আদিমুহূর্ত: মহাজগৎ তৈরি হওয়ার প্রথম সূত্রপাত বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের কম্পিউটার নির্মিত চিত্র
উনিশশো বিরানব্বই সাল। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজ থেকে কোচবিহার গিয়েছি তিন বিঘা হস্তান্তর কভার করতে। তিন বিঘা করিডর সামান্য এক ফালি রাস্তা। মাপে জায়গা বেশি হবে না। কিন্তু ভারত ভাগের সময় মানচিত্র এমন হয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা যেতে অনেক ঘুরপথ হত। অথচ, ওই করিডর ধরে এগোলে পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা সহজে যাতায়াত করতে পারবেন। ওই করিডরটুকু ভারতের মধ্যে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলায় অন্তর্গত। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী এবং শেখ মুজিবর রহমানের যে চুক্তি হয়, তাতে ওই করিডর বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা হয়। বাংলাদেশ এ নিয়ে লাগাতার দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে ঠিক হয়, দিনের কোনও কোনও সময় বেড়া দিয়ে ঘেরা ওই করিডর খুলে দেওয়া হবে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য। তাঁরা ওই পথে দেশের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের অন্য সময় ওই করিডর ওদের কাছে বন্ধ।
নয়াদিল্লিতে তখন পামুলাপারতি ভেঙ্কট নরসিংহ রাও-এর কংগ্রেস সরকার। আর পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। বামফ্রন্টের শরিক হয়েও আরএসপি দলের যতীন চক্রবর্তী খেপে উঠলেন তিন বিঘা করিডর খুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে। তবে, সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিল যে দল, তার নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। দেশপ্রেম যে দলের পয়লা নম্বর স্লোগান। এই দলের প্রথম সারির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই তখন কোচবিহারে আসতেন। করিডর খুলে দেওয়ার সময় যেমন এসেছিলেন মুরলী মনোহর জোশী। বিজেপির প্রেস কনফারেন্সে প্রধান বক্তা তিনি। এই জোশী পরে অটলবিহারী বাজপেয়ী নয়াদিল্লিতে সরকার গড়লে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হয়েছিলেন। আগের জমানা হলে ওই দফতরের দায়িত্বে থাকতেন শিক্ষামন্ত্রী। রাজীব গান্ধীর জমানা থেকে নাম বদলে গালভরা শব্দ জুটে যায়— মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। তো সেই বিজেপি নেতা এবং ভবিষ্যতের শিক্ষামন্ত্রী জোশী বার বার ঘোষণা করতেন, তাঁর দল কিছুতেই করিডর খুলতে দেবে না, সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেবে। কী করবেন? প্রেস কনফারেন্সে এ প্রশ্ন করা হয় জোশীকে। তিনি উত্তর দেন, আমরা কী করব, তা দেখতেই পাবেন। পুরো ব্রহ্মাণ্ড যখন তিন মিনিটে সৃষ্টি হয়েছে, তখন সময় পেলে অনেক কিছু হতে পারে।
করিডর খোলার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি বিজেপি। বিএসএফ হঠিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীদের। ওদের গুলিতে মারা যায় দুজন। কিন্তু, জোশী যা বলেছিলেন এক সাংবাদিককে, তা মনে গেঁথে যায়। এক সময়ে জোশী ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজ়িক্সের প্রফেসর ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই পড়েছেন ১৯৭৭-এ প্রকাশিত ‘দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস: আ মডার্ন ভিউ অব দ্য অরিজিন অব দ্য ইউনিভার্স’ বইখানি। যাতে বর্ণিত হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের পর প্রথম তিন মিনিটের ঘটনাবলি। লেখক নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গ। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ওয়েনবার্গ। বিষয় বিগ ব্যাং-এ জন্মকালে ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থা। ওই বক্তৃতায় ওয়েনবার্গ জানান, ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের তিন মিনিটের মাথায় পরমাণুর নিউক্লিয়াস (প্রোটন ও নিউট্রনের বাসা) তৈরি হল। তার পর? ওয়েনবার্গের মন্তব্য: “নাথিং অব এনি ইন্টারেস্ট উড হ্যাপেন ইন দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইউনিভার্স।” সব কিছু ঘটে গিয়েছে ওই প্রথম তিন মিনিটের মধ্যে। জোশী ফিজ়িক্সের মানুষ হয়ে ওই কথাটিই বলতে চেয়েছিলেন। ৮৮ বছর বয়সে ওয়েনবার্গের প্রয়াণের খবর পেয়ে জোশীর মন্তব্য মনে পড়ল।
নাহ, শুধু নোবেল প্রাইজ়ে ওয়েনবার্গের প্রতিভার পরিমাপ করা যাবে না। ব্যাপারটা বিজ্ঞানী ব্রায়ান গ্রিন (‘দি এলিগ্যান্ট ইউনিভার্স‘, ‘দ্য ফ্যাব্রিক অব দ্য কসমস’, ‘দ্য হিডন রিয়ালিটি’ এবং ‘আনটিল দি এন্ড অব টাইম’ বইগুলোর লেখক) ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৮০-র দশকের কথা। গ্রিন তখন চাকরি করেন আইবিএম কোম্পানিতে। আমেরিকার অস্টিন শহরে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ওঁকে আমন্ত্রণ জানাল বক্তৃতা দিতে। ওঁর বস বিখ্যাত কম্পিউটর বিজ্ঞানী জন কক তা শুনতে পেলেন। শুনে ককের প্রতিক্রিয়া: ওখানে আছেন প্রফেসর ওয়েনবার্গ। তিনি কী আসবেন তোমার বক্তৃতা শুনতে?
গ্রিনের উত্তর: হ্যাঁ।
তা শুনে ককের মন্তব্য: মনে রেখো, নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী অনেকে আছেন। ওয়েনবার্গ কিন্তু তাঁদের শ্রেণিতে পড়েন না। ওঁর জাত আলাদা।
বক্তৃতার সময় ককের সাবধানবাণী টের পেলেন গ্রিন। প্রশ্নে প্রশ্নে গ্রিনকে একেবারে জেরবার করে তুললেন ওয়েনবার্গ। একই অভিজ্ঞতার শরিক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ফ্রাংক অ্যান্টনি উইলচেক। যিনি লিখেছেন ‘ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিটিজ়: ফরটিনাইন মাইন্ড জার্নিজ় অ্যান্ড আ ট্রিপ টু স্টকহলম’, ‘দ্য লাইটনেস অব বিইং: মাস, ইথার, অ্যান্ড দি ইউনিফিকেশন অব ফোর্সেস’, ‘আ বিউটিফুল কোয়েশ্চেন: ফাইন্ডিং নেচার’স ডিপ ডিজ়াইন’ এবং ‘ফান্ডামেন্টালস: টেন কিজ় টু রিয়ালিটি’-র মতো বই। ওয়েনবার্গের প্রতিযোগী এই বিজ্ঞানী। তবুও তিনি মাঝে মাঝেই ওয়েনবার্গের ফোন পেতেন। তিনি ফোন করতেন উইলচেকের সর্বশেষ গবেষণা বা গণনার খোঁজ নিতে। ওয়েনবার্গের মৃত্যুর পর ‘নেচার’ জার্নাল অবিচুয়ারি লেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এই অধ্যাপককেই। উইলচেক লিখেছেন, “বিজ্ঞানীরা সঙ্গীত রচয়িতাদের মতোই বিভিন্ন স্টাইলের হন। আলবার্ট আইনস্টাইন এবং রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন বিদ্রোহী। ওঁরা ভালবাসতেন অন্য ভাবে চিন্তা করতে। ওয়েনবার্গ ওদের মতো নন। ওঁর পদ্ধতি পণ্ডিতসুলভ।...আইনস্টাইন এবং ফাইনম্যান যদি বেঠোভেনের কথা মনে করান, তবে ওয়েনবার্গ মনে করান বাখকে।”
বিজ্ঞানী: স্টিভেন ওয়েনবার্গ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স। ডান দিকে, তাঁর লেখা যুগান্তকারী ‘দি ফার্স্ট থ্রি মিনিট্স...’ বইটি।
জন্ম নিউইয়র্ক শহরে। উদ্বাস্তু ইহুদি পরিবারে। স্মৃতিকথায় ওয়েনবার্গ লিখেছেন, তাঁর বিজ্ঞানে কৌতূহলের মূলে বাবা ফ্রেডরিখ। যিনি ছিলেন সামান্য কোর্ট স্টেনোগ্রাফার। মা এভা নিতান্ত গৃহবধূ। ফ্রেডরিখ ছেলেকে ভর্তি করে দেন শহরের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্রংকস হাইস্কুল অব সায়েন্স-এ। এই বিদ্যায়তন অনেক নোবেলজয়ীর জন্ম দিয়েছে। লিয়োন কুপার এবং মেলভিন শোয়ার্জ যাঁদের অন্যতম। ওঁরা ওয়েনবার্গের প্রায় সমসময়িক। আর এক জন ওঁর সহপাঠী। সেলডন লি প্লাশো। ১৯৭৯ সালে যিনি ফিজ়িক্সে নোবেল প্রাইজ় পেয়েছিলেন ওয়েনবার্গের সঙ্গেই।
কী জন্য পুরস্কার? তা হলে বলতে হয় বিজ্ঞানীদের এক সাধের কথা। বিজ্ঞানীরা মিল খোঁজেন। আইজাক নিউটন বড় বিজ্ঞানী। কারণ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যে কারণে চাঁদ পৃথিবীর চার দিকে ঘোরে, সে কারণেই গাছের আপেল মাটিতে পড়ে। সবার মূলে ওই গ্র্যাভিটি। ইলেকট্রিসিটি। ম্যাগনেটিজ়ম। বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন, ও দুটো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে থাকে। যেন পয়সার এ পিঠ-ও পিঠ। ইলেকট্রিসিটি থাকলেই ম্যাগনেটিজ়ম থাকবে। ম্যাগনেটিজ়ম থাকলে ইলেকট্রিসিটি থাকবে। ও দুটো বিষয় একত্রে এখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম নামে পরিচিত।
আর এক বড় বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। যিনি গ্র্যাভিটিকে নতুন চেহারায় আবিষ্কার করেছিলেন। ওঁর সময়ে ব্রহ্মাণ্ডে দুটো ফোর্স বা বল জানা ছিল। গ্র্যাভিটি আর ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম। তিনি ভাবলেন, ও দুটো বোধহয় কোনও একটা ফোর্সের দুই রূপ। জীবনের চল্লিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন এক প্রচেষ্টায়। এটা দেখাতে যে, ওই দুটো একই ফোর্সের বিভিন্ন রূপ। ব্যর্থ চেষ্টা। সফল হননি তিনি। কাগজপত্র থেকে দেখা যায়, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ওই গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন আইনস্টাইন।
তাঁর মৃত্যুর পর জানা যায়, আছে আরও দুই ফোর্স। স্ট্রং এবং উইক। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে এক রত্তি জায়গার মধ্যে প্রোটন এবং নিউট্রনকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে রাখে স্ট্রং ফোর্স। আর, তেজস্ক্রিয়তা ঘটায় উইক ফোর্স। এখন বিজ্ঞানীদের জানা বলের সংখ্যা চার। সুতরাং, আইনস্টাইনের স্বপ্ন সফল করতে হলে এখন দেখাতে হবে, ওই চারটে বল একই ফোর্সের বিভিন্ন রূপ। সে কাজটা, কিছুটা হলেও, করেছেন ওয়েনবার্গ, গ্লাশো এবং পাকিস্তানের বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। একযোগে নয়, আলাদা আলাদা। ওঁরা তিন জন নোবেল পান উইক ফোর্স এবং ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম একই বল থেকে উদ্ভূত তা দেখিয়ে। ওঁদের সাফল্যের পর এখন উইক ফোর্স এবং ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়মকে একই বল গণ্য করা হয়। এর নতুন নামকরণ হয়েছে ‘ইলেকট্রোউইক ফোর্স’।
ইলেকট্রোউইক তত্ত্ব একটা বড় কাজ করে। কণাবিজ্ঞান আর বিশ্বতত্ত্ব মেশানো। আগে ও দুটো আলাদা ছিল। কণারাজ্যের ব্যাপার-স্যাপার এবং ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ও বিবর্তন আলাদা বলে ভাবা হত। এই তত্ত্ব বোঝাল, দুটো বিষয় একই। বিগ ব্যাং বুঝতে হলে কণা কী করে এল, তা বুঝতে হবে। ১৯৭২। প্রকাশিত হল নানা খণ্ডের টেক্সট বই। ‘গ্র্যাভিটেশন অ্যান্ড কসমোলজি’। ওয়েনবার্গের লেখা সে বই বিশ্বতত্ত্বের ছাত্রদের কাছে এখনও বেদ-বাইবেল।
মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে ওয়েনবার্গ চির কালই স্পষ্টবক্তা। ২০০৪-এ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ ঘোষণা করলেন ‘নিউ ভিশন অব স্পেস এক্সপ্লোরেশন’। এক প্রস্থ মানবারোহী সমেত মহাকাশযাত্রা। ওয়েনবার্গ রেগে প্রবন্ধ লিখলেন, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’ পত্রিকায়। হেডিং ‘দ্য রং স্টাফ’। মার্কিন সাংবাদিক টম উলফ ১৯৭৯-এ নাসা-র জয়গানে যে বই লিখেছিলেন, তার নাম ছিল ‘দ্য রাইট স্টাফ’। ওই বইয়ের প্যারডি করে। ওয়েনবার্গের সাফ কথা— মানুষকে মহাশূন্যে বয়ে নিয়ে যেতে অযথা খরচ। তার চেয়ে মানবারোহীবিহীন মহাকাশযাত্রা— যাতে খরচ অনেক কম— শ্রেয় নয় কি? ওয়েনবার্গের মতে, নাসা-র তরফে মানুষকে মহাকাশে পাঠানোর ইচ্ছেটা ‘স্পুটনিক ভীতি’-র আধুনিক সংস্করণ।
১৯৫৭-র অক্টোবরে সোভিয়েট ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অ্যাটম বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা তৈরি নিয়ে আমেরিকা-সোভিয়েট ইউনিয়ন ঠান্ডা লড়াই তখন তুঙ্গে। এর মধ্যে আবার ১৯৬১-এ য়ুরি গাগারিন এবং ঘেরমান তিতভ নামে দুই নভশ্চরের মহাকাশযাত্রা। তিতভের মহাকাশযান পৃথিবী প্রদক্ষিণ করল ১৭ বার। এর মধ্যে তিন বার আমেরিকার আকাশপথে। আমেরিকার রাজনীতিক, সাংবাদিক, জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত। তিতভ যদি আমেরিকা তাক করে হাইড্রোজেন বোমা ছুড়ে দেন! জনগণকে আশ্বস্ত করতে প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি ছুড়ে দিলেন প্রতিজ্ঞা: দশক শেষের আগেই আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠাবে। শুরু হয়ে গেল মহাকাশ দৌড়। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। ওয়েনবার্গের প্রশ্ন: কী লাভ হয় মানুষকে মহাশূন্যে পাঠিয়ে?
নিজেকে বিজ্ঞানী ওয়েনবার্গ বলতেন ‘ন্যাশনালিস্ট, রিয়ালিস্ট, রিডাকশনিস্ট অ্যান্ড ডিভাউটলি সেকুলার’। এ সবের মধ্যে ‘রিডাকশনিস্ট’ কথাটা আমি এখানে বর্ণনা করব। রিডাকশনিজম বিজ্ঞানীদের ‘ধর্মবিশ্বাস’ বলা যায়। কথাটার অর্থ, কোনও কিছুর ধর্ম তার উপাদানের ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা।
বায়োলজিকে যেমন কেমিস্ট্রি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, কেমিস্ট্রিকে ব্যাখ্যা করা যায় ফিজ়িক্স দিয়ে। এ ভাবে বায়োলজিকে কেমিস্ট্রি দিয়ে, কেমিস্ট্রিকে ফিজ়িক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করার নাম রিডাকশনিজ়ম। কোনও কিছুকে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদানের আলোকে ব্যাখ্যা। বিজ্ঞানী হিসেবে ওয়েনবার্গ এক জন রিডাকশনিস্ট। বিশ্বাস করেন, কোনও কিছুকে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদানের ধর্মের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা চির কাল প্রতিযোগিতামূলক। বিজ্ঞানীতে বিজ্ঞানীতে, ল্যাবরেটরিতে ল্যাবরেটরিতে, দেশে দেশে প্রতিযোগিতা। ১৯৮৩ সাল। ইলেকট্রোউইক থিয়োরির পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া গেল ইউরোপে জেনেভা শহরের কাছে সার্ন গবেষণাগারে। আবিষ্কৃত হল তিন কণা। ডাবলু-প্লাস, ডাবলু-মাইনাস এবং জ়েড-জ়িরো। আবিষ্কারের সাফল্য উচ্চপ্রশংসিত হল, পরে নোবেল প্রাইজ় পেলেন সার্ন-এর ডিরেক্টর কার্লো রুবিয়া। তার আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস কাগজে এডিটোরিয়াল বেরোল। মতামত শিরোনামেই পরিষ্কার: ‘ইউরোপ থ্রি, ইউ এস নট ইভন জেড-জিরো’।
হিগস বোসন কণা খুঁজতে হবে। কী কণা? যে কণা আর সব কণাকে ভর জোগায়। ভর বিনে ব্রহ্মাণ্ড হযবরল। ভর আছে বলে তৈরি হয়েছে গ্যালাক্সি নক্ষত্র গ্রহ উপগ্রহ। গাছপালা নদীনালা পাহাড়পর্বত। ভর আছে বলে মানুষেরা আটকে রয়েছি পৃথিবীতে, নইলে দিগ্বিদিকে ছুটতাম আলোর মতো। আর সবাইকে ভর জোগায় যে কণা, সেই হিগস বোসন খোঁজা, সুতরাং, অত্যন্ত জরুরি।
আমেরিকা খুঁজবে হিগস বোসন। ইউরোপের কাছে আর হারতে রাজি নয় আমেরিকা। টেক্সাসের ওয়াক্সাহাকিতে তৈরি হবে মেশিন। মাটির নীচে ৮৭ কিলোমিটার লম্বা টানেল। উপবৃত্তাকার। ওই সুড়ঙ্গপথে প্রায় আলোর বেগে বিপরীতমুখে ছুটবে পরমাণুর কণা প্রোটন। তাদের মধ্যে হবে সংঘর্ষ। চূর্ণবিচূর্ণ হবে তা। টুকরোটাকরার মধ্যে আতিপাতি করে খুঁজে দেখা হবে হিগস বোসন। মেশিনের নাম সুপারকন্ডাকটিং সুপারকোলাইডার (এসএসসি)।
অত পেল্লায় মেশিন তো তৈরি হবে, ডলার জোগাবে কে? নানা কারণে শুরু হল ঝামেলা। লেখা হল দুটো বই। এসএসসি-কে বাঁচাতে। ১৯৯২। ওয়েনবার্গ লিখলেন ‘ড্রিমস অব আ ফাইনাল থিয়োরি’। পরের বছর আর একখানি বই। ‘দ্য গড পার্টিকল: ইফ দ্য ইউনিভার্স ইজ় দ্য আনসার, হোয়াট ইজ় দ্য কোয়েশ্চেন?’। ওই দ্বিতীয় বই থেকেই হিগস বোসন কণার নাম হয়ে গেল ঈশ্বরকণা। অনেক শুনানি হল এসএসসি তৈরির আগে। এক শুনানি হল হাউস কমিটি অন সায়েন্স, স্পেস অ্যান্ড টেকনোলজিতে। সেখানে ডাকা হল ওয়েনবার্গকে। তিনি বললেন এসএসসি-র মতো মেশিনের উপযোগিতার কথা। বললেন, কোলাইডার মেশিন আবিষ্কৃত কণাগুলি— এবং তারা যে নিয়ম মানে— তা সুন্দর। এটা সম্ভাবনার ব্যাপার হতে পারে না। ওর মধ্যে এই ব্রহ্মাণ্ডের গভীরে কিছু একটার সন্ধান পাওয়া যায়। এর পর যা হয় ওই শুনানিতে, তা চমকপ্রদ। তর্ক বেধে যায় দুই কংগ্রেস সদস্যের মধ্যে। ইলিনয় রাজ্যের প্রতিনিধি রিপাবলিকান দলের হ্যারিস ফাওয়েল এবং পেনসিলভানিয়ার প্রতিনিধি ডেমোক্র্যাট দলের ডন রিটার-এর মধ্যে। ফাওয়েল এসএসসি-র সমর্থক, রিটার বিরোধী। ফাওয়েল বলেন, ওয়েনবার্গ যা বললেন, তার মানে দাঁড়াল, এসএসসি আমাদের ভগবানকে খুঁজে দেবে। রিটার উত্তরে বললেন, যদি তা-ই হয়, তবে আমি এসএসসি সমর্থন করব।
তর্ক শুনে হতবাক ওয়েনবার্গ। তিনি কস্মিনকালেও ধর্মবিশ্বাসী নন। ধর্ম ব্যাপারটাকে ঘৃণা করেন তিনি। যা হোক, এত করেও বাঁচানো গেল না এসএসসি-কে। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেস বন্ধ করে দিল এসএসসি। প্রস্তাবিত হাজার কোটি ডলারের ২০০ কোটি ডলার খরচ এবং ৮৭ কিলোমিটারের মধ্যে ২৩ কিলোমিটার টানেল খোঁড়ার পরেও। হিগস বোসন আবিষ্কৃত হল ইউরোপে সার্ন ল্যাবরেটরির লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার যন্ত্রে, ২০১২ সালে। হিগস বোসন কণার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালেই নোবেল প্রাইজ় পেলেন স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানী স্যর পিটার হিগস এবং ফরাসি বিজ্ঞাসী ফ্রাসোঁয়া এংলার্ট। আবার ইউরোপের কাছে হারল আমেরিকা।
দার্শনিক, বিশেষ করে নিউ-এজ গুরুদের সহ্য করতে পারেন না ওয়েনবার্গ। ১৯৯৬ সালে ঘটে গেল এক কাণ্ড। অনেক বছর ধরে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির দর্শনশাস্ত্র, সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপকেরা রাগে ফুঁসছিলেন। বিজ্ঞানীদের প্রকল্পে ফান্ডিং কেন এত বেশি, আর ওঁদের গবেষণা কেন শুকিয়ে মরছে? বিজ্ঞানে কোনও কিছুই তো ধ্রুব সত্য নয়। জ্ঞানও আপেক্ষিক ইত্যাদি ইত্যাদি। ওঁদের সাধের পত্রিকা ‘সোশ্যাল টেক্সট’। ওই পত্রিকায় প্রকাশের জন্য এক প্রবন্ধ লিখলেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ফিজ়িক্সের প্রফেসর অ্যালান সোকাল। প্রবন্ধের শিরোনাম, ‘ট্রান্সগ্রেসিং দ্য বাউন্ডারিজ়: টুয়ার্ড আ ট্রান্সফর্মেটিভ হার্মেনিউটিক্স অব কোয়ান্টাম গ্রাভিটি’। উপজীব্য, বিজ্ঞান গবেষণা দেশকালে আবদ্ধ; আপেক্ষিক সত্য খোঁজেন বিজ্ঞানীরা। ওঁরা ধ্রুব সত্য খোঁজেন না। সোকাল সেই সঙ্গে গুঁজে দিলেন কিছু হিজিবিজি শব্দ, যার কোনও অর্থ নেই। এবং তার সঙ্গে ঢুকিয়ে দিলেন এমন কিছু কথা, যা কলাবিদ এবং দার্শনিকরা পছন্দ করেন। অর্থাৎ, সোকালের প্রবন্ধটি একটা ভাঁওতা, ধাপ্পা। টোপ পেয়ে গিলে নিল ‘সোশ্যাল টেক্সট’। ছাপল সোকালের প্রবন্ধ। তখন সোকাল ‘লিংগুয়া ফ্র্যাংকা’ পত্রিকায় আর একটা প্রবন্ধ লিখে ফাঁস করলেন তাঁর ধাপ্পা। লিখলেন, কলাবিদ্যার অধ্যাপকেরা অন্তঃসারশূন্য। হিজিবিজি শব্দ দেখেই প্রবন্ধটা ছেপেছেন। মানে বোঝেননি। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ কাগজ প্রথম পাতায় সোকালের এই ধাপ্পাবাজির খবর ছাপল। ছাপবেই, বৌদ্ধিক জগতে এত বড় কাজিয়ার খবর ইদানীং কালে আর হয়নি যে!
বেশ হয়েছে। ওয়েনবার্গ খুশি হলেন কলাবিদ্যার হেনস্থা দেখে। ‘নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখে সোকালের ধাপ্পাবাজিকে তুলনা করলেন বিজ্ঞানের জগতে আর এক বড় ধাপ্পাবাজির সঙ্গে। ‘পিল্টডাউন ম্যান’ ধাপ্পাবাজি। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে শখের প্রত্নতাত্ত্বিক চার্লস ডসন সাসেক্স-এ পিল্টডাউন নামে একটা জায়গায় মানুষের খুলি সমেত কিছু হাড়গোড় খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেন। তাঁর আরও দাবি, ওগুলোই নাকি মিসিং লিঙ্ক— বানরজাতীয় প্রাণী আর মানুষের মধ্যবর্তী জীব। ৪১ বছর পরে ১৯৫৩ সালে জানা যায়, ওই হাড়গোড় জাল।
ফিরে আসি জনসাধারণের জন্য লেখা ওঁর বই ‘দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস’ প্রসঙ্গে। ওই বইতে লেখা ওয়েনবার্গের এক মন্তব্য ঝড় তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে যত বেশি জানা যায়, ততই একে উদ্দেশ্যবিহীন মনে হয়।’ উদ্দেশ্যবিহীন? এ যেন আলব্যেয়র কামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য আউটসাইডার’-এ নায়ক মেয়ারসল্টের মন্তব্য: ‘আমার মা আজ মারা গিয়েছে। অথবা হয়তো গতকাল। আমি নিশ্চিত বলতে পারি না....’ ধর্মপ্রাণ মানুষ এই জগতের অর্থ খুঁজে পায়। ওয়েনবার্গের মতো বিজ্ঞানী পান না।
বিজ্ঞানী কী জানেন? তাঁর কাজ গবেষণা করে যাওয়া। ‘দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস’-এ এই বিতর্কিত মন্তব্যের পরেই ওয়েনবার্গ জুড়ে দেন, “বাট ইফ দেয়ার ইজ় নো সোলেস ইন দ্য ফ্রুটস অব আওয়ার রিসার্চ, দেয়ার ইজ় অ্যাট লিস্ট সাম কনসোলেশন ইন দ্য রিসার্চ ইটসেলফ... দ্য এফর্ট টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ইউনিভার্স ইজ় ওয়ান অব দ্য ভেরি ফিউ থিংস দ্যাট লিফটস হিউম্যান লাইফ আ লিটল অ্যাবাভ দ্য লেভেল অব ফার্স, অ্যান্ড গিভস ইট সাম গ্রেস অব ট্র্যাজেডি।” বিয়োগান্ত উপাখ্যানের পেলব স্পর্শ? সিসিফাসের কাহিনি মনে পড়ছে। অভিশপ্ত জীবন ওঁর। পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে পাথর তোলা কাজ ওঁর। বার বার। উতরাই বেয়ে নেমে আসবে সেই পাথর। তা সে জানে। আবার সে তুলবে সে পাথর। এমনই তাঁর ভাগ্য। অথবা মহাভারতে কর্ণের উপাখ্যান। কুন্তী তাঁকে পাণ্ডব শিবিরে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলেন। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান কর্ণ বলেছিলেন, তাঁর কাম্য নয় রাজ্য লাভ বা যশোলাভ। তাঁর কাম্য বীরের সদ্গতি। তাই তাঁর জন্য থাক আশাহীন কর্মের উদ্যম, জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত।
১৯৯০ সালে অ্যালান লাইটম্যান এবং রোবের্টা ব্রাওয়ার একটি বই লেখেন। ‘ওরিজিনস: দ্য লাইভস অ্যান্ড ওয়ার্ল্ডস অব মর্ডান কসমোলজিস্টস’। ২৭ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ইন্টারভিউ। প্রায় সবাইকে প্রশ্ন করা হয়েছে ওয়েনবার্গের মন্তব্য সম্পর্কে। দশ জন মেনে নিয়েছেন ওই মন্তব্য। তেরো জন মানেননি। ওই তেরো জনের মধ্যে আবার তিন জন প্রশ্ন তুলেছেন, ব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশ্য থাকতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্গারেট জেলার যেমন জিজ্ঞাসা করেছেন, ব্রহ্মাণ্ড একটা ভৌত বিষয়, তার আবার উদ্দেশ্য হয় কী করে? প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস পিবলস, যিনি তিন বছর আগে নোবেল পেয়েছেন, তিনি অনুমান করেছেন, যখন ও কথা লিখেছিলেন, তখন সে দিনটা ওয়েনবার্গের নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু ঘটেছিল। আমরা তো ব্রহ্মাণ্ডের কাছে তুচ্ছ। আমরা কী ভাবলাম না ভাবলাম তাতে ব্রহ্মাণ্ডের ভারী বয়ে গেছে। প্রিন্সটনের আর এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন টার্নার মনে করেন, ওয়েনবার্গ আসলে পাঠককে চটানোর জন্যই ওই মন্তব্য করেছিলেন। ওয়েনবার্গের পছন্দ ওঁর সহকর্মী টেক্সাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেরার্ড ডি ভাউকুলোআর্স-এর মতামত। তিনি বলেছেন, ওয়েনবার্গ নস্ট্যালজিয়া থেকে এই মন্তব্য করেছেন। সত্যি নস্ট্যালজিয়া। অতীতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষ তাকাত, গ্রহ-তারা ঈশ্বরের গরিমা প্রকাশ করছে। বিজ্ঞানী ওয়েনবার্গ জেনেছেন, তা নয়।
ধর্ম আর বিজ্ঞান। প্রথমটা মানুষকে দিতে পারে স্বস্তি। ওয়েনবার্গ খুব ভাল করে জানতেন, দ্বিতীয়টা তা পারে না। বিশেষ করে, অনিত্য জীবনে। হ্যাঁ, মানুষের জীবন বড় অনিত্য। ‘ড্রিমস অব আ ফাইনাল থিয়োরি’ বইতে ওয়েনবার্গ লিখেছেন আর একটি বইয়ের কথা। ‘দ্য ইক্লাসিয়াসটিক্যাল হিস্ট্রি অব ইংলিশ পিপল’। নরথাম্ব্রিয়ার সম্রাট রাষ্ট্রের ধর্ম কী হবে, তা নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন। এক সন্ত রাজাকে বললেন, ‘হে রাজন, জীবন যেন চড়াই পাখির লাফ। বাইরে অন্ধকার, তুষারপাত, প্রবল শীত। এর মধ্যে একটা চড়াই পাখি এক জানলা দিয়ে ঢুকে এই ব্যাঙ্কোয়েট হলের ওম অনুভব করে আর এক জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায়। মানুষের জীবন যেন এই হলের ওমটুকু। মানুষ জানে না জীবনের আগে-পিছে কী আছে।’
সুতরাং, ধর্মে কী আসে-যায়?