স্রষ্টা: মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সময়টা উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক। বাগানবাড়িতে আড্ডা দিচ্ছেন চার জন। বেলগাছিয়া নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাতা, পাইকপাড়ার রাজ পরিবারের দুই ভাই, রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
আলোচনা চলাকালীন মাইকেল বললেন, যত দিন না বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের চল হচ্ছে, তত দিন বাংলা নাটকের উন্নতির আশা নেই। আর যতীন্দ্রমোহনের মত, বাংলায় এই ছন্দ সৃষ্টি সম্ভব নয়। কথাটা আদৌ পছন্দ হল না মধুসূদনের। কিন্তু নাটক, ফটোগ্রাফি, সঙ্গীতের সমঝদার যতীন্দ্রমোহনও নাছোড়। কবিকে ঈশ্বর গুপ্তের নাম করে দিলেন খোঁচা। গুপ্তকবি নাকি এক বার অমিত্রাক্ষরের প্যারোডি করে লিখেছিলেন— “কবিতা কমলা কলা পাকা যেন কাঁদি/ ইচ্ছা হয় যত পাই পেট ভরে খাই।” রসিকতায় চটলেন মাইকেল। ঈশ্বর গুপ্ত পারেননি বলে কি আর কেউ অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখতে পারবেন না! চ্যালেঞ্জ ঠুকলেন যতীন্দ্রমোহনকে, প্রমাণ করে দেখাব, অমিত্রাক্ষর লেখার জন্যে বাংলা ভাষা যথেষ্ট উপযোগী।
আত্মবিশ্বাস ছিলই, প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন মধুসূদন। হিন্দু কলেজে ‘সনেট’ রচনা হোক বা ইংরেজি কাব্যনাট্য ‘রিজিয়া’, দীর্ঘ দিন এই ছন্দ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন।
চ্যালেঞ্জ শুনে যতীন্দ্রমোহন বললেন, যদি সত্যিই তা সম্ভব হয়, কবির কাব্য নিজ অর্থে ছেপে দেবেন। মাইকেলেরও প্রতিশ্রুতি, দু-তিন দিনের মধ্যে অমিত্রাক্ষরে রচিত কয়েকটি স্তবক লিখে দেখাবেন।
কথামত এক দিন দেখা গেল, শুধু স্তবক না, অমিত্রাক্ষর ছন্দে মধুসূদন লিখেছেন কাব্যের আস্ত একটা সর্গ।
এমনধারা লেখা বাংলা ভাষায় হতে পারে, ভাবতেই পারলেন না যতীন্দ্রমোহন, রাজ-ভ্রাতৃদ্বয়। বিস্মিত হিন্দু কলেজের প্রাক্তনী রাজেন্দ্রলাল মিত্রও। তাঁর ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-তে প্রকাশ করলেন কাব্যটির প্রথম দু’টি সর্গ। কবির নাম ছিল না। রাজেন্দ্রলাল সৃষ্টির কৃতিত্ব দিয়েছিলেন কোনও ‘সুচতুর কবি’কে।
বইটি—‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। মধুসূদন তা উৎসর্গ করলেন ‘প্রেরণা’ যতীন্দ্রমোহনকেই। এক ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ বাদে মধুসূদনের বাকি কাব্যগ্রন্থ সবই লেখা এই ছন্দে। ইতিহাস গড়লেন মধু-কবি!