ছবি কুনাল বর্মণ।
অমরকণ্টকের পথে দুর্ধর্ষ ডাকাত মোহন সিংকে প্রায় পেড়ে ফেলেছে বাবলু। পঞ্চু মোহনের ভাই সোহনকে ফালা ফালা করে ফেলছে, এমন সময় আলো চলে গেল। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লাম, সারা বছর যখন এই সময় জারণ, বিজারণ আর ত্রৈরাশিকের ঝামেলায় আটকে থাকি, তখন আলোর অনুপস্থিতি অজুহাতের বাঁকা উঠোন হয়ে যায়।
চোখটা খুব টাটাচ্ছে।
আমার কি সাইনাস হল, মা?
এ বার বোধ হয় চশমাটা নিতেই হবে, বুঝলে!
এই সব বলে কৃশানু দে-র মতো পড়াশোনাকে ড্রিবল করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু এখন তো অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ। এই অখণ্ড সময়ের মালিক তো আমি, এই সময় আলোর এই চুরি-ডাকাতি ভাল লাগে? কর্মশিক্ষা ক্লাসে কুপি বানানো শিখিয়েছে। সে আর এমন কী হাতি ঘোড়া! ঘিয়ের শিশিতে তেল ভরে শিশির ছিপি ফুটো করে সলতে ঢুকিয়ে দেওয়া। কিন্তু ক্লাস সিক্সের আমি এটা বানিয়ে নিজেকে হোমি জাহাঙ্গির ভাবতে শুরু করেছিলাম, তাই ওটা মায়ের কাছ থেকে ধরিয়ে ছাদে রওনা দিলাম।
এই সময় বড্ড ভাল হাওয়া দেয়,আজ মঙ্গলবার, রাত আটটায় ডিডি মেট্রো-তে ‘শ্রীমান শ্রীমতী’ দেখা হবে না আলো না এলে। যাবতীয় মনখারাপ কেটে গেল ছাদে পৌঁছেই! তাতিন, টুবাই, সোমা, সবাই পাশের ছাদে ইতিমধ্যে হইচই জুড়ে দিয়েছে। সোমার যথারীতি দাবি, গান হবে। বাকিরা গাঁইগুঁই করছে, আমাকে দেখতেই সোমা কলকলিয়ে উঠল, “এই তো বুবান এসে গেছে, তুই-ই বল, গান হবে কি না?”
আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে! আমার ইচ্ছে হুল্লোড় হোক, আড্ডা হোক... গান-টান পরে দেখা যাবে। কিন্তু এটাও তো সত্যি, আমি আর সোমা দু’জনেই সেভেনে উঠেছি। ওদের ছাদের সর্বগ্রাসী কালির মাঝখানে দুটো অন্ধকার-মাখা হ্যারিকেন সোমাকে আরও রহস্যময়ী করে তুলেছে। এ রহস্য সোমার মধ্যে দু’বছর আগেও ছিল না, বা থাকলেও তা আমার বোঝার বাইরে ছিল। এই সময় ওকে অস্বীকার করার আত্মবিশ্বাসও আসছে না। মিনমিন করে বললাম, “গানই হোক।”
সবাই বলল, “তুই ওই ছাদে কী করছিস? আমাদের ছাদে আয়।”
আমি টুবাইয়ের হাতে শতরঞ্চি আর আমার কুপিটা ধরিয়ে পাঁচিল টপকে ওদের ছাদে পৌঁছে গেলাম। আমার কুপিটা ওদের হারিকেন দুটোর মাঝখানে বসেছে কি বসেনি, তাতিন গাঁট্টা মারল আমাকে, “তুই গান হবে বললি কেন? কোথাকার আলতাফ রাজা এলি তুই?”
তাতিন ক্লাস এইটে উঠবে। আমার খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু আজকাল কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে, তাই ওকে বেশি ঘাঁটালাম না। “না, না, আড্ডাও চলতে পারে...” বলে হাঁপ ছাড়ব ভাবলাম, সোমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “ইস! কী দলবদলু রে তুই? এক্ষুনি বললি গান, আবার এখন বলছিস আড্ডা?”
টুবাই বলল, “ট্রাম্প কার্ড খেলবি?”
আবার শুরু হল চেঁচামেচি। অবশেষে ঠিক হল, গান-আড্ডা মিলিয়ে-মিশিয়েই হবে। আমি এত ক্ষণ কী যেন বলছিলাম... যাচ্চলে! এ-কথা সে-কথা হতে হতে তাতিন হঠাৎ কেঁদে ফেলল, “আমি কাল বাবার গায়ে হাত তুলেছি!” বলে কাঁদতে কাঁদতে ছাদের কোণে জলের ট্যাঙ্কের দিকে সরে যেতে চাইল। আমরা আমাদের আলো নিয়ে ওর কাছে জড়ো হলাম, যাতে জলের ট্যাঙ্কের গাঢ়তর অন্ধকার আমাদের বন্ধুকে গিলে না ফেলতে পারে। আমরা কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলাম না, করতে হল না। ও নিজেই সব বলতে শুরু করল, “স্কুলে গেছিলাম এনসিসি-র জুতো ফেরত দিতে, ফিরে এসে দেখি মায়ের চোখের তলায় কালশিটে, কপালের মাঝ-বরাবর কাটা দাগ। বাবা বসার ঘরে বসে ঢুলছে। দুপুরের মধ্যেই মদ খেয়ে নিয়েছে। ছোটবেলা থেকে দেখছি এ সব, আমি ভাবতাম আমার কিছু এসে যায় না, কিন্তু কাল মাথা খারাপ হয়ে গেল।”
আমরা চুপ করে থাকলাম। আমরা জানতাম না কী বলতে হয় এ সময়। তাতিনদের বাড়ি থেকে অশান্তির আওয়াজ তো গোটা পাড়া শুনতে পায়। আড্ডাটা এপ্রিলের বিকেলের হাওয়ার চেয়েও এলোমেলো হয়ে গিয়ে আমার কুপির প্রাণসংশয় করছিল। বাচাল সোমা গান ধরল। শঙ্খচিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান। আমরা চুপ করে থাকলাম, সোমার গলা আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
গান শুনতে শুনতে টের পেলাম, এই বাড়ির বাকি ভাড়াটেদের মতো বা তাদের চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থা সোমাদের। সোমার বাবা কোথাও একটা নাটক করে, আবার অন্যদের নাটকের মিউজ়িকও করে, এই করেই ওদের চলে। আমি বাবার কাছে শুনেছি, সোমার বাবার এক সময় রাজনীতির কারণে জেলও হয়েছে। কিন্তু আমি যখনই দেখেছি, সোমার বাবার কিংবা মায়ের মধ্যে কোনও দৈন্য দেখিনি। কাকুর মুখে সব সময় হাসি, কাকিমার আদর সব সময় অনাবিল। আমি হঠাৎ টের পেলাম, আমার চোখের জল গড়িয়ে কুপির সলতেয় এক ফোঁটা পড়ে চড়চড় আওয়াজ হচ্ছে।
কী আপদ! কান্না পায় কেন আবার? ভাগ্যিস অন্ধকার! কেউ দেখে ফেললেই তো কেলো। শঙ্খচিল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুবাই গম্ভীর মুখে বলল, “আসল আন্ডারটেকার মারা গেছে, এখনকার আন্ডারটেকার নকল।”
ব্যস! লেগে গেল তর্ক, ভেসে বেরিয়ে গেল গণসঙ্গীত। সে দিন আলো কখন এসেছিল, আজ আর মনে নেই, কিন্তু স্মৃতির অন্ধকারে আড্ডাটা আজও গুপ্তধনের মতো জ্বলজ্বল করছে। বাড়িতে ফিরে, মনে আছে, আঙুল দিয়ে সলতের আগুন নিবিয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিল একটু, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ভালবাসলে এর চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট। আর ছাদ থেকে আসার সময় জলের ট্যাঙ্কের দেওয়ালে নিজেদের নাম লিখে এসেছিলাম। কী ভাবছিলাম আমরা? ওটা আমার বাড়ির ছাদ নয়, ওরা তিন জনও ভাড়াটে, অথচ সে বাড়ির জলের ট্যাঙ্কে আমরা দাবি করেছিলাম অমরত্বের অধিকার? কী ভেবে? আজ আর বলা সম্ভব নয়। হাসি পাওয়া উচিত কি? পাচ্ছে না যে! বরং উল্টোটাই…
উচ্চ মাধ্যমিকের পর, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, ২০০২
পান্থনিবাসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই কেয়ারটেকার কাকু বলে দিয়েছেন, সন্ধের পর আলো থাকে না। আলো তার কথা রেখেছে। চলে গেছে। আজকের পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের সঙ্গে তখনকার পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের কোনও মিল নেই। বাইরেও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সবাই জমিয়ে বসেছি মোম জ্বালিয়ে পান্থনিবাসের একটা ঘরে। আমাদের এমনিতে দুটো ঘর নেওয়া আছে। একটায় সোমা আর সোমার মা। আর একটায় আমি, তাতিন, টুবাই। এখন সবাই একই ঘরে আড্ডা দিচ্ছি। এটা সোমাদের ঘর, আমাদের ঘরে আমরা টুকটাক সিগারেট খাচ্ছি বলে কাকিমাকে আমাদের ঘরে ঢুকতে না দিয়ে আমরাই চলে এসেছি এ ঘরে।
মোমবাতির চার পাশে ভূতের গল্প ঘোরাফেরা করে এ সব জায়গায়। ঠিকমতো পাকড়াও করে আসরে ছাড়তে পারলেই কেল্লা ফতে।
আমি তারই চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। নিজে মুখে বলতে চাই না, আসর জমছিলও ভাল। শুধু তাতিন কেমন যেন উসখুস করছিল, কিছু ক্ষণ পর পর “একটু ঘুরে আসছি” বলে ঘর থেকে ঘুরে আসছিল। যাকগে, আমরা ভাবছিলাম ও বোধ হয় আমাদের থেকে একটু বেশি সিগারেট খাচ্ছে। তাতিন এ বছর আবার জয়েন্টের চেষ্টা করেছে, তাই পুরো বছর বসেই ছিল। ঘুরতে এসে কে আর অন্যদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়, আমরা আমাদের আড্ডায় জমে গেছি।
এখন বয়সের সঙ্গে আমার আর সোমাকে দেখে সে রকম কষ্ট হয় না। আমি নিজেও জানি না, যে ভাবে একটা বয়সে অনুভূতিটা এসেছিল, তেমনই তা কবে যেন কেটেও গিয়েছিল। তাই টুবাই আর সোমার যখন প্রেমটা হল, আমার কষ্ট তো হয়ইনি, বরং আনন্দই হয়েছিল। মাঝখানে কাকু, মানে সোমার বাবা মারা গেছেন। টুবাইরা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়ি করে পাশেই উঠে গেছে। টুবাই আর সোমার বিষয়ও এক। ওরা সব কোচিংয়ে এক সঙ্গেই যায়। কাকিমাও সবটাই জানেন। আমার মাথায় আসলে অভিনয়ের ভূত চেপেছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার গোটা আমিটাকে আমি শুধু রিহার্সাল রুমেই খুঁজে পাই। বাকি আর সব কাজে আমার টুকরো-টাকরা পৌঁছয়। তাই এই মুহূর্তে প্রেম নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথাও নেই। ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে ‘আমি শাহরুখ হব’ বলে ধ্যানও করছি রীতিমতো। আমার ইচ্ছে আমি কাল পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে পুজোর পর আমার বন্ধুদের আমার মনের এই গোপন লক্ষ্যের কথা জানাব। কী আর করবে? বড়জোর তাতিন খ্যাক-খ্যাক করে হাসবে, হাসুক। এই সব ভাবছি, সোমা কী গাইছে তাতেও খুব একটা মন নেই, হঠাৎ আমাদের ঘরের বাথরুম থেকে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ এল। আমরা দৌড়লাম। গিয়ে দেখি, বাথরুম ভিতর থেকে বন্ধ। আমি আর টুবাই লাথি মেরে বাথরুমের দরজা খুললাম। দেখলাম, কমোডের পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তাতিন। ওই অল্প আলোতেও দেখলাম তাতিনের এক হাতে রাংতা, আর এক হাতে একটা মোম। অবশ ঠোঁট থেকে ঝুলছে একটা রাংতার নল।
আমরা টের পাইনি, কাকিমা কখন পিছন থেকে এসে দাড়িয়েছে, কাকিমাই প্রথম চিৎকার দিল “ডাক্তার, এক্ষুনি!” তার পর সবটা সত্যি ধোঁয়াশা। কী ভাবে ওই রাতে লোকাল ডাক্তারের ব্যবস্থা করেছিলাম কেয়ারটেকারের হাতে-পায়ে ধরে তা আমরাই জানি, বা সত্যি বলতে জানি না। ডাক্তার আসেন, তাতিনের জ্ঞান ফেরে, আমরা ডাক্তারের ধমক এবং তাতিনের স্বীকারোক্তি থেকে জানতে পারি, তাতিন বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে শেষ ছ’মাস যাবৎ ব্রাউন শুগারের নেশা করছে। এ রকম ওর আগে কোনও দিন হয়নি।
ডাক্তারবাবু বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টুবাই দৌড়ে গিয়ে প্রথমে থাপ্পড় মারল তাতিনকে, তার পর ওকেই জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। আমরা টের পেলাম, তাতিনের চক্করে পড়ে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে, এখন আর মোমের আলোর দরকার নেই। নিবিয়ে দিলাম। ফিরুক কলকাতায়, হচ্ছে তাতিনের।
ঝড়ঝাপটা, ২৬ মে, ২০০৯
গতকাল আয়লার উৎপাতে সব লন্ডভন্ড হয়ে একাকার। চতুর্দিকে গাছ উপড়ে পড়ে পুরো পাড়া অন্ধকারে ডুবে গেছে, এ দিকে আর দু’দিন পর টুবাই বিদেশ চলে যাচ্ছে কাজে। আমিও শুটিং-এর কাজে বাইরে চলে যাব, তাই আজকেই একটু বসার আয়োজন করেছি। আমার বাড়িতেই। মদ অবশ্য নিয়ে এসেছে টুবাই। না, তাতিন খাবে না। তাতিন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে ফেরার পর আমাদের চাপে মানসিক হাসপাতাল থেকে তিন মাস চিকিৎসা করিয়ে আসে, তার পর আর কোনও নেশার জিনিস ছোঁয়নি। তাতে কী? ও দেখবে, আমরা খাব।
সবার শেষে ঢুকল সোমা। কে বলবে ও কলেজের রাশভারী অধ্যাপিকা? এসেই ঝঞ্ঝাট বাধিয়ে দিল— “এই গরমে ঘরে বসে মদ কে খায়? মোমবাতি নিয়ে বারান্দায় বসে মদ খাওয়া হবে...” এই রকম হাজারটা বায়নাক্কা। সবটাই মানা হল। যথারীতি আড্ডায় পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের কথা তুলে তাতিনকে খেপানোও হল। আমি কোন কোন ছবিতে ঝুলিয়েছি, তাই নিয়েও চাটাচাটি হল বিস্তর। রাত ঘন হল চেনা চুটকির হাত ধরে, কত পুরনো মুখ উঠে এল আমার বারান্দায় গল্পের ছুতো ধরে। ভুলটা করলাম আমি। হাসতে হাসতে সোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা কাকু-কাকিমা এ রকম কট্টর বামপন্থী, আর তুই কি না এই সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে হাজত ঘুরে এলি?”
সোমা ঠোট দিয়ে দাঁত কামড়ে কী একটা ভাবল। মোমের আগুনের মধ্য দিয়ে আঙুল চালাল বারকতক, তার পর বলল, “দেখ, আমি কী পন্থী, সেটা জানি না, তবে ছোটবেলায় বাবা আমাকে যা শিখিয়েছে, আমি এ বারও তাই করেছি। আমি মনে করেছি, যে বছর নন্দীগ্রামের মতো একটা ঘটনা ঘটেছে, সে বছর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুধু অশোভন নয়, অশ্লীল। তাই প্রতিবাদ করেছি, হাজত হয়েছে হয়েছে। আমার সঙ্গে তাতিনও ছিল।”
“আমার শুধু মনে হয়, চাকরি আরও বাড়লে খারাপ হত না,” টুবাই সিগারেটে টান দেওয়াতে আগুনটা উজ্জ্বল হয়ে দাড়িটা লালচে দেখাল।
“ডেডবডির উপর দিয়ে হেঁটে চাকরি? এটা তুই চাস?” তাতিনের গলাটা একটু বেসুর ঠেকল।
“তোদের তাই মনে হলে কিছু করার নেই, কিন্তু এই যে আমি বিদেশে যাচ্ছি, আনন্দ করে তো যাচ্ছি না, দেশে কাজ নেই বলে যাচ্ছি। মায়ের ডায়ালিসিস চলছে, এই সময় এই শহর ছাড়ার মানেটা বুঝিস তুই, তাতিন?” বলে সিগারেট অ্যাশট্রেয় গুঁজে সোমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে ড্রপ করব?”
কথার ধরন শুনে আমি আর তাতিন একেবারে এক সঙ্গে উঠে টুবাইকে জড়িয়ে ধরে কাতুকুতু দিতে শুরু করলাম। কবে ফিরবে ঠিক নেই, আবার দেমাক দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়া হচ্ছে! ব্যস, টুবাইয়ের আর বেরোনো হল না, আমরা সবাই এক সঙ্গে লেপ্টে থাকলাম খানিক ক্ষণ। আমাদের জট ছাড়ল সোমার গানে। সোমা বারান্দায় হেলান দিয়ে ধরেছিল, “আমি শুনেছি সেদিন তুমি…”
সে দিন জ্যোৎস্না উঠেছিল কি না মনে নেই, কিন্তু সোমার গলায় এক ধরনের পূর্ণিমা আছে, যা আমাদের তিন জনকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল বরাবরের মতো। মোমবাতিটা গলে গায়ে মোম জমে ঠিক শার্লক হোমসের মতো দেখতে লাগছিল।
আলো নেভার খবর, ৩০ মে, ২০২১
সে দিনও ছিল লোডশেডিং। দরজায় আওয়াজ শুনে মোমবাতিটা হাতে নিয়ে দরজা খুলেছিলাম। মূর্তির মতো মোম হাতেই বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। সম্বিৎ ফিরল তাতিন গায়ে হাত রাখতে। ঘরে ঢুকে পিঠে হাত দিয়ে সরিয়ে আনল ঘরের এক কোণে।
টুবাই মারা গেছে। বিদেশে। টুবাইয়ের নিজের বলতে এ দেশে কেউ আর নেই। কাকিমা ২০১৩-তে মারা যান। সোমা আর টুবাইয়ের বিয়েটা হয়নি। সোমা ক্রমশ মানুষের মধ্যে, এ দেশের কাজের মধ্যে এমন জড়িয়ে পড়ছিল যে, ওর পক্ষে বিদেশে টুবাইয়ের সঙ্গে থিতু হওয়া আর সম্ভব ছিল না, আর টুবাইয়ের পক্ষে এ দেশে ফেরা ছিল অযৌক্তিক। তাই ২০১৩-তে কাকিমা, মানে টুবাইয়ের মা যখন মারা যান, তখন এ দেশে এসে সোমার সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে নেয় টুবাই। তাতে টুবাইয়ের সঙ্গে সোমার সম্পর্কও খারাপ হয়নি। বরং এখন সোমা আর তাতিনের সম্পর্ক তলানিতে।
তাতিন এখন এলাকার খুবই প্রভাবশালী এক জন মানুষ। প্রশাসনের খাস লোক। সকালে তার দরজায় উমেদারদের ভিড় সদা সর্বদা। কিন্তু নন্দীগ্রামের জন্য পথে নামলেও সোমা কখনও তাতিনের অফিসে উমেদার হয়ে যায়নি। যত বার গেছে, প্রতিবাদ করতে গেছে। তাই এক সময়ের সহযোদ্ধা ছোটবেলার বন্ধু এখন আর দু’জন দু’জনের মুখ পর্যন্ত দেখে না। আমি কত বার চেষ্টা করেছি চার জনকে নিয়ে এক সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানানোর। এদের দু’জনের ঝামেলায় প্রত্যেক বার ভেস্তে গেছে, শেষে আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি। এই দামড়া বয়সে এ সব ভাল লাগে বন্ধুদের মধ্যে? সোমা নিজের কাজের চক্করে বিয়ে করল না, টুবাইয়ের অবশ্য পার্টনার ছিল দীর্ঘ দিনের। সেই জোহানেসবার্গে সবটা সামলেছে। আমাকে ফোনও টুবাইয়ের পার্টনার সুজ়ান করেছিল। কারণ, শুধু আমার নম্বরই সুজ়ানের কাছে ছিল।
আমি তখন সদ্য মেক-আপে বসেছি, খবরটা পাওয়ামাত্র পৃথিবী দুলে উঠেছিল। বাজার করতে বেরিয়ে গ্যাং-ফাইটের মাঝে পড়ে গুলি খেয়েছে টুবাই। কোনও রকমে তাতিনকে ফোন করি। তাতিন সব কাজ ফেলে আমার স্টুডিয়োয় দৌড়ে আসে উদ্ভ্রান্তের মতো, চোখ টকটকে লাল। সোমা সুন্দরবনে ছিল, আমার ফোনে খবরটা পেয়ে চুপ করে থাকল কিছু ক্ষণ, তার পর বলল, “রাখছি রে, পড়াতে যেতে হবে।”
আমি আর তাতিন দু’জন দু’জনকে ধরে হাউহাউ করে কাঁদলাম। আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিছু। টুবাই জোহানেসবার্গে গল্ফ ক্লাবের মেম্বার, নিয়মিত কর্পোরেট ম্যারাথনগুলোয় অংশ নিত। সব নেশা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমরা ঠাট্টা করতাম বিদেশে গিয়ে টুবাইয়ের যা রুটিন, ও নীরদ সি চৌধুরীর থেকে বেশি বাঁচবে। তাতিন নীরদ সি চৌধুরী কে জানতই না, তবু ও যে কেন হাসত, কে জানে! সেই জীবনটা একটা উটকো গুলির চক্করে শেষ হয়ে যাওয়া যেন এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।
আজকের স্মরণসভা আমি আর তাতিন আয়োজন করেছি। টুবাইয়ের এ দেশের বন্ধুরা সবাই আসবে, ওকে নিয়ে দুটো কথা বলবে, সেটুকুই। আমি অভিনেতা, যে কোনও জায়গায় সেলফির আবদার মেটানো আমার কাজের একটা অংশ। সেই সেলফি তুলতে তুলতেই দেখলাম সোমা এসে ঢুকল, দাঁড়াল টুবাইয়ের ছবির সামনে। আমার নতুন করে কান্না পাচ্ছিল, সেটা চেপে হাসিমুখের মুখোশে ছবি তুললাম আরও খানকতক। সোমা এখন চশমা পরে, দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি ওর মুখে স্পষ্ট। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। যারা নিজেদের মধ্যে মারপিট করে অযথা গুলিতে আমার বন্ধুকে মারল, তারা জানেও না, আমাদের জীবনের একটা অংশ তাদের একটা গুলির আঘাতে শেষ হয়ে গেল। আমরা পরস্পরের হাত ধরে কাঁদলাম। সোমা বলল, “এ বার উঠি রে।”
বললাম, “টুবাইয়ের জন্য কিছু গাইবি না?”
তাতিনের ভাঙা গলা শুনতে পেলাম, “ছেড়ে দে, আজ ওর গলা কেঁপে যাবে।”
দেখলাম, তাতিন জানলার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে। আর বহু দিন, বহু দিন পর দেখলাম নিজের প্রতিপক্ষের কথার প্রতিবাদ করল না সোমা। দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। সোমার অপস্রিয়মাণ ছায়াটা দেখতে দেখতে টের পেলাম, সোমার চেহারাটা আগের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে।
আঁধার দখলের ২১ অগস্ট, ২০২৪
যাদবপুরে এসে মিছিল শেষ। আর জি করের ডাক্তার মেয়েটির ঘটনা আমার মতো গা-বাঁচানো মানুষকে পর্যন্ত রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। এক কোণে কিছু মানুষ মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখছে, ওখানে প্রথম দেখলাম সোমাকে। উবু হয়ে বসে মোম জ্বালছে। ও আমারই বয়সি, কিন্তু আমার থেকে চুল বেশি পেকে গেছে ওর। ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম, “চা খাবি?”
যাদবপুরের এই চায়ের দোকানে আমরা চার জন মাঝেমধ্যেই চা খেতে আসতাম। আজ টুবাই পৃথিবীতে নেই, তাতিন মিছিলে নেই। চা খেতে খেতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে? তোর ক্লান্ত লাগে না?”
সোমা অবাক হয়ে তাকাল, “কেন রে?” বলে চায়ে চুমুক দিল।
আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, “আমি আজকের কথা বলছি না, আজ তো এই বিষয়ে আমিও পথে নামছি। কিন্তু তুই তো হেঁটেই চলেছিস সোমা। আর কত? কত দিন? তুই কত কিছু একা একা ঠিক করবি?”
সোমা হাসল কি? অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না ঠিক। বলল, “আমার সঙ্গে হাঁটলে বাক্স পড়ে যাবে তোর?” অন্ধকারেই প্রশ্ন করল।
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ?”
সোমা হাসতে হাসতে বলল, “তুই বাবা ফিল্মস্টার! আমার সঙ্গে হাঁটলে তোর বক্স অফিস পড়ে যাবে না তো?”
আমি হেসে বললাম, “যে মরে গেছে, তার আবার ম্যালেরিয়ার ভয়! চল উঠি।”
বিক্রমগড়ের এই দিকটা বেশ অন্ধকার। সোমা বলল, “তোর দামি সিগারেট একটা দে।”
ধরিয়ে দিলাম, নিজেও ধরালাম একটা।
সোমা বলল, “তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। তোর মনে আছে, টুবাই মারা যাওয়ার পর তোর থেকে আমি সুজ়ানের নম্বর নিয়েছিলাম?”
আচমকা প্রশ্নে চমকে গেছিলাম, তাও বললাম, “হ্যাঁ, কেন চেয়েছিলি?”
সোমা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, “তুই সাউথ আফ্রিকার সিস্টেমেটিক আউটেজ সম্বন্ধে কিছু জানিস?”
আমি বেকুবের মতো বললাম, “না।”
“আমিও জানতাম না। সুজ়ান বলেছে...” সোমা নিজের মনে বলতে থাকল, “বছরের কোন সময় শহরের কোন অংশে বিদ্যুৎ থাকবে না, তা আগে থেকে বলা থাকে। ওদের পোর্টালে গেলে দেখে নেওয়া যায়। সেই হিসেবে এলাকার মানুষ নিজেদের কাছে জল, এমার্জেন্সি লাইট তৈরি রাখে। সেই রাতে টুবাইদের ফ্ল্যাটের এমার্জেন্সি লাইটের ব্যাটারি খারাপ হয়ে যাওয়ায় টুবাই সুজ়ানকে বলে ফ্ল্যাটের তলার দোকানে যায় মোম কিনতে। তার কিছু ক্ষণ পরই সুজ়ান গুলির শব্দ শুনতে পায়। এই বার তুই ভাব বুবান, একটা লোক সব ছেড়ে বিদেশে গেল, ভাল থাকবে বলে বিদেশে গেল... যে লোকটা যদি জানতে পারত কোথাও কোনও ঝামেলা হচ্ছে, অন্য পাড়া দিয়ে যেত, তাকে বিদেশে একটা গুলি মেরে দিয়ে গেল? তাও একটা মোমবাতির জন্য?” সোমা হাসতে হাসতে বললেও ওর ভিতরের কান্নাটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।
এ বার আমার দিকে তাকিয়ে সোমা উত্তর দিল, “জানি না আমি ভুল না ঠিক কারণে হেঁটেছি। কিন্তু যখন আমার মন বলেছে এটা ঘরে বসে থাকার সময় নয়, তখনই পথে নেমেছি। নিজেকে অন্তত ঠকাইনি, আর নিজেকে না ঠকালে ক্লান্ত হওয়ার কথা তো আসে না বুবান। আমার সব মিছিলে তুই থাকবি না বুবান, তোর থাকার কথাও নয়। কিন্তু আমি থাকব, দুটো মোম আমার ঝোলায় নিয়ে আমি থাকব। যত দিন রাষ্ট্র আমায় কারণ দেবে, আর এ শহর অনুমতি, তত দিন আমি হাঁটব। আর জানিস বুবান, এই শহর আমাকে শিখিয়েছে, পথে এক বার নামতে পারলে বন্ধুর অভাব হয় না। একটা মোমের আলো থেকে জ্বলে ওঠে হাজার হাজার মোম, রাতের অন্ধকার আলোয় আলোয় মুছে যায়...”
আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। এ বার আমার ওঠার পালা। সোমাকে বলতে ও বলল, ও কাছেই থাকে, হেঁটে চলে যাবে। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো একে একে পেরিয়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে আমার ছোটবেলার বন্ধু সোমা। আমার সোমা, আমাদের সোমা। বৃষ্টির জন্য ছাতা বার করেছিল। বিবর্ণ পোশাকের তুলনায় ফ্যান্সি আগুনরঙা ছাতাটা একটু বেমানান লাগছিল। কিন্তু বিবর্ণ পোশাকের মাথার উপর ধরা বেমানান ছাতাটাই তো আমার শহর। সোমা হেঁটে যত দূরে যেতে লাগল, আমার মনে হতে থাকল, আমার বন্ধু আমাকে ছাড়িয়ে আমার শহর হয়ে উঠছে। নাকি আমার তৈরি সেই ক্লাস সিক্সের কুপি? অপটু, কিন্তু নিজের। সলতের ক্ষমতা অল্প, কিন্তু ছাদের অন্ধকারকে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেবে না কিছুতেই।
গাড়িতে উঠে আমার সহকর্মী বাবলুকে জিজ্ঞেস করলাম, “দুর্ধর্ষ ডাকাত মোহন সিংকে অমরকণ্টকে ধরে কোন জেলে দিয়েছিলে?”
বাবলু কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “কী দাদা?”
আমি হেসে বললাম, “কিছু না, চলো।”