Ghosts of Kolkata

কলকাতার হারিয়ে যাওয়া সেই সব ভূত

শুনশান নির্জন রাত। চিড়িয়াখানার উল্টো দিকে পেট্রল পাম্পের সামনে হাত দেখিয়ে ট্যাক্সি দাঁড় করাতেন এক জন। কী হত তার পর? কেন ঘটত সেই রকম ঘটনা? সে সময় হাই কোর্ট, আকাশবাণী থেকে শুরু করে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অবধি ভৌতিক অভিজ্ঞতার অভাব ছিল না কলকাতায়। ফের কোথা থেকে এসেছিল এই নতুন ভূত?

Advertisement

প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:২৭
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

তখনও রেসকোর্সের দিকটা এ ভাবে উড়ালপুলের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েনি। বিদ্যাসাগর সেতু তখনও দূর অস্ত। আলিপুর-রেসকোর্স অঞ্চলের রাস্তাগুলোও তখন বেশ চওড়া। সন্ধের পরে যখন যানবাহন কমে যেত, তখন ওই বিশাল চওড়া রাস্তাগুলোই যেন পথভোলা কোনও পথিক বা গাড়িকে গিলে খেতে চাইত। তার উপর আবার কুয়াশা কিংবা বৃষ্টির রাত হলে তো কথাই নেই। পুরো পরিবেশ যেন রুদ্ধশ্বাসে কোনও অঘটনের জন্য প্রতীক্ষারত।

Advertisement

এমনই এক রাতের ঘটনার খবর বেরিয়েছিল ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে নাকি চিড়িয়াখানার উল্টো দিকের পেট্রল পাম্পের সামনে প্রায়শই খাকি উর্দি পরা এক পুলিশ অফিসার হাত দেখিয়ে ট্যাক্সি থামান। বেশি বাক্যালাপের মধ্যে না গিয়ে চট করে ট্যাক্সির পিছনের সিটে উঠে বসে চালককে মৃদু স্বরে আশ্বাস দেন— “কোই ডর নেহি।” ট্যাক্সি রাতের অন্ধকার চিরে এগিয়ে যায় রেসকোর্সের দিকে। কিন্তু মোড়টা ঘুরতেই দরজায় যেন একটা খুট করে আওয়াজ হয়। চালক চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে, কোথায় সেই অফিসার? রাস্তাও তো খালি। কোথাও কোনও পুলিশ অফিসারের দেখা নেই। এমন অভিজ্ঞতা নাকি হয়েছিল একাধিক ট্যাক্সিচালকের।

খবরটি পড়ে অনেকেই খুশি হননি। বিজ্ঞান প্রচার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু যুক্তিবাদী মানুষ এই খবরে রীতিমতো চটে যান। সঞ্জয় পণ্ডিত নামে অন্য এক পত্রিকার সাংবাদিক ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে দেখতে নেমে পড়েন। ট্যাক্সিচালকদের ইউনিয়ন, বিভিন্ন থানা, লালবাজার ঘুরে এই সাংবাদিক এমন কোনও ঘটনার কোনওভিত্তিই খুঁজে পাননি।

Advertisement

এই গোত্রের খবরের প্রতি সঞ্জয়বাবুদের মতো যুক্তিবাদীরা বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। সঞ্জয়বাবু মনে করতেন যে, “ভূতের গল্পের প্রচার… মানুষের সচেতনা প্রচারের পথে… অতি কুৎসিত আগাছা।” তাঁর মতে, “যেখানেই শিক্ষার আলো গিয়ে পড়েছে, সেখানেই ভূতেরা হটে হটে যাচ্ছে। তাই আজ আর শহরে ভূতের গল্প বড় একটা শোনা যায় না। শহরবাসী ভূতের গল্প বললেও— মজা করে বলে, গভীর বিশ্বাসে নয়। খুব সুলক্ষণ এটা।”

সঞ্জয়বাবুর যুক্তিবাদ আসলে দু’টি সুনির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে চলার একটি সোজা, সরল পথ। একটি বলয় রয়েছে গ্রামবাংলায় কিংবা ফেলে আসা অতীতে। সেই বলয়টি ডুবে আছে অশিক্ষার নিবিড় অন্ধকারে। এই প্রথম বলয়ের মানুষজন রক্ষণশীল, আত্মবিশ্বাসহীন। আর অন্য বলয়টি শিক্ষার আলোকে আলোকিত, উজ্জ্বল। সেই বলয়ের স্থান শহরে। সেখানে ভূতেরা বিপন্ন, বিবর্ণ। একটি বলয় থেকে অন্য বলয়ে যাওয়ার রাস্তা যুক্তি এবং প্রগতি।

এই চিন্তার মূল্যায়ন করার যোগ্যতা আমার নেই, তবে এর ঐতিহাসিক অসারতার কথা আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি। ভূত শহুরে মানুষের কাছে বিরল এবং গ্রাম্য মানুষের নিত্যসঙ্গী— এমন কথার খণ্ডন সহজেই করা যায়। শুধু কলকাতা কেন, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শহরেই প্রচুর ভূতের গল্প শোনা যায়। তা যে কমে যাচ্ছে, তারও কোনও পরিসংখ্যানগত প্রমাণ নেই। বরং হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যক্ষ অ্যান্ড্রু কিপনিস সম্প্রতি তাঁর গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, চিনের শহরগুলিতে ভূতের ভয় গ্রামের থেকে বেশি তো বটেই, এবং তা বেড়েই চলেছে। অধ্যাপক কিপনিস মনে করেন যে, গ্রামের আপেক্ষিক পরিচিত পরিবেশ এবং সমাজ যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ততই ভূতের ভয় বাড়ছে। শহুরে প্রতিবেশীরা যতই অচেনা হয়ে যাচ্ছে এবং নাগরিকরা বার বার বাড়ি বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন, ততই তাঁরা মৃতদের ভয় পাচ্ছেন।

কিপনিসের বিশ্লেষণ ঠিক হোক বা না হোক, তাঁর সংগৃহীত তথ্য অস্বীকার করা যায় না। চিনের বাড়ন্ত শহরগুলিতে ভূতের ভয় বাড়ছে। তেমনই এও অস্বীকার করা যায় না যে, সব ভূত-বিশ্বাসী মানুষই অশিক্ষিত নন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্ল্যানচেট করতেন। সত্যজিৎ রায় ভূত এবং পুনর্জন্ম বিষয়ে সংস্কারহীন গবেষণায় আগ্রহী ছিলেন। বিদেশে আলফ্রেড ওয়ালেস, টমাস আলভা এডিসন, মারি কুরি, অলিভার লজ বা উইলিয়াম ক্রুকস-এর মতো বিজ্ঞানী থেকে আর্থার কোনান ডয়েলের মতো যুক্তিপ্রিয় লেখকও ভূত-বিশ্বাসী ছিলেন। ইতিহাসবিদের চোখে দেখতে গেলে কিন্তু মোটেই ভূত এবং বিজ্ঞানের এমন কোনও চিরাচরিত দ্বন্দ্ব ধরা পড়ে না। অনেক বিজ্ঞানী ভূতে অবিশ্বাসী হলেও অনেক বিজ্ঞানী ভূতে বিশ্বাসী বা সে বিষয়ে মুক্তমনা। তাই ভূত প্রগতির প্রতিবন্ধক না সহচর, বিজ্ঞানে বিরোধী না বিজ্ঞানসম্মত— তা বলা মুশকিল।

ইতিহাসবিদের কাছে ভূত অতীতের অপর নাম। স্মৃতির অবতার। তবে আধুনিক কালে ভূত এবং ইতিহাস সমার্থক নয়। ইতিহাস আজ এক নিয়মানুগ চর্চিত বিষয়। দলিল-দস্তাবেজের উপর নির্ভর করে, পাদটীকার জালে মুড়ে, কয়েকটি পেশাদারি নিয়ম মেনে অতীতের যে আখ্যায়িকা রচিত হয়, তা-ই আজ একমাত্র ইতিহাস রূপে মান্য। ভূত এত নিয়মের ধার ধারে না। তাই যে অতীত নিয়ম মেনে মহাফেজখানার ফাইলবন্দি হয়নি, সেই অতীত ভূতরূপে অবতীর্ণ হয়ে সমাজের আনাচ-কানাচে ঘোরে। বিশেষত, আলিপুরের পুলিশ-ভূতের মতো সর্বজনীন স্থানে যে ভূতের আবির্ভাব হয়, সে ভূত এক ধরনের অলীক সামাজিক স্মৃতির চরিত্রায়ণ।

আসলে অতীতকে যতই আমরা নিয়মের ঘেরাটোপে বেঁধে পেশাদারি ইতিহাস-চর্চার একাধিকার স্বত্বে গ্রহণ করতে উদ্যত হই, স্মৃতির অতীত ততই আমাদের হাত ফস্কে বাঁধা সীমানার বাইরে দৈনন্দিন জীবনে ইতিউতি উঁকি মারে। আর স্মৃতি যখনই ব্যক্তি বা পরিবারের সীমিত গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন হয়ে ওঠে, তখনই সেই স্মৃতি দিয়ে গড়া অশরীরীর অবয়বটিও হয়ে ওঠে সামাজিক।

এখানে বলে রাখা উচিত, ভূতের সার্বিক সামাজিকতা মেনে নিলে কোনও এক জন ব্যক্তি সত্যিই ভূত দেখেছিলেন কি দেখেননি, তার মূল্য আপেক্ষিক ভাবে কমে যায়। মূল প্রশ্নটি হয়ে ওঠে, কেন এই ধরনের একটি ভূতের গল্প একটি বিশেষ সময় একটি বিশেষ স্থানে চালু হল? সর্বজনীন সামাজিক মানস সম্বন্ধে সেই ভূতের গল্পটি আমাদের কী বলে? যেমন ধরুন, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর নৃতত্ত্বের অধ্যাপক হিয়োনিক ক্বন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ভিয়েতনামের গ্রামগুলিতে যুদ্ধের পরে কেমন আমেরিকান সৈনিকদের ভূত দেখা যেতে থাকে। সহজেই অনুমেয় যে, ভিয়েতনামে আমেরিকান আগ্রাসন না হলে সে দেশে আমেরিকান ভূতেদেরও দেখা যেত না। অধ্যাপক ক্বন এও বলেছেন যে, এই ধরনের ভূতের গল্পে সাধারণ গ্রামবাসীদের যুদ্ধের অবাধ হত্যালীলার প্রতি সুপ্ত অস্বস্তিও প্রকাশ পায়। আগ্রাসী সৈনিককে হত্যার মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী বা বৈপ্লবিক শ্লাঘা প্রকাশ পায়, তার সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণ মানুষের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতিও লুকিয়ে থাকে। তবে যুদ্ধ-উত্তর দেশে পরাজিত শত্রুর হননকে যত সহজে উদ্‌যাপন করা যায়, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো তত সহজ নয়। আর সেই নিরুদ্ধ সহানুভূতিই তখন ভূত হয়ে গ্রামবাসীদের ভয় দেখায়।

তবে অশরীরীদের ছাপ পড়ে সমাজজীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গে। আমেরিকান সমাজবিদ উইলিয়াম টমাসের মতে, একটি সমাজের মানুষ যে কোনও জিনিসকে যদি সত্য বলে বিশ্বাস করেন, তা হলে দার্শনিকের চোখে তা সত্য বা অসত্য যা-ই হোক না কেন, সেই বিশ্বাসের পরিণতিগুলি একটি সামাজিক সত্য বলে ধরে নেওয়া উচিত। ধরা যাক, একটা পাড়ার একটি বাড়ির হানাবাড়ি বলে দুর্নাম আছে। এ বার ভূত বলে কিছু থাকুক আর না থাকুক, সামাজিক এই বিশ্বাসের ফলে সেই বাড়িটির বাজারদর পড়ে যাবে। এটুকু তো নিঃসন্দেহে কঠোর অর্থনৈতিক সত্য। তাই সমাজতাত্ত্বিকের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে ভূত বলে কিছু আছে না নেই, তাতে কিছু তো আসে যায়।

কাজেই আনন্দবাজারের প্রকাশিত সংবাদটি ঠিক না ভুল, তা সামাজিক বিশ্লেষণের জন্য আপেক্ষিক ভাবে গৌণ। গুরুত্বপূর্ণ হল, এমন গল্প সেই সাংবাদিক ওই সময় শুনলেন কেন? যদি গল্পটি স্রেফ উড়ো খবরও হয়, সেটি ওই সময় অর্থাৎ ১৯৮২ সালের শুরুর দিকেই কেন শোনা গেল? আরও একটু অগ্রসর হলে এ প্রশ্নও উঠবে যে, গল্পটি এত দিন টিকল কেন? সেই ১৯৮২ সালে প্রথম ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এই পুলিশ-ভূতের কথা কিন্তু বার বার লোকের মুখে ঘুরেছে। শতাব্দী পেরিয়ে ২০১৪ সালে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনেও গল্পটির পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সম্প্রতি সত্যি ভূতের গল্পের একটি ইংরেজিতে সঙ্কলনেও আবার এই ভূতের উল্লেখ করা হয়েছে। যদি গল্পটি ভিত্তিহীনই হত, তা হলে গল্পটা প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সমাজের অলিন্দে পাক খাচ্ছে কেন?

আসলে সামাজিক এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল গল্পের প্রেক্ষাপট, বিস্তার, স্থায়িত্ব ইত্যাদি। কেন একটি গল্প একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে একটি সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, তা আমাদের সেই সমাজের বিষয় অনেক কিছু বলে দেয়। একটা আখ্যান, যদি সেটা কল্পনাপ্রসূতও হয়, কেন এক সময় বিপুল ভাবে জনপ্রিয় হল, তা সামাজিক স্তরে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তাই ফেরা যাক আবার ১৯৮২ সালের গোড়ার দিকটায়। গল্পটি নিয়ে আর একটু ভাবা যাক। সঞ্জয়বাবু যা-ই বলুন, ভূত তো কলকাতায় নতুন নয়। হাই কোর্ট, আকাশবাণী থেকে শুরু করে ওই আলিপুরেই ন্যাশনাল লাইব্রেরির মাঠ হয়ে কলকাতার আরও নানা জায়গায়ই তো ভূত দেখার গল্প চালু আছে, প্রায় কলকাতা শহরের জন্মমুহূর্ত থেকেই। তা এদের মধ্যে আবার আর একটি নতুন ভূতের দরকার হল কেন?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে আগেই দেখতে হবে, এই ভূতের নতুনত্ব কোথায়? কলকাতার প্রাচীন অশরীরীদের মধ্যে রাজা-মহারাজা-লাট-বেলাট অনেক থাকলেও পুলিশ-ভূত বিশেষ নেই। আলিপুরের এই ভূতের বিষয় যা প্রথমেই বলা হয় তা হল যে, এই প্রেতাত্মাটি মর্তে থাকাকালীন নগর কলকাতার কোটাল-বাহিনীর সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর পরও তিনি তাঁর উর্দি ছাড়েননি। তিন শতক পেরিয়ে আসা, ইতিহাসসমৃদ্ধ এই শহরে তো পুলিশের কোনও দিনই কমতি ছিল না। ঘাতে অপঘাতে তাঁরা অনেকেই এই শহরে মারাও গেছেন। তবু আমরা তেমন কোনও নামজাদা পুলিশ-ভূতের গল্প ১৯৮২-র আগে বিশেষ শুনতে পাইনি। কেন এই নতুন রকমের ভূতের আবির্ভাব ঘটল এই সময়?

পুলিশ-ভূতের দরকার কেন পড়ল, সে প্রশ্নের উত্তর চাইলে আমাদের বুঝতে হবে সেই সময়টির বিশেষত্ব ঠিক কোথায়। মোটামুটি ভূতের গল্পটি চালু হওয়ার এক-দেড় দশক আগে থেকে দেখলেই এর উত্তর মিলবে। ২১ এপ্রিল ১৯৮২-র থেকে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ১৩ বছর আগে, ২২ এপ্রিল ১৯৬৯ চারু মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল সিপিআই (এমএল) রাজনৈতিক দল। নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান তার প্রায় বছর দুই আগেই শুরু হয় গেছে। কিন্তু এই নতুন দলের মধ্যে দিয়ে নকশাল রাজনীতি একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছল। যদিও দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামবাংলার কৃষিসমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তিসাধনা, কিন্তু দলের রাজনৈতিক কৌশল অনুযায়ী শহর কলকাতা হয়ে উঠল এই লড়াইয়ের অন্যতম পরিসর। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের মে মাসে কলকাতায় প্রথম পার্টি কংগ্রেসে যখন চারু মজুমদার সরাসরি শ্রেণিশত্রু নিধনের ডাক দিলেন, তখন কলকাতাই হয়ে উঠল নকশাল রাজনীতির অন্যতম ক্ষেত্র, বা রণক্ষেত্র।

দেওয়ালে দেওয়ালে স্লোগান লেখা হল, ‘পুলিশ মারো, অস্ত্র কাড়ো’। ১৯৭০-এর জুন মাসে তালতলায় খুন হলেন পুলিশ কনস্টেবল রঞ্জিতকুমার রায়। সেই শুরু। সেই জুন থেকে অক্টোবরের শেষের মধ্যে মারা পড়লেন প্রায় ২৫ জন পুলিশকর্মী, জখম হলেন প্রায় ৩৫০ জন। পুলিশের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকল। বড়কর্তারা তত দিনে নড়ে বসেছেন। এক দিকে তাঁরা শুরু করলেন পাশবিক দমন নীতি। রুনু গুহ নিয়োগীর মতো অফিসারদের দিয়ে সরকারি ভাবে গুমখুন আর অত্যাচারের জোয়ার ডেকে আনলেন। অন্য দিকে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের বার বার বোঝাতে থাকলেন যে, সাবধানে, গা বাঁচিয়ে, যথাসম্ভব অফিস-বাড়ির নির্ধারিত চৌহদ্দির মধ্যে জীবন কাটাতে হবে। এক সময় কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত সকলকে জানিয়ে দিলেন যে, পুলিশকর্মীদের জন্য অবসর সময়ে সিনেমা-থিয়েটার দেখতে যাওয়াও নিরাপদ নয়।

সব মিলিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি দাঁড়াল যে, পুলিশ এক দিকে প্রাণভয়ে কোণঠাসা। আর অন্য দিকে সেই ভয় আরও উস্কে দিয়ে শাসকগোষ্ঠী তাদের নির্মম অত্যাচার তুঙ্গে তুলছে। পুলিশ এবং জনগণ, দু’জনেরই দু’জনের প্রতি অনাস্থা, ভয় এবং ঘৃণা। তবে লিখতে গেলে যতটা সহজে পুলিশ আর জনগণকে দু’টি পৃথক গোষ্ঠী রূপে চিহ্নিত করা যায়, বাস্তবে তা হয় না। সাধারণ পুলিশ কর্মচারীরাও এই একই সমাজের অন্তর্গত। তাঁরা এবং তাঁদের জাতশত্রু, মায় ষাট-সত্তরের দশকের আদর্শবাদী যুবক-যুবতীরা, প্রায়শই একই পাড়ার বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে রয়েছে নানা সামাজিক আদানপ্রদান। কেউ হয়তো কারও দাদার বন্ধু, কারও মাসতুতো ভাই বা একদা স্কুলের সহপাঠী। এই সামাজিক আত্মীয়-প্রতিবেশীদের জাতশত্রু ঠাওরানো এবং তাদের হত্যা কখনওই সহজ ব্যাপার নয়। তবু তা-ই হল। ১৯৭০ থেকে ’৭৫ এর জরুরি অবস্থার শুরু অবধি ইতস্তত চলল এই নিধনযজ্ঞ। বেশ কিছু পুলিশকর্মী বেঘোরে মারা পড়লেন, আর তাঁদের মৃত্যুকে অজুহাত বানিয়ে তাঁদের সহকর্মীরা মারলেন বহু ছাত্রছাত্রীকে।

তবে ক্ষুদ্র জলতরঙ্গ যেমন বিশাল ঢেউয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়, তেমনি জরুরি অবস্থার বৃহত্তর দমনযজ্ঞে নকশাল-দমনের কর্মকাণ্ড চাপা পড়ে গেল। ১৯৭৭-এ যখন দিল্লির কংগ্রেস সরকারের হারের মধ্যে দিয়ে সেই বৃহত্তর নিপীড়নের অবসান হল, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, পুরনো অন্যায়ের হয়তো কিছুটা প্রতিকার হবে। পশ্চিম বাংলায়ও বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল। গণতন্ত্রমনস্ক অনেকেই ভাবলেন, হয়তো রুনু গুহ নিয়োগীর মতো অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হবে। অর্চনা গুহর মতো পুলিশ-নির্যাতনের শিকার যাঁরা, তাঁরা কিছুটা আশা নিয়ে কোর্টে মামলা করলেন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসুও সকলকে আশ্বাস দিলেন যে সুবিচার হবে। কিন্তু হল না কিছুই।

যে পুলিশকর্মীদের অত্যাচারী হিসেবে সবচেয়ে বেশি নাম ছিল, তাদেরই বার বার পদোন্নতি হতে থাকল। কোর্টের মামলা কোর্টেই ঝুলে রইল বছরের পর বছর। নগরজীবন গতানুগতিকতা ফিরে পেল। ফলে ১৯৮২ সালের শুরুতে, এক দিকে যেমন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সত্তরের দশকের পাপমোচনের কোনও সম্ভাবনাই নেই, আবার ও দিকে কেউ এই অবিচার এবং অত্যাচারের কথা ভুলতেও পারছে না।

এই বিচারের অভাব এবং তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্মৃতির অবিচলতা যে কেবল নকশালপন্থী এবং তাঁদের পরিবার-বন্ধুদের বিদ্ধ করছিল তা নয়, সমগ্র নাগরিক সমাজই এই দোটানায় পড়েছিল। পুলিশ কর্মচারীরাও তারই অন্তর্গত। যে পুলিশ কর্মচারীরা নকশালদের হাতে মারা পড়েছিলেন, তাঁদের পরিবারবর্গ কিংবা বন্ধুবান্ধবও হয়তো কোনও ধরনের প্ৰকাশ্য বিচার আশা করেছিলেন। কিন্তু কিছুই হল না। বাম সরকার ব্যাপারটিকে যত দূর সম্ভব তামাদি করে দিল।

যে হেতু কোর্টের মামলাগুলো ঝুলে রইল দশকের পর দশক, তাই টালমাটাল সত্তরের গোড়ার সেই বছরগুলোর সরকারি ভাবে কোনও ইতিহাসও লেখা হল না। ঘটনাপঞ্জি সামাজিক স্মৃতি হয়েই রয়ে গেল। আজকাল অনেকে সেই স্মৃতির নাম দিয়েছেন ‘নক্সালজিয়া’, অর্থাৎ নকশাল আন্দোলনের জন্য নস্টালজিয়া। তবে সেই ‘নক্সালজিয়া’ তৈরি হচ্ছে নভেল, সিনেমা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। সরকার-স্বীকৃত কোনও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে নয়।

তবে ২০২৫ আর ১৯৮২-র পটভূমিকায় বিস্তর ফারাক। ১৯৮২-র গ্রীষ্মকালে ষাট-সত্তরের সেই বেদনাদায়ক, অমীমাংসিত সামাজিক স্মৃতি তখনও দগদগে। তার মধ্যে একটা জরুরি ভাব তখনও টাটকা। ভূত তখনও পিতৃলোকনিবাসী উপকারী বরদাতা হয়ে ওঠেনি, সে তখনও বিচার চাইছে, তার ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। তার প্রতিবেশীদের সে তখনও তার মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে আশ্বস্ত করতে চাইছে।

এ দিকে বছর গড়িয়ে দশক, দশক গড়িয়ে শতক শেষ হয়ে যেমন ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের পরিবর্তন হয়েছে, আলিপুরের পুলিশ-ভূতও পরিবর্তিত হতে থেকেছে। ২০১৩ সালের ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকাতে এই গল্পের একটি বর্ণনাতে বলা হচ্ছে যে, ভূতটি আদতে সুধাংশু গুপ্ত নামের এক পুলিশ ইনস্পেক্টরের। তিনি নাকি ঠিক ওই স্থানেই পথদুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন। পত্রিকাটি এ-ও জানাচ্ছে যে, অশরীরীটিকে নাকি পুলিশই সুধাংশুবাবু হিসেবে শনাক্ত করেছে। ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে ছাপা সেই খবরটিতে বলা হয়েছিল যে, ভূতের চেহারার সঙ্গে মিল ছিল সশস্ত্র পুলিশের এক ইনস্পেক্টরের। তিনি নাকি মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে গিয়ে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে পথেই মারা যান। আরও বলা হয়, নিঃসন্তান সেই ভদ্রলোকের স্ত্রীও ছিলেন এক জন সাব-ইনস্পেক্টর, এবং স্বামীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই তিনিও মারা যান। তবে কোনও নাম সে সময় শোনা যায়নি। বরং ১৯৮২ সালে পুলিশের নানা অফিসে ঘোরাফেরা করে, নানা লোকের সঙ্গে কথা বলেও সাংবাদিক সঞ্জয় পণ্ডিত এ সব কিছুই শোনেননি। তাঁর অনুসন্ধানে কোনও মৃত পুলিশ অফিসারের খবরই পাওয়া যায়নি, নাম তো দূরের কথা।

আরও বছর দশেক এগিয়ে ২০২৩ সালে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজে ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সদ্যপ্রকাশিত ভারতের নানা শহরের ভূতের কিংবদন্তি সংক্রান্ত একটি বই থেকে আরও বর্ধিত একটি বর্ণনা পেশ করেছেন। সেখানে আবার পুলিশটি ইনস্পেক্টর নন। সার্জেন্ট। তিনি ট্যাক্সিতে উঠে যেতে চান ভবানীপুর থানা। ১৯৮২ সালে বিদেহী পুলিশ তখন গন্তব্য বলেননি, কেবল ট্যাক্সিতে উঠতেই তাঁর সুখ ছিল। এই একুশ শতকে তিনি চলেছেন ভবানীপুর থানার উদ্দেশ্যে। তাঁর চেহারারও কিছুটা বিবরণ মেলে। লম্বা, স্বাস্থ্যবান এবং উজ্জ্বল, পাট-ভাঙা উর্দি পরা। বাকি আখ্যানটি একই রকম।

তবে এখানেই শেষ নয়। ঋকসুন্দরবাবু আরও একটি গল্পের হদিস দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনায়, যে ট্যাক্সিচালক তাঁর গাড়িতে সার্জেন্টকে তুলেছিলেন, তিনিই নাকি কিছু দিন পর আর এক বৃষ্টির রাতে দেখতে পান, রাস্তার ধারে আধো-অন্ধকারে কে যেন পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখেন, সেই পরিচিত সার্জেন্ট। মাথা ফেটে তাঁর সাদা উর্দি রক্তে লাল। তবু একটি ক্ষীণ হাত তুলে কোনও মতে তিনি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। তাড়াহুড়ো করে ট্যাক্সি থেকে নেমে তাঁকে সাহায্য করতে যেতেই ফের সব অদৃশ্য। কোথায় পুলিশ? কোথায় তাঁর টকটকে লাল রক্ত?

অধিকন্তু পরিচিত গল্পটিতে একটু মেলোড্রামার ছোঁয়া। পরের দিন খবর নিয়ে ট্যাক্সিচালক নাকি জানতে পারেন যে, বহু বছর আগে এখানে এক পুলিশ পথদুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুমুখে পতিত, তখন হাজারো ডাকাডাকিতেও কেউ গাড়ি থামিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। ১৯৮২ সালের গল্পে যা ছিল অনুচ্চারিত, যেমন পথদুর্ঘটনার ব্যাপার বা নাগরিক সহানুভূতিহীনতার কড়চা, ২০১৩ সালে তা বিশদে বিবৃত।

কাহিনির এই অতি বিস্তারের দু’টি পরস্পরবিরোধী পাঠ সম্ভব। প্রথম, হতে পারে যে ষাট-সত্তরের সেই রক্তাক্ত সামাজিক স্মৃতি যতই ম্লান হয়ে আসছে, আগে যা না বললেও সকলে বুঝত, আজ তা বিশদে বলে দিতে হচ্ছে। আবার এও সম্ভব যে, আজকের ‘নক্সালজিয়া’র জেরে ষাট-সত্তরের নতুন যে স্মৃতি তৈরি হচ্ছে, তা স্বীকৃত বা বিকৃত যা-ই হোক, তার মধ্য দিয়েই স্মৃতির নতুন টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে।

১৯৮২ সালে যখন নিহত পুলিশের অশরীরী আত্মা আনন্দবাজারের মতো বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে এক ধরনের ব্যাপ্তি লাভ করছে, তখন এই খণ্ডযুদ্ধের উল্টো দিকে নকশালদের বিদেহী আত্মা পাড়ার ফিসফাসের গণ্ডি পেরোতেও অক্ষম। কোনও নকশাল ভূতের খবর কোথাও ছাপা হচ্ছে না। সাহিত্যিক উপমা রূপেও নকশালদের ভূত হতে প্রায় নব্বইয়ের দশক শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যে কারণগুলোয় পুলিশের ভূত দেখা যাচ্ছে, সেই একই কারণে তো নকশাল-ভূতেরও দেখা পাওয়া উচিত। তারাও তো সেই ধ্বংসলীলার অমীমাংসিত, অস্বীকৃত স্মৃতির টুকরো। তবু কেন তারা ভূত হচ্ছে না? তবে কি মৃত কমিউনিস্টের ভূত হয় না?

আসলে ভূত যেমন পুলিশের হয়েছিল, নকশালদেরও হয়েছিল। শুধু প্রচারের মাধ্যমে ছিল ফারাক। পুলিশের ভূত নিয়ে যে হেতু খোলাখুলি কথা বলা যেত, তাকে বৃহত্তর গণমাধ্যমে স্থান দেওয়া যেত। এবং সেই স্থানমাহাত্ম্যে তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যেতেন শহরের আপামর জনতা। অথচ আশির দশকের শুরুতে নকশাল শহিদদের সম্বন্ধে অতটা খোলাখুলি কথা বলার জায়গা তৈরি হয়নি। তাই নকশালদের ভূতের গল্প খুবই সঙ্কীর্ণ গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ রয়ে গেল।

নকশাল ভূতের এই সব টুকরো কাহিনি ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে মূলত আন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা নানা ব্লগ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। অনেকে তাঁদের সীমিত পরিধির ব্যক্তিগত স্মৃতি বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এই ব্লগারদের লেখাতেই ধীরে ধীরে ধরা পড়ছে এত দিন পাড়ার আনাচ-কানাচে লুকিয়ে থাকা নকশাল ভূতেরা।

এ রকম দু’টি গল্পের উল্লেখ করব এখানে। প্রথমটি সিরিটি শ্মশানের নিকটবর্তী অঞ্চলের। পুরনো একটি খাটালে এক বার কিছু নকশাল ছেলে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু খাটালের গোয়ালারা পুলিশে খবর দিয়ে দেয়। পুলিশ ছেলেগুলিকে এনকাউন্টার করে শ্মশানের পাশের ঝিলে ফেলে দেয়ে। সেই ঝিলের তলায় ছিলেন জাগ্রত এক কালীমূর্তি। তিনিই ছেলেগুলিকে কোলে তুলে নিয়েছেন। আজও অমাবস্যার রাতে তাঁর সেই মৃত সন্তানদের কোলে করে তিনি নাকি ঝিলের জলে ভেসে ওঠেন। ও দিকে আর একটি নিঝুম বাগানে একটি নিমগাছ থেকে কখনও কখনও সন্ধেবেলায় ঝুলতে দেখা যায় গলায় দড়ি দেওয়া এক নকশাল যুবককে। অঞ্চল জুড়ে রয়েছে অনেক নকশাল ভূত। কিন্তু তাদের হদিস দিয়েছেন এলাকায় বড় হয়ে ওঠা, অধুনা প্রবাসী এক ব্লগার।

পরের গল্প আরও চমকপ্রদ। ঘটনাস্থল লালবাজার সেন্ট্রাল লক-আপ এবং এখানে ভূত স্বয়ং চারু মজুমদার। গল্পটিতে বলা হয়েছে যে, সত্তরের দশকে সমাজবাদী এক রাজনৈতিক নেতা নাকি বন্দি অবস্থায় পুলিশদের কাছেই জানতে পারেন যে, চারুবাবু লক-আপে মারা যাওয়ার পর থেকেই ওখানে মাঝে মাঝে দেখা দেন। অত্যাচারে জর্জরিত তাঁর হাড় হিম করা চিৎকারও নাকি শোনা যায় রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে!

আমার কাছে এই নতুন গল্পগুলির মৌলিক সত্যাসত্য গৌণ। মুখ্য হল, এই গল্পগুলি আজ প্রথম শ্রুতির চৌহদ্দি পেরিয়ে স্মৃতির আকারে লিখিত হচ্ছে।

এই গল্পগুলির পাশাপাশি কনস্টেবলের ভূতের গল্পটির চরিত্রটা আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। পুলিশ ভূতের দেখা মিলেছিল আলিপুরের মতো বড়লোক পাড়ায়। নকশাল ভূত বেরোয় হয় সিরিটির মতো একদা নিম্নমধ্যবিত্ত অঞ্চলে, কিংবা জেলের ভিতরে। তেমনই পুলিশ-ভূত কারও ক্ষতিও করে না, ভয়ও দেখায় না। ১৯৮২ সালের সেই প্রাথমিক আখ্যানে তো অ্যাক্সিডেন্ট বা রক্তও ছিল না। কেবল ট্যাক্সিতে ওঠা আর ভরসা দিয়ে নেমে যাওয়া। এ দিকে নকশাল ভূতরা সরাসরি পুলিশি আগ্রাসনের স্বীকার। অত্যাচার আর খুন বাদ দিয়ে তাদের গল্প বলাই যাবে না।

তবে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, পুলিশ-ভূতের গল্পে যেমন কেবল দু’টি দল— পুলিশ এবং জনগণ, নকশাল ভূতের গল্পে কিন্তু সমাজ বা জনগণের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ নানা বিরোধের আভাস মিলছে। এমন একটা সময়, যখন ‘নক্সালজিয়া’র চোটে নকশাল মানেই মধ্যবিত্ত মেদুরতায় মাখামাখি গরিব মানুষের নিঃস্বার্থ ত্রাতা, তখনই সিরিটির গল্পে ধরা পড়ছে খাটালের গোয়ালাদের ব্যতিক্রমী স্মৃতি। তারা কারা? নিম্নবর্গীয় তো অবশ্যই, সম্ভবত অবাঙালিও। অর্থাৎ জনগণের মধ্যে, অথচ উচ্চবর্ণের হিন্দু নকশাল শহিদদের থেকে বেশ আলাদা একটি সামাজিক থাক। যাদের নকশালদের প্রতি মনোভাব, অন্তত গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে, তেমন ইতিবাচক ছিল না।

এখানেই ভূতেদের চাপল্য। যতই তাদের নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার চেষ্টা হোক, তারা ঠিক হাত ফস্কে নবকলেবরে অন্যত্র দেখা দেবে। তাই যুক্তিবাদীরা যতই ভূতেদের নির্বাসনে পাঠাতে চান না কেন, ভূতেরা কিন্তু শহরে ছিল, আছে এবং আমার ধারণা চিরকালই থাকবে। ভূতেরা কিন্তু অতৃপ্ত আত্মা নয়, তারা আসলে ইতিহাসের বৈমাত্রেয় ভাই-বোন। কতকটা অমীমাংসিত ইতিহাস, যাকে সরাসরি স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। অর্থাৎ যে অতীত সেই সময়কার প্রধান সামাজিক স্মৃতির সঙ্গে খাপ খায় না, তাকেই ভূত-রূপে আবির্ভূত হতে হয়। চাপা স্বরে বলা মৌখিক কিংবদন্তি, খবরের কাগজের প্রথম পাতার খবর কিংবা প্রবাসী ব্লগারের স্মৃতির আখ্যায়িকা— ভূতের গল্পের মাধ্যম বদলের সঙ্গে সঙ্গে অতীতকে বার বার উস্কে দিয়ে আবির্ভাব হয় নিত্যনতুন ভূতের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement