ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।
আমি অবাক হলাম। জেঠু, বাবা আর ছোটকা এক হয়েছে! আমায় ডাকছে! আবার কী হল! নানা ফ্যাঁকড়া তো লেগেই থাকে!
রিজু ঘাবড়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইলোরা আসবে সোয়া ছ’টায়। ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে। দেখিস ভাই। ডোবাস না।”
আমি মাথা নেড়ে উঠলাম। টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে আবার দেখলাম। না, এখনও ব্লু টিক হয়নি। সাবুটা কী করছে? ফোন করব! করলে যদি না ধরে! বিশাল খারাপ লাগবে আমার! কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। আমি ওর বাবাকে, মানে কাকুকে ফোন করে খবর নিয়েছি যে, ও আবার কাজে বেরোচ্ছে। কিন্তু নিজে এখনও কথা বলে উঠতে পারিনি। গত চুয়ান্ন দিন আমি ওর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার নিজের মুখে ‘সরি’ বলা উচিত। কিন্তু কোথায় আটকাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।
লম্বা করিডর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমি বাবার ঘরের সামনে গেলাম।
বাবা গত তিন-চারদিন হল নিয়মিত আসছে অফিসে। ডাক্তার আরও রেস্ট নিতে বলেছিল। বাবা শোনেনি। সুস্থ হয়ে গেলে বাবা আর কারও কথা শোনে না।
আমি দরজায় নক করে একটু সময় নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
বাবার টেবিলটা বড়। কাচের। ইংরেজি ‘এল’ প্যাটার্নের। সেটা ঘিরে তিন ভাই বসে আছে। দেখলাম বাবা আর জেঠু হাসছে। ছোটকাকা কিছু একটা বলছে! দেখেই ভাল লাগল। বাবাকে হাসতে দেখা আর বর্ষাকালে টাইগার হিলে সানরাইজ় দেখা প্রায় এক ব্যাপার।
আমায় দেখে ছোটকা চুপ করে গেল। তার পর উঠে এসে বলল, “আয় আয়, দারুণ করেছিস তো!”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। কী করেছি বুঝতে পারলাম না।
জেঠু বলল, “বাগালে ফোন করেছিলেন। আমরা লোয়েস্ট হয়েছি। উই হ্যাভ গট ইট। এবার কিছু ফরম্যালিটিজ় আছে। পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বন্ড। কন্ট্র্যাক্ট। ফাইনাল কিউ এ পি সাবমিশন, ডিটেল জব প্রোগ্রেস বার চার্ট এটসেটরা এটসেটরা। হয়ে যাবে। তাই না?”
আমরা কাজ পেয়ে গেলাম তবে! যাক বাবা! আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এমন একট সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কাজটা হল যে, ভাল লাগছে খুব।
বাবা বলল, “বাগালে মেল করবে কাল। যা যা পেপার্স জমা করার আছে, তুই আর রিজু মিলে তৈরি করে জমা করে দিবি।”
আমি মাথা নাড়লাম।
ছোটকা হেসে বলল, “বড় হয়ে গেলি পুঁটি! তা শোন না, কয়েক দিন ঘুরে আয়। টেক আ ব্রেক।”
আমি বললাম, “একা যাব না। সবাই মিলে যাব। চলো না। সেই ক্লাস নাইনের পর আর যাইনি। বাবারও চেঞ্জ হয়ে যাবে।”
জেঠু বলল, “বাড়ি গিয়ে দেখছি। সবার সঙ্গে কথা বলে। আর একটা কথা। তোর গাড়িটা তো বছরতিনেক হল। ওটা বদলে নে।”
বাবা ভুরু কুঁচকে বলল, “দাদা, অর্ডার পেয়েই খরচ শুরু করলি?”
জেঠু হাসল, “ক’টা টাকাই বা দাম! প্লাস হি ডিড গুড। যা পুঁটি, গাড়ি পছন্দ করে নে!”
ঘর থেকে বেরিয়ে আমার খুব হাল্কা লাগল। না, গাড়ি আমি নেব না। আমার গাড়ি নিয়েই আমি খুশি। আর তিন বছর নয়, দু’বছর হয়েছে গাড়িটার। মাখনের মতো চলছে। বেকার টাকা খরচ করার মানে হয় না।
আমি ঘড়ি দেখলাম। প্রায় ছ’টা বাজে।
আর ওপরে না গিয়ে ফোন করে রিজুকে ডেকে নিলাম নীচে।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম মেঘ করে আছে বেশ। আকাশের একটা দিক কালো হয়ে আছে। আমি গাড়িতে বসে পাশের দরজাটা খুলে দিলাম। রিজু উঠে পড়ল। বলল, “ইলোরা আগেই চলে এসেছে।”
আমি হাসলাম। তার পর বললাম, “ও গাড়ির পেছনে বসবে। কিন্তু তুই সামনেই বসবি, বলে দিলাম। আমি তোদের ড্রাইভার নই যে, তোরা পেছনের সিটে বসে প্রেম করবি আর আমি গাড়ি চালাব!”
“কেন ড্রাইভার হওয়া খারাপ!”
“একটুও নয়। কিন্তু আমি তোর ড্রাইভার নই। ব্যস।”
রিজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।”
আমি গাড়ি নিয়ে ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের দিকে এগোলাম। ইলোরাকে তুলে নিয়ে আমরা হিন্দুস্থান পার্কের একটা বড় চাইনিজ রেস্তরাঁয় যাব। আমার খিদেও পেয়েছে বেশ।
“ওই যে ইলোরা!” রিজু উত্তেজিত হয়ে সামনে দেখাল। ভাবটা এমন, যেন চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়বে।
ইলোরাকে দেখলাম আমি। বেশ লম্বা মেয়েটা। সামান্য চাপা রং। সাধারণ দেখতে। চোখ দুটো খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। ঝকঝকে।
আমি গাড়ি দাঁড় করাতেই রিজু উসেইন বোল্টের মতো ছিটকে বেরোল। ইলোরাও আমাদের দেখে এগিয়ে এল।
রিজু পেছনের দরজাটা খুলে ঝুঁকে দাঁড়াল। ইলোরা হাসল সামান্য। তার পর উঠল। রিজু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো ছোট করে ঘাড় সামান্য নাড়িয়ে অনুচ্চারে ‘প্লিজ় প্লিজ়’ বলে মিনতি
করল দ্রুত।
আমি বললাম, “যা সিমরন, জি লে
আপনি জিন্দেগি।”
রিজু ঝপ করে পিছনের সিটে উঠে বসল।
আমি পিছনে ফিরে ইলোরার দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম, “হাই, আমি পুঁটি। রিজুর ড্রাইভার।”
ইলোরা আমার দিকে হাত বাড়াবে কী! দেখলাম রিজু ওর দুটো হাত ধরে বসে আছে! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুঝলাম ও নিজেও আর-একটা ‘চুয়ান্ন’ লেখার দিকে এগোচ্ছে।
এই সময়টা রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে বেশ জ্যাম থাকে। আমি তাই পূর্ণ দাস রোড ধরলাম।
বৃষ্টি পড়ছে এবার। গুড়িগুড়ি জলবিন্দু উইন্ড স্ক্রিনে ঘামের ফোঁটার মতো হয়ে আছে।
ইলোরাই কথা বলল প্রথম, “আপনার কথা আমায় অনেক বলেছে রিজু।”
আমি মাথা নাড়লাম, “সে বলতেই পারে। বড্ড বেশি বকে কি না!”
রিজু বলল, “আরে আমি কী বকি!”
আমি বললাম, “তাও তো আর সব গুণের কথা এখনও বলিনি।”
রিজু এবার ইলোরার হাত ছেড়ে সামনের সিটের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “প্লিজ় তোকে শোলের অমিতাভ হতে হবে না।”
“অনেক কাণ্ড আছে না কি?” ইলোরা মজা পেয়েছে এমন গলায় জিজ্ঞেস করল।
রিজু বলল, “আমি মহাকাব্য না কি যে অনেক কাণ্ড থাকবে? কোনও কাণ্ড নেই! তুমি আমার ফার্স্ট লাভ, ব্যস।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ ঠিক, এই বছর তুমিই ফার্স্ট।”
ইলোরাও আপনি থেকে তুমিতে এল, বলল, “ও বাবা, প্রতি বছরের সিস্টেম না কি! ভুল ছেলেকে প্রোপোজ় করলাম না কি বলো তো!”
রিজু অসহায় ভাবে বলল, “পুঁটি, সামনে তোর পাশে বসিনি বলে এভাবে বলছিস! আমি কী করলাম বল! কোনও দিনও কোনও মেয়েদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছি?”
“না তুলে তাকিয়েই ফাটিয়ে দিলি। আর তুলে তাকালে...” আমি শব্দ করে হাসলাম।
ইলোরাও হাসল। বলল, “ননভেজ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
রিজু বলল, “আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দে। আমি আত্মহত্যা করব।”
ইলোরা বলল, “সেই ভাল, না হলে ভুলভাল কিছু শুনলে আমিই তোমায় মেরে কুচিয়ে নুন দেব।”
আমি চট করে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ইলোরা এবার দু’হাত দিয়ে রিজুর হাত দুটো চেপে ধরেছে।
রেস্তরাঁটা আমার খুব প্রিয়। কয়েক জন ওয়েটার আমার মুখও চেনে। ভেতরে ঢুকে আমরা চার জনের টেবলে বসলাম। ওরা দু’জন এক দিকে আর অন্য দিকে আমি একা।
রিজু বলল, “তুই বিল মেটাবি তো?”
আমি বললাম, “আমি কেন? মেটাবি তুই। মাইনে পাস না?”
রিজু অবাক হয়ে বলল, “আরে, তুই তো বস। টাকা তুই দিবি।”
“বস কী রে! আমি চাকরি করি, তোর মতোই। এখনও ব্যবসায় নাম ঢোকেনি। আমি টাকা দেব কেন? স্পনসর জুটিয়ে প্রেম করবি না কি?”
রিজু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। ইলোরা থামিয়ে বলল, “তোমরা মারামারি কোরো। টাকা আমি দেব আজ। সারাক্ষণ এই মেল শভিনিজ়ম সহ্য হয় না আমার।”
রিজু বলল, “দারুণ। মেয়েরাই তো আসল। সমাজে মেয়েরা না থাকলে কী হত বলো তো! মেয়েরা সব পারে। কোথায় কোথায় সব চলে যাচ্ছে। স্পেসে, কিম্বা ধর নর্থ বেঙ্গল!”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। স্পেস আর নর্থ বেঙ্গল!
রিজু বলল, “জানিস না? কিছুই খবর রাখিস না? সাবু তো নেক্সট মান্থ থেকে নর্থ বেঙ্গলে বদলি হয়ে যাচ্ছে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। সাবু চলে যাচ্ছে কলকাতা ছেড়ে! রিজু জানে সেটা! আর আমি জানি না! বুকের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা লাগল! আবার নুনছাল উঠল না কি! আবার রি-এন্ট্রি নিল না কি সেই ইলেকট্রিক সাব-স্টেশনের ঝিঁইইইইই!
আমি কী বলব ভাবতে ভাবতে পকেটে ফোনটা নড়ে উঠল। আমি ফোন বার করলাম। যা দেখলাম তাতে চমকে উঠলাম একটু!