ভেঙে যাওয়া টুকরো কাচের ওপরে ঝুরঝুরে রোদ পড়লে যেমন সাত রঙের ঝিলিক দেয়, তেমন ভাবেই জলের শরীর ছলকে আলো বেরোচ্ছিল। সেই আলোর কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করছে কাঁচা আমের মতো মেয়েরা। ধূসর চিকচিকে বালির ওপর ছোট ছোট পা ফেলে। ও দিকে বাচ্চা মেয়েদের গলায় সুর করে গাওয়া গানগুলোর শব্দগুলিকে, এলোপাথাড়ি বাতাস ধাক্কা মেরে এ দিক-ও দিক ছিটিয়ে দিচ্ছিল। অনেকটা কনকচূড় ধান থেকে খই ফোটার মতো। কার্তিক মাসে সকাল গড়িয়ে দুপুর নামার সময়। বালির চরে এক সঙ্গে এক দল মেয়ে গাইছে ‘নদী নবেন্দ্র নদী নবেন্দ্র নদীকে বন্দএ নারী’। বালুকা ব্রত করছে মেয়েরা। সুবর্ণরেখা নদীর ধারে।
এই নদীর বালির একটা মাহাত্ম্য আছে। এই বালি ওদের পেট চালায়। তেত্রিশ বছরের ছোট রাই কাপড়টাকে হাঁটু পর্যন্ত তুলে অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে, একটা থালার ওপর নদীর বালি তুলছে। আর নদীর জল দিয়েই ধুয়ে নিচ্ছে বালির ধূসর আলগা শরীর। এমন ভাবে নদীর দেহটাকে রোজ ধুয়ে-পাখলে সোনা বার করে। সেই সোনা কিনতে আসে ‘নেহারা ধুলাইওয়ালা’-রা। সোনা কেনার ক্রেতাদের এমন নামেই ডাকে তারা। এই স্বর্ণরেণু গায়ে মেখে এই নদী সাগরের সঙ্গে মেশে। রাঁচি শহরের পনেরো কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পিস্ক নামের একটা জায়গা থেকে এই নদীর জন্ম। সেখানে পৃথিবীর গর্ভে জমানো জল পৃথিবীর শরীরের ভাঙা ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে। আসলে এটা একটা প্রস্রবণ। তার পর ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে বয়ে চলা। এই চলার পথে একা নয় সে। পথেই কারু, কাঞ্চি, করকরি, খরখরি, গরা, শঙ্খ, জুমার, ডুলুং ও আরও অনেক ছোট ছোট নদী এসে জল দেয় সুবর্ণরেখাকে।
তবে এই সব ছোট ছোট নদীর মধ্যে খরখরির সঙ্গে সুবর্ণরেখার সম্পর্ক আলাদা। খরখরি সুবর্ণরেখাকে ভালবাসত। কিন্তু কোনও দিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে। এক বৃষ্টির দিনে সুবর্ণরেখা আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে নিজের শরীর ভিজিয়ে আপন মনে নৃত্য করছিল। এমন মুহূর্তে খরখরি নিজেকে সামলাতে না পেরে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সুবর্ণরেখাকে। বিয়েতে রাজি হল সুন্দরী সুবর্ণরেখা। তবে একটা শর্ত দিল। যত দিন খরখরি সুবর্ণরেখাকে সোনায় মুড়ে রাখবে, তত দিন সে খরখরির সঙ্গে সংসার করবে। এই শর্তে রাজি হওয়ার পর থেকেই খরখরির জলের সঙ্গে সোনা এসে মেশে সুবর্ণরেখায়। এমনি লোকবিশ্বাস প্রচলিত ওড়িশার চৌমুখা গ্রামের মানুষের মনে।
তাকে সবাই ডাকে কোটরি বলে। ভাল নাম পারালকোটা নদী, ইন্দ্রাবতী নদীর একটা শাখা। বস্তারের পাহাড় থেকে জন্ম নিয়েছে এই নদী। তার পর ছত্তীসগঢ় ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা। ছত্তীসগঢ়ের জারেকুরসে গ্রামে নদীর বুকে সোনা পাওয়া যায়। জল পাথরের গা ঘষে আসার সময় নিয়ে আসে সোনার কণা। জল-বালিতে মিশে থাকা সোনাকে গ্রামের আদিবাসী মানুষেরা একটা ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নেয়। তেহেরান নামে এক জাদুকর ছিল। কালো জাদু জানত সে। তার কাছে একটা মন্ত্র ছিল। যার বলে সে পাথরকে সোনা করতে পারত। এই তেহেরান বাস করত মাটির নীচে। ইঁদুরের গর্তে। এই জাদুকর মরে যাওয়ার আগে ঠিক করল, তার জমানো সব সোনা কোটরি নদীকে দিয়ে যাবে। যাতে মানুষের মঙ্গল হয়। এমন ভেবে কোটরি নদীকে নিমন্ত্রণ করে সে, তার গর্তে। জাদুকরের নিমন্ত্রণে নদী গেলে কুটকি রান্না করে নদীকে খেতে দেয় ও তার শেষ ইচ্ছের কথা বলে। সেই দিন থেকেই কোটরি নদী জাদুকরের মাটির তলায় জমানো সোনাকে জলে ভেঙে ভেঙে জলের সঙ্গে ধুয়ে নিয়ে পৌঁছে দেয় মানুষের কাছে। এলাকাভেদে এই লোকবিশ্বাস কিছুটা আলাদা।
সঙ্গে পাল্টেছে চরিত্রের নাম ও কাহিনির গড়ন।
ভারতের নদীগুলোর মতো নদী সারা পৃথিবীতে বড় বিরল। গুজরাতে একটা নদী আছে, যে একটু ভিন্ন রকম। নদীটার নাম রুপেন। তরঙ্গ পাহাড় থেকে জন্ম নিয়েছে এই নদী। তার পর একশো পঁয়ষট্টি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সে মেশে আরব সাগরে। সেখানেই তার চলার শেষ। এই নদীটি মেহেশানা জেলার খেরালুর ওপর দিয়ে যখন বয়ে যায়, তখন সে স্বর্ণগর্ভা। জলের ধারায় বালির ভিতর দিয়ে ভেসে আসে সোনা। এক সময় স্থানীয় মানুষজন এই নদীতে সোনা ধরতেন। নদীর জলে নেমে তাঁরা গান গাইতেন। নদীকে সন্তুষ্ট করার গান। যেমন এই গানটা— ‘মেনে থোরুং সোনুন আপো, মেনে সারুন জীবন আপো’— অর্থাৎ, আমায় একটু সোনা দাও, আমায় ভাল জীবন দাও, এইটুকুই ছিল তাঁদের চাহিদা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনে এল বেঁচে থাকার জন্য ইঁদুর দৌড়। হারিয়ে গেল সেই গান। হারিয়ে গেল নদীর প্রতি মানুষের ভালবাসা।
এমনই সোনা থেকে ভালবাসা খুঁজে পাওয়ার নদী আমাদের বাংলার উত্তরবঙ্গেও রয়েছে। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙে তার চলার পথ। তার গতিপথের বাঁকে বাঁকে মিশে আছে কিংবদন্তিও। এক রাজপুত্র সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এক জঙ্গলঘেরা জায়গায় এসে বসল। অনেক পথ চলার পরিশ্রমে সে ক্লান্ত। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে তেষ্টায়। একটু দূর দিয়েই বয়ে যাচ্ছিল একটা নদী। ঝকঝকে তার জল। নদীর বুকে নুড়ি পাথর জলের ধাক্কা খেতে খেতে আলগোছে পড়ে রয়েছে। সেই পাহাড়ি নদীতে নেমে আঁজলা ভরে জল পান করতে গিয়ে রাজপুত্রের হাতে জড়িয়ে যায় একটা চুল। তবে সাধারণ চুল নয়, সেই চুলটা ছিল সোনার। সেই চুলটিকে নিজের কাছে রেখে স্রোতের পথ ধরে হাঁটতে লাগল সে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল এক অজানা দেশে। সেখানে গিয়ে দেখে, এক রাজকন্যার মাথা ভর্তি সোনার চুল। আর সেই চুল-ধোয়া জলেই তৈরি হচ্ছে নদী। সোনা কেশের এই নদীর নাম হল স্বর্ণকেশী। পরবর্তী সময়ে অপভ্রংশ হয়ে সঙ্কোশ। এমনই লোক বিশ্বাস রয়েছে সঙ্কোশ নদীতে সোনা পাওয়া নিয়ে। এই নদীতে ভেসে আসত গুঁড়ো সোনা। এখনও আসে, তবে তা না আসার মতোই। বালি পাথরের মাফিয়ারা নদী বুকে বড় বড় গর্ত করেছে। পাথর-বালি তুলে ফেলেছে। তাই নদীও মরেছে। সোনার কণা হারিয়েছে।