মেধাবী: মেধাবী: নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ছবি: গেটি ইমেজেস।
গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম দিক এমন একটা সময়, যখন সকালে খবরের কাগজ খুললেই মনে হত, এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল বলে। লড়াইয়ের এক দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, অন্য দিকে সংযুক্ত সোভিয়েট রিপাবলিকের নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভের চেয়ে কেনেডি ২৩ বছরের ছোট। যদিও ক্রুশ্চেভ বলতেন, ‘আমার পুত্রসম কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে খুব খারাপ লাগে’, তবু বিশ্বযুদ্ধের ভয়টা যেত না।
বিশ্ববাসীর কাছে ক্রুশ্চেভের পরিচয় রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ। আমাদের আলোচনা রাজনীতিবিদ ক্রুশ্চেভকে নিয়ে নয়, তাঁর মেধা এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ে, যা দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ অচেনা এক সমস্যারও সমাধান করেছিলেন। নিকিতার জন্ম ইউক্রেন সীমান্তের এক অতি দরিদ্র কৃষক পরিবারে। আর্থিক অভাবে তাঁর লেখাপড়ায় বার বার ছেদ পড়ে। একটু বড় হয়ে খনির কাজ করে পেট চালাতেন। তরুণ বয়সে তিনি হয়ে উঠলেন ধাতু নিয়ে কাজের এক সুদক্ষ কর্মী। পরবর্তী কালে ধাতুবিদ্যা নিয়েই তিনি লেখাপড়া করেন।
১৯৩৯ সালের কথা। নিকিতা ক্রুশ্চেভের বয়স তখন ৪৫। তখন তিনি সোভিয়েট ইউনিয়নের উচ্চ পদাধিকারী— পলিটব্যুরোর পূর্ণ সদস্য ও ইউক্রেন কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি। খনিতে, কারখানায় কাজ করা শ্রমিক, সৈনিক, ম্যানেজার, রাজনৈতিক কর্মী— বহু অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ এক মানুষ। মস্কো শহরের পুনর্নির্মাণ ও মস্কো মেট্রো তৈরির কাজে তিনি ছিলেন নেতৃত্বে। তাঁর কর্মস্থল ছিল মস্কো থেকে প্রায় আটশো কিলোমিটার দূরে কিয়েভে। সরকারি কাজে ক্রুশ্চেভকে প্রায়ই মস্কো থেকে কিয়েভ যাতায়াত করতে হত। গাড়িতেই যাতায়াত, কারণ ব্যয় সঙ্কোচনের উদ্দেশ্যে স্তালিন উচ্চপদাধিকারীদের প্লেনে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তাঁর এই যাত্রাপথের সঙ্গী ছিল তাঁর বিশ্বস্ত ড্রাইভার আলেকজ়ান্ডার জুরাভলেভ।
এক দিন যাত্রাপথে জুরাভলেভ ক্রুশ্চেভকে কথায় কথায় বললেন, ‘যে সব টায়ার আমাদের দেওয়া হচ্ছে সেগুলো বড় তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যাচ্ছে, গায়ে ফোস্কার মতোও পড়ছে। অথচ টায়ারগুলো একেবারে নতুন।’
ক্রুশ্চেভ দেখলেন এ তো অপচয়! অপচয় তিনি একদম পছন্দ করতেন না। তিনি কথাটা পেড়ে বসলেন সোজা স্তালিনের কাছে। স্তালিন ক্রুশ্চেভকে বললেন, ‘তুমি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখো।’
ক্রুশ্চেভ কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘টায়ার ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে আমার তো কোনও ধারণাই নেই।’
স্তালিনও ছাড়ার পাত্র নন, স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘ধারণা নেই তো কী হয়েছে, ধারণা তৈরি করো।’
ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে টায়ারের গুণমান উন্নতির জন্য একটি কমিটিও গঠিত হল। কমিটির কয়েকটা মিটিংয়ের পর, স্তালিনের কাছে পেশ হল রিপোর্ট। তার ভিত্তিতে ক্রুশ্চেভের প্রতি নির্দেশ এল— দেশের সবচেয়ে নামী টায়ার উৎপাদনকারী ইয়ারোস্লাভাল কোম্পানির কারখানা পরিদর্শন করতে হবে।
ক্রুশ্চেভের কারখানা পরিদর্শন শুরু হল একেবারে উৎপাদনের জায়গা থেকে। তিনি দেখলেন টায়ারের মধ্যে পর পর বসানো রাবারের স্তরবিন্যাস এবং ধাতব সরু সুতোর অবস্থান। তাঁর মনে হল, ধাতব সরু সুতোগুলো বড় বেশি সরু, অবিন্যস্ত ভাবে লাগানো। শুধু তা-ই নয়, চলাচলের ধাক্কা সহ্য করার জন্য যত সুতো দরকার, তার চেয়ে অনেক কম সুতো ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইয়ারোস্লাভাল কারখানা এক আমেরিকান কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছিল। ক্রুশ্চেভ প্রথম অনুসন্ধান করতে শুরু করেন, আমেরিকানরা কী ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে শিখিয়েছিল এবং বর্তমানে রাশিয়ান কারখানায় অনুসৃত প্রক্রিয়া তার চেয়ে আলাদা কি না। ক্রুশ্চেভের সন্দেহ ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়েছিল।
জানা গেল, কিছু দিন আগে সোভিয়েট ইউনিয়নের যানবাহন দফতরের তৎকালীন প্রধান লাজার কাগানোভিচ এই কারখানা পরিদর্শনে এসে উৎপাদন প্রক্রিয়া খুঁটিয়ে দেখেন এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন। খরচ কমানোর জন্য তিনি নির্দেশ দেন, টায়ারে ব্যবহৃত ধাতব সুতোর ব্যাস কমাতে হবে এবং কম সংখ্যায় এই সুতো ব্যবহার করতে হবে। এর ফলাফলকে এক দারুণ অগ্রগতি হিসেবে দেখানো হল এবং আমেরিকানদের চেয়ে রাশিয়ানরা বেশি উৎপাদনক্ষম মনে করে জাতিকে বিরাট আত্মশ্লাঘা উপহার দেওয়ার চেষ্টা হল। কাগানোভিচের আদেশ অনুসরণ করে উৎপাদনশীলতাই কর্মীর কুশলতার পরিমাপ, এই চিন্তাধারা প্রধান হয়ে ওঠে। তাঁর পরামর্শে কোম্পানিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এক ‘সম্মান বোর্ড’ টাঙাবার ব্যবস্থা করা হল। সেই বোর্ডে সেই কর্মীর ছবি লাগানো হত, যিনি সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করেছেন। উৎপাদনসর্বস্ব ব্যবস্থায় তিনি যে গুণমানের প্রশ্নে বিরাট আপস করে বসলেন, সেটা কারও নজরে এল না। কম খরচে প্রচুর উৎপাদন করতে গিয়ে গুণমান তলানিতে গিয়ে ঠেকল।
ক্রুশ্চেভের কমিটি সুপারিশ করল, আগের উৎপাদন পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হবে, কারণ অধিক উৎপাদন টায়ারের আয়ু শতকরা নব্বই ভাগ কমিয়ে দিয়েছে। কমিটির সুপারিশ স্তালিন গ্রহণ করলেন, পাশাপাশি ওই ‘সম্মান বোর্ড’ও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন।
আগের প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়ার ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল। কারখানাগুলো আবার টেঁকসই টায়ার তৈরি করা শুরু করল। টায়ারের আয়ু মাপার পরীক্ষা চালানো হল এবং যে কারখানার টায়ার আয়ু মাপার পরীক্ষায় ভাল ফল করল, তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা চালু হল। এই ঘটনা সমগ্র রাশিয়ার শিল্পায়নের উদ্যোগে এক বিশাল প্রভাব ফেলল। উৎপন্ন দ্রব্যের গুণমান যে সবার আগে বিবেচনা করা দরকার, সেটা সকলে মেনে নিলেন।
এখন আর ক্রুশ্চেভও নেই, সেই সোভিয়েট রাশিয়াও নেই। ক্রুশ্চেভের মতো এক জন বুদ্ধিমান দেশপ্রেমিককে ইতিহাস যদি শুধু এক রাজনীতিবিদের পরিচয়ে মনে রাখে, তা হলে সেটা ন্যায়সঙ্গত হবে না। দেশের জন্য, দলের জন্য যে কোনও কাজে এগিয়ে যেতে কখনও দ্বিধা করেননি এই মানুষটি।