স্মৃতিবাহী: নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি। চলছে প্রয়োজনীয় সংস্কারকার্য।
মাঝখানে সুরধুনী। দুই তীরে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দু’টি ইতিহাস। পূর্ব কূলে কাশীপুর উদ্যানবাটী। পশ্চিম কূলে বেলুড় মঠের অল্প দূরে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি। একটি বাড়ি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ ২৪৮ দিনের আশ্রয়স্থল। আবার অন্যটি রামকৃষ্ণোত্তর কালে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার ধারক ও বাহক। আজ ‘পুরনো মঠ’ নামে মহাতীর্থ। গঙ্গাতীরস্থ নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি তিন শতক ধরে দাঁড়িয়ে আছে জননী সারদা, ভগিনী নিবেদিতা, স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্যস্মৃতি আগলে। এই বাড়িতে বাস করে শ্রীমা আনন্দ পেয়েছেন বলে স্বামীজি বেলুড়ে শ্রীমায়ের জন্য একটি স্থান করার সঙ্কল্প করেছিলেন। এই বাগানবাড়ি এক কালে ছিল রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অস্থায়ী শিবির। স্বামীজির স্বপ্নের বেলুড় মঠ নির্মাণকালে এই বাগানবাড়িতে রামকৃষ্ণ মঠ ছিল সাড়ে দশ মাস (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ - ২ জানুয়ারি ১৮৯৯)। সেই সময়সীমার মধ্যেই নির্ধারিত হয়েছিল ভবিষ্যৎ বেলুড় মঠের গতিপ্রকৃতি।
নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের দোতলা বাগানবাড়িটির আদি মালিক ছিলেন এক জন ইংরেজ। ঊনবিংশ শতকের সত্তরের দশকে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় ওই বাড়ির মৌরসিপাট্টা লাভ করেন। নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন সে যুগের বিশিষ্ট আইনজীবী। থাকতেন কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। ১৮৬৭ সালে তিনি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হন। পরে সে রাজ্যের রাজস্ব সচিব, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদও লাভ করেন। কাশ্মীরে তাঁর একটি রেশমের কারখানাও ছিল। জম্মু-কাশ্মীরে প্রায় দু’ দশক কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। ১৮৯৬ সালে কলকাতা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং আঠারো বছর ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি যে সময়ে বেলুড়ের বাগানবাড়ির মৌরসিপাট্টা লাভ করেন, সে সময়ে বাড়ি সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল খুবই কম। তাই তিনি লালাবাবু সায়র রোডের উত্তরাংশে রাজেন্দ্রচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের থেকে ১ বিঘা ১৫ কাঠা ৪ ছটাক জমি কেনেন। স্বামী বিবেকানন্দের মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত সেই সময়কার বাগানবাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন, “তখন বাড়িখানি একতলা, শুধু সিঁড়ি দিয়া ছাদে উঠিবার স্থানটিতে একখানি ছোট ঘর এবং নীচেতে কয়েকটিমাত্র ঘর ছিল।... স্থানটি গঙ্গার ধারে, সামান্য ঘাসওয়ালা উঠান, পিছনে কিছু কলাগাছ ও সুপারিগাছ ছিল।... স্থানটি অতি নিরিবিলি ও সুরম্য।” পরবর্তী কালে কস্তুরীমঞ্জরী দাসী নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বাগানবাড়িটি কিনে নেন। কস্তুরীমঞ্জরীর পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ির মালিক হন তাঁর দৌহিত্র বিষ্ণুপ্রসাদ রায়। বিষ্ণুপ্রসাদ রায়ই বর্তমান বাগানবাড়ির রূপকার।
রামকৃষ্ণ মঠ স্থানান্তরিত হওয়ার আগেও শ্রীমা সারদা এই বাগানবাড়িতে এসে বেশ কয়েক বার থেকেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর শ্রীমা কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভিটেয় খুবই কষ্টে দিন কাটাতেন। তাঁর প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের আদেশ ছিল, “তুমি কামারপুকুরে থাকবে; শাক বুনবে, শাক-ভাত খাবে আর হরিনাম করবে।” তখন মা নিজের হাতে শাক বুনতেন, ছেঁড়া কাপড় গাঁট দিয়ে পরতেন। অভাবের কথা কাউকে বলতেন না। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য বলরাম বসুর গৃহিণী কৃষ্ণভাবিনী দেবী ও তাঁর শাশুড়ি মাতঙ্গিনী দেবী কামারপুকুরে গিয়ে মায়ের দুরবস্থা চাক্ষুষ করেন এবং কলকাতায় ফিরে ভক্তমহলে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করেন। তার পর থেকে ভক্তেরা উদ্যোগী হয়ে শ্রীমাকে মাঝে মাঝে কলকাতায় এনে রাখতেন। তখন বাগবাজারে মায়ের নিজের বাড়ি গড়ে ওঠেনি। হাওড়া ও কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বাড়ি ভাড়া করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হত।
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ির একাংশ শ্রীমায়ের ব্যবহারের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়। সম্ভবত মে মাসের মাঝামাঝি শ্রীমা বাগানবাড়িতে প্রথম পদার্পণ করেন। ছিলেন প্রায় ছ’মাস। থাকতেন দোতলার উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটিতে। তাঁর সঙ্গে থাকতেন শ্রীমায়ের দুই সঙ্গিনী যোগীন-মা ও গোলাপ-মা। এই বাড়িতে শ্রীমা থাকেন সব মিলিয়ে প্রায় দেড় বছর। সে সময়ে তাঁর থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করতেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। পরবর্তী কালে শ্রীমা ভক্তদের বাড়িটি সম্পর্কে বলেছিলেন, “আহা! বেলুড়েও কেমন ছিলুম। কি শান্ত জায়গাটি, ধ্যান লেগেই থাকত। তাই ওখানে একটি স্থান করতে নরেন ইচ্ছা করেছিল।”
এক দিন সন্ধ্যায় এই বাড়ির ছাদে ধ্যান করতে করতে শ্রীমায়ের নির্বিকল্প সমাধি হয়। তখন শ্রীমা, যোগীন-মা এবং গোলাপ-মা তিন জনেই ধ্যানস্থ। যোগীন-মার ধ্যান আগে ভাঙে। তিনি দেখেন, শ্রীমা নিঃস্পন্দ, সমাধিস্থ। বেশ কিছু সময় পর শ্রীমা অর্ধবাহ্যদশায় নেমে এসে বলতে লাগলেন, “ও যোগেন, আমার হাত কই, পা কই?” দুই সঙ্গিনী মায়ের হাত-পা টিপে দিতে দিতে বলেন, “এই যে পা, এই যে হাত ।”
১৮৯৩ সালে এই বাগানবাড়িতেই শ্রীমায়ের পঞ্চতপা ব্রত অনুষ্ঠিত হয়। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর মায়ের মনে তখন তীব্র বৈরাগ্য। জানা যায়, সেই সময়ে তিনি দেখতে পেতেন একটি কিশোরী গেরুয়া বস্ত্র, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। যেন তাঁর অন্তরের তীব্র বৈরাগ্যই এই বালিকা মূর্তি ধরেছে। সেই সঙ্গে জানা যায়, ঠাকুরের দেহরক্ষার পর এক প্রাচীন সন্ন্যাসী তাঁকে পঞ্চতপা করার কথা প্রায়ই বলতেন। পরে কাশী ভ্রমণের সময় এক নেপালি সন্ন্যাসিনী তাঁকে বলেছিলেন, “মাঈ, পঞ্চতপা করো।” এ সব দেখে শ্রীমায়ের উপলব্ধি হয় শ্রীরামকৃষ্ণই নানা রূপে নানা ভাবে তাঁকে পঞ্চতপা করতে আদেশ দিচ্ছেন। বাগানবাড়িতে থাকার সময় শ্রীমায়ের মনে সে ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন যোগীন-মা বলেন, “বেশ তো মা, আমিও করব।”
বাগানবাড়ির পশ্চিমে ইংরেজি ‘এল’ আকারে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত যে ঘরটির গা দিয়ে বর্তমানে দোতলার সিঁড়ি উঠে গিয়েছে, সেটিই ছিল অস্থায়ী রামকৃষ্ণ মঠের রান্নাঘর ও ভাঁড়ার। সেই ঘরের ছাদে মা পঞ্চতপা করেন। ছাদের উপর মাটি ফেলে তার পাঁচ হাত অন্তর ঘুঁটে দিয়ে চারটি আগুন জ্বালানো হয়। আকাশে পঞ্চম অগ্নি রূপে অবস্থান করছিল গ্রীষ্মের মার্তণ্ড! এই সম্বন্ধে স্বয়ং মা সারদামণি জানিয়েছেন, “প্রাতে স্নান করে কাছে গিয়ে দেখি আগুন গম গম করে জ্বলছে। প্রাণে বড়ই ভয় হল, কী করে ওর ভিতর যাব, আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে বসে থাকব! পরে ঠাকুরের নাম করে ঢুকে দেখি আগুনের কোন তেজ নেই।” সূর্যাস্তের পর যখন সন্ধ্যা নামল, তখন শ্রীমা ও যোগীন-মা সেই আগুনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। এই ভাবে সাত দিন ধরে শ্রীমা যোগীন-মার সঙ্গে উদয়াস্ত তপস্যা করেন। শ্রীমায়ের জীবনীকার স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখেছেন, পঞ্চতপা করার পর শ্রীমায়ের “শরীর ঝলসিয়া অঙ্গারবর্ণ হইল। তখন মনের আগুন অনেকটা নিভিল; গৈরিক পরিহিতা কিশোরীও চিরদিনের মতো বিদায় লইল।” বর্তমানে ওই ছাদের উপর সেই ঘটনার স্মৃতিরক্ষা করা হয়েছে।
শ্রীমা আরও জানিয়েছেন যে, বাগানবাড়িতে থাকার সময় তিনি নানা রকম দিব্যদর্শন পেতেন। বাগানবাড়ির স্নানের ঘাটে বসেই তিনি দেখেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ভবিষ্যৎ। সে দিন ছিল পূর্ণিমা। সন্ধ্যাবেলা। শ্রীমা ঘাটের সিঁড়িতে বসে মুগ্ধনেত্রে চন্দ্রালোকিত গঙ্গার শোভা উপভোগ করছেন। হঠাৎ দেখেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তরতর করে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে গঙ্গায় নেমে গেলেন। তাঁর দিব্যদেহ গঙ্গাবারিতে গলে মিশে গেল। হঠাৎ কোথা থেকে স্বামীজি এসে ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলতে বলতে দু’হাত দিয়ে সেই পবিত্র জল চার দিকে ছিটিয়ে দিচ্ছেন এবং সেই জলস্পর্শে অগণিত নরনারী মুক্তিলাভ করছে। সেই ঘাট এখন ‘শ্রীমায়ের ঘাট’ নামে সন্ন্যাসী ও ভক্তদের কাছে তীর্থস্বরূপ। ১৯৯১ সালে এই সুপ্রাচীন ঘাট স্থান পেয়েছে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সৌধের তালিকায়।
১৮৮৮ সালের শেষে বা ১৮৮৯ সালের গোড়ায় স্বামী অভেদানন্দ শ্রীমায়ের জগদ্বিখ্যাত স্তোত্র ‘প্রকৃতিং পরমাং অভয়াং বরদাং’ রচনা করে এই বাগানবাড়িতে বসেই স্বকণ্ঠে শ্রীমাকে শুনিয়েছিলেন। শ্রীমা তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “তোমার মুখে সরস্বতী বসুক।” ১৮৮৮ সালে এই বাড়িতেই কথামৃতকারের স্ত্রী নিকুঞ্জদেবী শ্রীমার কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা নিয়েছিলেন। শ্রীম এখানে বসে কথামৃতের পাণ্ডুলিপির কতকাংশ শ্রীমাকে পড়ে শুনিয়ে তাঁর অনুমোদন ও আশীর্বাদ লাভ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহরক্ষার পর স্বামীজি ও তাঁর গুরুভাইরা আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাসগ্রহণ করে বরাহনগর মঠে থাকতেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে মঠ বরাহনগর থেকে আলমবাজারে চলে আসে। ১২ জুন ১৮৯৭ তারিখে একটি ভয়ানক ভূমিকম্পে আলমবাজারের মঠবাড়িটি ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। তখন মঠবাসীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল, দেখা দিচ্ছিল তাঁদের বসবাসের উপযুক্ত স্থানের অভাব। এ ছাড়াও শ্রীরামকৃষ্ণের অস্থিকে গঙ্গাতীরে প্রতিষ্ঠা করতে স্বামীজি ছিলেন উদ্গ্রীব। স্বামীজির স্বপ্ন সত্যি হল ১৮৯৮ সালে। ৩ ফেব্রুয়ারি ১,০০১ টাকা দিয়ে বর্তমান বেলুড় মঠের জমির বায়না করা হয় এবং ৪ মার্চ স্বামীজির শিষ্যা মিস হেনরিয়েটা মুলারের দেওয়া ৩৯,০০০ টাকা দিয়ে ছোট দুটো বাড়ি সমেত বাইশ বিঘা জমি কেনা হয় পটনানিবাসী ভাগবৎ নারায়ণ সিংহের কাছ থেকে। মঠ-বাড়ি নির্মাণের তদারকির জন্য তখন নির্বাচিত জমির কাছে দক্ষিণ দিকে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি আবার মাসিক ৮৫ টাকায় ভাড়া নেওয়া হল। আলোচ্য বছরটির ফেব্রুয়ারি মাসে মঠ আলমবাজার থেকে উঠে এল বাগানবাড়িতে। এপ্রিল মাস থেকে প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার স্বামী বিজ্ঞানানন্দের তত্ত্বাবধানে শুরু হল নতুন জমিতে মঠের নির্মাণকাজ।
এই সময়ে এক দিন স্বামী যোগানন্দ, ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল এবং গোলাপ-মায়ের সঙ্গে শ্রীমা বাগানবাড়িতে এলেন। শ্রীমায়ের নৌকা বাগানবাড়ির ঘাটে লাগতেই শঙ্খধ্বনি হল। সন্ন্যাসীরা তাঁর চরণ ধুইয়ে ঠাকুরঘরের দালানে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ঠাকুরঘরে গিয়ে শ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণের পুজো করলেন। তার পর দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রামের পর স্বামী ব্রহ্মানন্দের অনুরোধে গেলেন মঠের নতুন জমিতে পদধূলি দিতে। ১৯০১ সালে প্রথম বার বেলুড় মঠে অনুষ্ঠিত দুর্গোৎসবে যোগদানের জন্য শ্রীমা পুজোর ক’দিন বাস করেন বাগানবাড়িতে। আবার ১৮৯৮ সালের ২৫ মার্চ বাগানবাড়িতে সৃষ্টি হল আর একটি ইতিহাস। সে দিন ভারতবর্ষে নবাগত মিস মার্গারেট নোবলকে স্বামীজি ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করলেন। ওই দিন সকালে মার্গারেট বাগানবাড়িতে এলে স্বামীজি তাঁকে ঠাকুরঘরে নিয়ে যান এবং তাঁকে শিবপুজো শেখান। তার পর দীক্ষিত করেন ব্রহ্মচর্যব্রতে। দীক্ষান্তে মার্গারেটের নাম হল ‘নিবেদিতা’। সে দিন আবেগভরা কণ্ঠে স্বামীজি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠা শিষ্যাকে আদেশ দিয়েছিলেন, “যাও, যিনি বুদ্ধত্বলাভের পূর্বে পাঁচশত বার অপরের জন্য জন্মগ্রহণ ও প্রাণ বিসর্জন করেছিলেন, সেই বুদ্ধকে অনুসরণ করো।” জানা গিয়েছে, সেই ঐতিহাসিক ঠাকুরঘরটি ছিল বাগানবাড়ির পশ্চিমে ছোট খোলা মাঠের ওপর। গোলপাতার ছাউনি, মেঝে ও দেওয়াল পাকা সিমেন্ট করা। বর্তমানে অবলুপ্ত।
কোলাহলমুখর আলমবাজার থেকে খোলামেলা, নির্জন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে মঠ স্থানান্তরিত হওয়ার পর স্বামীজি খুবই খুশি হয়েছিলেন। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বাড়িটির প্রশংসা করে বলেছিলেন, “দেখ দেখি কেমন গঙ্গা, কেমন বাড়ি! এমন স্থানে মঠ না হলে কি ভাল লাগে?” বাগানবাড়িটি স্বামীজির কত পুণ্যস্মৃতি আজও সযত্নে আগলে রেখেছে। ১৮৯৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি মহোৎসব আয়োজিত হয়েছিল এই বাড়িতেই। উৎসব উপলক্ষে মঠে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল। সন্ন্যাসীরা স্বামীজিকে মনের সাধে যোগী সাজালেন— “কর্ণে শঙ্খের কুণ্ডল, সর্বাঙ্গে কর্পূরধবল পবিত্র বিভূতি, মস্তকে আপাদলম্বিত জটাভার, বামহস্তে ত্রিশূল, উভয় বাহুতে রুদ্রাক্ষবলয়, গলে আজানুলম্বিত ত্রিবলীকৃত বড় রুদ্রাক্ষমালা।” যেন সাক্ষাৎ মহাদেব! পদ্মাসনে বসে অর্ধনিমীলিতনেত্রে স্বামীজি ‘কুজন্তং রামরামেতি’ স্তবটি মধুর স্বরে পাঠ করলেন। কণ্ঠে কেবল ‘রাম রাম শ্রীরাম রাম’ ধ্বনি। গাইলেন ‘সীতাপতি রামচন্দ্র রঘুপতি রঘুরাই’ গানটি। শুনে সকলেই মুগ্ধ। তার পর স্বামীজি নিজের বেশভূষা খুলে ভক্ত গিরিশচন্দ্রকে সাজিয়ে দিয়ে বললেন, “পরমহংসদেব বলতেন, ইনি ভৈরবের অবতার। আমাদের সঙ্গে এঁর কোনও প্রভেদ নেই।” ইতিমধ্যে স্বামী অখণ্ডানন্দ মুর্শিদাবাদ থেকে দু’টি পেল্লায় সাইজের ছানাবড়া নিয়ে বাগানবাড়িতে উপস্থিত। জানা গেল, শ্রীরামকৃষ্ণকে নিবেদন করার জন্য বহরমপুরের জনৈক জমিদার ছানাবড়া দু’টি তৈরি করে পাঠিয়েছেন। রস-সমেত দু’টির ওজন এক মন চোদ্দো সের।
এই বাড়িতেই স্বামীজির কলম থেকে জন্ম নিয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের আরাত্রিক ভজন ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’। ঠাকুরের জন্মতিথির দিনেই বাগানবাড়িতে ভজনটি সর্বপ্রথম গাওয়া হয়। স্বামী শিবানন্দ জানিয়েছেন, “স্বামীজি নিজে ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’ এই স্তবটি রচনা করলেন, তাতে সুর দিলেন এবং সকলকে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন।… সে কি অদ্ভুত দৃশ্য!” এখানেই স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের দু’টি স্তব ‘ওঁ হ্রীং ঋতং’ এবং ‘আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ঃ’ রচনা করেন।
বাগানবাড়িতে স্বামীজি বাস করেছেন ৩ মাস ২৮ দিন। সেই সময়সীমার মধ্যেই স্বামীজি গ্রহণ করেছিলেন নতুন মানুষ ও সন্ন্যাসী গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত কর্মসূচি। লিখেছিলেন ‘বেলুড় মঠের নিয়মাবলি’। বাগানবাড়িতে বসবাসকারী নবীন, প্রবীণ সকল মঠবাসীকেই বেঁধে দিয়েছিলেন নিয়মশৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে। মঠবাসীদের দৈনন্দিন কর্মসূচি ছিল, সূর্যোদয়ের আগে শয্যাত্যাগ, সকাল-সন্ধ্যায় এক ঘণ্টা করে জপ-ধ্যান, তার পর স্তব পাঠ, নবীনদের জন্য ‘ডেল সার্ট’ নামক শরীরচর্চা ও দুপুরে বিশ্রামের পর পড়াশোনা, সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের আরতি ও ধ্যান-জপ শেষে প্রশ্নোত্তরের ক্লাসে যোগদান। একতলার বৈঠকখানা ঘরে প্রশ্নোত্তরের আসর বসত। এই ঘরের উপরের ঘরটি ছিল লাইব্রেরি ও সাধু-ব্রহ্মচারীদের ক্লাসরুম। ভজন, কীর্তন ইত্যাদির আসর বসত নীচে পূর্ব দিকের বারান্দায়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দের জন্যেও নির্দিষ্ট ছিল ছোট এক-একটি ঘর। স্বামী ব্রহ্মানন্দের ঘরটি ছিল মঠের অফিস। দোতলার সর্বদক্ষিণের ঘরটি ছিল স্বামীজির জন্য নির্দিষ্ট।
১৮৯৮-এর অক্টোবরে স্বামীজি অমরনাথ, ক্ষীরভবানী দর্শন সেরে বাগানবাড়িতে ফিরেছেন। কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলেন না, সারা ক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। শরচ্চন্দ্র বাগানবাড়িতে এসে দোতলার ওই ঘরে গিয়ে দেখেন, “স্বামীজি মুক্তপদ্মাসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়া আছেন, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন, মুখে হাসি নাই, প্রদীপ্ত নয়নে বহির্মুখী দৃষ্টি নাই, যেন ভিতরে কিছু দেখিতেছেন।” শরচ্চন্দ্রকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এসেছিস বাবা, বোস।” স্বামীজির বাম চক্ষু রক্তবর্ণ। শিষ্যকে বললেন, “অমরনাথ দর্শনের পর হতে আমার মাথায় চব্বিশ ঘণ্টা যেন শিব বসে আছেন, কিছুতেই নামছেন না।”
ঠাকুরঘরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। স্বামী প্রেমানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের আরতি করছেন। সেই সময় ঘরের জানলা দিয়ে গঙ্গা দেখতে দেখতে স্বামীজি প্রফুল্ল কণ্ঠে বলছেন, “এমন জায়গা ছেড়ে তুই কি না কলকাতায় যেতে চাস। এখানে কেমন পবিত্র ভাব, কেমন গঙ্গার হাওয়া, কেমন সব সাধুর সমাগম! এমন স্থান কি আর কোথাও খুঁজে পাবি?”