Goddess Ganga

দীপাবলির পরদিনই বাপের বাড়িতে ফেরেন মা গঙ্গা

শ্বশুরবাড়ি গঙ্গোত্রীর মন্দির। সেখান থেকে সারা শীতকালের জন্য মুখবা গ্রামে আসেন গঙ্গা। এখানে তিনি মা নন, মেয়ে। যেমন বাঙালির উমা। তাঁর পূজারীরাও যে বাঙালি। আসল পদবি সান্যাল। বীরভূম থেকে কয়েক শতক আগে তীর্থ করতে এসে গঙ্গোত্রীতে থেকে গিয়েছিলেন এক যুবক।গঙ্গোত্রীর মন্দির ও তাকে ঘিরে থাকা জনপদ খোলা থাকে ছ’মাস। শীত-শেষের অক্ষয়তৃতীয়া থেকে দীপাবলির পরদিন পর্যন্ত। মন্দিরের দেবীকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে মুখবা গ্রামে।

Advertisement

চঞ্চলকুমার ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

সে-বছর হরিদ্বারে কুম্ভমেলা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন তীর্থযাত্রীর দল। এসেছেন কত সাধু, সন্ন্যাসী, পুণ্যার্থী। লক্ষ মানুষের ভিড়ে কোথাও ঠাঁই খালি নেই। সকলের মনের ইচ্ছে হর-কী-পৌড়ির পবিত্র ব্রহ্মকুণ্ডে গঙ্গাস্নান করে পাপমুক্ত হবে। আসে সেই ব্রাহ্মমুহূর্ত। শুরু হয় স্নানপর্ব। গঙ্গা মাইয়ার জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে চার দিক।

Advertisement

স্নান সারা হতেই সকলের মনে আনন্দ। পুণ্য সঞ্চয় করে এ বার ঘরে ফেরার পালা। কত দিন দেখা হয়নি আপনজনের সঙ্গে। বাংলার বীরভূমের কাছে সিমলকার গ্রাম থেকে এসেছেন কয়েকজন ব্রাহ্মণ। পদবি সান্যাল। এক জনের মনে হল এত দূর এসে মা গঙ্গার পবিত্র তীর্থ গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন না করে ফিরে যাবে! আর হয়তো কখনও এত দূরে আসা সম্ভব হবে না। কয়েকজন বলল, ঠিক কথা। সম্ভব হলে শুধু গঙ্গোত্রী নয়, চারধামই ঘুরে দেখা যাবে।

বাকি সঙ্গীরা চমকে ওঠে। সকলে ভয় দেখায়। চারধামের পথ বড় দুর্গম। যারা যায়, বেশির ভাগই আর ফেরে না। কিন্তু যারা যেতে চায় তারা নাছোড়। মরতে তো এক দিন হবেই। তীর্থভূমিতে মৃত্যু হওয়াও তো মহাপুণ্য! সকলের কাছে বিদায় নিয়ে শুভক্ষণে বেরিয়ে পড়ে তারা।

Advertisement

হরিদ্বার হৃষীকেশ পেরিয়ে হিমালয়ের পথ। সমতলের মানুষ পাহাড়ি পথে অনভ্যস্ত। ধীরে ধীরে পথ চলে। সারা দিন পথ চলা, রাতে চটিতে বিশ্রাম। এমনি করে এক মাস কেটে যায়। তারা এসে পৌঁছয় উত্তরকাশী। চার দিকে কত মন্দির, সাধুসন্তদের কুঠিয়া। তাঁদের তপস্যাক্ষেত্র। চার দিকে পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে পুণ্যতোয়া গঙ্গা। কয়েকদিন সেখানে বিশ্রাম করে আবার তীর্থযাত্রীরা এগিয়ে চলে। এ ভাবেই এক দিন তারা এসে পৌঁছয় ভাটোয়ারি। দুর্গম হলেও এই পর্যন্ত পায়ে চলা পথ ছিল। ভাটোয়ারি পার হতেই সামনে খাড়াই পাহাড়। চলার রাস্তা নেই। কয়েক জায়গায় পাথর কেটে ধাপ রয়েছে, তবে ধরবার কিছু নেই। এক বার পা ফসকালে নীচে গঙ্গায় তলিয়ে যেতে হবে। সারা দিনে তিন-চার মাইলের বেশি পথ চলা সম্ভব হয় না। দিনে প্রখর রোদ, রাতে বরফ জমা ঠান্ডা। ক্লান্তিতে শরীর-মন ভেঙে পড়ে। কয়েকজন ফিরে যায়। বাকিরা দুঃসহ কষ্ট আর মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে। মাঝে মাঝে দেখা হয় স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে। তারা উৎসাহ দেয়, খাবার দেয়। নতুন উদ্যমে চলতে থাকে তীর্থযাত্রীরা। দশ দিন চলার পর ভৈরবঘাঁটি পেরিয়ে অবশেষে তারা এসে পৌঁছয় গঙ্গোত্রী।

সকলে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে সামনে কেদারগঙ্গা এসে মিশেছে গঙ্গায়। চার দিকে বৃত্তাকার বরফাচ্ছন্ন পাহাড় আর দেবদারুর বন। জলস্রোতের প্রবল গর্জন ছাড়া কোনও কোলাহল নেই। গঙ্গার তীরে বালির চর পেরিয়ে ভৈরব পর্বত। তার মাঝে ভগীরথ শিলা, বিশাল একখানা পাথর। প্রচলিত বিশ্বাস, এই পাথরের উপর বসেই তপস্যা করেছিলেন ভগীরথ। প্রসন্ন হয়ে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন গঙ্গা। তাঁর পুণ্যস্পর্শে মুক্তি পেয়েছিল সগররাজার ষাট হাজার অভিশপ্ত সন্তান।

ভগীরথ শিলা ছাড়া কোনও মন্দির নেই গঙ্গোত্রীতে। সেই শিলার উপরেই মা গঙ্গা আর ভগীরথের পুজো দেন তীর্থযাত্রীরা। স্থানীয় কিছু মানুষ আর সাধু ছাড়া কেউ থাকেন না এখানে। তীর্থযাত্রীদের জন্যে রয়েছে পাহাড়ের গুহা। সেখানে রাত্রিবাস করে পরদিন ফিরে যান সকলে। বাংলা থেকে আসা সেই তীর্থযাত্রীদের মধ্যে এক জন এত অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, তাঁর আর ফেরা সম্ভব হল না। তাঁকে রেখেই ফিরে যান সকলে। স্থানীয় মানুষজন বহু কষ্টে তাঁকে নামিয়ে আনলেন নীচের পাহাড়ি গ্রামে। সেখানেই রয়ে গেলেন মানুষটি। যখন সুস্থ হলেন, তত দিনে শীত এসে গেছে। পথ বন্ধ। আর ফেরার উপায় নেই। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠল। সেখানকারই এক জনকে বিয়ে করে রয়ে গেলেন সেখানে। সন্তান-সন্ততিতে ভরে উঠল তাঁর সংসার। তার পর বহু বছর কেটে গেল, বহু জল বয়ে গেল গঙ্গায়। সান্যাল থেকে তার বংশধররা হল সিমোয়াল। আর এই সিমোয়ালদেরই গ্রাম মুখবা। ব্রাহ্মণ বলে তাঁরাই হলেন গঙ্গোত্রী মন্দিরের পূজারী। এখন থেকে দু’শো বছর আগে গোর্খা সেনাপতি অমর সিংহ থাপা গাড়োয়ালের রাজাকে হারিয়ে বিজয়গৌরবের স্মারক হিসেবে গঙ্গোত্রীতে ভগীরথ শিলার উপর স্থাপন করলেন প্রথম মন্দির। পাথরের ছোট মন্দির। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা।

১৮৮৭ সালে এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-শিষ্য স্বামী অখণ্ডানন্দ। তিনি লিখছেন, ‘‘গঙ্গোত্রীতে মা’র প্রবাহ ক্ষীণ হইলেও তাঁহার প্রচণ্ড বেগে শত ঐরাবতেরও সাধ্য নাই যে ক্ষণকাল দণ্ডায়মান থাকে। ভাগীরথীর উভয় পার্শ্বের অত্যুচ্চ পর্বতশ্রেণীর উপরিভাগ অগাধ তুষাররাশিতে পরিপূর্ণ এবং নিম্নভাগ গাঢ় হরিদ্বর্ণ দেবদারু বৃক্ষে সমাচ্ছাদিত। তাহার অলৌকিক সৌন্দর্য বর্ণনা করা কাহারো সাধ্যায়ত্ত নহে। আমি সেই অপূর্ব সৌন্দর্যরাশির মধ্যে একেবারে আত্মহারা হইলাম। গঙ্গোত্রী মন্দিরে মা’র ধাতুময়ী সুন্দর প্রতিমা দর্শন করিয়া পরম আনন্দ লাভ করিলাম। গঙ্গোত্রীতে মা- গঙ্গার একটি প্রস্তর নির্মিত মন্দির প্রতিষ্ঠিত আছে। যাত্রীদের ও পাণ্ডাদের জন্যে কয়েকখানি ঘর এবং তাহাদের আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সরবরাহের জন্য দুই একখানি দোকানমাত্র ছিল।’’

কালের প্রবাহে সেই মন্দির ভেঙে যাওয়ায় জয়পুরের মহারাজা সোওয়াই দ্বিতীয় মান সিংহ শ্বেতপাথরের বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দিলেন। মন্দিরে পাঁচটি গম্বুজ। চার দিকে বারান্দা। সেই সময় সিমোয়াল পরিবারের পাঁচ ভাইয়ের উপর মন্দিরের পুজোর ভার দেওয়া হল। তাঁদের বংশধররাই বর্তমান মন্দিরের পূজারী।

শ্বশুরালয়: গঙ্গোত্রীর মূল মন্দির। এখানেই দীপাবলি পর্যন্ত গঙ্গাদেবীর অধিষ্ঠান।

মন্দিরের ভিতরে রয়েছে মা গঙ্গার ধাতুমূর্তি। বাঁয়ে সাদা পাথরের দেবী সরস্বতী, ডান দিকে কালো পাথরের যমুনা দেবী। সামনে করজোড়ে ভগীরথ। কোনও মূর্তি স্পষ্ট বোঝা যায় না। মন্দিরের চূড়ায় পিতলের ঘট। মন্দির ঘিরে দোকানপাট, হোটেল, ধর্মশালা। একটু এগোলেই গঙ্গার অপ্রশস্ত জলধারা। ছোট নদীর চেয়েও ছোট। নুড়িপাথরের উপর দিয়ে প্রবল বেগে বহমান জলস্রোত।

গঙ্গোত্রীর মন্দির ও তাকে ঘিরে থাকা জনপদ খোলা থাকে ছ’মাস। শীত-শেষের অক্ষয়তৃতীয়া থেকে দীপাবলির পরদিন পর্যন্ত। মন্দিরের দেবীকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে মুখবা গ্রামে। পাহাড়ের উপর গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এত প্রশস্ত গঙ্গা হিমালয়ে আর কোথাও নেই। দু’দিকে বালির চর। মাঝখানে তিরতির করে কাচের মতো জল বয়ে চলে। চার দিকে আপেল খেত।

আগে গঙ্গা পার হওয়ার জন্যে ছিল দড়ির সেতু। দু’ধারে পাহাড়ের গায়ে দড়ি বাঁধা থাকত। দড়ির উপর এক হাত অন্তর কাঠ পাতা। ধরার জন্যে উপরের দিকে আরও দুটো দড়ি থাকত। ভয়ঙ্কর রকম দুলতে থাকা সেই সেতু ধরে লোকেরা গঙ্গা পার হত। সময়ের সঙ্গে সে দিনের বহু কিছু বদলেছে। অতীতের দড়ির সেতু আজ আর নেই। গঙ্গার উপর তৈরি হয়েছে লোহার ঝুলা পুল। সেই ঝুলা পুল পেরিয়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরে পৌঁছতে হয় পাহাড়ের ওপর মুখবা গ্রামে। এখান থেকে চোখে পড়ে গঙ্গার অন্য পাড়ে ধারালি গ্রামের গা ছুঁয়ে উঠেছে শ্রীকণ্ঠ পর্বতশৃঙ্গ। নীচে বাঁকা চাঁদের মতো দেবদারু বন। তার উপরে গোটা পর্বতটাকে কেউ যেন বরফের চাদরে মুড়ে দিয়েছে।

পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাড়িঘর। বেশির ভাগ কাঠের বাড়ি। অনেক বাড়িই শতাব্দপ্রাচীন। একটু এগিয়ে সাদা পাথরের মন্দির। অবিকল গঙ্গোত্রী মন্দিরের মতো। তবে আকার-আয়তনে ছোট। অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরের চাতালে পৌঁছতে হয়। মন্দিরের পাশেই নাটমন্দির। সেখানে আছেন সোমেশ্বর শিব। সোমেশ্বর শিব শুধু এই গ্রামের নয়, এই অঞ্চলের বেশির ভাগ গ্রামের দেবতা। এই মুখবা গ্রামের আদি নাম মুখীমঠ। প্রাচীনকালে মহর্ষি মাতঙ্গ আর ঋষি মার্কণ্ডেয় এখানে তপস্যা করেছিলেন। তাঁদের নাম থেকে এই গ্রামের নাম হয় মুখবা। এখানকার মানুষদের দু’টি করে ঘর। শীতে যখন গোটা অঞ্চল বরফে ঢেকে যায়, তখন সবাই নীচে উত্তরকাশীতে চলে যান। এখানকার ঘরবাড়ি বন্ধ থাকে। শুধু রয়ে যান মন্দিরের পূজারী পরিবার। শীতের ছ’মাস মা গঙ্গা এখানে পুজো পান। শীত শেষ হয়। বরফ গলে চার দিকে ফুল ফোটে। অল্প অল্প করে মানুষজন ফিরে আসতে আরম্ভ করে গ্রামে। জেগে ওঠে মুখবা। পুজো-পাঠ, চাষবাস, হোটেল, দোকান চালু হয়। ছ’মাসের আয়ে পুরো বছর চালাতে হয়। এই করেই তাদের জীবন চলে। দিন পাল্টাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। চাকরি করতে বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু অক্ষয়তৃতীয়ার উৎসবে ঘরে ফেরে সবাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement