ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
কয়েক বার রিং হওয়ার পর ফোন ধরে মল্লার, “হ্যালো।”
অভ্র অবাক হল, “সকাল আটটায় তুই উঠে পড়েছিস!”
মল্লার বলে, “ঘুম ভেঙেছে, কিন্তু বিছানা ছাড়িনি।”
“তোর কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন এই ক’দিন?”
মল্লার বলল, “ব্যস্ত ছিলাম।”
“কী নিয়ে ব্যস্ততা তোর?”
“প্রোগ্রাম ছিল।”
“ও! তা বইপত্র খুলেছিস?”
মল্লার বিরক্ত হল, “সকালে বোরিং কথা বলে মুড অফ করে দিস না। আগে এসএসসি-র নোটিস বেরোক, ফর্ম ফিলআপ করি, তার পর বইপত্র খুলব। এসএসসি প্রার্থীদের লাগাতার বিক্ষোভ সামাল দিতে একটা গাজর ঝুলিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষা নেওয়া হবে। ও রকম আশ্বাসে আমার আস্থা নেই। তা ছাড়া পণ্ডশ্রমে এই শর্মা রাজি নয়।”
“আচ্ছা। বুঝলাম।”
একটু থেমে মল্লার বলে, “একটা প্রশ্ন ছিল।”
“বল।”
“পরকীয়া ব্যাপারে তোর কী মতামত?”
অভ্র বলল, “তুই এই সাতসকালে পরকীয়া নিয়ে পড়লি যে!”
“জানিসই তো আমার মাথার পোকা মাঝেসাঝে নড়ে। তোর ভিউটা শুনি।”
অভ্র বলল, “পরকীয়া ভাল না খারাপ, তা জানি না। তবে এর শেষটা ভাল হয় না।”
“কেন?”
“অধিকাংশ কেস শেষ হয় ঘৃণা এবং কান্নায়। প্রায়ই অবৈধ সম্পর্ক থেকে ক্রাইম জন্ম নেয়। কখনও ব্ল্যাকমেলিং শুরু হয়, কখনও খুনখারাপির দিকে যায়। আজকাল কাগজে তো প্রায়ই পড়ি। প্রেমিক এবং বৌ মিলে পথের কাঁটা হাজ়ব্যান্ডকে খুন করছে। বর প্রেমিকার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বৌকে খুন করছে। চার দিকে এত ক্রাইমের অন্যতম কারণ পরকীয়া প্রেম।”
“দূর শালা! কোনও কিছুতেই কি পজ়িটিভ কিছু ভাবতে পারিস না? রাজ্যের আজেবাজে উদাহরণ শোনাচ্ছিস। খুন, ষড়যন্ত্র, ক্রাইম। টিভিতে ক্রাইম পেট্রল দেখাটা ছাড় তো! তোর মাথায় ভাল কিছু আসে না? ডার্টি মাইন্ড।”
“কী আশ্চর্য! আমি আমার ভিউটা বললাম। ওটাই ফ্যাক্ট। সেটা শুনে তোর রাগ হচ্ছে কেন? নিষিদ্ধ প্রেমে আনন্দ আছে, আবার বিপদও আছে। আমি যতটুকু বুঝি। কিন্তু তোর ব্যাপার কী? তুই কি গবেষণা করবি ওটা নিয়ে?”
মল্লার বলল, “না, জাস্ট মনে হল। তোকে একটা সিচুয়েশন বলছি। ধরা যাক কেউ ভালবেসে হাত বাড়াল, অন্য জন সেই বাড়ানো হাত ধরবে না?”
অভ্র বলে, “তাকে ভাল লাগলে তো হাত ধরাটাই স্বাভাবিক।”
মল্লারের গলায় খুশি, “দ্যাট’স মাই পয়েন্ট। এটাই বলতে চাইছিলাম। কেউ ভালবেসে এগিয়ে এলে তাকে মর্যাদা দিতে হয়, সম্মান দিতে হয়। ফিরিয়ে দিয়ে দুঃখ দিতে নেই। তাই না?”
“হুম। তবে এখন কেউ এগিয়ে এলেও হাত ধরতে পারব না। আমার মতো বেকার ছেলেদের এই বয়সে ও সব বিলাসিতা সাজে না। তবে একটা কথা বুঝলাম না।”
“কোন কথা?”
“কেউ এগিয়ে আসার সঙ্গে পরকীয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?”
মল্লার বিব্রত হল, “না। দুটোর মধ্যে কোনও সম্পর্কই নেই। এমনিই বলছিলাম।”
“রাত দশটা-এগারোটার দিকে তোকে ফোনে পাওয়া যায় না আজকাল। কী করিস তখন?”
মল্লার উত্তর দিল, “নেট অন করে জিকে-রচর্চা করি।”
“এই যে বললি তুই পড়াশোনার মধ্যে নেই!”
“বলেছিলাম বুঝি? না, সাবজেক্ট পড়ি না। তবে জিকে-র চর্চাটা করি। কাজে লাগতে পারে। তোর সব কিছুতেই এমন জেরা কেন?”
অভ্র অবাক হয়ে বলল, “জেরা কখন করলাম? তুই আজকাল ফোন ধরিস না, তাই জানতে চাইছিলাম। বলছিলাম যে আজ রূপা হলে ম্যাটিনি শো দেখতে যাবি?”
ও-প্রান্তে স্তব্ধতা।
অভ্র প্রশ্ন করল, “কী রে? চুপ করে গেলি যে!”
“একটু ভাবতে দিবি তো!” কিছু ক্ষণ চুপ থেকে মল্লার বলল, “ভেবে দেখলাম যে, হলে গিয়ে লাভ নেই। পুরনো বাজে হল, ওই হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মানে হয় না। এই পচা গরমে ঘেমেনেয়ে সিনেমা দেখা পোষাবে না। তা তোর হঠাৎ সিনেমা দেখার বাই উঠল কেন?”
“শুনেছি সিনেমাটা ভাল হয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’-র মেকিং ডিটেলসে দেখানো হয়েছে।”
মল্লার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “ও তো সবই জানা। দেখার কী আছে?”
“যাবি না তা হলে?”
“না। তুই দেখে নে।”
অভ্র বলল, “তা হলে থাক। একা হলে গিয়ে দেখতে এখন আর ইচ্ছে করছে না।”
“তা হলে তুই যাবি না?” মল্লার জানতে চাইল।
“না। বললাম তো, একা যেতে ইচ্ছে করবে না।”
“শিয়োর?”
অভ্র আশ্চর্য হল, “কী ব্যাপার? তুই শিয়োর হতে চাইছিস কেন?”
“না। এমনিই। রাখছি।”
বিকেল পাঁচটার সময়ে রূপা হলের সামনে পৌঁছল অভ্র। হলে সিনেমা দেখা হয় না বহু দিন, আজ কিছুই ভাল লাগছিল না, তাই একাই সে চলে এসেছে। কাউন্টারে হাত বাড়িয়ে টিকিট কিনল অভ্র। ম্যাটিনি শো ভেঙেছে এইমাত্র। মোটামুটি দর্শক হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। তখনই অভ্রর চোখ স্থির হয়ে গেল। সে দ্রুত একটা থামের আড়ালে চলে গেল।
মল্লার সিঁড়ি দিয়ে নামছে। মল্লারের পাশে ওটা কে? প্রমিতদার বৌ মনে হচ্ছে! দু’জনে হাত ধরাধরি করে নেমে আসছে। আর উঁকি দিতে পারল না অভ্র। সে মল্লারের চোখে পড়ে যাক তা চায় না। সে মাথা নিচু করে ইউরিনালের দিকে হাঁটা লাগাল। ভঙ্গিটা এমন, যেন সে চার পাশ সম্পর্কে উদাসীন এক জন, কিছুই দেখছে না।
একটা সিগারেট ধরাল অভ্র।
সে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে মল্লার কেন নিশ্চিত হতে চেয়েছিল, বোঝা যাচ্ছে এখন। অনায়াসে কত মিথ্যে বলেছিল মল্লার। বাজে হল, বিশ্রী গরম ইত্যাদি। ভাগ্যিস সে ম্যাটিনি শো-এর বদলে ইভনিং শো-এ এসেছে! না হলে ভীষণ একটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতি তৈরি হত।
তাদের দীর্ঘ আঠারো বছরের বন্ধুত্বেও গোপনীয়তা চলে এসেছে। প্রেমের মোহ মানুষকে বোধহয় রাতারাতি বদলে দেয়। অকপট মল্লারও ছলচাতুরি শিখে গেল!
প্রমিতদার বৌয়ের সঙ্গে মল্লারের সম্পর্কটা কত দূর গড়িয়েছে?
প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন নারীপুরুষকে এক সঙ্গে বা পাশাপাশি দেখলেই অন্য রকম ভেবে নেওয়ার মানসিকতা তার নেই। তবে এই দু’জনের মধ্যে যে সম্পর্ক হয়েছে, তা সে হলফ করে বলতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা আছে বলেই সে বুঝতে ভুল করে না। তার মানে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ব্যাপারটা আটকে নেই। কতখানি বেপরোয়া হলে দু’জনেই এক সঙ্গে সিনেমাহলে যায়? যে কোনও মুহূর্তে পরিচিত লোকের চোখে ওরা পড়তে পারত, তেমন কেউ যে দেখে ফেলেনি তার গ্যারান্টি দেওয়াও যায় না। তার রেফারেন্সেই মল্লার সিন্থেসাইজ়ার শেখাতে প্রমিতদার বাড়িতে পা রাখে। প্রমিতদা জেনে ফেললে পরিণাম খুব খারাপ হবে। তার দিকেও আঙুলটা উঠবে— ‘তুমিই তো মল্লার ঘোষের নাম বলেছিলে অভ্র!’
নিজের চালচুলোর ঠিক নেই, এই বয়সে পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগে মল্লার এক বার ভাবলও না! নিজের জীবনে অনর্থক জটিলতা ডেকে নিয়ে আসে কেউ এ ভাবে? এই প্রেম নিয়ে মল্লার কাউকে কিছু বলতে পারবে না, সারা ক্ষণ গোপন রাখার চেষ্টা করবে। অভ্রও ঠিক করল, এ নিয়ে সে মল্লারকে একটি কথাও বলবে না। সে কিছুই দেখেনি, কিছুই জানে না।
মনটা তিতকুটে হয়ে আছে তখন থেকেই। আজ সন্ধেয় তার কোনও টিউশন ছিল না বলেই সে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। রাত সাড়ে আটটা বেজেছে সবে। ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না, ঘরে ফিরে বই পড়ায় মন বসবে না।
তার মনে পড়ল, সান্যাল স্যরের বাড়ি এই পাড়াতেই। রূপা সিনেমার পাশের গলি দিয়ে ঢুকতে হয়। কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই আসত, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় মাঝেমধ্যে এসেছে। স্যরের কাছে নেট পরীক্ষার জন্য পড়াও শুরু করেছিল সে। তার পর বাবার আকস্মিক মৃত্যু সবকিছু ওলটপালট করে দিল। আজ এক বার স্যরের সঙ্গে দেখা করা যেতেই পারে।
ফোন করে সে কোনও সাড়াশব্দ পেল না। ছ’বছর অনেকটা সময়, স্যরের মোবাইল নম্বর বদলে যেতেও পারে। তার চেয়ে সোজা বাড়িতে চলে যাওয়াই ভাল।
সান্যাল স্যর তাকে দেখে খুশি হলেন, “অভ্র যে! কত দিন পরে এলে!”
প্রণাম করে অভ্র সোফায় বসল।
“আপনি ভাল আছেন?”
“চলে যাচ্ছে। বুড়ো বয়সে অনলাইন ক্লাসের হ্যাপা পোয়াতে হচ্ছে। আমি তো ও-সবে কখনও সড়গড় ছিলাম না। এখন আবার অনলাইন পরীক্ষার জন্য আন্দোলন চলছে। জানতে-শিখতে কেউ চায় না, সবাই টুকে মার্কস পাওয়ার সহজ রাস্তা চাইছে। আর একটা বছর আছে, চালিয়ে নেব যা হোক করে। তুমি কিছু করছ আজকাল?”
অভ্র আমতা আমতা করে বলল, “তেমন কিছুই করছি না। ওই কয়েকটা টিউশন করে চলে যাচ্ছে।”
“অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই। চোখের সামনে একটা শিক্ষিত প্রজন্ম কাজ না পেয়ে বসে গেল। কারও কোনও হেলদোল নেই। ধর্ম এই পোড়া দেশে ইস্যু হয়, ভোটে বেকারত্ব ইস্যুই নয়। আমার-তোমার প্রতিবাদে কিছুই হবে না। টিউশন করে কত পাচ্ছ?”
অভ্র বলল, “মাসে দশ হাজার।”
“অনার্সের কিছু মনে আছে?”
“না।”
“এক মাস সময় নাও। পড়াশোনা করো।”
অভ্র চুপ করে রইল। স্যর এতক্ষণ বাস্তব-ঘেঁষা কথাবার্তা বলে পড়াশোনা করার জ্ঞান দিচ্ছেন। সেপ্টেম্বর মাস পড়ে গেল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের বিজ্ঞপ্তি বেরোল না, বিষয়ের চর্চা করে তার কোনও লাভ আছে?
“তুমি কি জানো যে, প্যারামেডিক্যাল কলেজের গভর্নিং বডিতে আমি আছি?”
“জানতাম না, স্যর।”
“দু’হাজার উনিশ সাল থেকে অন্যান্য সাবজেক্টের পাশাপাশি নিউট্রিশন অনার্স পড়ানো হচ্ছে ওখানে। নিউট্রিশনে ফিজ়িয়োলজির একটা পেপার আছে। এক জন পড়াত, সে ছেড়ে দিয়েছে। তুমি করবে?”
অভ্র এ রকম প্রস্তাবে আগে মুহূর্তেই উদ্বেলিত হত। এখন সে সতর্ক, সহজে নিশ্চিত হতে পারে না। সে বলেই ফেলল, “কত দেবে?”
“বেসরকারি কলেজ। বেশি পাওয়ার আশা না করাই ভাল। মাসে আট হাজার পাবে।”
“ক’টা ক্লাস নিতে হবে সপ্তাহে?”
সান্যাল হাসলেন, “তুমি দেখছি আগেভাগে সমস্তটা বুঝে নিতে চাও। ভাল, প্র্যাগম্যাটিক হওয়া ভাল। সপ্তাহে আটটা ক্লাস নিতে হবে। সিমেস্টারের খাতা দেখা, প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা সবই করতে হবে। জুলাই থেকে সেশন শুরু হবে। ভেবে দেখো।”
“ভেবে দেখার জন্য ক’দিন টাইম পাব?”
“বড়জোর এক সপ্তাহ। তুমি প্রায়োরিটি পাবে। এর জন্যও অনেকে মুখিয়ে থাকবে। ডোন্ট ওয়েস্ট ইয়োর টাইম ইন থিঙ্কিং। এটা বরং একটা কো-ইনসিডেন্স। তুমি ঠিক সময়ে এলে, তাই প্রস্তাবটা দিতে পারলাম। অভিজ্ঞতা সব সময়েই কাজে লাগে,” সান্যাল বললেন, “তা ছাড়া কাজের মধ্যে, চর্চার মধ্যে থাকলে সময় ভাল কাটে।”
অভ্র বলল, “ঠিক আছে স্যর, আমি রাজি।”
“তোমার মোবাইল নম্বরটা বলো। সেভ করে রাখি। আমার পুরনো নম্বরটা নেই। নতুনটা সেভ করে নাও। সময় হলেই আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব।”
বেরিয়ে এসে অভ্র ভাবল, রাজি হওয়াটা কি ঠিক হল? মাসে বত্রিশটা ক্লাস নিতে হবে, মাত্র আট হাজার পাবে। এ-ও এক রকম এক্সপ্লয়টেশন। বেসরকারি প্যারামেডিক্যাল কলেজ, লাভ-ক্ষতির হিসেব রেখেই চলছে। এক সময় তার স্বপ্ন ছিল যে, কলেজে পড়াবে। তার পর অবস্থা এমন দাঁড়াল, মনে হল, কলেজ দূর অস্ত, স্কুলের চাকরি পেলেই সে হাতে চাঁদ পাবে। প্যারামেডিক্যাল কলেজটায় জয়েন করলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাবে। ওই টাকায় অনেক সুরাহা হবে, মাসে অন্তত দু’দিন গলদা চিংড়ি কিনতে পারবে।
ক্রমশ