Novel: ডানায় ডানায়

তার পর অনেক অনেক গল্প করল দুই সহকর্মী। গল্পের শেষে তারা নামল রাস্তায়। তারা কেউই এখনও কঠিন কথাটা বলে উঠতে পারেনি তাদের দুই সঙ্গীকে।

Advertisement

রূপক ঘটক

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২১ ০৭:১৮
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

অভিমানী গলায় গরিমা বলে, “থাক, এখন আর ভদ্রতা করতে হবে না। এতগুলো দিনে এক বার ফোন পর্যন্ত করলি না আর এখন জ্বলন্ত অবস্থার কথা জানতে চাইছিস?”

Advertisement

“আমি জানি তুই রাগ করবি, কিন্তু বিশ্বাস কর, কী ভাবে যে এক নিঃশ্বাসে সময়টা কেটে গেল! রোজ ভাবতাম গরিমাকে ফোন করি, ওর খোঁজখবর নিতে হবে, তখনই মনে হত, থাক, ওর সঙ্গে তো অনেকটা সময় নিয়ে কথা বলতে হবে, পরে করব।”

“বুঝেছি, বুঝেছি। এমন রাজকার্যে ছিলি যে দশ মিনিট ফোন করাটাও তোর কাছে বাহুল্য হত।”

Advertisement

“আরে করব না তা তো ভাবিনি। ভেবেছি পরে করব। ওই করে করে দিনগুলোই ফুরিয়ে গেল। মা, বাবাকে পর্যন্ত কী করছ, কেমন আছটুকু বলেই রেখে দিয়েছি।”

“এই যে বললি বাড়ি যাবি! তা হলে মা, বাবাকে ফোন করবি কেন? কোথায় ডুব মেরেছিলি রে ডুবোপাহাড়?”

“মুন্সিয়ারি। পাঁচ পাহাড় চুড়োর দেশ।”

“এই সত্যি রে? গিয়েছিলি ওখানে? কী যেন ভদ্রলোকের নাম?”

“শ্রীমান ইতিহাস।”

“বল্লাল সেন! বা! দারুণ ব্যাপার। ভাল করেছিস। তাও আমাদের সামনে কেন যে কথা না বলার মান-অভিমানগুলো করিস! আর এ দিকে কলকাতায় যে কক্ষচ্যুত উপগ্রহ পাক খেয়ে যাচ্ছে, তাকে কী বলবি?”

“তাকে তো অনেক দিন থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছি যে, তোমার সঙ্কেত এখানে ধরা পড়ছে না। এখন কেউ যদি কিছুতেই সেই সঙ্কেত দেখবে না, ধরবে না, বুঝবে না বলে গোঁ ধরে বসে থাকে, তা হলে তো মুশকিল।”

“আরে হ্যাঁ, তুই যখন ছিলি না, তখন তো এখানেও এক দিন এসেছিল।”

“এখানে? বিপ্লব? কই বলিসনি তো!”

“কী করে বলব? এক দিন বসে খাতা দেখছি, নতুন যে ছেলেটা কাজ করছে, বদু না কী নাম, এসে বলল ‘ম্যাডাম, এক জন আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে ভিজিটার্স রুমে অপেক্ষা করছে।’ আমি ভাবলাম কে আসবে! প্রকাশকের ছেলেরা তো সোজা চলে আসে। গিয়ে দেখি বিপ্লব। উদ্‌ভ্রান্তের মতো চেহারা। বলল, ‘তমা ম্যাডামের কোন খবর জানেন?’ আমি বললাম, আপনি ফোন করেননি? বলল, ‘না, ফোনে কথা হয়েছে, সে ভাবে কথা হয়নি। আমি জানি উনি নেই। ভাবলাম আপনি হয়তো জানেন, উনি কোথায় গেছেন। আমি বললাম, ও তো বাড়ি গেছে। ওখানে গেলে তো সপ্তাহখানেক থাকেই। কেন, কোনও জরুরি দরকার? তখন বলল, ‘না, কোনও দরকার নেই। এমনিই খোঁজ করছিলাম।’”

“অফিস গেছে না যায়নি, জিজ্ঞেস করেছিলি?”

“নিজেই বলল অফিসের কাজে এ দিকে এসেছে বলে ঘুরে গেল। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি।”

“এই হয়েছে এক জ্বালা। কাল ফেরার পর থেকে দু’বার-তিন বার করে ফোন। কিচ্ছু বলার নেই, শুধু এটা সেটা ফালতু কথা!”

“কথা না বাড়িয়ে বলেই দে না, তুমি নিজের কক্ষপথ দেখে নাও বাপু।”

“বলা যায়? তুই পেরেছিস?”

“আমিও পারিনি। আমার পরিস্থিতিও তোরই মতো। বরং আরও সঙ্গিন।”

“বল, তোর কথা বল। এসে থেকে শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। কী খবর তোর বল!”

“কী বলি তোকে বল তো! দিব্যি ছিল সব কিছু ঠেকনা দেওয়া। আমারও সেই মুন্সিয়ারি থেকে ফেরার পরই নতুন করে সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ধর, তোর পরিস্থিতিকে যদি আড়াইগুণ জটিল করার পর, তাকে লস্যির মতো গুলিয়ে নেওয়া হয়, সেই রকম।”

“কেন, স্নেহময় ওর চিৎকার চেঁচামেচি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে না কি?”

“না। কমিয়ে দিয়েছে। একদম শূন্য।”

“মানে?”

“মানে চেঁচামেচি নেই। পায়ে পায়ে ঘুরছে। ভেউ ভেউ করে কাঁদছেও বলতে পারিস।”

“কী যা তা বলছিস? খুলে বল।”

“কী আবার বলব? সে দিন কলেজ থেকে ফিরে বড় ট্রলিব্যাগটা বের করে গোছাতে বসেছি, তখনও কোন হস্টেল বা পেয়িং গেস্ট থাকার জায়গা ঠিক হয়নি, কিন্তু তমাল বলেছিল জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে, যাতে খুব তাড়াতাড়ি ছোট্ট একটা নোটিস দিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারি। বিশেষ করে মার্কশিট, সার্টিফিকেটগুলো নিতে যেন ভুল না হয়, সে সব মনে করিয়েছিল। আমি এক মনে সে সব করছি, তখন স্নেহময় ফিরল। অন্য দিনের থেকে একটু আগেই ফিরেছিল বোধহয়।”

“তার পর?”

“তার আগে থেকেই ক’দিন একটু বোমকে ছিল। আমার কথা না বলা, গম্ভীর থাকা দেখেই হয়তো ওর ওই অসভ্যর মতো চিৎকারটা বন্ধ ছিল। ওইটুকু বাদ দিলে তো মানুষটা খারাপ নয়।”

“বলছিস?”

“সেটা সব সময়ই বলব। শোন, কোনও মানুষই খারাপ হয় না। দেখতে হবে সে তোর জুড়ি কি না! এখন আমি বুঝতে পারছি, আমার পছন্দ-রুচি-ভাল লাগার সঙ্গে লোকটা যায় না, মেলে না। লোকে বলবে, তা হলে বিয়ে করলে কেন? কিন্তু বিয়ে না করলে বুঝব কী করে?”

“ঠিকই তো। তার পর?”

“ফিরে দেখি পায়ে পায়ে আমার ঘরে চলে এল। তার পর ব্যাগ গোছাতে দেখে পুরো চুপ করে গেল। একটা প্রশ্ন নয়, চিৎকার নয়, বাধা দেওয়া নয়... পুরো চুপ।”

“সে কী রে! তার পর?”

“আমি কিছুই পাত্তা দিলাম না। রাতে খেতে দিয়ে দেখি খেতে আর আসেই না। বাইরে থেকে ভাববাচ্যে ডাকলাম, উত্তর নেই।”

“এ তো পুরো রোমাঞ্চকর গল্প। তার পর?”

“বাধ্য হয়ে ওর ঘরে গেলাম। আলো নেভানো। পাখা চলছে না। এসি বন্ধ। আলো জ্বেলে দেখলাম চুপ করে পিছন ফিরে শুয়ে আছে।”

“তার পর?”

“গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম, দেখি গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সামনে গিয়ে দেখলাম একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর চোখ থেকে জল পড়ছে।”

“আহা রে! বেচারা! তার পর?”

“তার পর আর কী হতে পারে বল? বললাম, জ্বর হয়েছে আমায় বলোনি তো। তুই বিশ্বাস করবি না, ওর কপালে হাত দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার পর পুরো কেঁপে উঠল। তার পর যেই না ওর পাশটায় বসার জায়গা করে বসে মাথা টিপতে শুরু করেছি...”

“তখনই তোকে জড়িয়ে ধরল?”

“তখনই আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। একেবারে হাউহাউ করে।”

“এ মা! তাই?”

“তুই বিশ্বাস করবি না তমা, একদম ছেলেমানুষের মতো!”

“তার পর কী করলি?”

“কী করব বল? তার পর থেকে সেবা শুশ্রূষা শুরু করলাম। ডাক্তার দেখালাম, রক্ত পরীক্ষা হল। রিপোর্ট বলছে টাইফয়েড, তবে চিন্তার কিছু নেই। নাদুসনুদুস লোকটা রোগা হয়ে গেছে এই অসুখে। টানা ছুটি চলছে। পথ্য দিচ্ছি। তার মধ্যে কাল দেখি ছুটির সময় আমায় নিতে কলেজের বাইরে এসে অপেক্ষা করছে। ভাগ্যিস তমাল কাল উকিলের কাছে গেছিল, না হলে কী হত কে জানে!”

“তমাল রাগ করেনি?”

“রাগ করলেও ও কিন্তু বুঝল জানিস! প্রথম দিনই আমি যখন ওকে বললাম তখন মুখ ব্যাজার করে বসেছিল। আমি যখন বললাম, তোমার জুড়িকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে না। যার সঙ্গে এত দিন এক ছাদের তলায় থাকলাম, তাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে আমি যেতে পারব না। সেটা অমানবিকতা। তোমার ভয় কী তমাল? তোমার জুড়ি কোথাও পালাচ্ছে না। তুমি বরং ধীরে সুস্থে তত দিনে বাকি ব্যবস্থাগুলো করে ফেলো!”

“তুই কী বলছিস, জুড়ি?”

“হ্যাঁ রে, বাবা, তোর সেই সুখুচরের বুড়িদির কথাই ধার করলাম। দুটো শালিক, দুটো বক, দুটো চিল, দুটো টিয়া— তারা জুড়ি। তারা ডানা মেলে এক সঙ্গে। আর তাদের ডানায় ডানায় ছোট হয়ে যায় আকাশটাও। তাদের এক জন বন্দি হলে অন্য জন সঙ্গে সঙ্গে যায়। এত দিনে আমি জুড়ি খুঁজে পেয়েছি, এত দিনে তুইও খুঁজে পেয়েছিস তোর জোড়। তবে কেন কে জানে, কী ভাবে তার সুতো মুন্সিয়ারিতে বাঁধা ছিল। ওখানে না গেলে হয়তো যা ছিল, যেমন ছিল, আমাদের দিন কেটে যেত সে ভাবেই। ওখানে গিয়েই আমরা আবিষ্কার করলাম আমাদের অর্ধেক আকাশকে।

তার পর অনেক অনেক গল্প করল দুই সহকর্মী। গল্পের শেষে তারা নামল রাস্তায়। তারা কেউই এখনও কঠিন কথাটা বলে উঠতে পারেনি তাদের দুই সঙ্গীকে। বলতে পারেনি, হয়তো অন্য কোনও মুন্সিয়ারিতে লুকিয়ে আছে তাদের জোড়। অথবা জোড়কে খুঁজে পাওয়ার সুতো। তা বলতে না পারুক, এখন, এই মুহূর্তে তারা খুব খুশি। এই মুহূর্তে তারা সম্পূর্ণ। একে অপরের হাত ধরে তারা চলতে থাকে শহরের পথ ধরে। মনে হয় আলাদা নয়, আসলে তাদের গন্তব্য একই। সেই গন্তব্যের প্রতিশব্দ হয়তো নিয়তি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement