আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে।
আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভুবি।।
(পৃথিবীতে এ ইতিহাস অতীতের কবিরা বলেছেন, এখনও অন্য কবিরা বলছেন, ভবিষ্যতেও বলবেন।)
১
“পিতামহ! পিতামহ!”
কোলাহল করে দৌড়ে আসছে নবীন কুমারেরা। কুরুকুলর্ষভ শান্তনব ভীষ্মের চিন্তাজাল ছিন্ন হল, তিনি গবাক্ষ দিয়ে তাকালেন।
কাকতালীয় বটে। এই কৌরব-বালকদের নিয়েই তো তাঁর ভাবনা আবর্তিত হচ্ছিল এইমাত্র!
দিনের শেষ প্রহরে নির্জনে যখনই উপবিষ্ট হন, সচরাচর দুই ধরনের চিন্তনস্রোত তাঁর মনোভূমি প্লাবিত করে। হয় পূর্বকথা-রোমন্থন, নয় অনাগত ভবিষ্যতের জল্পনা। পূর্বস্মৃতি যখন গ্রাস করে, গাঙ্গেয়র ভ্রুযুগল ঈষৎ ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়। আয়ত লোচনগুলিতে কিঞ্চিৎ ঔদাস্য আসে, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলে এক বিষণ্ণ-মধুর অন্যমনস্কতা। দীর্ঘ বিসর্পিল জীবনমার্গের দুই ধারে কত বহুবর্ণিল অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে রইল, কত তীব্র-মৃদু আনন্দ-বেদনা, কত ফলবান কীর্তি আর ম্লান অচরিতার্থতার আলোক-প্রচ্ছায়া!... আর, যখন সম্মুখের দিনগুলির কথা ভাবেন, অজ্ঞাত ভবিষ্যতের ঘনান্ধকারেই অভাবিতপূর্ব ঘটনামালার সম্ভাব্য রূপরেখা কল্পনা করতে চান— তখন প্রশস্ত ললাটে গভীর কয়েকটি রেখা ফুটে ওঠে। চক্ষু কুঞ্চিত, ওষ্ঠাধরে দন্তের পেষণ এসে বসে অজান্তেই। শ্বাস ঘন হয়। অনিশ্চয়তা, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ! হ্যাঁ, মহান কুরুবংশের ভবিষ্যৎ দেবব্রতকে উদ্বিগ্ন করে।
ওই যে, প্রাকার-সংলগ্ন ক্রীড়ার অঙ্গন থেকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হয়ে আসছে কুরুকুলের ভবিষ্য। একবচন নয় যদিও। সংখ্যায় তারা শতাধিক!
বাতায়নের সন্নিকটে এসে পড়ছে তারা ক্রমশ। একশত পাঁচ। প্রায় একটি ছোটখাটো পদাতি-বাহিনীর সমান। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র, মৃত পাণ্ডুর পাঁচ। ধার্তরাষ্ট্র বলে যে শত বালকের পরিচিতি, তারা সকলেই গান্ধারীর গর্ভজাত নয় অবশ্য। একশত পুত্র কি আর বাস্তবে হয় কারও? ‘শতপুত্রের জননী হও’ এই আশীর্বচনও নিছক আলঙ্কারিক। প্রধানা রাজ্ঞীর নিজ-পুত্রদের সঙ্গে এই সমাবেশে অন্যান্য অনামা রানি, অন্তঃপুরিকা, আশ্রিতা তথা দাসীদের পুত্ররাও আছে— কিন্তু দলবৃদ্ধির জন্য রাজপরিবারের তরফে সকলকেই কৌরবকুমার, এমনকি সরাসরি গান্ধারীনন্দন বলেই ঘোষণা করা হয়েছে। এ এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত রাজপরিবারের। ‘রাজার একশত পুত্র’— এই প্রচারের মধ্যে রাজগরিমা তথা বংশপ্রতাপ বিকিরণের প্রয়াস! গৌরবে বহুবচন।
প্রাসাদ-রাজনীতি বড় বিচিত্র!
অবশ্য, কুরুকুলের ইতিবৃত্ত মন্থন করলে, বিচিত্র উপাদানের অভাব কোনও কালেই ছিল কি? অবাস্তব রটনা, অতিরঞ্জিত প্রচার, কুটিল রাজনীতি, গুপ্ত রহস্য! রাজ-শুক্রভুক মীনের গর্ভে কন্যার জন্ম; বিধবা রানিদের পুত্রোৎপাদনে সেই কন্যারই কানীন-পুত্রের নিয়োগ; রানিদের অসহযোগিতার কারণে অন্ধ ও নির্বীর্য রাজকুমারদ্বয়ের জন্ম; সেই নির্বীর্য পুরুষের পত্নীর আবার দেব-ঔরসে পুত্রলাভ...
স্বয়ং দেবব্রত গাঙ্গেয়র সঙ্গে জড়িত যে ইতিহাস, তাও কি কম রহস্য-অলৌকিকতায় মণ্ডিত? তাঁরই জননী নাকি একের পর এক সদ্যোজাত সন্তানকে স্বহস্তে নদীজলে নিমজ্জিত করে... কী অদ্ভুত অবিশ্বাস্য সব আখ্যান! অভিশাপ-আশীর্বাদ-দৈববাণী— অজস্র অতিপ্রাকৃতের আস্তরণে আবৃত ভীষ্মের জীবনকথা। প্রচারযন্ত্রের বিবিধ কূটকৌশল! প্রজাসাধারণও অলৌকিক-প্রসঙ্গের বিপুল ভক্ত; যেখানে যত বেশি অব্যাখ্যাত লোকাতীত রহস্যের ঘনঘটা, সেখানে তারা তত বেশি মোহিত, তত স্বতঃস্ফূর্ততায় নতজানু।
বৈমাত্রেয় ভ্রাতা, বেদ-বিন্যাসকারী মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, সম্প্রতি এসেছিলেন দেবব্রতর সকাশে। এই ভরতবংশের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তিনি একটি মহা-আখ্যানকাব্য রচনার পরিকল্পনা নিয়েছেন। একেবারে সেই পুরুবংশজ চেদি-নরপতি উপরিচর বসু যে বৃত্তান্তের উৎসমুখ, সেই প্রগাঢ় অতীত থেকে শুরু করে ‘ভারতানাং মহজ্জন্ম’— সমস্ত মহান ভরতবংশীয়ের জন্ম ও কীর্তিগাথা। সঙ্গে থাকবে দূরতর আদিকালের বিবিধ উপকাহিনিও। ব্যাসের শিষ্যমণ্ডলী তাঁকে এই বিপুল কর্মযজ্ঞে সহায়তা করবেন, তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। এই দ্বৈপায়ন বেদব্যাস এক যুগপুরুষ। ইনি পরাশর-তনয়, সাক্ষাৎ ভরতকুলজাত নন, তবু পৌরব-ইতিকথার এক অবিচ্ছেদ্য স্তম্ভবিশেষ। বস্তুত এই মুহূর্তে যে বংশধারাটি প্রবহমান, তা দ্বৈপায়নেরই দান। যে আখ্যানটি রচিত হতে চলেছে, তার কুশীলবদের মধ্যে তিনি নিজেও অন্যতম।
আলোচনাসূত্রে সেই মহাত্মাও কুরু-বৃত্তান্ত নিয়ে এই বিস্ময়ই ব্যক্ত করছিলেন। বিস্ময় স্বাভাবিক। শুধু তো কাহিনি-আখ্যান নয়, তাঁর পরিকল্পিত জয়-কাব্যে ব্যাস বিধৃত রাখতে চান আর্যসমাজে প্রচলিত তাবৎ দর্শন, বিশ্বাস, নীতি, শ্রুতি, দীক্ষা, চিন্তার এক সামগ্রিক অবয়ব। একটি বহুবিস্তারী মহা-দর্পণ! ব্যাস স্বয়ং বলছিলেন, কর্মে প্রবৃত্ত হয়েই তিনি উপলব্ধি করেছেন, কী বিচিত্র জটিল গতি এই ভারতেতিবৃত্তের! মহাকালের কত আশ্চর্য ইঙ্গিতে বারংবার দিক পরিবর্তিত হচ্ছে ঘটনাধারার... কৃষ্ণ-যবনিকার অন্তরালে আরও কত
মহানাট্য অপেক্ষমাণ!
ভীষ্ম নিজেকে ভাবনা-বীতংস থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন সচেতন প্রয়াসে। এই মুহূর্তে তিনি কেবল বর্তমানে নিবদ্ধ থাকতে আগ্রহী। নিরীক্ষণ করছিলেন তিনি, সব ক’টি বালককে। এমনটি গাঙ্গেয় প্রায়শই করেন, মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিতে চান প্রতিটি কুমারের চলন-বলনের ভঙ্গি, একক অথবা যৌথ কার্যকলাপের বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব-বিকাশের বিচিত্র স্তরগুলি। সতর্ক দৃষ্টি রাখাই আবশ্যক, কারণ এরাই মহান কৌরবসাম্রাজ্যের রক্ষক
হবে ভবিষ্যতে।
রক্ষক? না কি, বিনাশক?
ধাবমান রাজকুমারদের মধ্যে ওই যে সর্বাগ্রগামী ঋজু বলশালী দর্পিত কিশোর— রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন— ওর জন্মকালেই না দেখা গিয়েছিল বিবিধ দুর্লক্ষণ! মন্ত্রী বিদুর কী সব জ্যোতিষ-গণনা করে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, এই পুত্র থেকে সর্বনাশ হবে পৌরবকুলের, রাজ্য রসাতলে যাবে, এই শিশুকে ত্যাগ করাই বিধেয়!... সত্য ছিল কি সেই ভবিষ্য-ভাষণ?
সুযোগ পেলেই গঙ্গানন্দন বারংবার অপাঙ্গে দুর্যোধনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে সংক্ষুব্ধ হয় তাঁর মন। কুশাঙ্কুরের মতো অন্তরের গহনে বিঁধে আছে বিদুরের অশুভ ঘোষণা। বংশনাশ... রাজ্যধ্বংস... অমঙ্গল...
বনবাস থেকে মৃত রাজা পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র নগরে ফিরে আসার পর থেকেই নানা কুটিল আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে প্রাসাদ-রাজনীতিতে। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন ভীষ্ম, নবাগত জ্ঞাতিভ্রাতাদের সঙ্গে রাজপুরীর কুরুকুমারদের সৌহার্দ গঠনের। তিনি সমদর্শী হতে চেয়েছিলেন। গুরু কৃপাচার্যের কাছে যেমন সমস্ত গান্ধারীতনয় একত্রে অস্ত্রবিদ্যা শেখে, কুন্তী-মাদ্রীর পুত্রদেরও জন্যও সেই ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কিন্তু জ্ঞাতি তথা সতীর্থ হয়েও পাণ্ডুনন্দনদের সঙ্গে ধার্তরাষ্ট্রদের সদ্ভাব স্থাপিত হয়নি। বিশেষত পাণ্ডুর দ্বিতীয় পুত্রটি— বলবান ও অতিকায় ভীমসেন— তাকে ঘিরে নানা সমস্যা। অভিযোগ, সে ক্রীড়াচ্ছলে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের নির্যাতন করে। গঙ্গাপুত্র স্বয়ং তাকে শাসন করবেন মনস্থ করেছিলেন, এমন সময় অকস্মাৎ আর এক নিদারুণ গুপ্তবার্তা আসে। দুর্যোধন নাকি প্রতিহিংসা-অভিলাষে ভীমকে বিষাক্ত মিষ্টান্ন খাইয়েছিল, ভাগ্যবশত কোনওক্রমে সে মৃত্যুমুখ থেকে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু পাণ্ডবপক্ষ থেকে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ মৌন অবলম্বন করা হয়েছিল, ফলে অভিযোগের অভাবেই আর অনুসন্ধান-বিচার ইত্যাদি সম্পাদন করা হয়ে ওঠেনি। কে জানে, সংবাদ আদৌ সত্য ছিল কি না!
হ্যাঁ, দুর্যোধন বেশ কোপন ও উদ্ধতস্বভাব, এ লক্ষ করেছেন গাঙ্গেয়। হয়তো বালকোচিত ক্রোধ ও চাপল্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু হঠকারিতা করেও থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে সমগ্র কুল ও রাজ্য ধ্বংস করে ফেলবে— এত গুরুতর কল্পনা কি এখন থেকেই করে ফেলা সমীচীন হবে? দাসীপুত্র বিদুর সত্যই এত অভ্রান্তদ্রষ্টা?
বিদুরকে ঘিরে সংশয় আছে অনেক। ভীষ্ম জানেন, ধর্মজ্ঞ হলেও বিদুর নিরপেক্ষ নন। বিধবা রাজ্ঞী কুন্তী এবং পাণ্ডুপুত্রদের একান্ত বিশ্বাসভাজন এবং অতি-মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী এই ক্ষত্তা। পার্বত্য বনবাসে পাণ্ডুর প্রথম পুত্র জন্মানোর সম্ভাবনা-বার্তা তিনিই এনে দিয়েছিলেন হস্তিনাপুর-রাজসভায়, এবং উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “কুরুবংশ শীঘ্রই যুবরাজ পেতে চলেছে!” আনন্দবার্তা, তবু ভীষ্মের যেন মনে হয়েছিল এর মধ্যে কোথাও একটা গূঢ় রাজনৈতিক অভিসন্ধি আছে মন্ত্রীর। প্রজন্মের প্রথম সন্তান কুন্তীরই হোক বা গান্ধারীর, পাণ্ডুপুত্রই যুবরাজ হোক বা ধৃতরাষ্ট্র-তনয়— প্রৌঢ়প্রায় দাসীপুত্র বিদুরের তা নিয়ে অতি-প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার কী আছে?
এ দিকে, এই আলোড়নের পরিণামেই সম্ভবত, অনতিপরেই ধৃতরাষ্ট্রের অন্তঃপুর থেকেও ঘোষিত হয় জ্যেষ্ঠ গান্ধারীপুত্রের জন্মসন্দেশ। অন্দরের জনশ্রুতি, যুধিষ্ঠিরের জন্মের সংবাদ আগে আসতে পারে গোপন সূত্রে এমন আভাস পেয়েই, পূর্ণগর্ভা রানি গান্ধারী ভিষক্দের নির্দেশ দেন— নির্ধারিত লগ্নের আগেই কৃত্রিম উপায়ে তাঁর পুত্রজন্ম ত্বরান্বিত করতে। ফলে, দুর্যোধনের জন্মের উৎসবও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়। তখনই বিপরীত দিক থেকে প্রচার ভেসে আসে, কুন্তীও তত ক্ষণে পুত্রবতী হয়েছেন। কার জন্ম আগে, কে প্রকৃত জ্যেষ্ঠ— যুধিষ্ঠির না দুর্যোধন— এ নিয়ে একটা বিসম্বাদও শুরু হয়েছিল প্রাসাদে ও রাজধানীতে। আর ঠিক তখনই বিদুর শৃগাল ও গর্দভের ডাক শুনতে পেয়ে জ্যোতিষ-গণনায় বসেন...
সময়-সংযোগগুলি কেমন বিভ্রান্তিকর, না? নানাবিধ বহুমাত্রিক জটিলতা নিহিত আছে চলমান ঘটনাবর্তের গভীরে!
আজকাল সব বিচার কেমন অনিশ্চিত বোধ হয়। যুক্তিগুলি বল্গাহীন তুরঙ্গের মতো ছুটে যেতে চায় ইতস্তত। যে স্বচ্ছ বুদ্ধি ও অমোঘ দূরদৃষ্টির জন্য গঙ্গাপুত্র বিশ্রুত ছিলেন, তা আজ মাঝে মাঝেই ধূমাচ্ছন্ন লাগে। বিদুর যা বলেছিলেন তা কি সত্য? এই প্রজন্মের হাতেই হবে বংশনাশ? সে নিয়তি কি স্বচক্ষে দেখে যেতে হবে কুরুন্যগ্রোধ ভারত-শিরোমণি ভীষ্মকে?
যদি বাস্তবিকই সত্য হয় হয় সে ভবিষ্যবচন, তবে সেই অমোঘ অন্তিম কত দূরে? তাঁর নিজের কতটুকু দুর্বিপাক-ভোগ জড়িত রয়েছে সেই চরম পরিণামের সঙ্গে? পিতৃ-আশীর্বাদে দেবব্রত ভীষ্মের করতলগত ইচ্ছামৃত্যু, এমনই জানে সকলে। সর্বব্যাপী বিনাশের আভাস আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করবেন বরং।
কিন্তু, সে কর্মই কি উপযুক্ত হবে হস্তিনা-ছত্রধর মহাভাগ শান্তনুনন্দনের? সেই পলায়নী পন্থা? তিনি যে মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে কথা দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রের রক্ষক হয়ে থাকবেন, বংশের সর্ব-অকল্যাণ রোধ করবেন। তবে? তরী নিমজ্জমান দেখেই নিষ্ক্রান্ত হওয়া তাঁর পক্ষে সমীচীন হবে, না বিপর্যয়-রোধে প্রবৃত্ত হওয়া?
“পিতামহ!” আবার এক তীক্ষ্ণ ডাক। অন্যমনস্ক ভীষ্ম আবার চকিত হলেন।
কৃষ্ণবর্ণ বালক, তৃতীয় কৌন্তেয়, যার নাম অর্জুন— সে-ই তিরবেগে সকলকে অতিক্রম করে গবাক্ষ ছুঁয়ে ফেলেছে। তার তরুণ কণ্ঠ উত্তেজনায় আরও শাণিত শোনাচ্ছে, সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “শীঘ্র আসুন, এক অদ্ভুত ব্যাপার!”
২
“কী ঘটেছে, বৎস?”
এক সঙ্গে কথা বলতে চায় অনেকে, কেউ ঘটনা বিবৃত করতে চায় তো কেউ কেবল বিস্ময়-প্রকাশে অধিক আগ্রহী, কেউ শুধুই পিতামহকে ডাকতেই অত্যুৎসাহী। দুর্যোধন কেবলই চেষ্টা করছে বাকিদের বক্তব্যে বাধা দিতে, সে-ই একা বলতে চায়; কনিষ্ঠ পাণ্ডব বালক সহদেব স্বর উচ্চগ্রামে তুলে তার এই প্রয়াসের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সব ক’টি কণ্ঠ মিলেমিশে দুর্বোধ্য কোলাহল। শুধু ‘কূপ’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘শর’, ‘আহার্য’ এমন সব অসংলগ্ন শব্দ শ্রুতিগ্রাহ্য হচ্ছে, সামগ্রিক অর্থ বোধগম্য নয়।
ভীষ্ম ঈষৎ কঠোরস্বরে বললেন, “কুমারগণ, গুছিয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের পক্ষে তোমরা যথেষ্ট বয়ঃপ্রাপ্ত। সমস্বরে কোলাহল কোরো না, কোনও একজন স্বচ্ছ ভাষায় ঘটনা বিবৃত করো।”
ভর্ৎসিত হয়ে সকলের মধ্যেই কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা-দোলাচল, তার মধ্যেই শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এল সৌম্যমুখ যুধিষ্ঠির। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্র— স্বর্ণাভ-গোধূম-বর্ণ ও মধ্যমদেহী এই কিশোরের প্রতিও কুরু-পিতামহের দৃষ্টি সজাগ। হিমালয়ের ঋষিরা বলেছিলেন, এই কুমার স্বয়ং ধর্মের অপত্য! হস্তিনা-সিংহাসনের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রজাবর্গের একটা বড় অংশ তাকে সমীহ করে, বিপ্রবর্গ ও পুরোহিতকুলের নয়নমণি সে, যদিও দুর্যোধনের পক্ষেও কিছু জনসমর্থন বর্ধমান বলে জানেন ভীষ্ম। নিরপেক্ষ তুলনা করে গাঙ্গেয়র কিন্তু যুধিষ্ঠিরকেই অধিকতর চক্রবর্তী-লক্ষণযুক্ত মনে হয়। বুদ্ধিমান অথচ চতুর নয়, আত্মবিশ্বাসী কিন্তু দুঃসাহসী নয়, সদা-বিনীত তবু চাটুভাষী নয়। তাকে সর্বপ্রথমে চোখে পড়বে না, কিন্তু চোখে পড়ার পর সে-ই সর্বাধিক মনোযোগ-সম্ভ্রম আকর্ষণ করবে— এমনই তার ধীরোদাত্ত বাচন ও সুবিবেচক আচার।
এত ক্ষণ সমাবেশের একেবারে সম্মুখবর্তী ছিল না যুধিষ্ঠির, কিন্তু এই মুহূর্তে বাকি সকলের দ্বন্দ্বের মধ্যে তাকেই স্থিতবুদ্ধি দেখাল। নম্র কিন্তু স্পষ্টস্বরে সে বলল, “হে মহাভাগ! আমরা প্রাকারের বাইরে গ্রামসংলগ্ন এক ভূমিতে কাষ্ঠ-বীটক নিয়ে ক্রীড়া করছিলাম, সহসা বীটকটি এক কূপে পড়ে যায়। কূপ শুষ্ক কিন্তু অতি সঙ্কীর্ণ, নীচে বীটক দেখা যাচ্ছিল কিন্তু সেখান থেকে উদ্ধার করা দুরূহ। আমরা নানা ভাবে প্রযত্ন করেও ব্যর্থ হচ্ছিলাম। এমত সময়ে সেখানে এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ উপস্থিত হলেন। তিনি আমাদের দুরবস্থা দেখে পরিহাস করলেন...”
ক্রমশ