ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২১
Novel

Novel Series: মায়াডোর

Advertisement

অভিনন্দন সরকার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০৬:১৫
Share:

ছবি: বৈশালী সরকার

পূর্বানুবৃত্তি: নীরবে বন্ধুত্ব রেখে চলার নিষ্প্রাণ প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্তীয় বেরিয়ে যায়। নিজের ভিতরে মহীরুহ পতনের শব্দ শুনতে পায় মঞ্জীরা। বাড়ি ফেরে ভাঙা মন নিয়ে। রাত্তিরের খাওয়া নিয়ে সামান্য বায়না করতেই মায়ের কাছে জোর ধমক খায় ডাম্বো। অবাক ডাম্বোকে সামলায় মিহিকা। ডাম্বোকে খাইয়ে তাকে নিয়ে মঞ্জীরার কাছে যায় সে। পরে এক দিন পার্টি অফিসে তার কাজে ব্যস্ত ছিল আকাশদীপ। বেয়ারা এসে জানাল, তার সঙ্গে দেখা করতে দুজন ভিজ়িটর অপেক্ষা করছেন।

Advertisement

একটা গোপন আশঙ্কাও হচ্ছে আকাশদীপের। এর আগে একাধিক জনসভায়, টিভি, রেডিয়ো, নিউজ় চ্যানেলে সি এম-এর কাজের তীব্র সমালোচনা করেছে আকাশদীপ, কখনও কখনও তা ব্যক্তি-আক্রমণের স্তরেও নেমে এসেছিল। সি এম-এর মতো ক্ষুরধার মানুষ সে সব ভুলে গিয়েছেন, এ হতেই পারে না। তবে, রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধুত্ব আর স্থায়ী শত্রুতা বলে কিছুই হয় না, এই যা ভরসা। তবু আগামী কাল সি এম-এর সঙ্গে মিটিংটা বেশ অস্বস্তি নিয়েই শুরু করবে আকাশদীপ।

Advertisement

ডাম্বো মাথা নাড়ল, “না, বাড়ি গিয়ে খাব। টিফিন খেয়েছি। আমার খিদে নেই।”

আকাশদীপ জোর করল না, বেয়ারাকে দিয়ে ঠান্ডা পানীয় আনিয়েছে দু’জনের জন্য।

আকাশদীপ মিহিকার দিকে তাকাল, “মিহিকা, তোমার দিদির মুখে কাফের কথা শুনলাম। আই অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট। কিন্তু এ ব্যবসা দাঁড় করাতে প্রচুর খাটনি। তুমি বিউটি পার্লার, স্পা এই লাইনে ভাবতে পারতে। এ ছাড়া আমাকে বললে পেট্রোল পাম্পের লাইসেন্স অথবা ফরেন লিকার শপ যা চাইতে করে দিতাম। দু’বছরে পয়সা রাখার জায়গা পেতে না।”

“ভাল লাগার জায়গাও তো একটা থাকে, তাই না আকাশদীপদা?” নতমুখে বলল মিহিকা।

“ও ইয়েস, অ্যাবসোলিউটলি! সেটা তো সবার আগে। যাই হোক তুমি তোমার কাফের একটা কার্ড দিয়ে যেয়ো। আমার ইনফ্লুয়েন্সটা তো খুব কম নয়, ছোটখাটো প্রচুর গ্যাদারিং-এর রেফারেন্স পেয়ে যাবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মিহিকা, আমি যত দিন আছি তোমায় কাফে চালাতে চিন্তা করতে হবে না।”

ডাম্বো মিমির দিকে তাকাল, মাথা নিচু করে ঠান্ডা পানীয় খাচ্ছে মিমি। বাবার কথায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ সেই রাতে এই মিমিরই কী আশ্চর্য রূপ দেখেছিল সে।

সে দিন রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ডাম্বো আর মিহিকা ঢুকেছিল মঞ্জীরার ঘরে। দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল মঞ্জীরা। শোওয়ার ভঙ্গিতে পরিষ্কার যে, সে এখনও ঘুমিয়ে পড়েনি। অথচ মিমি বেশ কয়েক বার ডাকলেও সাড়া দিচ্ছিল না মা। ডাম্বো এর পর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মায়ের ওপর, মা কে উঠতেই হবে, এ ভাবে না খেয়ে মা ঘুমিয়ে পড়তে পারে না।

মঞ্জীরা বিরক্ত হয়েছিল, “কী হচ্ছেটা কী? গায়ের ওপর থেকে সরে যাও ডাম্বো। ভাল লাগছে না।”

ডাম্বো সরেনি, সে মায়ের রাগ ভাঙানোর উপায়টা জানে। রাগ যত ক্ষণ না পড়বে, তত ক্ষণ সে জড়িয়ে ধরে থাকবে মাকে।

একটু পরে উঠে বসেছিল মা। শুধু উঠে বসাই নয়, মিমির আনা খাবারও টুকটাক মুখে তুলতে শুরু করেছিল। তখনই মিমি বলে উঠেছিল, “এ ভাবে কষ্ট পাওয়ার কোনও মানে আছে দিদিয়া?”

মা উত্তর দেয়নি, নীরবে খাবার মুখে তুলছিল।

মিমি এ বার যেন অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তোর মনে আছে দিদিয়া, বাবার নিজের মেয়েদের ওপর তেমন ভরসা ছিল না! আমার তো মনে হয় সারা জীবন একটা ছেলে-সন্তানের অভাববোধ বুকে নিয়ে বেড়াত বাবা। অথচ মা কত অন্য রকম ছিল তাই না? সব সময় চেয়েছে আমরা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াই, নিজেদের ভালমন্দের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারি। বাবার দাপটের কাছে তবু মা এঁটে উঠতে পারত না। না হলে কুড়ি বছর বয়সে তোর বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই কি আটকাতে পেরেছিল মা?”

এ বার চোখ তুলে মিমির দিকে তাকিয়েছিল মা, মিমি হাত রেখেছিল মায়ের কাঁধে, “তবু কী হল বল তো দিদিয়া? তুই ভাল চাকরি পেলি, আমার কাফেটাও ক’দিনে দাঁড়িয়ে যাবে কিন্তু কিছু কি পাল্টাল রে? আমাদের ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকলেই কি আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম? একটা পচা-গলা সিস্টেম, যেটা আমাদের এত হাজার বছর পায়ের তলায় পিষেছে, সেই নিয়মের বাইরে কি বেরোতে পারলাম দিদিয়া?”

একটু দম নিয়ে মিমি বলেছিল, “কেন আজও তোর মতো একটা মেয়ের আকাশদীপ গাঙ্গুলিকে প্রয়োজন হয় বলতে পারিস! আকাশদীপ বাদই দে। এই জীয়ন, উত্তীয়দা এরা আমাদের কে হয়? কেন প্রতি পদে আমাদের মনে হবে যে, এরা থাকলে ভাল হত? বাবাকেই কি আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে জিতিয়ে দিচ্ছি না দিদিয়া? বার বার কি প্রমাণ করে দিচ্ছি না সত্যিই এক জন পুরুষের আমাদের কত প্রয়োজন? কিন্তু সত্যিই কি তাই? ওদের ছাড়া কি আমরা চলতে পারি না? কেন নিজেকে এ ভাবে কষ্ট দিবি তুই ওদের জন্য? আর বৃথা পুরুষের সমান হওয়ার চেষ্টাই বা কেন করতে যাব দিদিয়া? আমরা মেয়ে, দিদিয়া। মেয়েমানুষ নই। পুরুষমানুষও নই। জাস্ট একটা মানুষ। তাই না? আমি আবার বলছি দিদিয়া, নিজেকে কষ্ট দিস না।”

ডাম্বো দেখেছিল, মিমি উঠে গিয়ে মায়ের আলমারি খুলল আর সেখান থেকে একটা ব্রাউন পেপারের বড় এনভেলপ এনে রাখল বিছানার উপর। তার পর মায়ের চোখে চোখ রেখে শান্ত ভাবে বলেছিল, “কাউকে ভালবাসলে শুধু ভালবাসার কারণে বাসব আমরা দিদিয়া, আশ্রয় বা অবলম্বনের কথা ভেবে তো একেবারেই নয়। তোর কি মনে হয়, এই ডাম্বোটার উপরেও জাস্টিস করছিস তুই?”

ডাম্বোর হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েছিল মিমি, তার পর ওকে বলেছিল, “আজও আমার সঙ্গে ঘুমোবি। মায়ের একটু একা থাকা দরকার। চল ডাম্বো।”

ঘর থেকে বেরোনোর আগে ডাম্বো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল মা চুপ করে বসে আছে। অন্যমনস্ক মানুষের মতো দৃষ্টি। পরম মায়া আর বিষণ্ণতা মায়ের সুন্দর মুখটা ঘিরে ছিল। সেই মুহূর্তেই যেন হঠাৎ করে অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিল ডাম্বো। বুকের ভিতরটা ওই মায়াবতী নারীর জন্য হু হু করে উঠেছিল তার।

আহা রে! ডাম্বোর মা। ডাম্বোর দুঃখিনী মা।

“সো, ডাম্বো দ্য চ্যাম্প! কী খবর? মিসিং ড্যাড?”

আকাশদীপের স্বরে ঘোর কাটল ডাম্বোর।

ডাম্বো নিজের স্কুলব্যাগ কোলে বসে ছিল। সে কোল্ডড্রিংক্স-এর বোতলে ডোবানো স্ট্রয়ে বড় টান দিয়ে নিল, তার পর সামনে ঝুঁকে এসে নিচু গলায় বলল, “আমার কিছু খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে, তোমার কি শোনার সময় হবে এখন?”

আকাশদীপ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তার পর ফাইলের স্তূপ সরিয়ে রেখেছে এক পাশে, হাসিমুখে বলল, “বলো কী বলবে? কিন্তু বেশি সময় নিয়ো না, আমি একটু বিজ়ি আজ।”

ডাম্বো কিছু বলার আগেই মুখ খুলেছে মিহিকা, সামান্য উৎকণ্ঠা নিয়েই জানতে চাইল, “আগে বলো তোমার শরীর কেমন আছে আকাশদীপদা?”

“কেমন দেখছ? এক মাসের মধ্যে এ রকম ইমপ্রুভমেন্ট... ডাক্তার তো নিজেই অবাক।”

“খুব ভাল কথা, প্রেশার কন্ট্রোলে আছে তো?”

“রেগুলার মনিটরিং হচ্ছে মিহিকা। আজ সকালেই দেখেছি। একদম নর্মাল।”

“ব্রেকফাস্টের পর প্রেশারের যে ওষুধটা খাও, সেটা খেয়েছ?”

“ওরে বাবা, তুমি তো দেখছি অনেক খবর রাখো। তোমার দিদি বলেছে বুঝি? হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, খেয়েছি। ফিলিং ওয়ান্ডারফুল।”

মিহিকা স্বগতোক্তির ঢঙে বলল, “তা হলে ঝামেলা নেই। নে ডাম্বো, শুরু কর।”

ডাম্বো যেন মিমির ইশারার অপেক্ষাতেই ছিল, সে গলা ঝেড়ে উদাত্ত কণ্ঠে শুরু করল,

“অন্ধ মোহবন্ধ তব দাও মুক্ত করি।

রেখো না বসায়ে দ্বারে জাগ্রত প্রহরী,

হে জননী, আপনার স্নেহকারাগারে

সন্তানেরে চিরজন্ম বন্দী রাখিবারে।...”

আকাশদীপের চোখ ছানাবড়া। সে ভাবতেও পারছে না পার্টি অফিসের চেম্বারে তার বারো বছরের ছেলে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে দিয়েছে।

ডাম্বো অবশ্য অবিচল। সে গড়গড়িয়ে কবিতা বলছে, তার চোখ বুদ্ধমূর্তির মতো অর্ধোন্মীলিত,

“...দীর্ঘ গর্ভবাস হতে জন্ম দিলে যার

স্নেহগর্ভে গ্রাসিয়া কি রাখিবে আবার?

চলিবে সে এ সংসারে তব পিছু পিছু?

সে কি শুধু অংশ তব, আর নহে কিছু?

নিজের সে, বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার—

সন্তান নহে গো মাতঃ, সম্পত্তি তোমার॥”

কবিতা বলা শেষ হলে ডাম্বো বড় শ্বাস ছেড়ে চুপ করে গেল। আবার স্ট্রতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঠান্ডা পানীয় খেল কিছুটা। আকাশদীপ অবিশ্বাসের চোখে তাকাল মিহিকার দিকে, মিহিকা তাকিয়ে আছে দেওয়ালে টাঙানো এক জন দেশনায়কের ছবির দিকে। দেশনায়কদের মুখ সচরাচর থমথমে প্রকৃতির হয়, এই দেশনায়কের মুখ হাসি-হাসি। ছবি থেকে অপলক তাকিয়ে আছেন মিহিকার দিকে, মিহিকারও চোখের পলক পড়ছে না।

আকাশদীপ বাধ্য হয়ে দৃষ্টি ফেরাল ছেলের দিকে, “শুনে ভাল লাগছে, তুমি ‘সঞ্চয়িতা’ পড়ে ফেলেছ। তোমার সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ কি বাংলা? এ বার ক্লাস সিক্স হল, তাই না?”

“বাবা, তার চেয়েও বড় কথা হল এই কবিতাটার অর্থ। এই কবিতায় রবি ঠাকুর বলছেন, ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের প্রপার্টি নয়। খুব সত্যি কথা। তা হলে তো বাবা-মাও ছেলেমেয়েদের প্রপার্টি নয়, তাই না বাবা?” ডাম্বো থেমে থেমে বলল, “ছেলেমেয়েদের মানুষ করা ছাড়াও তো তাদের নিজেদের লাইফ আছে। তুমি আমায় ফেলে যখন চলে গেছিলে, সেটা তোমার নিজের চয়েস। আর আজ মা যদি আমার মুখ চেয়ে তোমার বাড়িতে ফিরে যায়, তবে তো মায়ের লাইফটাই আর রইল না, বাবা। মা তো আমার প্রপার্টি নয়, তাই না?”

আকাশদীপের মুখে কথা সরছে না, সে নির্বাক তাকিয়ে আছে ডাম্বোর দিকে। ডাম্বো বলল, “তুমি আমার বাবা হয়েই থাকো। মাকে ছেড়ে দাও বাবা, মা সত্যিই ফিরতে চায় না।”

আকাশদীপ অসহায় চোখে তাকাল মিহিকার দিকে, “এ সব কী বলছে ও? কী বলছে মিহিকা?”

ডাম্বো নির্বিকার ভাবে স্ট্রয়ে টান দিচ্ছে, বোতল ফাঁকা। ফরর ফরর আওয়াজ হচ্ছে।

মিহিকা কাঁধ ঝাঁকাল, “এ কী! তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন আকাশদীপদা? আমি কী বলব? আমি একটু আউটস্পোকেন বলে তোমরা সব কিছুর জন্য আমায় দায়ী করো। দিস ইজ় নট ডান।”

ডাম্বো এরই মধ্যে স্কুলব্যাগ থেকে একটা কাগজের প্যাকেট রেখে দিয়েছে আকাশদীপের টেবিলে। উঠে দাঁড়িয়েছে মিহিকাও, “চলি আকাশদীপদা, ভাল থেকো। চল ডাম্বো।”

ডাম্বো আর মিহিকা চলে গেছে মিনিট পাঁচেক হল। দু’হাতে মাথার রগ চেপে বসে আছে আকাশদীপ। তার মুখেচোখে হতাশা আর ক্লান্তি মাখামাখি। আকাশদীপের সামনে ডাম্বোর দেওয়া ব্রাউন পেপারের সেই এনভেলপটা রাখা আছে। সেই প্যাকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে তারই পাঠানো ডিভোর্স পিটিশনের কাগজটা। ডিফেন্ডেন্ট পার্টির সইয়ের জায়গাগুলো আর খালি নেই, খুব সম্প্রতি সেখানে সই করা হয়েছে। উজ্জ্বল নীল কালি, স্পষ্ট বলিষ্ঠ হাতের স্বাক্ষর: মঞ্জীরা গাঙ্গুলি।

১৪

কিছু ক্ষণ হল সকাল হয়েছে। নরম একটা আলো খুব সাবধানে মঞ্জীরাদের আবাসনের পাঁচিল টপকাল। আর তার পর এক পা এক পা করে ছড়িয়ে পড়ল গোটা কম্পাউন্ড জুড়ে।

ঘুম ভাঙলেও মঞ্জীরা শুয়ে আছে বিছানায়। আজ তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। ডাম্বোর স্কুলও বড় ক্লাসের পরীক্ষার জন্য ছুটি। সকালে ওঠার তাড়া নেই, জিম জগিং...আজ কিছু ভাল লাগছে না তার। এ রকম হয় বর্ষাকালে। গা ম্যাজম্যাজ করে, বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। অথচ আজ এমন উজ্জ্বল দিনেও মঞ্জীরা বিছানা ছাড়তে পারছে না।

মঞ্জীরা জানলার পর্দা টেনে সরিয়ে দিল। রোদ-পাখিদের ঝাঁক যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল, মুহূর্তে হুটোপাটি শুরু করেছে মঞ্জীরার ঘর আসবাব বিছানা জুড়ে। কিছু দুঃসাহসী রোদের কণা ছুঁয়ে দিল মঞ্জীরার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে আসা চুল অথবা তার ঘুম জড়ানো চোখের পাতা।

দিনের শুরুতেই মঞ্জীরার শরীর মনে এক আশ্চর্য আলস্য। এই আলস্যের কারণ মঞ্জীরার নিজেরও জানা নেই। আকাশদীপের সঙ্গে পাকাপাকি বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ার পরের স্বস্তি নাকি উত্তীয়র থেকে দূরে থাকা, নতুন করে শুরু হওয়া বিরহের দিনরাত্রি... কোনটা তাকে বেশি প্রভাবিত করল বুঝে উঠতে পারছে না সে।

নিশিজাগরণ চলছে নিরন্তর। ভোরের একটু আগে চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে, বেলা পর্যন্ত সেই নিবিড় আলস্য বিছানা ছাড়তে দিচ্ছে না মঞ্জীরাকে। পাশ ফিরে শুল মঞ্জীরা। ফেব্রুয়ারি শেষ হতে চলল, শীত সহজে এ বার জায়গা ছাড়তে চাইছে না বসন্তকে। হয়তো সেই কারণেই শহরের হাওয়ায় এখনও হিম ভাব বজায় আছে। সকালের দিকে ফুল স্পিডে ফ্যান চললে মঞ্জীরা গায়ে একটা পাতলা চাদর টেনে নিচ্ছে আজকাল।

মাসখানেক হল এই অস্থিরতা আর আলস্য হাত ধরেছে মঞ্জীরার। সময় তবু স্থির বহমান। দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে মঞ্জীরার চোখের সামনে দিয়ে। সকালের জিম, জগিং, ডাম্বোর স্কুল, অফিস, ফিরে এসে নিজের কুঠুরিতে সেঁধিয়ে যাওয়া। এক দিন হয়তো মিহিকার সঙ্গে সিনেমা অথবা তারই কাফেতে দেখা করতে গেল মা-ছেলে।

যা চেয়েছিল সবই তো পেয়েছে মঞ্জীরা। পেরেছে অবাঞ্ছিত যাপন সরিয়ে রাখতে, বাকি জীবন নিজের মতো করে কাটানোর ইচ্ছেও পূরণ হতে চলেছে। তবু চার পাশে কী অস্বাভাবিক শূন্যতা!

মাঝে এক দিন লোপামুদ্রা ফোন করে বসলেন। অস্বস্তি সত্ত্বেও ফোনটা না ধরে পারল না মঞ্জীরা।

“মঞ্জি, ভাল আছিস?”

“হ্যাঁ, তুমি কেমন আছ?”

“আমার কথা আর বলিস না মঞ্জি। পায়ে ব্যথা, কোমর ব্যথা, এ সব আমার সঙ্গেই যাবে, ও নিয়ে আর ভাবি না।”

“ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখিয়ে এস এক বার। রিপ্লেসমেন্টের কথা বলেছিলেন ডক্টর সর্দার। ভাবলে কিছু?”

“আরে না রে। আর ও সব নিয়ে ভাবি না। ভেবেছিলাম ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এল, তা সে তো আবার নতুন করে মেতে উঠেছে। কলকাতায় প্রায় থাকেই না, আজ ঘাটাল, কাল পারুলগঞ্জ, আবার সেই আগের ছুটোছুটি শুরু করেছে। না মরলে আমার আর শান্তি নেই রে মঞ্জি।”

অস্বস্তিকর কিছু সময়ের নীরবতা পেরিয়ে লোপামুদ্রা সাবধানে বলেছিলেন, “এক দিন আসবি মঞ্জি? আগে যেমন আসতিস। এখন তো ছোটখোকা প্রায়ই বাড়ি থাকে না, এক দিন এসে ঘুরে যা না। ডাম্বোর ছবিটাও দেখিনি কত দিন।”

মঞ্জীরা সাড়াশব্দ দেয়নি। লোপামুদ্রা গলা নামিয়ে বলেছিলেন, “পাকাপাকি ডিভোর্সটা যখন হয়েই গেল তখন তো শাশুড়ি-বৌ এর সম্পর্কটা আর রইল না। মেয়ের মতো না হলেও, এক জন বুড়ো বন্ধুর কাছে তো আসতেই পারিস, তাই না?”

নিঃশব্দে ফোন রেখে দিয়েছিল মঞ্জীরা। সে জানে খুব শিগগির এই নারীর সঙ্গে দেখা করতে এক সন্ধেয় তাকে বালিগঞ্জ ছুটে যেতে হবে। আকাশদীপকে সরিয়ে দিতে পেরেছে, কিন্তু যত দিন লোপামুদ্রা আছেন বালিগঞ্জের ওই বাড়ির মায়া কাটাতে আপাতত পারছে না মঞ্জীরা।

পাশের ঘর থেকে ডাম্বোর পড়ার আওয়াজ আসছে। গত কয়েক মাসে তার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। স্কুল যাওয়া নিয়ে আর ঝামেলা করে না। আজই মঞ্জীরা ওঠার আগেই ডাম্বো পড়তে বসে গেছে, ক'মাস আগে এ কথা ভাবাও যেত না। কী করে এতটা পালটে গেল ছেলেটা! তার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার জীবনেও তো ঝড় কম যায়নি। কোনও পরিবর্তনই এক দিনে হয় না। তার অগোচরে একটু একটু করে পালটে গেছে ডাম্বো। জীবন যুদ্ধে মেতে থাকা মঞ্জীরা খেয়াল করেনি। তার কাছে ডাম্বো এখনও ছোট্ট ছেলেটাই থেকে গেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement