পরবগান: নিজেদের মধ্যেই বাজনা বাজিয়ে গান গেয়ে আনন্দ করেন এই মানুষজন। ছবি: নারায়ণ দে।
তিটুসমা একটা গান বেঁধেছেন। তিরিশ বছর বয়সি যুবতী তিটুসমা টোপ্পো নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের বাঁধা গান শুনিয়ে থাকেন। এ তল্লাটে সব অনুষ্ঠানই হয় পুজোর সময় থেকে। তিটুসমা গান বাঁধেন নিজের ভাষাতেই। একটা গান বেঁধেছেন, ‘মালাইয়া আবুরে, বুঝাইয়া আবু’। যার অর্থ হল, ‘কোন মেয়ে অন্য রাস্তায় পালিয়ে যাচ্ছে। যা বাবু, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। আমরা ওকে শিখিয়ে দেব। বুঝিয়ে দেব।’ পিচ রাস্তার এক পাশে মাঝেরডাবরি চা বাগান, অন্য পাশে বক্সার জঙ্গল। তিটুসমার বাড়ি বক্সার জঙ্গল ঘেরা কালকূট বস্তিতে। এই সব চা-বাগান, বনবস্তি থেকে বহু মেয়েকে কাজের লোভ দেখিয়ে কোথায় যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর কেউ খোঁজ পায়নি। তিটুসমা তাই এই গানটি বেঁধেছেন। তাঁর ভাবনা, গান শুনে অনেকে সচেতন হবে। পুজোর সময়ে নানা অনুষ্ঠান হয় চার পাশে, মেলা বসে। সেখানে গান শোনাতে ডাক পড়ে তিটুসমার। তাই পুজোর আগে থেকে নতুন নতুন গান বাঁধেন তিনি। এই গানটিও কোনও এক পুজোর আগে তৈরি। সে অর্থে এটিও পুজোর গানই বটে।
তিটুসমা পুজোর মেলায় গিয়ে গান করেন। গানের আগে তাঁর নাম ধরে ঘোষণা হয়, “এখন গান গাইবেন তিটুসমা টোপ্পো।” প্রতি বারই যখন নিজের নাম অন্যের মুখে শোনেন তিনি, তত বারই কেউ যেন ভেতর থেকে বলে ওঠে, “এ কিন্তু আমার আসল নাম নয়।” তাঁর উপাধি টোপ্পো নয়, অসুর। তিটুসমা অসুর।
“বলুন তো, দুর্গাপুজোর মেলায় কেউ অসুরকে গান গাইতে ডাকবে?” এই প্রশ্ন থেকেই একে একে উপাধি বদলে নিতে শুরু করেছেন আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি চা বাগান এবং লাগোয়া এলাকার অসুর গ্রামের ‘অসুরেরা’। তিটুসমার যেমন উপাধি বদলে গিয়েছিল স্কুলে। গোটা ক্লাসে তিনিই তখন একমাত্র ‘অসুর’। জঙ্গল বনবস্তি যখন কাশফুলে ভরে যেত, পুকুরে-ডোবায় পদ্ম ফুটে উঠত একটা-দুটো, তখন কত প্রশ্ন শুনতে হত তিটুসমাকে— “হ্যাঁ রে, তোর ঠাকুরদা কি আসল অসুর ছিল?” “তোদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে দুর্গা ঠাকুরের যুদ্ধ হয়েছিল?” স্কুলবেলায় বাড়ি ফিরে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইত বড়দের কাছে। বড়রা বলেছেন, “পুজো চলে এসেছে। এখন আর বাড়ি থেকে বেরোতে হবে না। দুর্গা বিসর্জন যাক, তার পরে।” ছোটবেলায় তিটুসমা দেখেছেন, পুজোর আগে থেকে গোটা গ্রাম ঘরে থাকে। সন্ধেবেলায় দূর থেকে ঢাক-কাঁসরের শব্দ ভেসে এসেছে, তখন ওঁরা দুয়ার দিয়েছেন ঘরে। সকাল বেলায় অন্য ছেলেমেয়ের দল হাতে কাশফুল নিয়ে মুখ দিয়ে ঢাকের বোল নকল করে শব্দ বের করেছে, নেচেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন তিটুসমারা। চোখাচোখি হয়ে গেলে ছেলের দল থেকে কেউ দু’পা এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছে, “তোমরা কি অসুর?” তিটুসমা তখনও দুয়ার দিয়েছেন ঘরে।
তার পরে এক দিন স্কুলে পদবি বদলে গিয়েছে তিটুসমার। অসুর থেকে টোপ্পো। এখন আলিপুরদুয়ার রেল হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন তিটুসমা। কপালে হাত রেখে রোগীর উত্তাপ বোঝার চেষ্টা করেন, ওষুধ খাইয়ে দেন। ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলেন রোগীকে। বাড়ি ফিরে গান বাঁধেন। পুজোর মেলায় শোনানোর জন্য যে গান বাঁধা হয়, তা বিলক্ষণ পুজোর গান! শব্দ করে হাসেন তিটুসমা। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আমরা তো অসুর। অসুররা কি পুজোর গান বাঁধতে পারে?”
আলিপুরদুয়ার জেলার মাঝেরডাবরি, জেলা সদর শহর থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে বেশ কয়েক ঘর অসুর রয়েছেন। তাঁরা সত্যিই মহিষাসুরের বংশধর কি না, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বহু লোক গবেষক বিস্তর পুঁথি দেখে, তথ্য জোগাড় করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তা হল— এ সব নেহাতই কাল্পনিক সত্য। কল্পনা-উত্তর সত্য হল, অসুর বলে একটি সম্প্রদায় আছে, যাঁরা নিজেরাই নিজেদের মহিষাসুরের উত্তরসূরি বলে ভেবে নিয়েছিলেন। যাঁদের আশপাশের বসতির লোকেরা অসুর বলে দেগে দিয়েছে। যাঁরা মনে করেন, মা দুর্গা তাঁদের পূর্বসূরিদের যুদ্ধে বধ করেছেন। এবং এই কল্পনা-উত্তর সত্য থেকেই দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে ঘরে দুয়ার এঁটে বসে থেকেছেন অসুর সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। দিন কেটেছে ভয়ে। পুজোর সময়ে কেউ কেউ ঘরে কালো কাপড়ের টুকরো ঝুলিয়ে রেখেছেন। পুজো শেষে নদীতে স্নান করে আবার নিজেদের কাজে ফিরেছেন।
অসুর সম্প্রদায়ের মানুষরা এখন চা-পাতা তোলেন, কৃষিকাজ করেন, বাইরে দোকানে কর্মচারীর কাজে যান। আর পাঁচটি জনজাতি সম্প্রদায়ের মতো তাঁদেরও নিজেদের ভাষা আছে। সে আঞ্চলিক ভাষায় ওঁরা কথা বলেন, তার নাম ‘আসুরি’। তাতে আমাদের চেনা শব্দও আছে। ওঁরা চালকে বলেন চাউল, ডালকে বলেন ডাইল। আবার মাছ হল উতু। ওঁরা মা-কে ডাকেন আমা বলে।
একাধিক পুজো জড়িয়ে আছে তাঁদের জীবনচর্যায়। সারনা পুজো, নাওয়া খানি, গোহালি পুজো, খালিয়ান পুজো, হোলি পুজো, শিকারি পুজো, বনগারি পুজো উল্লেখযোগ্য। মাঝেরডাবরির অসুর মহল্লায় দেখা মিলবে এক পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের সঙ্গে। গায়ের রং তামাটে। চুল এক দিকে পেতে আঁচড়ানো। তাঁর টিনের বাড়ি। বৃষ্টির জল আটকাতে জায়গায় জায়গায় প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধন দেওয়া। মাটির উঠোন। ঘরে ঢোকার মুখে একটি সন্ধ্যামালতী গাছ, তাতে অনেক ফুল ফুটেছে। তিনি রামকুমার টোপ্পো। অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু নামে সে উপাধি গিয়েছে ঘুচে। তিনি পঞ্চায়েত সদস্যও। তাঁর মুখে সব সময়ে হাসি। যা জানতে চাওয়া হয়, হাসিমুখে শোনেন, হাসি মুখে উত্তর দেন। “অসুর থেকে টোপ্পো না হলে কি পঞ্চায়েত সদস্য হতেন না?” প্রশ্ন শুনে স্বভাবসিদ্ধ হাসেন রামকুমার। বলেন, “সে সব আর নেই।” পুরনো দিনের কাহিনি শোনান তিনি। বলতে থাকেন, “আমার বাবা তো বটেই, সে সময়ের বড়রা কেউ দুর্গাপুজোয় যেতেন না।” রামকুমার দেখেছেন, পুজোর অনেক আগে থেকে বাড়িতে আনাজ সংগ্রহ করে রাখা হত। চাউল, ডাইল, উতু— সব। যাতে পুজোর ক’দিন কোনও প্রয়োজনেই বাড়ি থেকে বেরোতে না হয়। ওঁদের মনে সে সময় ভয় দেখেছেন রামকুমার। সঙ্গে দেখেছেন দুঃখও। তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা প্রায় সকলেই পুজোর সময়ে আধমরা হয়ে থাকতেন। ক্ষোভে, দুঃখে, নাকি কোনও অপমানে, তা এখন ঠিক মনে করতে পারেন না রামকুমার। তবে পুজো আসা মানেই একটা যে সুর কেটে যাওয়া, তা দিব্যি মনে আছে তাঁর। সকালে রোদ এক পাশ থেকে আর এক পাশে যেতে না যেতেই হাঁড়িয়া, মদ খেয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত গ্রাম। সন্ধের পরে কোনও উঠোনে আলো জ্বলত না। চা-বাগানে পাশের মহল্লায় যখন দুর্গামণ্ডপ থেকে ধুনোর গন্ধ বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তত ক্ষণে অসুরদের গ্রাম যেন আর কেউ জেগে নেই। ছোটরা কেউ একটু জোরে কথা বললে ধমক শুনেছে, “তুহার কি মস্তি লাগিসে?” তোদের কি উৎসব না কি? রামকুমারের মনে আছে, বড়রা বলতেন, দুর্গাপুজো তাঁদের উৎসব নয়। এখন আর সে সব বাধা নেই। রামকুমার জানান, তিনি এখন পুজোমণ্ডপে যান। মেলায় যান। অনেক ক্ষণ ধরে গান শোনেন। তিনি বলেন, “বাপ-জেঠাদের সময় এখন আর নেই। সেই নিয়মরীতিও আর নেই, আমরা সবার সঙ্গে দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে অন্য সব উৎসব পালন করি।”
শোনা যায়, এ তল্লাটে এক সময়ে অসুরপুজো হত। অসুরদের গ্রামে নাকি সে সব প্রচলিত ছিল। তবে খুবই সাবধানে। ‘বহিরাগত’ নজর এড়িয়ে। সে পুজোয় স্বাভাবিক ভাবেই দেবী দুর্গা নায়িকা নন, বরং পূজিত হতেন অসুর। সেখানে অসুর খলনায়ক নয়, এক শক্তিময়ী আর্য নারীর হাতে অকালমৃত এক অনার্য বীর। তাই লুকিয়ে-চুরিয়ে হত সেই পুজো। যদিও রামকুমার সে সব কথা মানেন না। তিনি বলেন, “আমার জন্মের পর আমি কোথাও অসুর পুজো হতে দেখিনি।”
জন্মের আগে? সে কথা আর কে-ই বা বলতে পারে! স্বভাবসিদ্ধ হাসেন রামকুমার অসুর।
এক সময় চা-বাগানের ইংরেজ ম্যানেজাররা ছোটনাগপুরের মালভূমি এলাকা থেকে তাঁদের অনেককে নিয়ে এসেছিলেন আলিপুরদুয়ারে। এই এলাকা ছাড়া ডুয়ার্সের ক্যারন চা-বাগানেও অসুর সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা আছেন। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে অসুর সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৪৮৬৪ জন। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার, এই দুই জেলাতেই এদের মোট সংখ্যা ছিল ৩১০৮ জন। এঁরা দ্রাবিড় গোষ্ঠীর অন্তর্গত বলেই অধিকাংশের দাবি। স্থানীয় আদিবাসী অর্থাৎ, রাভা, টোটো, গারো, মেচ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা চা-বাগানে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন না বলেই বলা হয়। তাই ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, সাঁওতাল পরগনার মতো জায়গা থেকে অসুরদের উত্তরবঙ্গে এনেছিলেন ইংরেজরা। দীর্ঘ দিনের বসবাসের সুবাদে তাঁদের কথ্য ভাষাও বদলে গিয়েছে। আসুরি ভাষায় খুব একটা কেউ কথা বলেন না এখন, সাদ্রি-হিন্দি মেশানো ভাষাই শোনা যায় এ মহল্লায়। তবে এ সমাজে এখনও জাঁকিয়ে রয়েছে পিতৃতন্ত্র। পিতার সম্পত্তির ভাগ ছেলেরাই পেয়ে থাকেন, বিবাহিত মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পান না। তবে অবিবাহিত মেয়েরা বর্তমান সময়ে পিতৃ-সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকেন। যদি কোনও ব্যক্তির দু’জন স্ত্রী থাকে, তবে প্রথম স্ত্রীর সন্তান সম্পত্তির ভাগ পাবেন। অন্যরা পাবেন না। তবে প্রথম স্ত্রীর সন্তান না থাকলে দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পত্তির ভাগ পাবেন। কোনও ব্যক্তির কোনও উপপত্নী থাকলে, তিনি সম্পত্তির ভাগ পাবেন না, অথচ তাঁর পুত্রসন্তান ভাগ পাওয়ার অধিকারী।
অসুর সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা খুঁটিয়ে দেখেছেন লোকগবেষক প্রমোদ নাথ। তিনি অসুর সমাজ নিয়ে বইও লিখেছেন। তাঁর কথায়, নানা প্রথা, বিধিনিষেধ রয়েছে অসুরদের জীবনযাত্রায়— “অপদেবতা বা অশরীরী আত্মার কু-নজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এখনও অসুরেরা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সন্ধ্যায় বা রাতে একা কোথাও যেতে দেয় না। এ ছাড়াও সাধারণত মৃত পূর্বপুরুষদের কোনও একটি নাম এই নবজাতকের জন্য বেছে নেওয়া হয়।” অর্থাৎ, চলে আসা নামগুলি হারাতে চায় না এ সমাজ। এমন প্রথা অনেক সমাজেই আছে। যদিও প্রথাগুলি এখন সর্বত্রই অনেকটা আবছা হয়ে এসেছে।
আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি চা-বাগানে অসুর পাড়ায় এখন ২২টি পরিবার থাকে। চা-বাগানের পরে পিচরাস্তা। তার পরে বক্সার জঙ্গল। সেখানে কালকূট বস্তির অসুরগ্রামে রয়েছে ১৮টি পরিবার। এখানেই থাকেন রামকুমার, তিটুসমারা। তাঁদের অনেকেই এখন ধর্ম পরিবর্তন করেছেন। তিটুসমার মায়ের নাম কারীয়। তাঁর বয়স এখন নব্বই। তিনি পুজোমণ্ডপে যান না। বেশ কয়েক বছর আগে, যে বার নিষেধ করার মতো শেষ ব্যক্তিটিও আর রইল না, সে বার মণ্ডপে গিয়ে কারীয় পুজো দেখে এসেছেন। তার পরেও কয়েক বার গিয়েছিলেন। এখন তিটুসমা যান। মেলায় যান, গান করেন। রামকুমারদের মতো অনেকে ধর্ম পরিবর্তন করেননি। তাঁরাও পুজোমণ্ডপে যান। ছোটদের কাপড়-জামা কিনে দেন। হাতে টাকাও গুঁজে দেন। তবে সকলে অঞ্জলি দেন না।
কেন দেন না? ওদেরই এক জন বলেন, “কোনও কারণ নেই, এমনিই। অনেকে অঞ্জলি দেয়। আবার অনেকে দেয় না।”
সময় বইতে থাকে। স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে এখনও প্রতি বছর পুজো আসে অসুরদের গ্রামে।