাদার বন্ধু শান্তিময় রায়কে বেছে নিয়েছিল জীবনসঙ্গী হিসেবে। ১৯৪০-এ বিয়ে, বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই স্বামীর কারাবাস। স্কুলে পড়ানোর কাজ নিয়েছিলেন সাবিত্রী, চাকরি করতে গিয়ে শিশুকন্যার দেখাশোনায় সমস্যা হচ্ছে দেখে ছেড়ে দেন সে কাজ। শিক্ষিতা মেয়ে অথচ নিজে উপার্জনক্ষম নন, এই আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে। লেখালিখিকে আঁকড়ে ধরায় সেই খেদ দূর হয়েছিল। সংসারের নানা কাজের মধ্যেই সময় বার করে লিখেছেন ন’টা উপন্যাস, কিছু ছোটগল্প, এমনকি শিশু-কিশোরপাঠ্য বইও। শেষ উপন্যাস ‘বদ্বীপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে, শেষ বই ‘নীল চিঠির ঝাঁপি’ ১৯৮০-তে। মারা গিয়েছেন ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের হিসেবে এই তো সে দিন, ত্রিশ বছরের কিছু বেশি। অথচ পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকের মধ্যে লেখা সাবিত্রী রায়ের বইগুলো আজ কলেজ স্ট্রিটের বইবাজারে পাওয়া যায় না— একমাত্র ‘সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা-সংকলন’ নামে তাঁর ছোটগল্প-সংগ্রহটি ছাড়া।
এ আমাদের দুর্ভাগ্য। সাবিত্রীর বই, বিশেষত উপন্যাসগুলি না পড়া মানে, একটা খুব জরুরি আর জটিল সময়কে শুধু সাম্যবাদী মতবাদের দিক দিয়ে বলে নয়, মানবিক জীবনবোধ দিয়ে বুঝতে অস্বীকার করছি আমরা। ভুলে থাকছি একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের যাত্রাপথের মাইলফলক আর খানাখন্দ, উভয়কেই। এই বিস্মৃতি কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, ভয়ঙ্করও; কারণ আজকের রাজনীতিতেও চোখে পড়ে সেই উত্তরণ ও স্খলন, সাবিত্রী যা পঞ্চাশ বছর আগে লিখে গিয়েছেন।
তাঁর ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে পৃথ্বী, রথী, ফল্গু, শীতা, সাগরীর মতো নিবেদিতপ্রাণ পার্টিকর্মীর গায়ে গায়েই ঘোরাফেরা করে নন্দলাল, ব্যোমকেশ, মধু মুখার্জির মতো স্বার্থান্বেষী নেতারা। শীতাংশু নামের তরুণ কর্মীটি স্তম্ভিত হয়ে দেখে, সারা দিন না-খাওয়া কৃষক কর্মীদের একটু অর্থসাহায্যের আবেদন নস্যাৎ করে ব্যোমকেশ তাকে নিয়ে ‘একটু চা খাওয়া যাক’ বলে রেস্তরাঁয় ঢোকে, ডবল কাপ চা আর পুরু অমলেট অর্ডার দেয়। ব্যোমকেশের বাড়িতে শৌখিন আসবাব, নরম গালিচা, বিলিতি কাপে সুগন্ধি চায়ের সঙ্গে সাম্যবাদী নেতার বিপ্লবের বুলিকে মেলাতে পারে না সে। প্রতিবাদ করে পৃথ্বী আর রথী দু’জনেই ‘বুর্জোয়া সংস্কারবাদী’ ছাপ্পায় দল থেকে বহিষ্কৃত, নেতা নন্দলাল কৌশলে রথীর স্ত্রী সাগরীকেও টেনে আনে নিজের কমিউনে, সাগরীকে চাপ দেয় রথীকে ডিভোর্স দিতে। আসলে হিংস্র পুরুষের কামুক নজর পড়েছে বিপ্লবের স্বপ্ন-দেখা মেয়ের উপরে, নন্দলালের স্যাঙাত এক দিন সাগরীকে জানিয়েই দেয়, ‘নন্দলাল is waiting for you...’ এই ঘিনঘিনে নীচতার আবর্তে সাম্যবাদ কোথায়! দল আর মতাদর্শের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে যে পুরুষতন্ত্রের রাক্ষস, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে দাঁতনখ নিয়ে— রাজনীতি-সচেতন নারী তার কবল থেকে বাঁচে কী করে— লিখে যান সাবিত্রী।
শুধু নেতা আর কর্মী নয়, জোতদার আর কৃষক নয়, পুরুষ আর নারী নয়। সবার উপরে তো জেগে থাকে মানুষ। বিপ্লব, বিদ্রোহ, দেশভাগ, দাঙ্গা পেরিয়ে রোজকার জীবনটা টেনে-হিঁচড়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয় তাকে। ভাত খেতে হয়, ভাতের সন্ধানে বেরোতে হয়। এই নিরাবরণ নিরাভরণ মানুষকে সাবিত্রী দেখেন দরদ দিয়ে। ‘পাকা ধানের গান’-এর মূল চরিত্র পার্থ যখন হাজংদের নিয়ে কৃষক আন্দোলনে মিলিটারির গুলিতে প্রাণ দেয়, সাবিত্রীর কলম সে বর্ণনায় দৃঢ়। জমিদারের ধামাধরা জগাই বাড়ুজ্জের বিরুদ্ধে পাহাড়পুরের সাধারণ মানুষের সংগঠিত প্রতিরোধের ছবি আঁকেন অনমনীয় ঋজুতায়। সেই কলমই যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ছোটগল্পে— যেখানে মন্বন্তরের পরের কলকাতায় বিরাট অভিজাত বাড়ির নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে আসা ফ্যান আর তার সঙ্গে মিশে থাকা কয়েকটা ভাতের জন্য কামড়াকামড়ি করে ক্ষুধার্ত মানুষ। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা— কাজের মেয়ে গোলাপি যে ক’টা ভাত পায় নিজেই খেয়ে ফেলে, স্বামীকেও দেয় না। আবার ‘পাকিস্তান’ থেকে চলে আসা অন্ধ ভিখিরি শহরের রাস্তায় ‘ময়ূরপঙ্খি নৌকা আমার মেঘনা চরে বাড়ি’ গান গেয়ে যত না ভিক্ষে চায়, তারও বেশি চায় বাউলের, শিল্পীর যথোচিত সম্মানটুকু। পুব বাংলার গ্রামের সম্পন্ন বাড়িতে সারা জীবন সেবা-দেওয়া বুড়ি পরিচারিকাকে রেখেই ‘ইন্ডিয়া’ রওনা দেয় সবাই। যে ছেড়ে যায় আর যাকে ছেড়ে যাওয়া হয়, এই দুই অসহায় মানুষের জন্যই ভালবাসা টলটল করে সাবিত্রীর কলমে।
এক ক্রান্তিকালের কথাকার হয়েও বাংলার ‘মূলস্রোতের’ সাহিত্যিকদের আলোচনায় উঠে আসে না সাবিত্রী রায়ের লিখন। বিয়াল্লিশের অগস্ট আন্দোলন বলতেই যেমন অমোঘ ভাবে ভেসে ওঠে সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, তেভাগা আন্দোলন-দেশভাগ-দাঙ্গার সূত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ যেমন প্রগাঢ় ভাবে মনে পড়ে, পঞ্চাশের মন্বন্তর বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (নাকি সত্যজিৎ রায়ের?) ‘অশনি সংকেত’, অমলেন্দু চক্রবর্তীর গল্পটা মনে না রেখেও যে ভাবে মৃণাল সেনের ছবির জন্য মনে রাখি ‘আকালের সন্ধানে’, তেমন করে তো সাবিত্রী রায় আর তাঁর লেখালিখিকেও মনে রাখা উচিত ছিল! এই অতল বিস্মৃতি প্রাপ্য ছিল না সাবিত্রীর। গণ্ডিবদ্ধ সাংসারিকতা থেকে বাঙালি মেয়েকে উত্তরণের হদিশ দেওয়া আশাপূর্ণা দেবী, বা জল-জঙ্গল-মাটির সংগ্রামের হয়ে কলম ধরা মহাশ্বেতা দেবী যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, সাবিত্রী রায় তা পাননি। তিনি রয়ে গিয়েছেন তাঁরই গল্পের চরিত্র শকুন্তলা দেবীর মতোই নিভৃতে, পানের পিক আর সর্দি-বসা পাকা কফ লাগা দেওয়াল পেরিয়ে সরু গলির মধ্যে স্যাঁতসেঁতে বাড়ি যার ঠিকানা; জ্বরার্ত শিশুর পরিচর্যা, রান্না, দেবর-শাশুড়ির বিদ্রুপ আর স্বামীর উদাসীনতা সয়েও যিনি লিখে যান। গত বছর জন্মশতবর্ষ পেরিয়েছে সাবিত্রী রায়ের, বাঙালি প্রকাশনাগুলো তাঁর বই পাঠকের হাতে ফের তুলে দেওয়ার ভার নিলে তাঁর লেখক-সম্মানটুকু বাঁচে।