Netaji Subhas Chandra Bose

শিগগিরই একদিন ভাতে ভাত খাওয়াতে হবে

আবদার সুভাষচন্দ্র বসুর। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর কাছে। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে নেতাজির অন্তর্ধানের কয়েক দিন আগের ঘটনা। সেটাই দু’জনের শেষ দেখা। এক রাতে চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল এক দল ছাত্র।

Advertisement

কৃষ্ণা বসু

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০০:০৯
Share:

সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসু বাসন্তী দেবীকে বলতেন, “তুমিই সুভাষের আসল মা, আমি তো কেবল ধাত্রী।”

Advertisement

কিংবদন্তি জাতীয়তাবাদী নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) বিধবা স্ত্রী বাসন্তী দেবী এখনও জীবিত (১৮৮০-তে জন্ম, মৃত্যু ১৯৭৪)। এখন তিনি বৃদ্ধা। কিন্তু বছর কয়েক আগেও তাঁর স্মৃতি ছিল পরিষ্কার। সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা অদ্ভুত হর্ষ-বিষাদ মিশিয়ে বলতেন। এই গল্প লেখককে কত বার যে বলেছেন!

তাঁকে প্রথম কবে দেখেছিলেন বাসন্তী দেবী? ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ওটেন-কাণ্ডের পরে। এক রাতে চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল এক দল ছাত্র। তখন তিনি জনপ্রিয় আইনজীবী, ব্রিটিশ কালা-আইনের হাত থেকে বাংলার জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের রক্ষা করছেন। দাশ-দম্পতি যখন নৈশাহারে বসেছেন, তখন তাঁদের কাছে ভিজ়িটার্স স্লিপ এনে দিলেন ভৃত্য। দেশবন্ধু বললেন, “ওঁদের নিয়ে আসুন।” বাসন্তী দেবী অবাক। “তুমি ওঁদের খাওয়ার ঘরে আসতে বলবে না,” তিনি বললেন। “কেন নয়?” জানতে চাইলেন দেশবন্ধু। ছাত্রদল ভিতরে ঢুকে পড়ল, তার মধ্যেই ছিলেন সুভাষ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিষিদ্ধ। অভিযোগ, তরুণ ব্রিটিশ অধ্যাপক এডওয়ার্ড এফ ওটেন, যাঁর উদ্ধত আচরণ ছাত্রদের আহত করেছিল, তাঁর উপর সংঘটিত ছাত্র-হামলার নেতা ছিলেন সুভাষ। বাসন্তী দেবী প্রথম বার সুভাষচন্দ্র বসুকে দেখলেন। তখন তাঁর বয়স ১৯।

Advertisement

কয়েক বছর পার হল। ১৯২১ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের নিয়োগ থেকে সুভাষের পদত্যাগ ভারতে হইচই ফেলে দিল। ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ড থেকে দেশবন্ধুকে এ কথা জানিয়েছিলেন তিনি, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সুভাষ লিখেছিলেন, “বঙ্গে ন্যাশনাল সার্ভিস প্রোগ্রামের প্রচারক আপনি। সেই জন্য, সামান্য যেটুকু শিক্ষা, মেধা, শক্তি এবং উৎসাহ আমার আছে, তা নিয়েই আজ আমি আপনার কাছে এসেছি।”

কলকাতায় পৌঁছে তিনি দেশবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কিন্তু দেশবন্ধু কলকাতায় ছিলেন না, বাসন্তী দেবীকে অতিথি সম্পর্কে জানানো হল। তাঁকে বলা হল, “সুভাষ বসু এসেছেন।” তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “সেই সুভাষ বসু, যিনি আইসিএস থেকে পদত্যাগ করেছেন!” সে দিন তাঁরা অনেক ক্ষণ কথা বললেন। বিশেষ এক সম্পর্কের সূচনা সে দিনই। বাকি জীবন বাসন্তী দেবীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন সুভাষ, সেই নামেই উল্লেখ করতেন সর্বত্র।

যখনই কোনও বিষয় নিয়ে গুরু-শিষ্য মতভেদ হত, মধ্যস্থতা করতেন বাসন্তী দেবী। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে সুভাষ লিখেছিলেন, “অনেকেই ভাবেন, আমরা তাঁকে [চিত্তরঞ্জন] অন্ধ ভাবে অনুসরণ করি। আমি নিজে অন্তত বলতে পারি যে, অজস্র প্রশ্নে তাঁর সঙ্গে তর্ক করেছি। আমাদের ঝগড়াগুলো মায়ের মধ্যস্থতায় মিটমাট হত।” ১৯২৪ সালে কলকাতার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হলেন দেশবন্ধু, এবং ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের (সিএমসি) চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার হিসেবে চাইলেন সুভাষকে। সুভাষ তৎক্ষণাৎ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। গুরুকে তিনি বললেন, সিএমসি-র চিফ এগজ়িকিউটিভ হওয়ার জন্য তিনি আইসিএস ছাড়েননি। হতাশ দেশবন্ধু স্ত্রীর শরণাপন্ন হলেন— “দেখো, তুমি যদি বোঝাতে পারো।” উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর শেষ অবধি তাঁকে ওই পদ গ্রহণের ব্যাপারে রাজি করাতে পারলেন বাসন্তী দেবী। সুভাষকে তিনি বললেন, চাকরির সূত্রে পাওয়া বেতন গ্রহণ করার দরকার নেই। সেই টাকা সুভাষ তাঁকে দিয়ে দিতে পারেন। ভাল কাজে সব সময়ই অর্থের প্রয়োজন হয়।

দেশবন্ধু যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁর পরিবারের মেয়েরা অসহযোগ আন্দোলন এবং কোর্ট অ্যারেস্টে অংশগ্রহণ করবেন, আপত্তি তুললেন সুভাষ। তিনি মনে করেছিলেন, সব পুরুষেরা বন্দি হলে তবেই মেয়েরা এগিয়ে আসবে, তাদের আগে পাঠিয়ে দেওয়া অনুচিত। কিন্তু দেশবন্ধু ছিলেন নাছোড়বান্দা। বাসন্তী দেবী আবারও সুভাষকে মত বদলে রাজি করালেন। এমনকি, তাঁকে সত্যাগ্রহের স্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেও অনুরোধ করলেন সুভাষকেই। দ্রুত গ্রেফতার হলেন বাসন্তী দেবী। এই ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে কলকাতা এবং গোটা বাংলা জুড়ে ক্ষোভের ঢেউ তুলল। সরকার বুঝল, একটা সাঙ্ঘাতিক ভুল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই মাঝরাতে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল। বাসন্তী দেবীর গ্রেফতারি নিয়ে জনমনে যে ভয়ানক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, তা কাজে লাগানোর কথা ভাবছিলেন দেশবন্ধু। স্ত্রীকে অকস্মাৎ বাড়ি ফিরে আসতে দেখে খুব হতাশ হয়েছিলেন তিনি। বাসন্তী দেবী স্বামীকে বলেছিলেন, “পুলিশ আমাকে কারাগারে রাখবে না, তুমিও আমাকে বাড়িতে রাখতে চাও না। আমি কোথায় যাব?”

যখন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হচ্ছে, তখন পৌঁছলেন সুভাষ। বাসন্তী দেবীকে ফিরে আসতে দেখে অঝোরে কেঁদে ফেললেন। তর্ক থেকে মন সরে গেল বাসন্তী দেবীর, সুভাষকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। জানালেন, ভাল আছেন তিনি।

নেতাজি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। সহজে ভেঙে পড়তেন। দেশবন্ধু তাঁকে নাম দিয়েছিলেন ‘ক্রন্দিত অধিনায়ক’ বা ‘ক্রাইং ক্যাপ্টেন’। তাঁর কান্নার অভ্যেস নিয়ে ঠাট্টা করতেও ছাড়তেন না। ১৯৩৩ সালে বিভাবতী বসু (আমার ভাবী শাশুড়ি) এবং তাঁর পুত্র আমার ভাবী স্বামী শিশির, যাঁর বয়স তখন মাত্র ১৩, তাঁদের নিয়ে শরৎ ও সুভাষকে দেখতে জব্বলপুর জেলে গেলেন বাসন্তী দেবী। বসু-ভ্রাতৃদ্বয় তখন সেই কারাগারে বন্দি। সুভাষ ভগ্নস্বাস্থ্য, চিকিৎসার জন্যে ইউরোপে যাওয়ার কথা। দর্শনার্থীরা যখন ফিরে যাচ্ছেন, নেতাজি ভেঙে পড়লেন, কান্না থামেই না। বাসন্তী দেবী ছিলেন স্থির, শান্ত। প্রয়াত স্বামীর একটি শাল সুভাষকে দিয়ে বলেন, এই শালের সঙ্গে দেশবন্ধুর আশীর্বাদ আছে।

অনুপ্রেরণা: স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

ব্যক্তিগত বিষয়ে বাসন্তী দেবীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতেন সুভাষ। সুভাষকে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, “বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবছ?” ভারতে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা ছিল যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া অবধি বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেছেন সুভাষ। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবে সুভাষ বলেছিলেন, “আমি নিশ্চয়ই বিয়ে করব। কখনও বলিনি, করব না।”

অনেক পরিবারই সুভাষের সঙ্গে সম্বন্ধের আশায় বাসন্তী দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করত। এক বার এক মেয়ের বাবা কংগ্রেসের তিলক তহবিলে এক লক্ষ টাকা দান করতে চাওয়ার পর একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। এই ‘অফার’ পেয়ে সুভাষকে নিয়ে তামাশা না করে থাকতে পারেননি দেশবন্ধু! জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে বাড়িতে ডেকে পাঠান। বলেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে।

সুভাষ এসে অনুদানের খবর পেয়ে সাঙ্ঘাতিক উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দেশবন্ধু তখন ভাবলেশহীন ভাবে বলেন, এখানে একটা সমস্যা আছে। সমস্যা? “হ্যাঁ। তোমাকে ওই ভদ্রলোকের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।” সুভাষ এতে মোটেই আমোদিত হন না, বরং খুব রেগে যান। সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর যখন নৈশভোজে বসছেন, তখন হুড়োহুড়ি করে তাঁকে চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে ডেকে আনা হয়! কিছু ক্ষণ পর তিনি শান্ত হন, বাসন্তী দেবীকে রাতের খাবার বানিয়ে দিতে বলেন।

সুভাষের জন্য রান্না করা বাসন্তী দেবীর কাছে নতুন নয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরেও তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যেতেন সুভাষ। বেশির ভাগ সময়েই খুব দেরি করে যেতেন, বারান্দায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। রাত গভীর হতে তাঁর পিছন পিছন আসা পুলিশ সিআইডি-র লোকেরা বাইরে ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ত, কখনও বৃষ্টির দাপট সহ্য করতে হত। কিন্তু ওই বেচারাদের জন্য বাসন্তী দেবীর মতো সহানুভূতি ছিল না সুভাষের। তিনি বরং বলতেন, “ওদের অপেক্ষা করতে দিন। ওরা ভিজুক। বিশ্বাসঘাতকদের একটু শাস্তি পাওয়া দরকার।” সুভাষ চলে যাওয়ার আগে তাঁকে সামান্য রাতের খাবার পরিবেশন করতেন বাসন্তী দেবী। সিদ্ধ ভাত আর তরকারি— বাঙালির ‘ভাতে ভাত’। সুভাষের খুব প্রিয় খাদ্য। ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে ৩৮/২ এলগিন রোড-এর (অধুনা নেতাজি ভবন) পারিবারিক ভবন থেকে বিদেশে পলায়নের ঠিক আগে সুভাষকে শেষ বার দেখেছিলেন বাসন্তী দেবী। অনশন করার পর সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, শরীর তখনও বেশ দুর্বল। বাসন্তী দেবীর মনে পড়ে, তাঁর দিকে তৃষ্ণার্ত ভাবে চেয়ে হেসে সুভাষ বলেছিলেন, “মনে রেখো, শিগগিরই আমাকে এক দিন ভাতে ভাত খাওয়াতে হবে।” আজও সেই খাওয়ানো বাকি।

১৯২৫ সালের জুন মাসে, অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। মাত্র ৫৪ বছর। এই শোকে বাসন্তী দেবী এবং সুভাষের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ছিল। সুভাষ প্রথমে শোকে অভিভূত হলেও সিদ্ধান্ত নেন যে, দেশবন্ধুর শিষ্য হিসেবে ভারত স্বাধীন করার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে। অসহযোগ আন্দোলনে বাসন্তী দেবীর যোগ দেওয়ার বিরোধী সুভাষ এ বার চাইলেন, দেশবন্ধুর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করুন তাঁর স্ত্রী। কিন্তু জনজীবন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন বাসন্তী দেবী। বারবার তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও বিফল হন সুভাষ। তিনি মিশরের ম্যাডাম জ়াগলুল পাশা (সাফিয়া খানুম), যিনি উম-অল-মিসরিইন (সব মিশরীয়ের মাতা) নামে পরিচিত হন, এবং চিনের ম্যাডাম সান ইয়াৎ-সেন (সুং চিং-লিং)-এর উদাহরণ দিয়ে তাঁকে প্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এঁরা দু’জনেই স্বামীর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক নেতৃত্বে এসেছিলেন, যথাক্রমে ১৯২৫ ও ১৯২৭ সালে। কিন্তু কোনও অনুরোধেই বাসন্তী দেবীকে টলানো যায়নি। হতাশ হয়ে তাঁকে তিরস্কার করে সুভাষ বলেন, “দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর যাঁরা কর্তব্যে অবহেলা করেছেন, আপনি তাঁদের মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে...”।

সুভাষ কেন বাসন্তী দেবীকে তাঁর স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে চেয়েছিলেন, তার পিছনে একাধিক কারণ আছে। বাংলায় কংগ্রেসের রাজনীতি তখন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গোলকধাঁধায় বিপন্ন। সুভাষ বিশ্বাস করতেন, বাসন্তী দেবীই হতে পারেন কাঙ্ক্ষিত ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু গভীরতর কারণটি হল, ভারতীয় নারীদের শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ নয়, নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গাতেও যাওয়া দরকার বলে মনে করছিলেন সুভাষ। রাজনৈতিক সভায় তিনি একটি জনপ্রিয় বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতেন: ‘না জাগিলে আজ ভারত-ললনা’। ১৯২৭ থেকে তিনি নিজের বড় ভাই ও ঘনিষ্ঠতম রাজনৈতিক সহযোদ্ধা শরৎচন্দ্র বসুর স্ত্রী বিভাবতীকেও রাজনীতির কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই ভাবনারই চূড়ান্ত ফসল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আজ়াদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট। ইতিমধ্যে সুভাষ বাসন্তী দেবীর জয়গানও করেন— “আপনি কেবল চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী নন, আপনি বঙ্গমাতার অবতার।”

বাসন্তী দেবীকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার পিছনে আর একটি তৃতীয় কারণও থাকতে পারে। জীবনের সেই পর্যায় তিনি তখনও পার হননি, যখন তাঁর আর গুরু বা পথপ্রদর্শকের দরকার পড়বে না, ১৯২১ থেকে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। শিষ্য থেকে নেতার ভূমিকায় এই রূপান্তর মনের উপর ভয়ানক চাপ তৈরি করে। তাই গোড়ার দিকে, দেশবন্ধু চলে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল, তা বাসন্তী দেবীকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন সুভাষ। দেশবন্ধু যখন দার্জিলিং-এ প্রয়াত হন, সুভাষ তখন বর্মায় সরকারের দ্বারা কারারুদ্ধ। কলকাতায় দেশবন্ধুর শেষকৃত্যে গাঁধীর নেতৃত্বে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। সুভাষ বাসন্তী দেবীকে লিখেছিলেন, “যিনি একই সঙ্গে আমার জীবনের লক্ষ্যে আমার বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক, তিনি আর নেই। আজ আমি একেবারে নিঃস্ব। একমাত্র আপনিই এই অসহায় মানুষটির আশ্রয়।” চিঠির নীচে সই করেছিলেন, ‘আপনার সম্পূর্ণ অকর্মা কিন্তু ভালবাসার পুত্র সুভাষ’।

এটা বলাই যায় যে, নিজের মায়ের চেয়েও বাসন্তী দেবীর সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সেই দিক থেকে প্রভাবতী বসুর কথা ঠিক। দাশ-দম্পতি তাঁর কাছে ছিলেন দ্বিতীয় অভিভাবকের মতো, যাঁদের সঙ্গে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠ এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্ক ছিল সুভাষের, নিজের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে যা ছিল না।

বাসন্তী দেবীকে সুভাষ যে রাজনৈতিক ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিলেন, তাতে তিনি রাজি ছিলেন না। কিন্তু পর্দার পিছনে প্রিয় সুভাষের জীবন সংগ্রামে তিনিই ছিলেন মূল শক্তি। ১৯২৫-এ দেশবন্ধুর প্রয়াণ এবং ১৯২৮-এ বাসন্তী দেবীর নিজের পুত্র চিররঞ্জনের মৃত্যুর পর সুভাষ আর তাঁর ‘মা’-এর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তবু তিনি আড়ালেই থাকতে চাইতেন। ১৯৩৮ সালে নেতাজি যখন কংগ্রেসের সভাপতি হলেন, তিনি বাসন্তী দেবীর সঙ্গে অধিবেশনে যেতে চেয়েছিলেন। সে বছর গুজরাতের হরিপুরায় অধিবেশন বসেছিল। তাঁকে আসতে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলেন সুভাষ, কোনও লাভ হয়নি।

বাসন্তী দেবীর মাতৃসুলভ স্নেহ কেবল সুভাষেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৩২ সালের গোড়ার দিকে যখন আমার শ্বশুর শরৎচন্দ্র বসু গ্রেফতার হন, তখন আমার শাশুড়ি বিভাবতীর নিজেকে এবং তাঁদের আট সন্তানকে রক্ষা দায়িত্ব নিতে হয়। সাড়ে তিন বছর জেলে কাটান শরৎচন্দ্র বসু। আমার ভাবী স্বামী শিশিরের পরিবারের এই কঠিন সময়ে বিরাট মানসিক আশ্রয় হন বাসন্তী দেবী।

১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে, শিশিরের সঙ্গে আমার বিয়ের কিছু কাল পরে তিনি এক মহিলার সঙ্গে আমাকে আলাপ করাতে নিয়ে যান, যাঁকে তিনি ‘ঠাকুমা’ বলে ডাকেন। তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে যাই। দীর্ঘদেহী বৃদ্ধাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। তাঁকে দেখলেই সম্ভ্রম জাগে, কিন্তু দুঃখের বাতাবরণও অনুভব করা যায়। তিনি প্রায়ই সুভাষের কথা বলতেন, সব সময়ই গভীর আকাঙ্ক্ষা এবং হারানোর অনুভূতি নিয়ে।

১৯৬০-এর দশকের গোড়ায় ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িতে (নেতাজি ভবন) শিশির যখন নেতাজি মিউজ়িয়ামের সূচনা করলেন, তখন তিনি একটি অনুরোধ নিয়ে বাসন্তী দেবীর কাছে গিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে বর্মার কারাবাস থেকে ফেরার সময় সংগ্রহ করা অনেক বর্মি জিনিসপত্র সঙ্গে এনেছিলেন সুভাষ, যার মধ্যে ছিল একটি সেগুন কাঠের চেয়ার এবং খুব সুন্দর মর্মর বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধমূর্তির প্রদর্শনী হল ১ উডবার্ন পার্কের নতুন ভবনে, ১৯২৮-এর গোড়ায় এলগিন রোডের পাশে নির্মিত যে বাড়িতে পরিবার ও সুভাষকে নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন শরৎ। ১৯৩০-এর শুরুর দিকে বাসন্তী দেবীর মনে হয়েছিল, ত্যাগের প্রতীকস্বরূপ বুদ্ধ পারিবারিক ভবনে থাকা উচিত নয়। তিনি সেটি নিয়ে এসে রাখলেন চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের ছোট উপাসনাস্থলে। দেশবন্ধুর স্মৃতিতে দক্ষিণ কলকাতায় তৈরি হয় এই মহিলা হাসপাতাল। প্রায় ৩০ বছর মূর্তিটি সেখানে ছিল। নেতাজি মিউজ়িয়ামে প্রদর্শনীর জন্য ঠাকুমার কাছে সেই মূর্তিটি চান শিশির। সেটি মিউজ়িয়ামের গোড়ার দিকের সংগ্রহের একটি। তাঁকে লেখা সুভাষের অনেকগুলি চিঠিও তিনি নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোকে দান করে যান। ১৯৫৭ সালে নেতাজি ভবনে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন শিশির।

নিঃসন্দেহে সুভাষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীদের অন্যতম বাসন্তী দেবী।

(১৯৭১ সালে প্রবন্ধটি লেখেন কৃষ্ণা বসু। চার জন নারী, যাঁরা নেতাজির জীবনকে প্রভাবিত করেছেন— বাকি তিন জন তাঁর মা প্রভাবতী, বৌদি বিভাবতী, এবং স্ত্রী এমিলি শেঙ্কল— তাঁদের নিয়েই ছিল মূল বড় প্রবন্ধটি। প্রকাশের জন্য এটি সামান্য সম্পাদনা করেছেন সুমন্ত্র বসু।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement