পিনাকী ভট্টাচার্য
দারচিনি যিশুর জন্মের ২০০০ বছর আগে থেকেই দামি রান্না, ওষুধ আর সুগন্ধি তৈরিতে অপরিহার্য ছিল ইউরোপে। ৩০১ সালে এক পাউন্ড দারচিনির দাম ছিল পাঁচ চাষির দিনমজুরির সমান।
দারচিনি ইউরোপে আসত আরবি বণিকদের সঙ্গে। তারা মহা ধুরন্ধর লোক। কোত্থেকে দারচিনি আনছে সেই ব্যাপারে এক্কেবারে মুখে কুলুপ। পাছে মৌরসিপাট্টা চলে যায়! উলটে উৎকট সব গল্প ফাঁদত। বলত, তাদের দেশে উঁচু পাহাড়ের ওপরে বিশাল বিশাল পাখি থাকে, তারা বাসা বাঁধে দারচিনির ডাল দিয়ে। সেই বাসা এত ওপরে আর পাখিগুলো এত হিংস্র যে সেখানে যাওয়া অসম্ভব। তবু সাহেবরা দারচিনি পছন্দ করে বলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের নীচে ষাঁড়ের মাংসের বড় বড় টুকরো ছড়িয়ে রাখে তারা। পাখিরা যখন মাংসের লোভে নীচে ঝাঁপায়, তখন তাদের বাসা ভেঙে পড়ে। বণিকরা সেই বাসার টুকরোগুলো কুড়িয়ে চম্পট দেয়। কখনও আবার বলত, পাহাড়ের গভীর গুহায় সাপের পাশে পড়েছিল এ সব। জান বাজি রেখে সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে দারচিনি জোগাড় করে এনেছে তারা। এ সব গল্প দিয়ে দারচিনির দাম আকাশছোঁয়া করে নিত। সব মিলিয়ে দারচিনি নিয়ে রহস্য জমাট। তাই তার পকেটকাটা দাম নিয়ে প্রশ্নের সাহস হত না কারও। স্বয়ং জ্যেষ্ঠ প্লিনিও বিশ্বাস করতেন, এক জন লোক দূর ইথিয়োপিয়া থেকে দাঁড়-মাস্তুলহীন নৌকোয় শুধুমাত্র অজেয় সাহস সম্বল করে দারচিনি নিয়ে প্রথম পৌঁছেছিল ইউরোপে। আর প্লিনির হাজার বছর পর ক্রুসেডের যুদ্ধের সময়েও দারচিনি-রহস্য জারি! সিয়র দ্য জ্যাভিল তাঁর রাজার সঙ্গে ক্রুসেডের জন্যে মিশর যান। ফিরে এসে, ১২৪৮ সালে তিনি লেখেন, নীল নদের মোহনা পৃথিবীর কিনারা! সেখানে জালে করে দারচিনি জল থেকে তোলা হয়!
মার্কো পোলো প্রথম দারচিনির এক উৎস খুঁজে বার করেন। চিন থেকে আট টন দারচিনি নিয়ে দেশে পৌঁছন। কিন্তু তাঁর কপাল খারাপ। আরবদের দারচিনির সঙ্গে এ বস্তুর গুণমানের প্রচুর ফারাক। একই সময়ে তাঁর দেশেরই পাদ্রি, জন অব মন্তেকর্ভিনো, তেরো মাসের জন্য ভারতে আসেন। তিনি আবিষ্কার করেন, মালাবার উপকূলের (তামিলনাড়ু) দক্ষিণে এক দ্বীপ (শ্রীলঙ্কা) দারচিনির আসল দেশ। আর দারচিনি হল গাছের ছাল। সে গাছের সঙ্গে ইউরোপেরই লরেল গাছের অদ্ভুত মিল। এই দারচিনির দেশ আবিষ্কার করার কৃতিত্বের জন্যই, পোপ পরে তাঁকে পিকিং-এর আর্চবিশপ নিযুক্ত করেন।
দারচিনির ট্যাক্স থেকে বিস্তর আয়। ইউরোপের লড়াকু দেশগুলো পড়ল ঝাঁপিয়ে। পর্তুগিজরা ভারতে এসে দক্ষিণ দিকে পা বাড়াল। কারণ উত্তরে দিল্লির দরবার। অনেক জবাবদিহি করতে হবে সেখানে। তার চেয়ে দক্ষিণ নিরাপদ। চুপি চুপি আগ্রাসন চালানো যাবে। তা ছাড়া দক্ষিণ মশলাপাতির দেশ। আসল গুপ্তধন তো সেখানেই! শ্রীলঙ্কাতেও পর্তুগিজরা আস্তানা গড়ে ফেলল আর একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দারচিনির কারবার নিজেদের থাবায় পুরে ফেলল। কিন্তু ১৬৩৮ সালে ওলন্দাজরা পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দ্বীপের দখল নিল, আর ব্যবসা চালাল দেড়শো বছর। তদ্দিনে মেক্সিকো থেকে অভিযানে বেরিয়ে স্পেনীয়রা ভাসতে ভাসতে ফিলিপিন্স এসে পৌঁছেছে। সেও দারচিনির দেশ। দারচিনির ব্যবসা ভাগ হয়ে গেল দুই দেশের মধ্যে।
১৭৯৬ সালে ওলন্দাজদের উৎখাত করে শ্রীলঙ্কার দখল নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই চা, কফি আর চকোলেটের জমানা শুরু হয়ে গিয়ে মশলার মৌরসিপাট্টা চলে গেল, আর ব্রিটিশদের হাতে রইল পেনসিল!
pinakee.bhattacharya@gmail.com
টিকটিকির টিউশনি
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
এম (Aim) অব ইয়োর লাইফ’ রচনায় প্রথম লাইনটাই ছিল ‘এম অব আ লাইফ ইজ দি সেল অব আ শিপ’। বাংলায় ‘তুমি কী হইতে চাও’ রচনায় ওই ইংরেজি কোটেশনটা দিয়ে দেওয়া যেত। বাংলা রচনায় ইংলিশ কোটেশন চলে, কিন্তু ইংলিশ ‘এসে’-তে বাংলা উদ্ধৃতি চলত না, চলে না।
গদগদে গদ্যে এই ধরনের রচনার একটা বাঁধা গৎ থাকে। ডাক্তার হয়ে দেশসেবা কিংবা শিক্ষক হয়ে জাতির মেরুদণ্ড। দু-এক জন ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’ কোটেশন দিয়ে পাইলট। ‘পাইলট’ রচনা বইতে থাকে না, বাবা কিংবা প্রাইভেট স্যরকে দিয়ে বানিয়ে রাখতে হয়।
একদা আমিও প্রাইভেট স্যর ছিলাম। একটা টিউশনিতে, ছাত্রটির নাম ছিল রতন। ক্লাস এইট। ছাত্রের বাবার চালু মুদি-দোকান। বলেছিলেন, ‘আপনি যা পড়াবেন— আমার কিছু বলার নেই। সুদকষা আর লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলো কষে করাবেন, ব্যস। কিন্তু, আপনার প্রধান কাজটা হবে ছেলের বদ অভ্যেস ছাড়ানো।’ সামান্য স্তব্ধতা নিলেন। তার পর বললেন, ‘ছেলেকে আলাদা ঘর দিইচি, ভেবেচি ডিসটার্ব ছাড়া খুব পড়ালেখা করবে। দেখতুম, রাত এগারোটা পর্যন্ত টেবিল ল্যাম্পে পড়ালেখা করছে, কিন্তু রেজাল্টখানা যাচ্ছেতাই। আগে কিন্তু ভাল করত। জানি, এইটে অ্যালজাবড়া ট্যালজাবড়া সব হ্যাবড়াজাবড়া ঢোকে, কিন্তু আমার ছেলের মাথার ঘি তো এত খারাপ হবার কথা না। ওকে রোজ খাঁটি গাওয়া ঘি খাওয়াই। ঘরে ডালডা ঢোকাই না, ব্রাহ্মীশাক খুঁজেপেতে আনি, ছেলে কেন এ রকম গোল্লা খাবে? ব্যাপারটা কী? সে দিন ছেলেকে বামাল সমেত ধল্লুম।’ আবার স্তব্ধতা।
বুঝলেন, শীতকাল। রাত এগারোটা। ছেলের ঘরে টেবিল ল্যাম্পো জ্বলছে। আমি একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। আবার স্তব্ধতা।
কী দেখলুম জানেন? ছেলে আমার টিকটিকি বই পড়ছে। ‘গভীর রাতের আগন্তুক’। তার পর ঘর সার্চ মেরে পাওয়া গেল ‘নীল সমুদ্রের বাজপাখি’, ‘বিভীষণের হুংকার’— এ সব বই। বাজপাখি সিরিজ। গাদাগুচ্ছের স্বপনকুমার। ভাল করে কানটা মুলে দিয়ে বইগুলো সিজ করে নিলুম। তার পরও দু-চার বার হানা দিয়েছি, তেমন কিছু পাইনিকো। কিন্তু রাত্তিরে ওর পড়ার ধরন দেখে সন্দেহ হতে লাগল। পড়ছে, কিন্তু আওয়াজ নেই। আচমকা ওর ঘরে ঢুকতেই ও বইটা বন্ধ করে দিল। দেখি, মলাটে উপনিষদের গল্প। বইটা ঝপাং করে খুলে দেখি, দীপক চ্যাটার্জি কালো পোশাক পরে গভীর রাতে গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে পাইপ বেয়ে উঠচে। মানে, ব্যামো যায়নি। ওর এটা সারাতে হবে। ওয়াচ রাখবেন, কষে হোম টাস্ক দেবেন, যেন ও-সব পড়ার টাইম না পায়।
ছেলেটার মাথার ঘি যে খারাপ ছিল না, সেটা মলাট পালটানোতেই বুঝেছিলাম। আমি ক’দিন পর অন্য বইগুলোর অভ্যন্তর দেখতে গেলে ও বলেছিল, ‘সব বইতে স্বপনকুমার ফিট করে না স্যর, সাইজে ছোট কিনা, উপনিষদ আর সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকার মলাটই ফিট করে।’ আমি বলি, ‘এখন কিছু দিন বন্ধ থাক, গরমের ছুটিতে হবে’খনে।’
ওর বাবা বলতেন, ‘ওয়াচ রাখছেন তো মাস্টারমশাই? দরকার হলে স্পাইং করবেন।’ আমি বলি, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার কথাবার্তায় খুব গোয়েন্দা গল্পের ইয়ে পাই।’ উনি বললেন, ‘আরে, হুকাকাশিই তো আমার বারোটা বাজিয়েছিল। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের গোয়েন্দা। কিরীটী-দীপক ওর কাছে কিছু না। দু’বার ম্যাট্রিকে হল না। ঠেকে শিখেই তো আপনাকে রাখা।’
ছেলেটার পিতৃদত্ত নাম নিয়ে অসন্তোষ ছিল। নামটা রতন রেখে দিল? রতন তো দীপক ব্যানার্জির অ্যাসিস্ট্যান্ট। দীপক রাখলেই তো হত।
রতন পড়ার টেবিলকে বলত অকুস্থল। ‘একটু অপেক্ষা করুন স্যর, এক্ষুনি অকুস্থলে আসছি।’ কঠিন অঙ্ক হলে বলত বিভীষিকা। অঙ্ক না পারলে মাথা নিচু করে বলত ‘রহস্যের সমাধানটা হল না।’ জ্যামিতির চাঁদা-কম্পাসকে বলত অস্ত্রশস্ত্র। ও এক দিন বলল, ‘একটা রচনা লিখেছি স্যর, নিজের ভাষায়, জীবনের লক্ষ্য। একটু দেখে দেবেন স্যর?’ দেখলাম। ‘আমি গোয়েন্দা হইয়া খুনি, প্রতারক, জালিয়াতদের ধরিয়া সমাজসেবা করিতে চাই...’ সূচনা-উপকারিতা-অপকারিতা-উপসংহার। ‘অপকারিতা’-র মধ্যে শুধু আছে, গোয়েন্দা হইতে গেলে ছোটবেলায় বাবার কানমলা খাইতে হয়। ছেলেটার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে যায় আমার। বছর দুয়েক পর ছেড়ে দিই।
খাতার রচনা আর জীবনের খাতা মেলে না কখনও; রতনের মিলেছিল। জেনেছিলাম, গোয়েন্দা বিভাগেই চাকরি পেয়েছে। কিছু দিন আগে এক বিয়ের আসরে দেখা। বলল, কত কঠিন রহস্যের সমাধান করেছে ও। জাল পাসপোর্টের চক্র, অস্ত্র তৈরির কারখানা, অপহৃত ব্যবসায়ীর হদিশ... বলল, ও এখন সিবিআই-তে। সিবিআই শুনে একটু আড়ালে নিয়ে শুধোই, ‘আচ্ছা রতন, চিটফান্ডের —র ব্যাপারটা বল তো, কারুক্কে বলব না।’
ও মাথা নিচু করে নখ কামড়াচ্ছিল। কঠিন অঙ্ক না পারলে যেমন করত। নখ কামড়াচ্ছিল, নাকি আঙুল?
swapnoc@rediffmail.com