ছবি: পিয়ালী বালা।
আগুন যখন আলো
যেখানে চিতার পর চিতা জ্বলতেই থাকে অহোরাত্র, কখনও নির্বাপিত হয় না আগুন; যেখানে একটি শরীর ছাই হওয়ার মুহূর্তেই আরও অনেক শরীরে অগ্নিসংযোগ ঘটে; কাছে-দূরের বনজঙ্গল উজাড় করে যেখানে পিপুল-বেল-বটের শরীর নিংড়ে কাঠের রাশি আসতেই থাকে, জল-মাটি-আকাশ-বাতাস-আগুনে তৈরি অবয়বকে, আগুনের মধ্যস্থতায় জল-মাটি-আকাশ-বাতাসে প্রত্যর্পিত করা হয় প্রতিক্ষণ, যেখানে কালভৈরব কেবল দরজা পাহারা দেন, ঘরে ঢোকেন না কারণ মহাকাল মানুষকে নিতে এসেছেন; যেখানে বাবা-মা’র দাহসংস্কার করতে সন্তান, সন্তানের দাহসংস্কার করতে বাবা-মা এসে দাঁড়ান, ভারতের জানা-অজানা গ্রাম-নগর, শহর, জনপদ থেকে; যেখানে তপস্যারত বিষ্ণুর ঘামে পূর্ণ হয় কুণ্ড, যার নাম চক্র-পুষ্করিণী, আর তা দেখতে গিয়ে মহাদেবের কানের কুণ্ডল খুলে পড়ে যায় কুণ্ডের ভিতরেই, যেখানে অনন্ত শিখা কখনও লাল আর কখনও হলুদ হয়ে প্রতিভাত হয় বলে, উচ্চারিত হয়, “কনকসমান কলেবর রক্তাম্বর রাজে/ রক্তপুষ্প গলমালা কণ্ঠনপর সাজে”, সর্বনাশ যেখানে কর্মফল আর কর্তব্যকে দু’কাঁধের বাঁকে চড়িয়ে রাস্তার পর রাস্তা চলতেই থাকে যেন যাপনই উদ্যাপন, সেই মনিকর্ণিকা যদি প্রথমে দু’জন, তার পর দশ জন, তার পর দু’শো, দু’হাজার, দু’লক্ষ আর তার পর অগণিত, অসংখ্য, অজস্র মানুষের বুকের ভিতর জ্বলতেই থাকে? জ্বলতে, জ্বলতে আগুনই হয়ে যায় আলো, মন্থন অন্তে উঠে আসা অনন্ত গরলের ভিতর থেকেই উপচে ওঠে অমৃত, যার প্রত্যেকটি ফোঁটার নাম, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”?
আন্তিগোনের আওয়াজ
থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাটের কোণে/ মাকড়সা তো জালই বোনে/ লড়াই চলে, লড়াই চলে ক্রেয়ন আর আন্তিগোনে... ট্রেনে-বাসে, চায়ের ঠেকে দিনরাত্তির এখন কেবল লড়াইয়েরই কথা। কিন্তু আসলে কি এ কোনও লড়াই? আন্তিগোনে কি আসলেই কোনও যুদ্ধে নামতে চেয়েছিল মহাপরাক্রমী ক্রেয়নের সঙ্গে? সে কেবল চেয়েছিল তার ভাইয়ের মৃতদেহ সৎকারের অধিকার। সে বলতে চেয়েছিল, নম্র কিন্তু সুদৃঢ় কণ্ঠে, সমাহিত হওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না কারও থেকে, সে রাজার পক্ষে বা বিপক্ষে যে দিকেই থাকুক না কেন।
মৃত্যুর পর হত্যাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেওয়ার ভিতরে কাজ করে রাজচক্রের যে দুর্লঙ্ঘ্য অলাতচক্র, সাধারণ মানুষ তাকে দূর থেকে ‘সিস্টেম’ বলে সেলাম ঠোকে। কিন্তু সেই সিস্টেমেরও রয়েছে সীমা, শিশুপালও রাজাই ছিল যত ক্ষণ না তার পাপের সংখ্যা একশো এক ছুঁয়েছিল। এই শিশুপালের সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে আমাদের পৃথিবীতে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যার ক্ষমতা যত কম, তত বেশি তার দেখনদারি। রাজা কবে নিজেই নিজের ধ্বজা ধ্বংস করতে পথে নামবেন, তা আমাদের জানা নেই। যেমন জানা নেই যে, সর্দার তথা সুবিধাভোগীদের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি নিজেও পারবেন কি না ‘সুশাসনের প্রতিশ্রুতি’কে বাস্তবায়িত করতে। ৯ অগস্ট সকাল থেকে আমরা কেবল জেনেছি যে, একটি তারা পিদিমই হাজার তারা জ্বালে, দাহ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে দ্রোহ।
পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভিডিয়ো, দেখা গেছে, লঙ্ঘিত হয়েছে আইনের ন্যূনতম নিরাপত্তা-কবচ। চিরকালের সমকালকে প্রাণ দেওয়া গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাসে, বহু বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে গিয়েছিল সেই দূর বিকেলের কথা, যে দিন তাঁর বাবা তাঁকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের নিহত ডাক্তার মানবীরও হয়তো মনে পড়ছিল, তাঁর কঠিন সংগ্রামী বাবা-মায়ের তাঁকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে যাওয়ার কথা।
মানুষকে সহজে নিঃশ্বাস নেওয়ানোর কাজে দিনাতিপাত করতেন যিনি, তাঁর কী মনে হচ্ছিল, পৈশাচিকতার পরতের পর পরত নিজের অস্তিত্বে খুলে যেতে দেখে, তা আমরা জানতে পারব না আর কোনও দিনই। কিন্তু যে দ্রুততায় তাঁর মরদেহ চুল্লির ভিতর ঠেলে দেওয়া হল আরও অনেক নিথর শবদেহকে অতিক্রম করে, সে ভাবে প্রথম হতে চায়নি আমাদের কন্যা। সে তো এমনিই গোল্ড-মেডালিস্ট হওয়ার মেধা ও ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল। তাঁর রিসার্চ পেপার, নতুনত্ব আর সম্ভাবনায় আরও অনেককে ছাপিয়ে গিয়েছিল বলেই না তা তারথেকে হাতিয়ে নিয়ে অন্যকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, সফোক্লিসের সময়ে কি উত্তরসত্য ছিল না, নাকি ছিল তখনও? খুনি খুঁজে বার করার রাস্তা আরও কঠিন করে তোলার জন্য তড়িঘড়ি দেহ পুড়িয়ে দেওয়া আর দেহ সৎকার করতেই না দেওয়া, দুই-ই কি একই দাঁড়িপাল্লার এ দিক আর ও দিক নয়?
তার পর, প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের উৎসমুখে দাঁড়ানো মেয়েটির মা এবং বাবার কণ্ঠস্বরে আমরা মহাকাব্যকে জীবন্ত হতে দেখতে পাই। গ্রিক নাটকে হেমন যেমন সম্রাট ক্রেয়নের পুত্র হয়েও দাঁড়িয়েছিল আন্তিগোনের পাশে, নিজের মৃত্যু দিয়ে প্রেমিকার পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিল, আড়াই হাজার বছর পার হয়ে যাওয়া বাস্তবে আমরা তেমন দেখতে পাইনি। তবে নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়ার মা যখন ক্যামেরার সামনে বলে ওঠেন, “টালা থানায় চলে গিয়ে বার বার বলেছি, আমাদের মেয়ের বডি প্রিজ়ার্ভ করতে চাই, পুলিশ আমাদের হেল্প করেনি, আমাদের উপর প্রেশার দিয়েছে; আমাদের কথা শোনেনি...” তখন তাঁর গলায় আন্তিগোনেকে আবিষ্কার করি আমরা। এক জন মৃতদেহকে সমাহিত করার, আর এক জন তা সংরক্ষণ করার কথা বলছেন। কিন্তু দুইয়ের মূলে একটিই প্রশ্ন। জীবনকে যা তছনছ করে দিয়ে গেছে, মৃত্যুকেও তা সম্মান দেবে না? মরদেহ বহনকারী গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করা প্রতিবাদীদের ধাক্কা দিয়ে, সরিয়ে, সব প্রতিরোধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে?
যারা তা করে, তারা জানে না যে, প্রতিরোধকে সাময়িক ভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়া গেলেই প্রতিবাদ চাপা পড়ে না। অপমানের অনুসারী হয়ে, লাঞ্ছনার অনুবর্তী হয়ে বাঁচবে বলে যাদের মনে করা হয়, শোক তাদের ভিতর থেকে শ্লোক বের করে আনে। অগণিত পঙ্ক্তি রংমশালের মতো ছড়িয়ে পড়ে দশ দিকে। ক্ষমতার প্রতিনিধিরা তাদের ভিতরকার বালির দিকে আঙুল তোলে যত বার, তত বারই তাদের ভিতরের আগুন, সামান্য দেশলাইকাঠিকেও নক্ষত্র করে তোলে।
হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, “আকাশ-সমান এই ক্ষত/ ঢাকবে তুমি জোর কত?”
কার নিন্দা করো তুমি।মাথা করো নত
জড়ভরতের কথা কি ভুলে গেছেন সবাই? সেই মহাজ্ঞানী, মহাপণ্ডিত যিনি পোকামাকড় অবধি মাড়িয়ে ফেলতে চাইতেন না বলে অতিরিক্ত হাঁটাচলা থেকেও বিরত থাকতেন? এক দিন আপনাতে আপনি মগন, জড়ভরতকে চোখে পড়ে যায় পরগনার রাজার, যিনি তখন পালকি চেপে চলেছিলেন কোনও কাজে বা অকাজে। পথে পালকির এক বেহারার পা মচকে যাওয়ায় অসুবিধায় পড়ে যান রাজা। তখনই চোখে পড়ে, দূরের গাছতলায় কে যেন বসে আছে একা। তৎক্ষণাৎ হুকুম যায় লোকটিকে সামনে এনে দাঁড় করানোর। পেয়াদারা মুহূর্তের মধ্যে জড়ভরতকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে, আর রাজাও অবিলম্বে তাঁকে জুড়ে দেন পালকি টানার কাজে। কোনও কথা না বলে নীরবে বেহারার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন জড়ভরত, কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই বোঝা যায় যে, তাঁর পা পড়ছে বেতালে। তেমনটাই হওয়ার কথা, কারণ জড়ভরত সর্বদা সতর্ক থাকতেন যাতে তাঁর পায়ের চাপে কোনও কীটপতঙ্গের পর্যন্ত প্রাণনাশ না হয়। এ বার, তাই করতে গিয়েই এলোমেলো পা পড়ছিল ওঁর। এক জন তাল ভাঙলেই তাল ভেঙে যায় সবার, আর সবচেয়ে বেশি অসুবিধে হতে থাকে পালকির ভিতরেথাকা সওয়ারির।
ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা তাই জড়ভরতকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিং স্কন্ধং বাধতি?” অর্থাৎ “কাঁধে ব্যথা করছে নাকি?”
উত্তরে জড়ভরত রাজার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলেন, “তথা ন বাধতে স্কন্ধং যথা ‘বাধতি’ বাধতে।” মানে, “কাঁধে তত ব্যথা করছে না, আপনার ভুল সংস্কৃতে যতখানি ব্যথা করছে।”
উত্তর শোনামাত্র রাজা পালকি থামিয়ে মাটিতে নেমে এসে হাঁটু গেড়ে বসেন জড়ভরতের সামনে। জানতে চান কে তিনি, কী তাঁর প্রকৃত পরিচয়।
সে রামও নেই, সে অযোধ্যা তো নেই-ই। অতএব এখন সংবেদনশীলতাকে শিকেয় তুলে নির্লজ্জ ক্ষমতালেহনই সাপ-লুডোর সিঁড়ি বেয়ে ওঠার প্রকৃষ্ট রাস্তা। কোনও নরাধম তা করতে গিয়ে নিহত চিকিৎসক-পড়ুয়ার ফোনে ঘাতকের ফোন আগে এসেছে কি না, তাই নিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন, কেউ আবার আত্মজিজ্ঞাসার ধার না ধেরে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা আমাদের ডাক্তারবাবু বাড়িতে দুর্গাপূজা করতেন কী ভাবে, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সামাজিক মাধ্যমে। এরা কি নিজেদের সাধারণ জ্ঞানও প্রাপ্তির সিন্দুকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন?
যখন কেউ বাড়িতে দুর্গাপূজা করেন, তখন পাড়ার আরও দশটা বাড়ি থেকে সহযোগিতার হাত এগিয়ে আসে। কেউ মায়ের অস্ত্র-বস্ত্র, কেউ বা অষ্টমীর ভোগের খিচুড়ির দায়িত্ব নেন। বিশেষ করে এক জন ডাক্তার যখন সেই পূজায় ব্রতী হন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দ্বারা উপকৃত অজস্র রোগী এগিয়ে আসেন পূজার খানিকটা ভার কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য। দৃষ্টি এবং অন্তর্দৃষ্টি, দুই-ই অন্ধ না হয়ে গেলে তা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
আর যারা, দশ জন খুন করে এক জন ধর্ষণ করেছে না উল্টোটা, তাই নিয়ে তরজা বসিয়ে নৃশংসতম অপরাধকে লঘু করার খেলায় মেতেছে, তাদেরই বিবেকই অন্ধ; তাই কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
জনতা কিন্তু কেবল কথা নয়, কাজেও এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়েছেন। ‘মধ্যবিত্তের আন্দোলন’ জাতীয় খেলো কথায় একে আর সীমায়িত করা যাবে না কিছুতেই। যাবে না কারণ, বাষ্প যখন আকাশে উঠতে শুরু করে, তখন তা কোনও অট্টালিকার ছাদে আটকে থাকে না। এই আন্দোলনও কোনও পরিণতির পরোয়া না করে, নিজের দশ হাত মেলে দিয়েছে দিগন্তের দিকে। তাতে হাত মিলছে, একে একে, সমাজের সবার।
দাবি: বিচার চেয়ে রাজপথে জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিল।
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
দুয়ার এঁটেই হয়তো ঘুমিয়ে ছিলাম আমরা, চার পাশের সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে কিংবা নিজেদের মতো করে তাকে ব্যবহার করতে চেয়ে। বছর পনেরো আগের একটি সিনেমার সংলাপ মনে আসে, পৃথিবীতে মানুষ আছে ভালবাসার জন্য আর মালপত্র ব্যবহারের জন্য। মুশকিল তখনই হয় যখন আমরা মালপত্রকে ভালবাসতে শুরু করি আর মানুষকে ব্যবহার করা আরম্ভ করে দিই।
তেমন ঘটেছিল বলেই বোধহয় আমাদের চোখের পর্দা বুজে গিয়েছিল অর্ধেক, আমরা টের পাইনি যে প্রাণসঞ্চারের ঠিকানাগুলোয় মৃত্যুদূতদের কারবার চালু হয়েছে। লাখো মানুষ যেখানে ধন্বন্তরির স্পর্শলাভ করতে গেছেন, সেখানে দেহের প্রত্যঙ্গ বিক্রির ঠেক পর্যন্ত দানা বেঁধেছে। আজ খবরের কাগজের অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন পড়ে আমরা চমকে উঠছি ঘৃণায়, থরথর কাঁপছি রাগে। কিন্তু অর্থহীন সেই রাগ আর লজ্জা যদি না জমাট বেঁধে থাকা অব্যবস্থার মেঘ ফুঁড়ে, মুক্তির অঝোর বৃষ্টি ঝরাতে পারে, তা হলে রেহাই নেই আমাদের।
আমরা আক্রান্ত বলে কাঁদছি, আর্তনাদের অধিকার আক্রান্তের জন্মগত বলে কাঁদছি। কিন্তু তার ভিতর থেকে যে আক্রোশ জন্ম নিচ্ছে, তাকে লুম্পেনের তাণ্ডবের চাবিকাঠি বলে যেন ভুল না করে কেউ। অনুতাপ থেকে যে তাপ ছড়িয়ে পড়ে, তার ছোঁয়ায় যাবতীয় পাপ পুড়ে যায়। কিন্তু প্রত্যেকটি পাপের গর্তে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা মুদ্রারাক্ষস যদি বমি করতে থাকে ধাতু, তবে পাপের কেন্দ্রে পৌঁছনোর রাস্তা দুর্গম হয়ে ওঠাই নিয়তি।
কর্মক্ষেত্রে চরম নৃশংসতার শিকার হওয়া মেয়েটি আমাদের সবাইকে কাঁদতে শেখায়নি কেবল, শিখিয়েছে নিয়তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
আমরা জানি সে শারীরিক ভাবে ফিরবে না আর, জানি যে বেনোজলের অনুপ্রবেশ থেকে দেওয়াল ভেঙে ফেলার কারসাজিতে খুনের প্রমাণ পাওয়া কঠিন। জানি যে বিচার সত্যের ভিত্তিতে নয়, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই হয়, তবু এই দুকূলপ্লাবী আবেগ এক এমন সুনামির জন্ম দিয়েছে, যা কোনও কেঠো বাস্তবতার পরোয়া করে না। এই পবিত্র আগুন নিজের ভিতরে সেই মৃগনাভির সুগন্ধকে ধারণ করেছে, যা মাইলের পর মাইল পেরিয়ে নিজের অস্তিত্ব চেনাতে সক্ষম। আশি বছরের বৃদ্ধা থেকে আট বছরের শিশুকে সে পথে নামিয়েছে। দিল্লির সরকারি বাসে একটি খুন-ধর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে তবিশ খয়ের যে লিখেছিলেন, “রেপ রিমেনস দ্য সেন্ট্রাল মেটাফর অব আওয়ার লাইভস”—চ্যালেঞ্জ করেছে সেই চলমান বীভৎসতাকেও।
ঘূর্ণির মাটির পুতুল বিখ্যাত আর এই প্রতিবাদ এমন ঘূর্ণির সামনে এনেছে আমাদের, যেখানে পুতুলরাও সব মানুষ হয়ে বিচার চাইছে।
দুঃস্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সকল নির্ঝরের। জেগে উঠেছে যত দূর চোখ যায় তত দূর। আর ঘুমোনোর অবকাশ নেই কারও।
নিদ নাহি আঁখিপাতে
আর জি কর বলতে বলতে আমরা ভুলে যাই, কলেজের নাম রাধাগোবিন্দ করের নামে। যেখানে গোবিন্দ জাগ্রত, সেখানে রাধা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন কী করে? রাধা আর গোবিন্দ তো দেব-দেবী, নারী-পুরুষের রূপক পেরিয়ে চিরকালীন যুগল। দিন আর রাত্রি যে রকম, জাগরণ আর ঘুম যেমন।
সেই কবে আমরা পড়েছিলাম যে, বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া রাজা ডানকানকে হত্যার কারণে ম্যাকবেথ আর ঘুমোতে পারবে না। সে রাজা হতে পারে সসাগরা পৃথিবীর, কিন্তু তার চোখ আর কখনও জড়িয়ে আসবে না ঘুমে, যে হেতু ‘ম্যাকবেথ ডাজ় মার্ডার স্লিপ’।
৮ অগস্ট রাতে এই শহরেও ঘুম খুন হয়ে গেছে। ছত্রিশ ঘণ্টা ডিউটির পর এক মানবীর প্রার্থিত ঘুমের ভিতরে ঢুকে পড়েছে ঘাতক, ধর্ষকরা। তারা এখনও অধরা, সেমিনার রুম সংলগ্ন ঘরের দেওয়াল ভেঙে ফেলায়, অপরাধী শনাক্তকরণ হয়তো বা বিশ বাঁও জলে, কিন্তু যা জ্ঞাত, তা হল তারা নিদ্রাকেও রেহাই দেয়নি।
সভ্যতার ইতিহাসে ঘুমের অধিকার বা সেই অধিকারের লড়াই খুব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমেরিকায় দাসপ্রথা যখন রমরমিয়ে চলত, তখনও অনেক বড় জোতদার কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের পেট ভরে খেতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত। কিন্তু প্রাণ ভরে ঘুমোতে দেব, এমন কথা রাজনীতি বা পুঁজির জায়গা থেকে উচ্চারিত হয়নি প্রায় কখনওই। দেশে দেশে, কালে কালে, ধনী ঘুমোবে বলে গরিবের জেগে থাকা নিয়ম, ঊর্ধ্বতন বিশ্রাম নেবে বলে অধস্তনের দু’চোখের পাতা এক না করাই রীতি।
প্রার্থনার মন্ত্রে দেবীর কাছে তাই কেবল শান্তি বা শক্তিই চাওয়া হয়নি। ‘যা দেবি সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা’-ও বলা হয়েছে আবহমানকাল, যুগের পর যুগ।
সেই নিদ্রাকে যখন হত্যা করা হল, জাগরণ কী ভাবে নিশ্চেষ্ট থাকতে পারে? ‘রাত দখল’-এর আয়োজন তাই কেবল রাত্রিকে ফিরে পাওয়ার লড়াই নয়, হাড়ভাঙা খাটুনির পর ঘুমের হককে প্রতিষ্ঠা করারও দাবি। সেই ঘুমের জন্য পালঙ্ক সবার থাকে না, দরকারও নেই। কিন্তু দূরপাল্লার বাসে, ট্রেনে, কর্মস্থলে, জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে রাধার এবং গোবিন্দের ঘুমের যে শান্তি লুঠ হয়ে গেছে ৮ অগস্ট, তা ফিরে না পাওয়া অবধি স্বস্তি নেই।
যা বলবে তাই মানব না
এত এত দুর্ঘটনা ঘটছে, ট্রেন দুর্ঘটনায় কত লোক মারা গেল, কয়েক মাসের ভিতরে, জনজাতির একটি মেয়ের গলা কেটে কেউ ফেলে গেল তারই বাড়ির সামনে, কেন একটি নিয়েই এত কথা? বার বার পিন ফোটানো চলছেই, সমবেত শোকের গায়ে।
প্রতিটি মৃত্যুই যন্ত্রণার, প্রতিটি হত্যা ক্ষমাহীন, কিন্তু মহাভারতেও, অনেকে মারা যাওয়ার পরও অভিমন্যুর হত্যা এত স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে কেন? কারণ এক বালককে চক্রব্যূহের ভিতরে আটক করে খুন করেছিল মহারথীরা সে দিন।
সে তবু যুদ্ধ ছিল। আজ, মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসা এক মেধাবী ডাক্তারকে অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল কেন? সে দুর্নীতির মৌচাকে ঢিল মারার উদ্যোগ নিয়েছিল, তাই? কী ভাবে পাস হয় হাসপাতালের টেন্ডার? এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে যাওয়া ওষুধ আবার কী ভাবে ফিরে আসে? কেমন ভাবে গুম হয়ে যায় লাশ?
‘টাকারি টাকামাপন্নে টাকান্তে সর্বদেবতা’ করে বেড়ানো শঠদের বাঁচানোর জন্য প্রশ্নের ছড়াছড়ি এখন।
জুনিয়র ডাক্তাররা ধর্মঘট করায় রোগীরা পরিষেবা পাচ্ছে না যাঁরা বলছেন, তাঁরা কেন জানাবেন না, বহু ডাক্তার সরকারি উচ্চপদে থেকেও কেন এ দিক-ও দিক নার্সিংহোম খুলে বসতেন বা দেদার রোজগার করতেন সেখান থেকে? সরকারি অধ্যাপক যেমন শুধু সরকারি কলেজেই পড়াতে পারেন, সরকারি ডাক্তারকে সরকারি হাসপাতালেই পরিষেবা দিতে হবে কেবল, এই নিয়ম করতে কে বারণ করেছে?
ঘুঘুর বাসা তৈরি করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ লুঠ করবে একটি শ্রেণি, আর অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা নিরাপত্তা চাইলেই তারা ভিলেন? শোকপালনের সময় যুবক-যুবতীরা কেন নেচেছে, তাই নিয়ে অনেকেরই ভীষণ আপত্তি। তাঁরা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের সেই গানের পঙ্ক্তি কখনও শোনেননি, “প্রলয়নাচন নাচলে যখন হে নটরাজ/ জটার বাঁধন পড়ল খুলে...” কখন নেচেছিলেন মহাদেব? নাচতে নাচতে নটরাজ হয়ে উঠেছিলেন কখন? সতীর চলে যাওয়ার বেদনায় যখন তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ, তখনই তো?
এবার মৃত্যুকে মারো
তার পরও সরকারি হাসপাতালে পরিষেবার অভাবে একটিও প্রাণ চলে গিয়ে থাকলে, তা ঘোর দুর্ভাগ্যের। কোন্নগরের যে মা সন্তান হারিয়ে চিকিৎসকের অপ্রতুলতাকে দায়ী করছিলেন, তাঁর যন্ত্রণাতেও কোনও খাদ নেই। শামসুল হক লিখেছিলেন, “মানুষে মানুষে নাই কোনও ভেদ দুঃখের ভিতর।” দুঃখের বীজতলাতেই জন্ম নেবে আউশ আর আমন। মাটির উপরের ফসলই তো মাটির তলার মরা খনিজের বিকল্প।
চিনের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এক বার অংশগ্রহণের সুযোগ এসেছিল, সন্তানহারা বাবা-মায়েদের বাৎসরিক মিলনোৎসবে। চিন সরকারের এক সন্তান নীতির ফলে সন্তান হারানো নিঃস্ব, রিক্ত সেই সব মা-বাবা তাঁদের সংগঠনের নাম দিয়েছেন, ‘স্টার হারবার’ বা ‘তারাবন্দর’। তাঁদের বিশ্বাস, প্রত্যেক সন্তানের মৃত্যুর পর একটি করে নতুন তারা জন্মায় আকাশে। তাই প্রত্যেকের হারিয়ে ফেলা সন্তান রয়েছে সেই তারাবন্দরের আকাশে।
ভাবতে ইচ্ছে করে, রাস্তায় বসে যে ডাক্তাররা তাঁদের দাবিকে মানুষের দাবিতে রূপান্তরিত করতে পারলেন, তাঁরাই পারবেন, পথবাসী মানুষটিরও বাঁচার অধিকার সুনিশ্চিত করতে। যে তারার আলোয় চোখ ভরে ওঠে, সেই তারা কখনও মরতে পারে নাকি?