—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বয়স মাত্র ন’বছর। যৌনাঙ্গে ঢুকে রয়েছে মার্বলের বল। টানা রক্তপাত হচ্ছে। একরত্তি মেয়েকে বাঁচানো যাবে কি না, তাই ভেবে মা-বাবা দিশাহারা। চিকিৎসকের হাত-পা ধরছেন আর বলছেন, “বাবুর বাড়িতে এই অবস্থা হয়েছে আমার মেয়েটার। কিন্তু পুলিশকে কিছু বলতে চাই না। বাবু মেরে ফেলবেন। আপনি দয়া করে মেয়েটাকে বাঁচান!”
কলকাতার এক ব্যবসায়ী পরিবারের অন্দরমহলের এই ঘটনা জানিয়ে স্ত্রীরোগ চিকিৎসক বলেন, “ওই ব্যবসায়ী নিজে ফোন করে বলেন, মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। তবে পুলিশে জানানো যাবে না। জানালেও লাভ হবে না। ব্যবসায়ীর এক ভাইয়ের কাজ এটা। মেয়েটি পরিচারিকা-মায়ের সঙ্গেই ওই বাড়িতে থাকত। স্নানঘরে পোশাক দিয়ে আসার জন্য মাঝেমধ্যে মেয়েকে পাঠাতেন মা। এই পোশাক দিয়ে আসার মধ্যেই মেয়েটিকে নানা ভাবে যৌন হেনস্থা করত ব্যবসায়ীর ভাই। খেলনা দেখানোর নাম করে ভাইব্রেটর, স্টিমুলেটর ব্যবহার করা শুরু হয় মেয়েটির উপর। তেমনই এক দিন স্টিমুলেটরের মাথায় থাকা দুটো মার্বলের বল ভেঙে মেয়েটির যৌনাঙ্গে ঢুকে যায়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মেয়েটিকে নিয়ে আসা হয় আমাদের কাছে।” চিকিৎসক জানালেন, মেয়েটির যোনিদ্বার কার্যত ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। কোনওমতে বাঁচানো গেলেও ভবিষ্যতে আর স্বাভাবিক উপায়ে মা হতে পারবে না সে।
এর পরে থেমে চিকিৎসক বললেন, “সেই ব্যবসায়ী জানেন, তাঁর ভাই বহু দিন যাবৎ শিশু পর্নোগ্রাফিতে আকৃষ্ট। পিডোফিলিয়ার লক্ষণও ধরা পড়েছে। কিন্তু চিকিৎসা করানো তো দূরস্থান, শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধ করলেও পুলিশে মামলা হয়নি।”
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন এক মনোরোগ চিকিৎসকও। ১৭ বছর বয়সি কিশোরকে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হয় পর্নোগ্রাফির নেশা ছড়ানোর জন্য। কিন্তু চিকিৎসায় বেরিয়ে আসে অন্য এক দিক। জানা যায়, ছোটবেলায় ছেলেটি দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে যেত। সেখানেই ন’বছর বয়সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয় তার। মামা তাকে বোঝায়, বয়ঃসন্ধির আগে নিজের শরীর সম্পর্কে কিছু বিষয়ে তার জানা উচিত। মনোরোগ চিকিৎসক বলেন, “এই অন্য রকম অনুভূতি অনুভব করানোর নামে তাকে শেখানো হয় স্বমেহন। এর পরে এই মামা তাকে প্রথম পর্নোগ্রাফি দেখায়। ধীরে ধীরে পর্নোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক তৈরি করানো হয়। ১৭ বছর বয়সে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, যে খাওয়া-ঘুম উড়ে যায় সেই ছেলের। দীর্ঘক্ষণ বাড়ির বাথরুমে কাটাত সে। স্কুলে গিয়েও এমন নানা কাজে নাম জড়ায় তার। ছেলেটি বহু আগেই নিজের বাবা-মা’কে মামার এই কাজ সম্পর্কে বলেছিল। কিন্তু কিছুই করা হয়নি, কারণ মামা এই পরিবারে টাকা দিত। পিডোফিলিয়ার কথা বুঝিয়ে বলায় উল্টে বাবা-মা আমায় বলেন, এ সব বাইরে কী বলব? মামাই তো!” তাঁর কথায়, “সেই ছেলের এখন ২৫ বছর বয়স। পর্নোগ্রাফির নেশা ছাড়তে পারলেও স্বাভাবিক মেলামেশা, সম্পর্কের প্রতি ভীতি কাটেনি তার। কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে মামাকে দেখলেই অস্বস্তি শুরু হয়। আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সেই ছেলে।”
শিশুদের উপর এমন যৌন অত্যাচারের ঘটনা বাড়ছে উত্তরোত্তর। গোটা দেশের মতো এই রাজ্যেও সামনে আসছে শিশুদের যৌন নির্যাতনের নানা ঘটনা। কিন্তু অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে পরিবারের অন্দরেই। সম্প্রতি কলকাতার কয়েকটি বিত্তশালী পরিবারের এমন ঘটনা সামনে আসায় এ নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনিক মহলে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থানায় লিখিত অভিযোগ না হওয়ায়, কী ভাবে পদক্ষেপ করা হবে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে বলে লালবাজার সূত্রের দাবি।
তবে এই অভিযোগও উঠেছে, সমাজের নিচুস্তরে এমন ঘটনা ঘটলে তড়িঘড়ি গ্রেফতারি এবং ‘প্রোটেকশন অব চিল্ড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস’ (পকসো) বা জুভেনাইল জাস্টিস আইনের ধারায় মামলা করা হচ্ছে। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালীরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে ক্ষেত্রে গ্রেফতারি তো দূর, পুলিশ অভিযোগ শুনেও কিছুই করছে না বলে অভিযোগ।
দীর্ঘ দিন শিশু অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি, হয় মামলা রুজু হচ্ছে না, নয়তো মামলার ফাইল চেপে দেওয়া হচ্ছে প্রভাব খাটিয়ে। ওই সংগঠনের কর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগীর কথায়, “এই রাজ্যে ২০১৯ সাল থেকে গত কয়েক বছরে শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার বা ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। গত দু’বছরে অপহরণ বা বাল্যবিবাহের মতো অপরাধকেও ছাপিয়ে গিয়েছে শিশুর উপরে যৌন অত্যাচারের অপরাধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর পিছনে পিডোফিলিয়ার প্রভাব থাকলেও একে শুধুই রোগ বলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনের তেমন ভাবনা-চিন্তা নেই। রোগ বলে উল্লেখ করায় দোষী বহু ক্ষেত্রেই আইনের চোখে ছাড়পেয়ে যাচ্ছে।”
(চলবে)