Novel

ডানায় ডানায়

নিজের কাঁধ এগিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব হাত রাখল তমার কাঁধে। তার কপালে চুমু খেল।

Advertisement

রূপক ঘটক

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২১ ০৮:৪২
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

কী  আশ্চর্য, কাঠ কাঠ ছাড়া ছাড়া ছন্দ কেটে যাওয়া ব্যবহার নিমেষেই ঠিক হয়ে গেল যখন সে তার কাঁধে মাথা রাখল। নিজের কাঁধ এগিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লব হাত রাখল তমার কাঁধে। তার কপালে চুমু খেল।

Advertisement

তমা বলল, “দাঁড়া না, বৃষ্টির শব্দ শুনছি!”

বিপ্লব আদুরে গলায় বলল, “শুনতে হবে না, আমার হৎস্পন্দন শোন।”

Advertisement

তমা বলল, “একটা গান গা না।”

বিপ্লব বলল, “আমি গান জানি না।”

তমা রাগ দেখিয়ে বলল, “তা হলে কী জানিস?” বলেই মনে হল ভুল হল। ছেলেটা না ছন্দ কাটার মতো কোনও উত্তর দিয়ে বসে। হলও তা-ই। বিপ্লব তার হাত দিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, “আমি অনেক কিছু জানি, দেখবি?”

তমা উত্তর দিল না। মাথাটা সোজা করল। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বলল, “তুই চকলেট এনেছিস বলিসনি তো।”

বিপ্লব সেই রকম ঘোর লাগা সুরে বলল, “আমি তো আরও কিছু এনেছি, তাও তো বলিনি।”

তমা এবার একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, “কী?”

বিপ্লব একই রকম সুরে বলল, “ওই যে, যা ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়, কিন্তু ওষুধ নয়!”

তমা কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দিয়েছিল।

এই ঘটনার বছর, সওয়া এক বছর আগে প্রথমবার তাদের দু’জনের দেখা হয়েছিল। ঘর ছেড়ে শহরে এসে থাকা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব কি তাড়াতাড়ি হয়? এই শহরকে ভালবেসে ফেলা কমবয়সিদের নিজেদের মধ্যে কি তাড়াতাড়ি গাঢ় হয় বন্ধুত্ব? মনে হয় তাই। বৃথা ছুটির দিনগুলো তারা অর্থবহ করে তুলেছিল কখনও অকারণ হেঁটে, কখনও বা কফি হাউসের আড্ডায়। আস্তে আস্তে তস্য বন্ধুরা দূরে চলে গেছে, তারা নিজেরা সময় কাটিয়েছে। তমা জানত সে একটু খেপাটে। আবার তমা ভাবত, হয়তো তা নয়। সব স্বাভাবিক মানুষই হয়তো নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে, অস্বাভাবিকও ভাবে। তার মনে হত, বিপ্লবের মধ্যে সারল্য আছে। ওর সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগে। কিন্তু এটাই কি সব? কোনও পরীক্ষা বাকি থেকে যাচ্ছে না তো? এই কি তার সেই জুড়ি? সে যখন আকাশে ডানা মেলবে অর্থহীন, তখন সে-ও পাড়ি দেবে তো তার আকাশে? বৈষয়িক হিসেবে বিপ্লব দড়। সেটা তাদের আকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হবে না তো? তাদের হাসিখুশির দিনে, সংসার পাতার স্বপ্ন দেখা সুখ-সংলাপের সব ভালর তুমুল মিলের সম্পর্কে প্রথম বেসুরো সুর বাজল সেই সন্ধ্যায়। তমা কিন্তু সে দিন রাগ দেখায়নি। রাগ দেখাতে সে পারেও না। আলো জ্বালার একটু পরে স্বাভাবিক মুখে সে বলেছিল, “আজ তোকে রান্না করে কিছু খাওয়াই বিপ্লব? কী খাবি?”

ধাতস্থ হতে একটু সময় নিয়েছিল বিপ্লব। তার পর বলেছিল, “না, না, কিছু খাব না।”

তমা বুঝতে পারছিল পরিস্থিতি সহজ করার জন্য গল্প দরকার। কথা দরকার। কোনও সূত্র দরকার। এমন একটা সূত্র যা থেকে ঝরঝর করে কথা এসে যাবে। তার আর বিপ্লবের আলাপচারিতায় বেশির ভাগ সময়ে বলার দায়িত্ব তো নেয় সে-ই। আর বিপ্লবের ভূমিকা শ্রোতার। তমা ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে বলে, “বাইরে কি ঝড়ও হচ্ছিল না কি তুই আসার সময়?”

তার কথা শুনে বিপ্লব বলল, “বাইরে তখনও ঝড় হচ্ছিল না, এখনও হচ্ছে না। তুই কি আমায় ভাগাতে চাইছিস?”

বিপ্লবের কথার ধরনে হেসে ফেলে তমা। বিপ্লবও হাসে। তার পর বলে, “চাইলেও আমি এখন ভাগছি না।” বলে আবার হাসে।

খানিক ক্ষণ আগে পর্যন্ত তমার মনে যে রাগ জমেছিল, তা দূর হয়ে যায়। হাসলে বেশ লাগে বিপ্লবকে। লম্বা রোগা চেহারা। পরিপাটি সাজসজ্জা। একটা ডেনিম পরেছে। সঙ্গে একটা মেরুন টি-শার্ট। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীদের চেহারায় কি আলাদা সপ্রতিভতার ছাপ থাকে? মনে হয় তমার। সে দিন বিপ্লবকে দেখে আবারও মনে হয়েছিল সেটা।

তার পর বিপ্লবই মুখ খুলেছিল, “আমাদের সংসার এখানেই পাতলে কেমন হয় তমা?” তমা উৎসাহ দেখিয়ে বলল, “এত ক্ষণে একটা ভাল কথা বলেছিস। এখানেই থাকবি তো তুই?”

বিপ্লব বলল, “থাকব বলেই তো বলছি। আচ্ছা, বিশ্বাস না হয়, আজই থেকে দেখাতে পারি।”

তমা বলল, “আজ থেকে থাকতে তোকে কে বলেছে? মেসের লোকজন কী বলবে?”

“মেসে কে আর কার খোঁজ রাখে। আমার খোঁজ তো একমাত্র তুই-ই রাখিস। অফিস থেকে ফেরার পর আমার ফোন বাজলেই বুঝি তুই ফোন করেছিস খোঁজ নিতে। আজ সেই পরিশ্রম কমল।”

“আজ অফিস যাসনি?”

“তুই ভুলে গেছিস, আজ শনিবার।”

“ও হ্যাঁ, তাও তো বটে। এই শোন না, আমার বাড়িটা ঘুরে দেখবি না?”

“কী আর দেখব? শুনে শুনে কান পচে গেছে। ছোট ঘরটা ঠিক করেছিস পড়ার জন্য। বড়টা শোবার ঘর। চল, দেখি কেমন সাজিয়েছিস তোর ঘর!”

তখন ঝোড়ো হাওয়া বইছিল বাইরে। বৃষ্টি পড়ছিল নগণ্য দু’-এক ফোঁটা। তমা সমস্ত আলো জ্বেলে ঘুরে ঘুরে দেখাল তার একার সাম্রাজ্যকে। তার পর আবার এসে বসল তারা। খাওয়ার বড় টেবিলের সামনে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে। তমা বলল, “বৃষ্টির গন্ধ তোর ভাল লাগে না?”

বিপ্লব সামান্য হাসল। তমা বলল, “বৃষ্টির শব্দ তোর ভাল লাগে না?”

বিপ্লব সেই হাসিটাই আবার হাসল। তমা বলল, “আলোটা নিভিয়ে দিই? তার পর তোর সঙ্গে অনেক অনেক গল্প করব।” ভেতর থেকে ভাল লাগার বোধ তখন তার মনের আকাশে দু’হাত ছড়িয়ে হাঁটছে। সে তার পরিপাটি আঁচল গুছিয়ে আলো নিভিয়ে বিপ্লবের পাশে বসে তার দু’টি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল। তার পর বলল, “বল, এ বার তোরা অফিসের বন্ধুরা কোথায় বেড়াতে যাচ্ছিস?”

বিপ্লব বলল, “ঠিক হয়নি এখনও।”

সে বলল, “কে ঠিক করে?”

বিপ্লব বলল, “সবাই এক-একটা মত দেয়, অন্যরা সেটা বাদ দেয়। শেষে পাগলা শ্যামা কোনও একটা জায়গার নাম না বলে শুধু বর্ণনা দিতে শুরু করে। এত সুন্দর করে বলে যে, সবাই বলে, ‘ওরে নাম বল, জায়গাটা কোথায় সেটা বল,’ ও বলে, ‘সে সব জেনে কী হবে, আগে ফাইনাল কি না বল!’ তখন সবাই রাজি হয়। এটা আমাদের প্রতি বারের ছবি।”

তমা বলে, “কেমন বর্ণনা বিপ্লব?”

বিপ্লব বলে, “সে আমি বোঝাতে পারব না।”

“তাও চেষ্টা কর।”

“অসম্ভব। আমি বলতে শুরু করলে সেই জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে যাবে।”

“এ বারের যাওয়ার কিছু ঠিক হয়নি?”

“না, এক সঙ্গে বসা হয়নি।”

তমা বলে, “আশ্চর্য!”

“কেন, আশ্চর্য কেন?”

ধরা গলায় সে বলে, “আমারও চেনা এক জন আছে, যে এ ভাবে গল্পে গল্পে ছবি এঁকে তোলে।”

বিপ্লব একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সে কে? পুরুষ না মহিলা?”

হঠাৎ যেন চমক ভাঙে তমার, সে বলে, “সুখুচরের বুড়িদি। আমার ছোটবেলার সখী। তোর পাগলা শ্যামার সঙ্গে ওর দেখা করিয়ে দিলে হত। দেখা যেত, ওরা একই জুড়ি কি না।”

বিপ্লব বলে, “তোর অর্ধেক কথা আমি বুঝি না। তমা বলে, “বুঝতে হবে না, মুখস্থ করে রেখে দে। যে দিন দরকার হবে, গড়গড় করে মনে পড়ে যাবে।”

বিপ্লব বলল, “আমি মুখস্থ করতে ভাল
পারি। দেখবি?”

তমা বলল, “তা কী মুখস্থ করলি তুই,
আমার ভাষণ?”

বিপ্লব বলল, “তোর বাড়ির আনাচ কানাচ। যাচাই করবি?”

তমা অবাক হয়ে বলল, “এ মা, এটা আবার কী করে যাচাই করব?”

বিপ্লব বলল, “আয় না, দেখ।”

দু’চোখে কৌতূহল নিয়ে তমা উঠে দাঁড়াল। আলো না জ্বললেও ঘর নিকষ অন্ধকার নয়। আশপাশ থেকে উড়ে, ভেসে আসা আলো আছে। তমা উঠে দাঁড়াতেই তাকে কোলে তুলে নিল বিপ্লব। বিপ্লব সবল, পেশিবহুল। সে পালকের মতো অনায়াসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল তমাকে। তমা বলল, “কী হচ্ছে এটা!”

বিপ্লব তাকে কোলে নিয়েই দু’পা হেঁটে বেসিনের সামনে গিয়ে বলল, “এটা বেসিন। তুই বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে এখানে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবি। আমি অফিস থেকে ফিরে এখানে এসে তোকে চুমু খাব। এই ভাবে...”

চোখ বোজে তমা। কানের কাছটা গরম হয়ে ওঠে। বিপ্লবের ঠোঁটের নোনতা স্বাদ তখন তার বাইরের ঠোঁটে। তাকে কোলে রেখেই চুম্বন গভীরতর করে তোলে বিপ্লব।

দীর্ঘ চুম্বনের পর তমা বলে, “এ বার নামা।”

বিপ্লব কথা না শুনে তাকে কোলে নিয়েই আরও দু’পা এগিয়ে যায়। তমার মনে হয়, তার শরীর যেন একটু একটু করে উষ্ণতা টের পাচ্ছে। যেন চেতনানাশক বড়ি তাকে আচ্ছন্ন করছে ভাল লাগায়। কিন্তু তখনও কোথা থেকে একটা খচখচে কাঁটা বিঁধতে থাকে। যেন তার স্বপ্নের পুরুষ তার কাছে এসেও ধরা না দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর বার বার বলে দিচ্ছে ‘এ নয়, এ নয়।’ স্বাস্থ্যবান, রূপবান এই পুরুষই কি তার সেই জুড়ি? তার হঠাৎ বুড়িদির মুখখানা ভেসে ওঠে। এক বার ভাবে, তাকে বলে, ‘চল ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভিজি।’ সে জানে, পরম যত্নে ছাতা ব্যবহার করা, নিয়ম করে রোদরক্ষা ক্রিম ব্যবহার করা বিপ্লব আঁতকে উঠবে এই প্রস্তাব শুনলে। কিন্তু বিপ্লব যত হাঁকপাক করে, তাকে পরীক্ষা করার ইচ্ছে তত জোরালো হয় তমার। সে চায় রসিয়ে, ধীরে, পূর্ণ সম্মতিতে সেই মাহেন্দ্রমুহূর্ত উপভোগ করতে। ‘সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে’ কার সম্বন্ধে যেন বলেছিল বুড়িদি, সেটাও মনে পড়ে তার। বিপ্লব কিন্তু অনুরোধ শুনেই তাকে নামাল না। আরও দু’পা এগিয়ে গিয়ে বলল, “এটা আমাদের বেডরুম, এখানে আমার ওপর তুই অত্যাচার চালাবি।” বলে বালির পাঁচিল যে ভাবে ধীরে ধীরে মাটিতে মেশে, সেই ভাবে আস্তে আস্তে তাকে কোলে নেওয়া অবস্থাতেই বিছানায় অবতরণ করে। তমা বলে, “ইশ! ছাড়, চারিদিক খোলা!” বিপ্লব কোনও উত্তর না দিয়ে আবারও চুম্বন করে তাকে। নিজের অর্ধস্ফুট উচ্চারণে তমা নিজেই চমকে যায়। তার মনে হয়, বিপ্লব নয়, পরীক্ষাটা তার নিজের। সেও কি গলে যাচ্ছে না? বুঝতে পারে না তমা, শুধু বুঝতে পারে সেই জুড়ি খোঁজার কথাটা সে ভুলতে পারছে না। সে আবার বলে, “দরজা জানলা সব হাট করে খোলা বিপ্লব, প্লিজ় ছাড়!”

বিপ্লব তখন তার গলায় নাক ঘষছে, বুকে নাক ঘষছে। সে বলে, “এই অন্ধকারে কে আমাদের দেখতে পাবে?” তখন তার একটা হাত চলে এসেছে তমার মসৃণ পেটে। সে সমানে চুমু খেয়ে যাচ্ছে তমার চোখে, গালে, বুকে, গলায়, পেটে। তার হাতের এক টানে খুলে যায় তমার আঁচল। এ বার বিরক্তিটা বেড়ে যায় তমার। সে তো ভেবেছিল অনেক কিছু। সেই ভাবনায় ছিল মোমবাতির মোহময় আহ্বান। ছিল স্বেচ্ছায় পোশাকশূন্য হওয়ার ঐশ্বর্য! সে তো প্রথমতম ঘনিষ্ঠতাকে উৎসবের মতো উদ্‌যাপন করতে চেয়েছিল। তার সব উপাদানই তো হাজির। পাখির জোড়ের মতো তারা ডানা মেলবে, ঘুরবে, উৎসব করবে। এ রকম চোরের মতো, ট্রেন ধরার মতো, পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা পড়ার মতো তো তা হওয়ার কথা নয়! এ বার সে বলল, “বিপ্লব!”

বিপ্লব বলল, “আমি কোনও কথা শুনব না।”

সে বলল, “আমার ভাল লাগছে না বিপ্লব,” তার পর বিরক্ত গলায় কাটা কাটা উচ্চারণে আবার বলে, “আমার ভাল লাগছে না।”

থেমে যায় বিপ্লব, তার পর বাজ-পড়া গাছের মতো উঠে দাঁড়ায়। তার পর বাইরের ঘরের চেয়ারে গিয়ে বসে থাকে বেশ কিছু ক্ষণ। সে যেন বুঝে উঠতে পারছে না সঙ্গিনীর এই আচরণ। আরও খানিক ক্ষণ পর বলেছিল, “আমি যাচ্ছি, দরজাটা বন্ধ করে দে।”

আজ তমা অনায়াসে সেই দিনটার কথা মনে করতে পারে। কারণ তার কোনও আক্ষেপ ছিল না, ছিল না অনুতাপ। এখনও মনে আছে, সেদিন বিপ্লব চলে যাওয়ার পর তার একটুও ক্ষোভ বা দুঃখ হয়নি। সেদিন কেন যেন সে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement