শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: কুনাল বর্মণ
কড়া নাড়ে ব্যোমকেশ
কেয়াতলা, কলকাতা। রয়েছেন প্রবীণ ও নবীন দুই সাহিত্যিক। নবীনের কাছে নিজের প্রিয় চরিত্রটির নেপথ্য গল্প পাড়ছেন প্রবীণ। জানালেন, চরিত্রটির নামে ছায়া আছে তাঁর হস্টেলবেলার এক প্রিয় বন্ধুর। অনুজ ফিরে গেলেন গল্পগুজব করে। আচমকা তার পরে দরজায় ঘণ্টা। এক বৃদ্ধ। প্রবীণ সাহিত্যিক: ‘কী চাই?’ বৃদ্ধ নিজের নাম বলে পূর্বসূত্র ভাঙলেন, ‘আমাকে চিনতে পারছিস না?... তোর প্রথম বই যৌবনস্মৃতি যে প্রকাশ করেছিল।’ আনন্দে আত্মহারা প্রবীণ সাহিত্যিক। কত কালের হারিয়ে যাওয়া পুরনো বন্ধু কড়া নেড়েছে। গল্প জমে উঠল। বৃদ্ধ বললেন, ‘তুই আমাকে বিখ্যাত করে রেখে গেলি। বাংলা সাহিত্যে ব্যোমকেশের মতো রহস্য-নায়ক একটাও হয়নি।’
এত ক্ষণে সবাই হয়তো বুঝতে পেরে গেলেন যোগসূত্রটা। প্রবীণটি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুজ সাহিত্যিক, শংকর। আর ওই বৃদ্ধ হলেন ‘সত্যান্বেষী’ ব্যোমকেশের ছদ্মনামধারী, অতুলচন্দ্র মিত্র স্বয়ং। অথচ, ওই ‘রহস্য-নায়ক’-এর স্রষ্টা পনেরো বছর ধরে তাঁর সৃষ্টি-সন্তানকে ছেড়ে ছিলেন। পরে পুণেতে এসেছেন। কালক্রমে নতুন তৈরি স্থায়ী বাড়ি ‘মিথিলা’য় উঠেছেন। ফের মনে পড়ল। কেন? কারণ পাঠক। কলকাতায় এসে দেখেছেন যে, ব্যোমকেশ-রহস্যের মায়ায় আটকে পড়েছেন অগণিত পাঠক। আবার জন্ম নিতে শুরু করল সে— ‘চিত্রচোর’, ‘দুর্গরহস্য’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘আদিম রিপু’ প্রভৃতি। বাঙালি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হল ব্যোমকেশ, অজিত আর সত্যবতীতে।
আসলে ‘পাঠক’, এই বিষম বস্তুটিই সব সময় ভাবিয়েছে শরদিন্দুকে। কিছুটা দুশ্চিন্তাও তাড়া করেছে কখনও-কখনও। বিষয়টা হয়তো টের পেয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। নামটা অচেনা? বাদল বসু। আনন্দ পাবলিশার্সের প্রাক্তন প্রকাশক। তা এই ‘পিওন থেকে প্রকাশক’-এর অভিজ্ঞতা—
“রচনাবলি বেরোবে শরদিন্দুর। কিন্তু রচনাবলি, রচনাসমগ্র, এ সব নাম পছন্দ নয় লেখকের। শব্দ-সাগর মন্থন করে শরদিন্দু আনলেন নতুন নাম, ‘অম্নিবাস’। প্রথমে দু’টি খণ্ড প্রকাশিত। কিন্তু লেখক যে তখনও নিঃসংশয় নন। বলছেন, ‘তোমরা আদ্য ও মধ্যপরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়েছ সত্য, কিন্তু তীর্থ পরীক্ষা এখনও বাকি। Public বইখানাকে কীভাবে নিয়েছে তা না জানা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।’
তিন-চারটি বিজ্ঞাপনেই শরদিন্দুর বইয়ের কেমন চাহিদা হয়েছিল, তার সাক্ষ্য দেন বাদল বসু, ‘তাঁর যে এত অনুরাগী পাঠক এবং ক্রেতা আছেন একথা বোধকরি স্বয়ং লেখকও জানতেন না।’”
পাঠ ও সৃষ্টি
পাঠকের নিক্তিতেই কি সৃষ্টির কদর বুঝতে চেয়েছেন শরদিন্দু? এই জায়গা থেকে যেন বিষয়টি ডালপালা ছড়ায়। তৈরি হয় সাহিত্যের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়ার এক মহাকাব্যিক সত্যান্বেষণ। যে সত্যান্বেষণে দীক্ষা দরকার। আর তার প্রথম ধাপ, সাহিত্য-পাঠ। শরদিন্দু তাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ। শুরুটা ছোট থেকেই। লেখকের জন্ম, ৩০ মার্চ, ১৮৯৯-এ। বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা ৭টা ১৪। জন্মস্থান, উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে মামার বাড়ি। বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মা বিজলীপ্রভা দেবী। শরদিন্দুরা দুই ভাই, তিনি ও অমরেন্দু আর এক বোন কল্যাণী। তারাভূষণ অত্যন্ত সফল আইনজীবী, মুঙ্গের বার অ্যাসোসিয়েশনের অর্ধ-শতকের সভাপতি। তারাভূষণের ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবহের ছোঁয়া লেগেছিল। গানও শিখেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। সেই সূত্রে সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ অনুরাগ। আর জীবিকাসূত্রে সঙ্গী মোটা-মোটা বই। মা-ও তাই, তবে পড়েন সাহিত্য। ঠাকুরমাও পড়ুয়া। তিনি ডুব দেন ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’-এ।
ছোট্ট শরদিন্দু দেখে বাড়ি জুড়ে তিন-চার আলমারি বই— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখের। আর এত্ত পত্রিকা— ‘বসুমতী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’, ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি। কতই বা বয়স তখন। মেরেকেটে তেরো-চোদ্দো বছর। মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রায় মুখস্থ। লুকিয়ে-লুকিয়ে চলে উপন্যাস পড়াও। অবশ্য বাংলা হলে লুকিয়ে। ইংরেজিটা প্রকাশ্যেই। কারণ, বাবা বলে দিয়েছেন, ইংরেজি বইতে বাধা নেই। ওতে ইংরেজিতে দড় হবে ছেলে। কিন্তু ওই বয়সে বিলিতি ভাষার বই কী আর সবটা বোঝা যায়! পরোয়া নেই। যেটা বুঝতে পারে না, কল্পনার রঙে রাঙিয়ে পূরণ করে নেয়কিশোর শরদিন্দু।
কালক্রমে মুঙ্গের ট্রেনিং অ্যাকাডেমি ঘুরে মুঙ্গের জেলা স্কুল। ড্রিল-মাস্টার পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী বললেন, ‘তোমরা কবিতা লেখ না কেন?’ শুরু ও-ই। শরদিন্দুর কবিতার বিষয় হল, ‘কষ্টহারিণীর গঙ্গাঘাট’। মাস্টারমশাই প্রশংসা করলেন। শরদিন্দুরও সাহিত্যে নাড়া বাঁধা হল। স্কুলেরই মাস্টারমশাই কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার ইতিহাস নিয়ে কী যেন এক বই পড়তে দিলেন এক দিন। হয়তো সেই সূত্রেই পরে চৈতন্যদেবের গোড়ার জীবন নিয়ে লিখবেন ‘চুয়াচন্দন’। ঘটনাচক্রে, গল্পটি শরদিন্দু ছ’বার লিখেছিলেন, শুধুমাত্র তৃপ্তির খোঁজে। এখানেও যেন মনের সত্যান্বেষণ।
এমন মন-কেমনের ডাকপিওন প্রথম চিঠিটা পাঠিয়েছিল ম্যাট্রিক শেষে। ইলাহাবাদে মামার বাড়িতে গিয়েছেন শরদিন্দু। একলাই কাটে। ঠা-ঠা দুপুরে মন কেমন করে। খাতার পাতায় ফুটে উঠল প্রথম গল্প, প্রথম অলৌকিক গল্পও বটে সেটি, ‘প্রেতপুরী’-র খসড়া। ‘পুষ্পপাত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। ‘সূৰ্য্যাস্তের পর শ্রাবণের বৃষ্টি আরো চাপিয়া আসিয়াছিল’ যখন, হয়তো তখন থেকেই মাথার মধ্যে উঁকি দিতে থাকল অজস্র গল্পগাছা। তিনি তখন মোটে ষোলো। লিখলেন ‘প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত’, যা পরে নাম পাল্টে ‘দাদার কীর্তি’।
আসলে শরদিন্দু, কীর্তিকে শুরু থেকেই যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়িয়ে দিতে চান সাহিত্যের অরণ্যে। সে অরণ্যের আর এক নাম কি কলকাতা? বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশোনা করতে এলেন। মেছুয়াবাজারের ওয়াইএমসিএ-র হস্টেল, বাদুড়বাগানের মেস এবং ৬৬, হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস— বাস্কেটবল খেলোয়াড় শরদিন্দু যেন ‘হুক পাস’ দিয়ে এক স্বাধীন অরণ্যে ওড়াউড়ি শিখছেন। তত দিনে শেখা হয়েছে মুঙ্গেরের বাড়িতে বজ্যুলালের কাছে লাঠিখেলা। কলকাতা নামের অরণ্যে কত কিছুর হাতছানি— অজিতের, অজিতকুমার সেনের বন্ধুতার আড্ডা। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শেক্সপিয়র, জেন অস্টেন, বার্নার্ড শ, হল কেন, ম্যাথু আর্নল্ড, আর্থার কোনান ডয়েল, লিয়ো টলস্টয়, ইভান তুর্গেনেভদের বিচিত্র পৃথিবীর হাতছানি। অরণ্য-গোধূলির আলো-আঁধারিতে বিজো গ্র্যান্ড অপেরা হাউস (পরবর্তী কালে ‘গ্লোব’), পিকচার প্যালেস, পিকচার হাউসে দেখা বিলিতি সিনেমায় যেন তৈরি হতে থাকে এক স্বপ্নের দেশ। মিনার্ভার নাটক, সাহিত্যসভায় বক্তৃতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি মিলিটারি কোর-এর নিদারুণ নিয়মানুবর্তী জীবন, শরদিন্দু যেন শ্রমণের মতো হাঁটছেন কলকাতার বুক জুড়ে। কিন্তু মিলিটারি জীবন যেন ‘প্রভুতান্ত্রিক’, ওতে ‘আত্মজ্ঞান অত্যন্ত লঘু হয়ে পড়ে’!
কলেজ পাশটাও হল এই করে। এই বার? বাবার নির্দেশে আইন পড়া। হল না। বাড়ি ফিরলেন। তিনটি বছর মাঠে মারা গেল, অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে বিলিতি সিগারেট বর্জন আর বরদার গল্পে বার বার ফিরে আসা ‘বাণীমন্দির’ নিয়ে। স্রেফ বাড়িতে বসে-বসেই দিন কাটে। শেষে হতাশ বাবার দিকে তাকিয়ে পটনা ল’কলেজ থেকে আইনের পাঠক্রম পড়লেন বটে, কিন্তু আইনে সিদ্ধি পাওয়ার মতো ‘পাটোয়ারি বুদ্ধি’ যে তাঁর নেই। তবে লাভ একটা হল! নানা মামলার মালমশলা পেলেন, যা পরে সাহিত্যে কাজে লাগাবেন।
অবশেষে বছর ঊনত্রিশ বয়সে ঠিক করলেন অনেক হয়েছে। বাবার উপার্জনের উপরে নির্ভর করে ‘...বাণীর আরাধনায় শান্তভাবে জীবন কাটাইয়া দিব।’ ব্যোমকেশ-সঙ্গী অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু এমনটাই ভেবেছিল। বাণী-আরাধনাতেই হল উপার্জনও। ‘পুষ্পপাত্র’-এ ‘বিজয়ী’ গল্পের জন্য পাঁচ টাকা। ১৯৩৩-এ প্রকাশ প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘জাতিস্মর’। এতেই আছে ‘মৃৎপ্রদীপ’ গল্পটি। সে গল্পের নুড়ি-কাঁকর কুড়োনোরও গল্প আছে। এক দিন কুমরাহারে প্রাচীন পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরছিলেন শরদিন্দু। হঠাৎ হাতে এল প্রাচীন এক মৃৎপ্রদীপ। বাড়িতে এনে টেবিলে রেখে তা জ্বাললেন শরদিন্দু। কয়েক দিন ওই জ্বলন্ত প্রদীপের দিকে তাকিয়ে থাকেন শুধু। ধরা দিল কুমারদেবী, চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রবর্মাদের আখ্যানভাগ, ‘মৃৎপ্রদীপ’। এমনই গল্প লেখার গল্প আছে ‘রক্তসন্ধ্যা’-কে ঘিরেও। লেখকের মনটা বড্ড অস্থির তখন। নতুন কিছু লিখতে হবে। হাতে এল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ‘ফিরিঙ্গি-বণিক’। চোখের সামনে ছবির মতো ফুটে উঠল কালিকট নগর, ভাস্কো ডা গামারভারতে আসা, নিষ্ঠুর ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে দেশীয় বণিকদের সংঘাত।
ঘরে সেন্সর
লেখা চলে, কিন্তু মনের সত্যান্বেষণে অনেক সময়ে অন্য এক জন রক্তমাংসের মানুষকে যে দরকার হয়, যিনি হবেন হয়তো বা প্রথম পাঠক। যাঁর কাছে আবদার রাখা যায়, গল্প করা যায় কাহিনি নিয়ে। প্রায় ছ’ফুটের শরদিন্দুর প্রথম পাঠক, মেরেকেটে সাড়ে চার ফুটের স্ত্রী: পারুলবালা দেবী। দম্পতির তিন সন্তান, দিব্যেন্দু, অতনু, শান্তনু। শরদিন্দু তাঁর এই একমাত্র বান্ধবীটি সম্পর্কে বলছেন, ‘সেন্সরশিপটা আমার ঘরে থেকে যাওয়ায় লাভ হয়েছে। ছাপা হওয়ার আগে লেখা আমি আর কাউকে পড়াই না।’ পারুলবালার সঙ্গে এমন সত্য-জীবনেও কিন্তু সাহিত্যের রূপ-রস-গন্ধ লগ্ন আছে।
টের কি পারুলবালাও পেয়েছেন যৌবনের প্রথম প্রহরে? সদ্য বিবাহিত তখন। কলকাতা ফিরবেন লেখক। কিন্তু শরদিন্দু লিখছেন, ‘বধূ চুম্বন করিতে অসম্মত। তথাস্তু।’ কখনও বা হস্টেল থেকেই স্ত্রীকে ইংরেজিতে লিখছেন প্রেমপত্র, ‘মাই সুইট লিটল লাভিং ওয়াইফ, আই হ্যাভ আ লঙ্গিংইন মাই হার্ট টু ফ্লাই অ্যাওয়ে টু ইউ টু কিস ইয়োর সুইট লিপস...’।
এই ‘হেলথ ইনস্পেক্টর’, ‘রেশনিং অফিসার’ এবং প্রথম পাঠিকা বৌটিকে এক বার উদ্ধারের গল্পও বলছেন শরদিন্দু। ১৯৩৪-এর ভূমিকম্পের দিন মুঙ্গেরের বাড়িটা কেঁপে উঠল স্বভাবতই। ভূমিকম্প থামলে দেখা গেল, নীচে নামার সিঁড়ি বন্ধ। গিন্নিকে নিয়ে মাটিতে নামলেন শরদিন্দু। নিজেকে পরিহাস করে বলছেন ‘শৌর্যের চূড়ান্ত দেখিয়ে’। এই শৌর্যবান স্বামীর জন্য পারুলবালার একটি উটকো কাজ আছে। প্লেট প্লেট আলুভাজা করা, চা করা। লেখক স্বামীটি গল্পের নকশা কাটেন। আর আনমনে উড়ে যায় মুঠো মুঠো আলুভাজা।
ভালবাসাবাসির এমন নদী কিন্তু বুড়ো বয়সেও পূর্ণ জোয়ান। সাক্ষ্য, সাহিত্যিক শংকরের। ঘরোয়া আড্ডা। সাহিত্যিকেরা সব এসেছেন। শরদিন্দু তখন বছর ষাট। খাবারদাবার, চা নিয়ে হাজির পারুলবালাও।
শরদিন্দু: ‘এঁকে তোমরা ভাল লিখে সন্তুষ্ট রাখবার চেষ্টা কোরো। জানো তো শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত উপদেশের কথা: বাংলায় লিখে যদি টিকে থাকতে চাও তাহলে মালক্ষ্মীদের চটিও না।’
পারুলবালা: ‘তুমি আর বোলো না, সব সময়ই তো চটিয়ে রেখেছ।’
এ ভাবে শরদিন্দু রসিকতায় মাতিয়ে রাখেন বাড়ির সবাইকেই। পুত্রবধূদের সব রকম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বলেন ‘প্রাণ যা চায়’, তাই করবে। বৌমা রেখার স্মৃতিতে আছে, শ্বশুরমশাইয়ের খাদ্যপ্রিয়তা। বিশেষত কচুর ঘণ্ট, মাছ খাওয়ার গল্প। আবার নাতি তূণকের পোষা কাঠবিড়ালীর নাম তিনি দিয়েছেন চিড়িকদাস। বৌমা রেখার নাম রেখেছেন ‘চিচিং’। নাতি দীপঙ্করের স্মৃতিতে আবার রয়েছে ঠাকুরদার পিঠে চড়ে ‘তিল গোনা খেলা’ বা ঠাকুরদার বলা ভূতের গল্পগুলো। বস্তুত অলৌকিক গল্পের প্রতি শরদিন্দুর দুর্বলতা বহু দিনের। শুনতে শুনতে এ-ও মনে পড়তে পারে যে, ‘মোক্তার ভূত’, ‘নন্দনগড় রহস্য’ ইত্যাদি-সহ ২৮টি কিশোর গল্পের লেখকের নামও শরদিন্দু।
সাহিত্যে সত্য
লেখকের সত্যান্বেষণের একটি উদ্দেশ্য অনেক সময়, নিজস্ব ‘সত্যের’ দ্বারা অন্যকে অনুপ্রাণিত করা। সাহিত্যের আঙিনায় তা-ই যেন করছেন শরদিন্দু। চেয়েছেন অনুজ সাহিত্যিকদের পাশে থাকতেও। শংকরের ‘বোধোদয়’ নিয়ে খুব বিতর্ক তৈরি হয়। বিমল মিত্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শরদিন্দুর কিন্তু উক্তি, ‘ব্রাইট, বোল্ড, বেপরোয়া— চালিয়ে যাও।’ দিয়েছিলেন পরামর্শও, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো ভাবনা নেই যা আড়াইশ/ তিনশ পাতার মধ্যে প্রকাশ করা যায় না।’ অকারণ শব্দ ব্যবহারের তিনি যে ঘোর বিরোধী। কিন্তু আবার পাঠক-চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান। বলছেন, ‘এদেশের পাঠক বোকা, সে পাতার হিসেবে বইয়ের দাম দেয়, প্রতিটি পাতায় কতটা ভাবনা-চিম্তা আছে তার হিসেবে না।’
আসলে নিজের ভাবনা-চিন্তা সম্পর্কে স্পষ্টবাদী বলেই হয়তো বা ব্যোমকেশ নিয়ে সাফাই দিতে চেয়েছেন। গোয়েন্দা-কাহিনিকে অনেকে ‘অন্ত্যজ শ্রেণির সাহিত্য’ বলেন, এ কথা বিলক্ষণ জানেন শরদিন্দু। কিন্তু এডগার অ্যালান পো, আর্থার কোনান ডয়েল, জি কে চেস্টারটনরা যা লিখেছেন, তা লিখতে তাঁর যে ‘লজ্জা’ নেই, সেটাও বুক ঠুকে জানান। বলতে পারেন, ব্যোমকেশ তাঁর প্রিয় সৃষ্টি। ১৯৩২-এ আবির্ভাব ব্যোমকেশের। ব্যোমকেশ-কেন্দ্রিক পূর্ণ কাহিনির সংখ্যা ৩২টি। ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্ত-হীরা’, ‘সত্যান্বেষী’, ‘বেণীসংহার’ প্রভৃতির লেখকের সঙ্গে সৃষ্ট চরিত্রের বয়সের ফারাক ন’বছর। শরদিন্দুর কলকাতায় মেস ও অন্য খরচ মিলিয়ে মাসে তিরিশ টাকা বরাদ্দ ছিল। ঘটনাচক্রে অজিতের মাসখরচ গল্পে পঁচিশ টাকা।
ব্যোমকেশকে সাহিত্যের শুদ্ধতার মাপকাঠিতে দেখতে চান শরদিন্দু। তাই বলেন, ‘ওগুলি নিছক গোয়েন্দা কাহিনী নয়। প্রতিটি কাহিনীকে আপনি শুধু সামাজিক উপন্যাস হিসাবেও পড়তে পারেন।’ আর সেই সমাজ-উপন্যাসের নায়ক ঘোরাফেরা করে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর এক অস্থির সময়ের মধ্যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মধ্য ও উত্তর কলকাতা জুড়ে, মানুষের অতর্কিতে হওয়া বিপদ, তার রূপ-রস-গন্ধের মধ্যে। এই রকম এক সমাজ-দেখা, দাঙ্গাধ্বস্ত কলকাতার মানব-জমিনের ছবি ‘বিষের ধোঁয়া’ উপন্যাসেও।
কিন্তু শুধু ব্যোমকেশ বা নিজের সাহিত্য নয়, সমকালীন সাহিত্যকেও শরদিন্দু দেখছেন নির্মোহ সমালোচক ও শুদ্ধতার চশমা পরে। আর সেই দৃষ্টি এতটাই খর যে, রেহাই পাচ্ছেন না ভারতীয় সাহিত্যের তিন কিংবদন্তি বন্দ্যো-বংশজাত লেখকও। কমিউনিস্ট-বিরোধী শরদিন্দু মানিকের সাহিত্যে ‘...একটা রাজনৈতিক মতবাদের প্রচারকার্য’ ছাড়া কিছু দেখছেন না। তবে স্বীকারও করেছেন মানিকের লেখার সঙ্গে ‘ভাল পরিচয় নাই’। বস্তুত এখানে বামপন্থী পাঠকদের ক্ষোভ-দুঃখের কিছু নেই। কংগ্রেসপন্থী তারাশঙ্করেরও ‘কবি’ ছাড়া কিছুই বোধহয় মনে ধরেনি তাঁর। ‘মন্বন্তর’-এর কলকাতা শরদিন্দুর মতে ‘ব্যর্থ চেষ্টা’। সামগ্রিক ভাবে এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের সাহিত্যে শরদিন্দুর মনে হয়েছে, ‘নিগৃহীত আকাঙ্ক্ষা বিকৃত বিকলাঙ্গ রূপে দেখা দিয়েছে।...তারাশঙ্করের দুঃখ অস্বাভাবিক দুঃখ।’ আর বিভূতিভূষণ? তাঁর দুঃখ স্বাভাবিক। ‘কিন্তু সবই অ-গোছালো ভাবে’ উপস্থাপিত। একই ভাবে বনফুল, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সবারই কিছু না কিছু ‘খুঁত’ বার করছেন শরদিন্দু।
আধুনিক সাহিত্যে শরদিন্দু ‘বিড়ির আগুন’ আর অশ্লীলতা ছাড়া বড় কিছু একটা খুঁজে পাননি। এর কারণও নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি— ‘বাঙালী কামপ্রবণ জাতি, তাই তাহার সাহিত্যও রতিরসে ওতপ্রোত’! সাহিত্যে অহেতুক রতির অনুপ্রবেশ নিয়েই বোধহয় আপত্তিটা ওঁর।
শরদিন্দুর মতে, শরৎচন্দ্র শুধুই শিল্পী। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্র হলেন শিল্পী ও মনীষী। ‘লেখকের আদর্শ’-এর সৌধ তৈরি করতে গিয়ে শরদিন্দুর সিদ্ধান্ত, ‘বঙ্কিমচন্দ্রকে আদর্শ বলিয়া জানিবে। তিনি ভিন্ন বাংলায় অন্য আদর্শ নাই।’ আর রবীন্দ্রনাথের প্রতি অভিমানও আছে কিছুটা। নিজের বই পাঠিয়েও যে কবির উত্তর মেলেনি। যদিও, রবীন্দ্রনাথ তখন খুবই অসুস্থ। কিন্তু তাতে রবীন্দ্র-অনুরাগে খামতি পড়েনি। ‘ক্ষণিকা’ পড়ে মনে হয়েছে, সেখানে যেন রবি-কবির ‘পূর্ণ যৌবনের সমস্ত শক্তি’ প্রকাশিত।
এক জন সাহিত্যিক শরদিন্দুর অকুণ্ঠ প্রশংসা পান, তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রধান কারণ, আলী সাহেবের ভাষা। ওই ভাষায় যে একটা ‘খাঁটি বাঙালির মন’ রয়েছে।
বস্তুত, শরদিন্দুর সাহিত্যে সত্যান্বেষণের অন্যতম অস্ত্র তাঁর ভাষা। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জাতিস্মর’ থেকে শুরু করে মোট ২২টি ইতিহাসগন্ধী লেখায় ভাষার গাম্ভীর্য দিয়ে আশ্চর্য মায়াজাল তৈরি করেছেন বাংলা সাহিত্যের ‘বিহারি গ্রুপ’-এর এই লেখক। অভিনন্দন জানিয়ে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘তাঁহার বিদ্যাবত্তা, রচনাচাতুর্য ও ভাষার মাধুর্য ও ঔদার্য দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছি।’ ইতিহাসগন্ধী ‘গৌড়মল্লার’, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ বা পণ্ডিতপ্রবর হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে লেখা ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’-এর আশ্চর্য আবহে আমরাও যেন থম মেরে বসে থাকি। প্রথম দু’টি কাহিনি লিখে খুব তৃপ্তি পান শরদিন্দু। তাঁর প্রিয়জন প্রমথনাথ বিশীর মতে, ‘...বঙ্কিমবাবুকে মনে এনে দেয়...’। ইতিহাসগন্ধী উপন্যাসগুলি নিয়ে তর্কসাপেক্ষ ভাবে সর্বোত্তম শংসাপত্রটি এসেছিল এক জন ইতিহাসবিদের থেকেই। রমেশচন্দ্র মজুমদার। বলছেন, ‘...লোকে ইতিহাস পড়ে না— কিন্তু আপনার বই পড়িবে।’ কিন্তু শরদিন্দুকে বাঙালির ইতিহাসবিস্মৃতি পীড়া দিয়েছে। আক্ষেপ করেছেন, ‘আমরা অমৃতের পুত্র নয়, আমরা বানরের বংশধর এই কথাটাই এখন বড় কথা।’
ইতিহাসগন্ধী লেখার গাম্ভীর্যের সঙ্গে রয়েছে বরদার বৈঠকি কথনকৌশল, ব্যোমকেশের নাগরিক গতিশীল ভাষার মায়াজাল। ভাষার বিষয়টা খেয়াল করেছেন আচার্য সুকুমার সেন। বলছেন, ‘কাহিনীকে ভাসিয়ে তাঁর ভাষা যেন তরতর করে বয়ে গেছে সাগরসঙ্গমে।’ কিন্তু এই ভাষার প্রকৃতি কী? ধন্দে পড়েন কি মুগ্ধ সুকুমারও! বলছেন, ‘সাধু-চলিত কিংবা চলিত-সাধু’! ভাষা বিচারে না গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো আমরা বোধহয় শুধু ‘তাঁর গদ্যের একটা আলাদা স্বাদ’ গ্রহণের চেষ্টা করতে পারি শুধু।
অর্থ-অনর্থ
আসলে সাহিত্যের সত্যান্বেষণে আদর্শ থাকে নিজের জায়গায়। কিন্তু তাতে অর্থ-যোগ কতটা? ভাবতে বাধ্য হন শরদিন্দুও। তিন ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। বাবার পসার কমে গিয়েছে। ১৯৩৭-এ বই লিখে বার্ষিক আয় ১৮০০ টাকা। এই পরিস্থিতিতে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের একটা চিঠি পেলেন। তাঁর শ্যালক হিমাংশুনাথ রায় ওরফে হিমাংশু রাই ‘বম্বে টকিজ়’-এর কর্তা। চিত্রনাট্যকার হিসেবে বম্বে যাওয়ার প্রস্তাবটা আগে পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যাননি। কিন্তু শরদিন্দু গেলেন। আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে শরদিন্দুর সঙ্গে দেখা হল তারাশঙ্করের। শরদিন্দু বললেন, ‘আপনি নিলেন না, আমি নিয়ে নিলাম ও কাজ।’
গেলেন মুম্বই। শরদিন্দু সিনেমার গল্প লিখেছেন ইংরেজিতে। ‘ভাবী’, ‘বচন’, ‘দুর্গা’, ‘কঙ্গন’, ‘নবজীবন’, ‘আজ়াদ’, ‘পুনর্মিলন’— বম্বে টকিজ়-এ সাতটি ছবির সঙ্গে জড়িয়েছেন শরদিন্দু। কিন্তু শুধু বোধহয় অর্থ নয়, সাহিত্য-শিল্পের সত্যান্বেষণের সম্ভাবনাটাও কাজ করছিল শরদিন্দুর মনে, ‘সিনেমা শিল্পের অপূর্ব সম্ভাবনার কথা ভাবিয়া হাত নিশপিশ করিত’। মহারাষ্ট্র-পর্বের স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায় ‘ঝর্ণা’, ‘চিড়িকদাস’, ‘কিসের লজ্জা’, ‘বোম্বাই কা ডাকু’ প্রভৃতি গল্পে। বম্বে টকিজ়-এর পরে কিছুদিন আচারিয়া আর্ট প্রোডাকশনেও কাজ করলেন। পরে ফ্রিলান্স।
শরদিন্দুর গল্প নিয়েও চলচ্চিত্র কম হয়নি। বাংলায় ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘রাজদ্রোহী’ বা ‘শজারুর কাঁটা’র আগেই শরদিন্দুর নিজের করা চিত্রনাট্যে ‘দেবদূত’ ও ‘বিষের ধোঁয়া’ পরিচালনা করেন লেখকের দ্বিতীয় পুত্র অতনু। ‘ঝিন্দের বন্দী’ ‘তপনা’ (তপন সিংহ) করবে জেনে খুব খুশি হন। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই উপন্যাসটি পাঠকসমাজে আলোড়ন তুলেছিল। চলচ্চিত্রটিও তা-ই। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ শরদিন্দুর পছন্দ হয়নি। কারণটা বোধহয়, লেখক শরদিন্দু নিজের সৃষ্টিকে খুঁজে পাচ্ছেন না ছায়াছবিতে, ‘আরে দূর ওই ব্যোমকেশ নাকি? ব্যোমকেশ কস্মিনকালে চোখে চশমা পরেনি... ব্যোমকেশের নাক হল ধারালো, বেশ লম্বা, নাতিস্থূল চেহারা।’ শরদিন্দুর পৌত্রপ্রতিম প্রবীর চক্রবর্তীরও এই বিষয়ে সাক্ষ্য আছে। তিনি বলেন, ‘দাদু চিড়িয়াখানা দেখে ঠাট্টা করেছিলেন, ইস! ব্যোমকেশ তো কায়েত, তাকে উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়… একেবারে বামুন বানিয়ে দিল।’ ব্যোমকেশ কেন বক্সী, তার কারণ এক সাক্ষাৎকারে এক বার বলেওছেন শরদিন্দু, ‘কায়েতদের বুদ্ধি বেশি’! ঘটনাচক্রে, ফেলুদা প্রদোষচন্দ্রও কিন্তু কায়স্থই, মিত্র!
কিন্তু যে সম্ভাবনার কথা ভেবে মুম্বই আসা শরদিন্দুর, সেটা মিলল না। দেখলেন, ‘সিনেমা কর্ম যে শিল্প কর্ম নয়, বাণিজ্য কর্ম...’। বস্তুত, শরদিন্দু অপেক্ষা করছিলেন এক গুণী পরিচালকের— ‘সিনেমা শিল্প নিজ স্বকীয় স্বতন্ত্র স্রষ্টা-শিল্পীর জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে— যাহাকে শিল্পের অন্য ক্ষেত্র হইতে টানিয়া আনিবার প্রয়োজন হইবে না...’। বিমল রায় তাই বম্বে টকিজ়-এ যোগ দেওয়ায় খুব খুশি হন। সিনেমার গল্প লিখতে আসার সময়এবং পরবর্তী অভিজ্ঞতা যে শরদিন্দুর মেলেনি, তা ধরা পড়ে ‘ছায়াপথিক’ উপন্যাসের সোমনাথ চরিত্রটির মধ্যে।
অথচ, জীবনের ঘটনার মেলা-না মেলার বিষয়টি নিয়ে শরদিন্দু আজীবন চর্চা করেছেন। বিষয়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু। শরদিন্দু ডায়েরিতে লিখছেন, ‘জন্মসময়ের অভাবে লগ্ন স্থির করিতে পারিতেছি না... চেহারা ইত্যাদি হইতে মনে হয় সিংহ লগ্ন। সিংহ লগ্নের বুধ মারক। বুধ দশার আরম্ভেই মৃত্যু হইয়াছে।’ ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, শরদিন্দু ‘পাকা জ্যোতিষী’। নিকটজনদের কাছে জ্যোতিষী শরদিন্দুর কদর অন্য রকম। ডাকযোগে তারাশঙ্কর তাই প্রশ্ন করেন, ‘অশুভটা কোন পথ ধরে আসবে? একটু আলোকপাত করলে সুখী হব।’ আবার প্রিয় বন্ধু প্রমথনাথ চিঠিতে লিখছেন, ‘আপনার বিরহে আমরা অর্থাৎ প্রতুলবাবু, জিতেনবাবু, বিমল মিত্র, গজেনবাবু ও আমি সকলেই কাতর। আপনি আসিয়া গ্রহনক্ষত্রকে একটু সচল করিয়া দিবেন, এইভরসায় আছি।’ এই প্রমথনাথের সঙ্গেই শরদিন্দু ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’য় ‘পাকা’ অভিনয় করেন।অভিনয়ের সঙ্গে নাটক লিখেছেন, ‘বন্ধু’, ‘লালপাঞ্জা’, ‘ডিটেকটিভ’ প্রভৃতি।
শরদিন্দুর মনে হয়েছে, জ্যোতিষ শাস্ত্রের সাফল্য ‘শতকরা আশিভাগ’। শুধু মনে করেননি, মিলিয়েওছেন। এক জনের ছক পরীক্ষা করে অতীত নিয়ে কিছু বলার পরে, ভবিষ্যৎবাণীও করলেন, ‘তোমার রাজযোগ রয়েছে।... রাজযোগ মানে রাজসম্মান তুমি পাবে, দেশের সরকারও তোমায় সম্বর্ধনা জানাবে।’ উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। এমনকি, হৃষীকেশ যখন আরব সাগরের পারে হতাশ হয়ে কলকাতাফেরার কথা ভাবছেন, তখনও শরদিন্দু তাতেনিষেধ করেছেন।
বিস্মিত হন শংকরও। প্রথম দেখা। শংকরকে দেখে শরদিন্দু বললেন, ‘বাবা, তোমার নিশ্চয় কর্কট রাশিতে জন্ম। আর লগ্নটা কী? কুম্ভ?’ দু’টোই মিলে গেল। এমনকি, প্ল্যানচেটে স্বয়ং শরদিন্দু একটি সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত করেছিলেন, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন বাদল বসুও!
সত্যের পুরস্কার
সাহিত্যের সত্যান্বেষণ করে চন্দ্রহাস (ছদ্মনাম, শরদিন্দুর) কোনও পুরস্কার পেয়েছিলেন কি? উত্তরটা লুকিয়ে আছে তাঁর জীবনেই। রবীন্দ্র পুরস্কার, ভারত সরকারের পুরস্কার: ‘প্রাইজ় কম্পিটিশন ফর চিলড্রেন লিটারেচার’, পত্রপত্রিকার কিছু সম্মান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎ স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি ঝুলিতে এসে পড়ে। কিন্তু এ সবের চেয়েও বড় পুরস্কার শরদিন্দু চেয়েছেন, পেয়েছেনও। ‘কালের মন্দিরা’ লেখা শুরু ১৯৩৮-এ। মাঝে বিরতি। ১৯৪৮-এ ফের লেখা। আবার ব্যবধান। শেষে ১৯৫০-এর ৪ ফেব্রুয়ারি শেষ। সত্যান্বেষী শরদিন্দু পুরস্কৃত হলেন, ‘...লিখিয়া আনন্দ পাইয়াছি... এই আনন্দটুকুই আমার পুরস্কার এবং ভাবিয়া দেখিতে গেলে এর চেয়ে বড় পুরস্কার লেখকের আর নাই।’ আর এই লেখকের জন্য আকুতিটা ধরা আছে ১৯৭০-এর ১১ জানুয়ারির আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কলকাতার কড়চা’ বিভাগে। শিরোনাম, ‘ব্যোমকেশ কোথায়?’ সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের প্রধান শাখা থেকে এক লক্ষ টাকা উধাও হয়েছিল সেই সময়ে। কড়চা আরও নানা গোয়েন্দা চরিত্রের উল্লেখ করেও বিশেষ ভাবে লিখছে, ‘শরদিন্দুবাবুর ব্যোমকেশ এখন কোথায়? সত্যান্বেষী হয়েও তিনি চুপ করে বসে আছেন কি করে?’
এই লেখকের প্রয়াণ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০, সকাল ৮টা ১৫-য়, মুম্বইয়ে ছেলের বাড়িতে। পুরস্কারের প্রাপ্তি নিয়ে তাঁর যাওয়া, আর রেখে যাওয়া একটি প্রত্যাশা। সেখানেও সাহিত্যের সত্য অন্বেষণ যেন— ‘আমার চিন্তা ও স্বপ্নের বীজ যদি বাঙালির সারবান মনের ক্ষেত্রে পড়িয়া থাকে, তবে আমার নাম সকলে ভুলিয়া গেলেও আমার বাঁচিয়া থাকা নিরর্থক নয়।’ বেঁচে থাকুক চিন্তাশীল বাঙালি!
তথ্যঋণ: ‘শরদিন্দু অম্নিবাস’ (১-১২ খণ্ড), ‘চরণ ছুঁয়ে যাই’: শংকর, ‘স্মৃতি চিত্রণ’: পরিমল গোস্বামী, ‘দিনগুলি মোর’: প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, ‘আমার সাহিত্য জীবন’: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়’: শ্রাবণী পাল, ‘অশোকনগর’, ‘কোরক’ এবং আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ