Novel

novel: মায়াডোর

উত্তীয় চলে গেলেও কাজ অবশ্য থেমে থাকল না। ফ্লেক্সের লোকটা এসেছিল, ফাইনাল ডিজ়াইনটা মিহিকা আর জীয়ন ঠিক করে নিল।

Advertisement

অভিনন্দন সরকার

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:৫৮
Share:

ছবি: বৈশালী সরকার।

Advertisement

জও লোপামুদ্রা টুকটাক কুশল জিজ্ঞেস করলেন মঞ্জীরার। ডাম্বোর সব কথা জানতে চাইলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। প্রমাণ সাইজ়ের দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কয়েকটা। শেষমেশ তদ্গত হয়ে বসে রইলেন।

লোপামুদ্রাকে দেখছিল মঞ্জীরা। বছর পাঁচেকেই কত পাল্টে গেলেন মানুষটা। সে দিনের সেই বিরাট অট্টালিকা আজ এক পরিত্যক্ত ভগ্নস্তূপ। অথচ কী দাপটই না দেখেছে সে এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর। দুই ছেলে, ছেলের বৌ থেকে স্বামী পর্যন্ত তটস্থ হয়ে আছেন তাঁর সামনে।

Advertisement

শুধু কি তাই? নিজেদের সম্পর্কের ভাঙন যখন নির্লজ্জের মতো বাড়ির সবার সামনে জানিয়ে দিয়েছিল আকাশদীপ, তখনও তো এই মহিলা কাছে টেনে নিয়েছিলেন মঞ্জীরাকেই। বিচারকের রায় শোনানোর স্বরে বলে উঠেছিলেন, “না বাবিন, মঞ্জীরাকে আমি ওর বাবার কাছে থেকে চেয়ে এনেছিলাম। আমি বেঁচে থাকতে ও এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। আর তা ছাড়া সম্পর্ক তো তুমি ভাঙছ, ও তো ভাঙেনি। বাড়ি ছেড়ে যেতে হলে তুমি যাবে, ও নয়। ওর বিয়ে শুধু তোমার সঙ্গে হয়নি বাবিন, গোটা গাঙ্গুলি পরিবারের সঙ্গে হয়েছে, এ কথাটা ভুলে যেয়ো না।”

জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর ছিল লোপামুদ্রার। গোটা ঘর সেই স্বরে গমগম করে উঠত।

কখন পাল্টে গেল মানুষটা? ছোট ছেলে বাড়ি ছাড়ার পর? স্বামীর মৃত্যু? ডাম্বোর দীর্ঘ অদর্শন? মঞ্জীরার দূরে সরে যাওয়া... কোন শোকের অভিঘাতে কয়েক বছরেই এমন অথর্বপ্রায় হয়ে গেলেন লোপামুদ্রা!

কাকিমার আসার খবর পেয়ে এরই মধ্যে ঝিমলি এসে হাত ধরে মঞ্জীরাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেল। দোতলা জুড়ে দিব্যি সাজানো গোছানো সংসার পেতে বসেছে দেবিকা। বাড়ির একতলা জুড়ে অনলদীপের চার্টার্ড ফার্মের অফিস আর গ্যারাজ। ছোট ভাই থাকলে এই বাড়ির কী ভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হত সে কথা আজ আর ওঠে না। গোটা বাড়িটাই এখন অনলদীপ আর দেবিকার। তবে তা নিয়েও কখনও উষ্মা অনুভব করেনি মঞ্জীরা। একটু আপনি-কোপনি স্বভাবের হলেও দেবিকা এক মুহূর্তের জন্যও কখনও তার প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখায়নি।

আকাশদীপ যখন মঞ্জীরাকে ডিভোর্স পিটিশন পাঠিয়েছিল তখনও মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছিল দেবিকা, “এত সাহস পায় কী করে এই ব্যাটাছেলেগুলো! তোমার দাদা এ রকম করতে পারবে? দেব না দু’দিনে বিষ ঝেড়ে!”

আজও ছোট জা-কে পাশে বসিয়ে অনেক কথা বলল দেবিকা। তার সব কথাই ঘুরেফিরে অনলদীপে এসে শেষ হয়। অনলদীপের কাজের চাপ, তার আয়-পয়, বাড়তে থাকা ব্লাড প্রেশার... মুগ্ধ হয়ে শোনে মঞ্জীরা। ঝিমলি তার নতুন পাওয়া ল্যাপটপ নিয়ে আসে কাকিমাকে দেখাতে, অনুযোগের সুরে বলে ওঠে, “কাম্মো, তুমি তো ডাম্বোকে নিয়ে এলে না আর, নেক্সট মান্থে আমার ফিফটিন্থ বার্থডে, বাবা বলেছে বড় করে করবে। ছাদে প্যান্ডেল হবে। প্লিজ় ভাইকে নিয়ে এসো সে দিন।”

আদরের হাত তার মাথায় বুলিয়ে দেয় মঞ্জীরা, মিষ্টির প্যাকেটটা তুলে দেয় তারই হাতে, “এই নে, পাকা বুড়ি। তোর পছন্দের মিষ্টি। ছোটবেলায় কেমন আঙুল চেটে চেটে খেত, তাই না দিদি!”

অনলদীপ ঝটিতি এসে মঞ্জীরার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে গেল। তার অফিস এখন জমজমাট, তার কি বসার জো আছে? তবু চেম্বারের কাজের ছেলেটিকে দিয়ে চপ আনাল অনলদীপ।

চাপা গলায় দেবিকা বলল, “বেশ করেছ ডিভোর্স দাওনি। কর দেখি কত সংসার করবি অন্য জায়গায়! তবে দু’কান কাটা হলে যা হয়, শুনেছি এখনও নাকি এক সঙ্গে থাকছে দু’জনে।”

এমন ঠাসবুনোট এক সংসারী বাতাবরণে অনেক দিন আসেনি মঞ্জীরা। তার ভাল লাগছিল, কিন্তু দেবিকার কথা শোনামাত্র সে শামুকের মতো গুটিয়ে গেল। অথচ ব্যাপারটা নতুন নয়, তবু প্রতি বার এই প্রসঙ্গ উঠলে একই রকম কষ্টে কুঁকড়ে যায় মঞ্জীরা। আকাশদীপ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পরই যে সে একেবারে একতরফা সইসাবুদ সেরে ডিভোর্স পিটিশন পাঠিয়ে দেবে তা ভাবেনি কেউই। ঘটনাটা স্পষ্ট হয়েছিল মাসখানেক পর। খবরের কাগজটা বৈঠকখানার সোফায় আছড়ে ফেলেছিল অনলদীপ, “নাউ থিংস আর ক্লিয়ার। দ্যাট অন্তরা শর্মা, ওর সঙ্গেই এক ফ্ল্যাটে আছে বাবিন। ছি ছি! একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে, ঘরে একটা পাঁচ বছরের ছেলে থাকতে... ছিঃ!”

হ্যাঁ, সে দিনই সব সংযমের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল মঞ্জীরার। বালিগঞ্জের গাঙ্গুলিবাড়িতে সেটাই তার শেষ দিন।

দেবিকার সঙ্গে অল্প কিছু কথা সেরে উঠে পড়ল মঞ্জীরা। নিপাট সুন্দর ঘরকন্না। কাচা ধপধপে বিছানার চাদর, কৃষ্ণনগরের পুতুল দিয়ে সাজানো শো কেস, ঠাকুরের আসন থেকে আসা ধূপের গন্ধ, সাদা ঝিরি কাটা কাপড় ঢাকা ঝিমলির হারমোনিয়াম... এ সবই বেশি ক্ষণ বসতে দেয় না মঞ্জীরাকে। তার মনে হয় তার নিঃশ্বাস এই ঘরের হাওয়ায় মিশলেও বুঝি বা তাল কাটতে পারে এই নিপাট সৌন্দর্যের।

বেরিয়ে আসতে গিয়েও একটা তালা দেওয়া ঘরের সামনে থমকে গেল মঞ্জীরা। আশ্চর্য! এত বছর পরেও লোপামুদ্রা ছোট ছেলে-বৌয়ের ঘর বেদখল হতে দেননি। মাঝে মাঝে কাজের লোক ঝাঁড়পোছ করে। বাকি সময় তালা দেওয়াই থাকে।

প্রাণের থেকে প্রিয় ছোট ছেলের জন্য বাড়ির সেরা ঘরটা রেখেছিলেন লোপামুদ্রা। হায়! যার জন্য ফুলের বাগান সাজায় মানুষ, সেই দাগা দিয়ে চলে যায়। যুগে যুগে এই হয়ে এসেছে, তবু ফের ইচ্ছের চারাগাছের পরিচর্যা করে মানুষ, নিপুণ হাতে সার দেয় আকাঙ্ক্ষার মূলে... আবার কেউ এসে ছারখার করে দিয়ে যাবে শখের বাগিচা, ছিঁড়ে কুচিকুচি করবে সাধের পাপড়ি... সেই প্রতীক্ষাতেই কি?

এই ঘরেই মঞ্জীরা-আকাশদীপের প্রথম রাত, নিগূঢ় গোপন কত বিনিময়, সদ্যোজাত ডাম্বোও তো হাসপাতাল-ফেরত প্রথম এসেছিল এই ঘরে। গাঙ্গুলিবাড়িতে সে এক উৎসবের দিন।

শুধু কি তা-ই? এই ঘরেই চরম অবহেলা, উপেক্ষাও তো পেয়েছে সে, রাতের পর রাত অপেক্ষা করেছে মঞ্জীরা, আকাশদীপ ফেরেনি। এই ঘরেই শেষতক হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছিল আকাশদীপ, “প্লিজ় আমায় ছেড়ে দাও মঞ্জি, আমি ছেলের আর তোমার সব দায়িত্ব নেব, শুধু আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও। যে জীবন আমি বেছে নিয়েছি তাতে এই পরিবেশ অসহ্য লাগছে আমার। এক সঙ্গে থাকা মানে সারা জীবনের তিক্ততা বয়ে নিয়ে বেড়ানো। তার থেকে আলাদা থাকাটাই সবার পক্ষে ভাল, তাই না? আর তা ছাড়া আজকাল আকছার ডিভোর্স হচ্ছে, সোশাল স্টিগমা তো নেই আর। প্লিজ় নিজের মতো থাকো মঞ্জি, আমাকেও বাঁচতে দাও।”

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ঝিমলি জড়িয়ে ধরল মঞ্জীরাকে, “কাম্মো, নেক্সট মান্থ কিন্তু, তুমি ভুলে যেয়ো না। ভাইকে নিয়ে আসবে বলো।”

ঝিমলিকে আদর করে দিল মঞ্জীরা, হাসিমুখে বলল, “আসব বাবা, আসব।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছিল মঞ্জীরা। এই মানুষগুলোর এমন নির্ভেজাল আত্মীয়তা, পরিপূর্ণ এক সংসারের চালচিত্র, এ সবই তারও হতে পারত। কিন্তু কিছুই হল না। মঞ্জীরাই বা পিছুটান কাটিয়ে কেন চলে আসতে পারে না? এই কারণ হয়তো সে কোনও দিনই বুঝবে না।

ডাম্বোর মতো বাবা-অন্ত প্রাণ ছেলে পর্যন্ত আজকাল বাবার কথা বলে না। মঞ্জীরাই শুধু আলমারির লকারে রাখা ডিভোর্স পিটিশনটায় সই করে উঠতে পারল না।

বাসস্ট্যান্ডে থিকথিকে ভিড়। জনঅরণ্যে সবাই যে যার ব্যথা লুকিয়ে কাজে ডুবে আছে, নিয়মমাফিক যন্ত্রের মতো বেঁচে থাকাটুকু বিলিয়ে রেখেছে নৈমিত্তিকতার প্রবাহে। এত সাধের মানবজনম, তবু শেষ পর্যন্ত এক নিরন্তর দুঃখযাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। চোখের জল যে তার শুকিয়ে গেছে তা আরও এক বার বুঝল সে।

মঞ্জীরা শব্দ করে হেসে উঠল।

দেওয়াল জুড়ে হাওড়া ব্রিজ।

ফোটোগ্রাফি নয়, হাতে আঁকা ছবি। ছোটখাটো নয়, এলাহি ব্যাপার। পনেরো ফুটের দেওয়ালের পুরোটাই প্রায় জুড়ে আছে এই সেতু আর সেতুর নীচে এ পাশে-ও পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কলকাতার আরও দর্শনীয় স্থান। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, তারামণ্ডল, শহিদ মিনার, কী নেই! দেওয়ালের আড়াআড়ি চলে গেছে ট্রামলাইন, সেই লাইন বেয়ে চলা ট্রামের মুখ অবিকল জীবন্ত এক মজারু মানুষের মতো। রঙের ব্যবহারে পরিমিত ঔজ্জ্বল্য, আধুনিকতা আর ঐতিহ্যের দুর্দান্ত মিশেল।

উত্তীয়, মিহিকা আর জীয়ন দাঁড়িয়ে ছিল দেওয়ালটার সামনে। কাফের এক পাশের দেওয়াল জুড়ে ইন্টিরিয়র ফার্মের লোকেরা আশ্চর্য এই শিল্পকর্ম করে রেখেছে। যখন এই কোম্পানিকে কাজের বরাত দেওয়া হয়েছিল, তখনও তারা যে নিজেদের কাজ এই উচ্চতায় নিয়ে যাবে তা কেউই ভাবতে পারেনি।

শুধু কি তাই? মেঝেতে ঝকঝকে ঘিয়ে রঙের সেরামিক টাইলস, ফলস সিলিং-এর ফাঁকফোকর থেকে উঁকি মারছে আবছা মায়াবী হরিদ্রাভ আলো। জানালার কাচে সবুজ-নীলের কারুকলা। এখনও ফার্নিচার এসে পৌঁছয়নি, তার আগেই মিহিকার কাফে মায়াপুরীর রূপ নিয়েছে।

আর এ সবই তারা করেছে আশ্চর্য রকম কম দক্ষিণায়। এতটাই কম যে মিহিকা ভেবেছিল, যে ফিক্সড ডিপোজ়িটটা গত সপ্তাহে সে ভাঙিয়েছে, তার থেকেই ইন্টিরিয়র ফার্মের পেমেন্ট করে দেবে।

তাকে নিরস্ত করেছিল উত্তীয়, “ক্যাশ হাতে রাখুন মিস চ্যাটার্জি। হাজার একটা হিডেন কস্ট আসবে এর পরে। কোম্পানি কিন্তু তৎক্ষণাৎ সব খরচ বিয়ার করবে না।”

মিহিকা ভেবে দেখেছে, উত্তীয় খুব একটা ভুল বলেনি। আর তা ছাড়া লোন শোধের জন্য উত্তীয় দীর্ঘতম রি-পেমেন্ট স্কিম করে দিয়েছে, ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে অসুবিধের কিছু থাকবে না। উত্তীয়কে যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে মিহিকা। একটা লোক একা দাঁড়িয়ে থেকে কাফের ইনিশিয়াল সেট-আপটা করে দিচ্ছে।

এই তো কয়েক দিন আগে কাজ চলাকালীন পলিটিকাল পার্টির কিছু ছেলে ঝামেলা পাকিয়েছিল, ভয়ার্ত মিহিকা ফোন করেছিল উত্তীয়কে। ঝামেলা মিটে গিয়েছিল। সময় লেগেছিল ঠিকই, তবু মিটে গিয়েছিল। কী করে মিটেছিল জানে না মিহিকা। শুধু পার্টি অফিস ঘুরে এসে উত্তীয় বলেছিল, “ঠিক আছে মিস চ্যাটার্জি, আর প্রবলেম হবে না।”

এই ব্যাপারটার পোশাকি নাম নির্ভরতা। মিহিকা জানে, সারা জীবন পুরুষদের সে বিশেষ উন্নত প্রজাতির প্রাণী হিসেবে গণ্য করেনি। বাবার চেয়ে মাকে সে বেশি ভালবাসত। বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় যখন হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে তার বয়সি মেয়েরা নালে-ঝোলে হত, মিহিকা ফিরেও তাকাত না কারও দিকে। কেউ তাকে অহঙ্কারী বলত, কেউ ভাবত লেসবিয়ান, মিহিকা পাত্তা দিত না। সেই কারণেই হয়তো একটাও ভাল বন্ধু হল না তার। এই যে জীয়ন সারা দিন তার সঙ্গে লেগে থাকে, কখনও মিহিকার মনে তার প্রতিও অন্য রকম চিন্তা আসেনি।

সত্যিই কি আসেনি? হয়তো এসেছে। পাত্তা দেয়নি মিহিকা।

কোনও দিন কিছু বুঝতেও দেয়নি সে জীয়নকে। ছেলেদের ধাত তার জানা আছে। যত দিন দূরে দূরে, তত দিন সব ঠিক। হাতের মুঠোয় মেয়েমানুষ পেলেই তাকে সম্পত্তি ভাবা শুরু হয়ে যাবে... ‘ওখানে যেয়ো না,’ ‘ওই পোশাক পোরো না,’ ‘ওই ছেলেটার সঙ্গে এত কথা কিসের?’ তার ওপর ঘুমে চোখ ভেঙে এলেও রাত অবধি ফোনে বকবকাও তার সঙ্গে... অসহ্য! এ সব মিহিকা ঘেন্না করে। সে ফ্রি বার্ড। কেউ তার পায়ে শিকল পরাচ্ছে, খাঁচায় পুরে দানাপানি দিচ্ছে... এ সব কোনও দিন মেনে নিতে পারবে না সে।

সেই মিহিকাকে উত্তীয় সন্ধে নামার আবছায়ায় নির্মীয়মাণ কাফেতে বসে বলেছে, “মনে রাখবেন কাফে শুধু কফি খাওয়ার জায়গা নয়, এখানে লোকে প্রাণের কথা বলতে আসবে, কেউ আসবে লেখালিখি করতে, হয়তো বিজ়নেস ডিলও ফাইনাল হবে এখানে বসে। তাই হালকা মিউজ়িক চাই, আলোর ভারসাম্য চাই, আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড। পুজোর সময়টা ইউটিলাইজ় করতে হবে, উই মাস্ট হ্যাভ আওয়ার সেকেন্ড ব্রাঞ্চ বাই নেক্সট ইয়ার।”

বিমুগ্ধ চোখে উত্তীয়র দিকে তাকিয়ে থাকে মিহিকা। তখনই কিচেন থেকে কফি বানিয়ে নিয়ে টেবিলে রাখে জীয়ন, “ওহ থ্যাঙ্কস জিয়ান, এটার খুব প্রয়োজন ছিল।” একটা কাপ তুলে মিহিকার দিকে এগিয়ে দেয় উত্তীয়, “আসুন, মিস চ্যাটার্জি।”

মিহিকা কফির কাপে চুমুক দেয়, নরম গলায় বলে ওঠে, “বন্ধুরা আমাকে ‘মিস চ্যাটার্জি’ বলে ডাকে না উত্তীয়দা। আমি মিহিকা, শুধুই মিহিকা।”

জীয়ন চমকে তাকায় মিহিকার দিকে। রাস্তার আলো-অন্ধকার কাফের ভিতর এক মায়াবী বিভ্রম তৈরি করেছে, সেই আলোয় মিহিকাকে দেখাচ্ছে উর্বশী রম্ভার মতো, তার ঠোঁট ভিজে আছে সদ্য চুমুক দেওয়া কফির স্পর্শে।

জীয়ন মনে মনে সেই ঠোঁট ছুয়ে দেয়, শূন্য দৃষ্টিতে কাফের দেওয়ালের হাওড়া ব্রিজের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “আর আমাকে বন্ধু হোক বা শত্রু, কেউই জিয়ান বলে ডাকে না। আমি জীয়ন, শুধুই জীয়ন।”

উত্তীয় মনের চোখে দেখতে পাচ্ছিল, কয়েক দিনের মধ্যে এই আলো-আঁধারি চিত্র পাল্টে যাবে, তার জায়গায় রমরমিয়ে চালু হয়ে যাবে মিহিকার কাফেটেরিয়া। মানুষ অন্ধকার পছন্দ করে না, নিরন্তর তার যাত্রাপথ আঁধার পেরিয়ে আলোর দিকেই। উত্তীয় বুঝল, মিহিকা, জীয়ন আর এই আবছায়াময়, অর্ধনির্মিত কাফের ঘরে ব্ল্যাক কফির ধোঁয়া ওঠা সন্ধেটা তার একটু বেশিই ভাল লাগছে।

মিহিকার চিবুকের গঠন বার বার অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে উত্তীয়কে, অদ্ভুত মিল! তার অন্য এক জনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

মনে মনে হাসল উত্তীয়। এই কাফের পিছনে কম মেহনত করেনি সে। প্রথম যে দিন পলাশের বিজ়নেস স্টার্ট-আপ হেল্প অর্গানাইজ়েশন থেকে মিহিকাকে ফোন করিয়েছিল সে দিনও এতটা ভাবেনি সে। কিন্তু গল্পটা এগিয়েছে মসৃণ ভাবে। পলাশের সঙ্গে মিহিকার আলাপ হয়েছে, স্টার্ট-আপ ডেভলপার ফার্মের ওপর ভরসা রেখেছে মিহিকা। পলাশকে উত্তীয় চেনে দীর্ঘ দিন। করিতকর্মা ছেলে। শুধু সুন্দরী মহিলা দেখলে নিজের দৃষ্টি বশে থাকে না তার, এ ছাড়া ছেলে হিসেবে পলাশ নিরীহ। মিহিকার কেসেও ভাল রকম উতরে গেছে পলাশ, আর এই গল্পে সুন্দর করে নিজেকে প্লেস করেছে উত্তীয়।

মিহিকা যদি জানতে পারে পলাশের সংস্থা আর উত্তীয়দের ব্যাঙ্কের মধ্যে কোনও টাই-আপ নেই, সে কি খুব রেগে যাবে? হয়তো অবাকও হবে।

ব্যাঙ্ক লোনের ব্যাপারটা প্রায় পুরোটাই নিজের হাতে করেছে উত্তীয়। তার ব্যাঙ্ক লোনের পেপারে গ্যারান্টারের জোগাড় পর্যন্ত উত্তীয় করে দিয়েছে, বিস্ময় লুকোতে পারেনি মিহিকা, “উত্তীয়দা! এটা কী? আমার জন্য এত বড় রিস্ক?”

“আরে ধুস! আমরা এ রকম মাঝে মাঝেই করি। আর তা ছাড়া আপনার ওপর পুরো বিশ্বাস আছে। বছর পাঁচেক পর নিজেও তো গর্ব করে বলতে পারব যে, কাফে চেনের মালকিন মিহিকা চ্যাটার্জি আমাকেও চেনেন। রিফ্লেক্টেড গ্লোরির লোভটা ছাড়তে পারলাম না। পরে রাস্তাঘাটে দেখতে পেলে তখন চিনতে পারবেন তো মিস চ্যাটার্জি?”

হো হো করে হেসে উঠেছিল উত্তীয়।

ব্যাপারটা এতটাও সহজ ছিল না। আগেকার দিন হলে উত্তীয় নিজেই মিহিকার লোনের গ্যারান্টার হয়ে যেত। কিন্তু এখন ব্যাঙ্কের নিয়মকানুন পাল্টেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা গাপিয়ে অনায়াসে পগার পার হচ্ছে উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীর দল। এ দিকে ক্ষুদ্র শিল্পের খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য ব্যাঙ্কের নিয়মের কড়াকড়ি বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।

মিহিকার জন্য প্রভাবশালী গ্যারান্টার খুঁজতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি উত্তীয়কে। উপায় ছিল না। তা না হলে নিজের সামান্য কিছু ফিক্সড ডিপোজ়িট মর্টগেজ রেখে এত বড় লোন পেত না মিহিকা। ফাইনাল ডেকরেশনের কাজ প্রায় হয়ে এসেছে। দু’জন কুক আর এক জন বেয়ারার সঙ্গে কথা ফাইনাল হয়ে আছে, জুন মাস থেকে জয়েন করে যাবে তারা।

ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল উত্তীয়। অনেক কষ্টে গৌরগোপালকে ম্যানেজ করে বেরিয়েছে সে অফিস থেকে। আগের দিন খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল, আজও লেট হলে চাপে পড়ে যাবে সে।

মিহিকা তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, “কী হল? এখনই চলে যাবে উত্তীয়দা?”

উত্তীয় হাসল, “হ্যাঁ মিহিকা, এক বার অফিসে ঢুঁ মেরে তার পর বাড়ি ফিরব।”

উত্তীয় চলে গেলেও কাজ অবশ্য থেমে থাকল না। ফ্লেক্সের লোকটা এসেছিল, ফাইনাল ডিজ়াইনটা মিহিকা আর জীয়ন ঠিক করে নিল। লোকাল কেবল চ্যানেলের ছেলেটা এসে বকবক করে গেল কিছু ক্ষণ। তার বয়স বেশি নয়, বাবার ব্যবসায় এই বয়সেই নেমে গিয়েছে সে।

মিহিকার বয়সি মেয়ে নিজে ব্যবসা করতে চলেছে শুনে সে যারপরনাই বিস্ময় প্রকাশ করে এসেছে আগাগোড়া। আজও বিজ্ঞাপনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করতে করতে অনেক সময় নিয়ে নিল সে। বিজ্ঞাপনের থেকে মিহিকার দিকেই তার নজর বেশি। যাওয়ার আগে বার বার করে বলে গেল, যে কোনও প্রয়োজনে যেন মিহিকা তাকে ফোন করে। এই এলাকায় তার প্রতিপত্তি নেহাত কম নয়, বেশ কয়েক বার সে কথা মনে করিয়ে দিল ছেলেটি।

শাটারের লোকটা ঝোলাচ্ছে, এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ডেট ফেল করল সে। এ ভাবে কাচের দেওয়াল মোড়া দোকান ফেলে চলে যেতে প্রতিদিনই মন খুঁতখুঁত করে মিহিকার।

আজ ওদের কাছে চেনা বাহন ছিল না। জীয়নের বাইকের আজ ষাণ্মাসিক সার্ভিসিং। সাত সকালে বাইক সার্ভিস সেন্টারে দিয়ে সে মিহিকার সঙ্গে কাফেতে চলে এসেছে।

কাফেতে তালা ঝুলিয়ে ওরা বাসে চেপে প্রথমেই গেল সার্ভিস স্টেশনে। সেখানে ফর্মালিটি মিটিয়ে দু’জন যখন বাইরে বেরোল, তত ক্ষণে সন্ধের অন্ধকার বেশ গাঢ়। জায়গাটা বেশ নির্জন। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো বিগড়ে আরও বেশি নিঝুম হয়ে আছে চারপাশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement