গোস্বামী দুর্গাপুর। বেশ অদ্ভুত নামের এই গ্রামটিতে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন কখনও? তেমন পাথুরে প্রমাণ নেই, তবে না যাওয়ারও কোনও কারণ নেই। শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়া কতটুকু আর পথ! সেখানে, চুয়াডাঙা মহাসড়কের পাশে এই গ্রাম। শিলাইদহের জমিদারি সামলানোর কোনও অবসরে রবীন্দ্রনাথ এক বারও যাননি ছোড়দিদি বর্ণকুমারীর শ্বশুরবাড়িতে, এমনটা মনে হয় না। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহ হয়েছিল এই গোস্বামী দুর্গাপুরে।
এই গ্রামের বিখ্যাত মুখোপাধ্যায় পরিবারের অনেকেই কৃতী। যেমন বঙ্কিম-বান্ধব রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কবি ও গদ্যলেখক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তবে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় বিস্তৃত হয়ে আছে ‘হিন্দু ফিলোসফি’, ‘হিন্দু মাইথোলজি’-র মতো একাধিক গ্রন্থে। তাঁর ছোটভাই সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় চিকিৎসক হিসেবে ভারতখ্যাত। জার্মান ভাষায় সুপণ্ডিত এবং কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অকালপ্রয়াত সতীশচন্দ্র ছিলেন বর্ণকুমারীর স্বামী। রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাইবাবু।
তিন-সাড়ে তিন বছরের বড় এই দিদি সম্পর্কে ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: ‘...ছোড়দিদি আমাদের সঙ্গে সেই একই নীলকমল পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে পড়িতেন, কিন্তু পড়া করিলেও তাঁহার সম্বন্ধে যেমন বিধান, না করিলেও সেইরূপ। দশটার সময় আমরা তাড়াতাড়ি খাইয়া ইস্কুল যাইবার জন্য ভালোমানুষের মতো প্রস্তুত হইতাম, তিনি বেণী দোলাইয়া দিব্য নিশ্চিন্তমনে বাড়ির ভিতরদিকে চলিয়া যাইতেন...।’ বর্ণকুমারী রবিকে বেশ বকাঝকাও করতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন সদ্য বিবাহিত। বালক রবির ইচ্ছে করত নতুন বৌঠানের সঙ্গে ভাব জমাতে, কিন্তু ভিতরমহলে যাওয়ার উপায় নেই। কখনও কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারলেও, ছোড়দিদি তাড়া দিয়ে বলতেন: “এখানে তোমরা কী করতে এসেছ, যাও, বাইরে যাও।”
দেবেন্দ্রনাথের দুই কন্যা শরৎকুমারী আর বর্ণকুমারী অতিমাত্রায় সাংসারিক ছিলেন। তাঁরা মগ্ন থাকতেন ঘরের কাজে। সকাল থেকে তাঁদের বসত কুটনো কোটার আসর, সেই সঙ্গে মেয়েলি আড্ডা— দুই বোন ছাড়াও তাতে থাকতেন সৌদামিনী, প্রফুল্লময়ী, সর্বসুন্দরী, কাদম্বরী-সহ আরও অনেকেই। বাড়ির ছোট ছোট মেয়েরাও গল্পের টানে সেখানে হাজির হত। রন্ধনপটু বর্ণকুমারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’ নাটকে প্রসন্নর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই অভিনয় দাগ কেটেছিল বালিকা ভাইঝি ইন্দিরার মনেও। ছোটপিসির অভিনয় নকল করে দেখাতেন তিনি। অন্যান্য বড় নাটকে বর্ণকুমারীকে অংশ নিতে দেখা না গেলেও অভিনয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। অনেক বার নাটকের মহলায় তিনি উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েছেন। সেলাই-ফোঁড়াইয়ে দক্ষ ছিলেন, গানও জানতেন। ভালবাসতেন উপাসনা সেরে দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে। কিছু কিছু লিখেছেনও, কিন্তু লজ্জায় সঙ্কোচে নিজের নামে প্রকাশ করতে পারেননি। তাই আজ পুরনো ‘ভারতী’র পাতা থেকে তাঁর বেনামি লেখাগুলো খুঁজে বার করা খুবই কঠিন।
কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা নিয়ে যত ‘গোয়েন্দা কাহিনি’ উঠে এসেছে তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বর্ণকুমারীর নাম। তিনি নাকি অমল হোমকে বলেছিলেন: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোব্বার পকেটে সে কালের এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর সঙ্গে ‘জ্যোতিদাদার অন্তরঙ্গতার পরিচায়ক কতকগুলো চিঠি পাওয়া যায়। চিঠিগুলো পেয়ে কাদম্বরী ক’দিন বিমনা হয়ে কাটান। সেই চিঠিগুলোই তাঁর আত্মহত্যার কারণ এই কথা নাকি কাদম্বরী দেবী লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই লেখাটি ও চিঠিগুলো সবই মহর্ষির আদেশে নষ্ট করে ফেলা হয়।’ বস্তুত কাদম্বরী দেবীর এই ‘সুইসাইড নোট’-সিরিজ়ের বীজ রোপণ করেছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ— বর্ণকুমারী ও অমল হোমকে বরাত দিয়ে। ওদুদকে খারিজ করে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন: ‘এ-বিষয়ে অমল হোমের কোনো লেখা আমরা দেখিনি, সুতরাং বর্ণকুমারী দেবীর মুখে তাঁর শোনা কথা এবং তাঁর মুখে ওদুদ সাহেবের শোনা কথা… কতখানি নির্ভরযোগ্য সে-সম্বন্ধে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।’
নব্বই বছর বয়সে প্রয়াত (৩ নভেম্বর ১৯৪৮। একই তারিখে ১৮৬৯ সালে তাঁর বিবাহ হয়েছিল) বর্ণকুমারী দেবী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বাদশতম সন্তান। মহর্ষি তাঁর জমিদারি সম্পর্কিত শেষ উইল করেন ১৮৯৯-এর ৮ সেপ্টেম্বর। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কনিষ্ঠা কন্যার জন্য তিনি জমিদারি আয় থেকে বরাদ্দ করেছেন প্রথমে মাসে সাতাশি টাকা, পরে তা বেড়ে হয় একশো টাকা। উইলের হিসেব মতো নানা জনকে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ ছিল বার্ষিক বাহান্ন হাজার চারশো টাকা। এই অর্থপ্রদানে দায়বদ্ধ ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ। কবির যখন চুয়াত্তর বছর বয়স, একমাত্র জীবিত দিদি বর্ণকুমারী ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দিলেন! দুই বছর ধরে তাঁর ভাতা বন্ধ কেন— প্রাপ্য আদায়ের জন্য এই মামলা রুজু হল ১৯৩৫-এর মার্চ মাসে। কলকাতা হাইকোর্টে মিস্টার প্যাংক্রিজের এজলাসে বর্ণকুমারীর আবেদন ছিল: ‘তিনি দেবেন্দ্রনাথের একমাত্র জীবিত কন্যা ও দুঃস্থা... এবং উইল অনুসারে ভাতা পাইবার যোগ্যা।’ সে বছরে ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তার শিরোনাম ছিল: ‘হাইকোর্টে রিসিভারকে সম্পত্তির দখল ছাড়িয়া দিতে নির্দেশ/ বর্ণকুমারী দেবীর খোরপোষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত।’ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে আদালতে এই মামলাটি লড়েছিলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা এন সি চট্টোপাধ্যায়। এখানেই নিষ্পত্তি হয়নি এই মামলার। নভেম্বরে বর্ণকুমারী আবার একটি আবেদন করেন। আনন্দবাজারে এই বিষয়ে ২৭ নভেম্বর একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়ে যাওয়া মামলা সম্পর্কে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল সহজেই অনুমেয়। পরে অমিতা ঠাকুর লিখেছিলেন: ‘বর্ণকুমারী দেবী অন্যান্যদের প্ররোচনায় ভাই-এর নামে নালিশ করেছিলেন সত্য কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ বয়সে মতিভ্রম না হলে নিজেই ভাইকে টাকার কথা লিখতে পারতেন। তাহলে এ কেলেঙ্কারী হত না। আর একশ টাকা মাসোহারার জন্য না খেয়ে মারা যাচ্ছিলেন না...।’
অথচ চিত্রা দেব ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’-এ জানাচ্ছেন: ‘খুব বৃদ্ধ বয়সেও ভাইফোঁটার দিন জোড়াসাঁকোয় এসে কবিকে ফোঁটা দিয়ে যেতেন বর্ণকুমারী। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের যোগাযোগ অটুট ছিল।’ ১৯৪০-এর ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান। কালিম্পং থেকে গুরুতর অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে আসা হল সে বছর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। সেখানে ‘পাথরের ঘরে’ কবি রোগশয্যায় শুয়ে আছেন। নীলরতন সরকার, বিধানচন্দ্র রায়-সহ আট জন চিকিৎসকের একটি দল এবং একটি সেবক-সেবিকা সঙ্ঘের পরম যত্নে কবি ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠলেন। বেশ কয়েক দিন উদ্বেগ আর আশঙ্কায় কেটেছে। তবে তখনও তাঁকে বিছানায় উঠিয়ে বসাবার অবস্থা আসেনি। দুর্গাপুজো পার হয়ে এল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। বর্ণকুমারী দেবী এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। রানী চন্দ লিখেছেন: ‘সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে— গৌরবর্ণ একখানি শীর্ণ হাতের শীর্ণতর আঙ্গুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন। দুজন দুপাশ হতে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারী দেবীকে।’ অসুস্থ ভাইয়ের জন্য যমদুয়ারে কাঁটা ফেলে ছোড়দিদি বসলেন কবির বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রবির উপরে তাঁর খুব রাগ হয়েছে। কালিম্পং পাহাড়ে গিয়েই তো অসুখ বাধিয়ে এসেছে সে। ছোটবেলার মতো আবারও ফিরে এল বকুনিপর্ব: ‘দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে?’ রবীন্দ্রনাথ চার পাশের সবার দিকে এক বার দৃষ্টি ঘুরিয়ে মাথা নেড়ে বললেন: ‘না, কক্ষনো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে।’ নির্মল এই রসিকতায় ঘরের মধ্যে খিলখিল হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল।
মামলার সেই তিক্ত স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ কি মাত্র পাঁচ বছরে ভুলে গিয়েছিলেন! মনে হয় না। যে নির্মল আনন্দের রেশ তিনি সেই দিন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই নির্মলতার উল্টো পিঠ চূড়ান্ত নির্মমতার আবহেই ভ্রাতৃদ্বিতীয়াকে দেখিয়েছেন তাঁর ‘ভাইফোঁটা’ গল্পে। ১৩২১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশিত এই গল্পে অনু (অনসূয়া) তাঁর জীবনের শেষ ভাইফোঁটাটি তার থেকে বছরছয়েকের বড় সত্যধনকে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কৈশোরযাপনে তাদের অন্তরঙ্গ সখ্যে ঠিক ভাই-বোনের স্নেহপদার্থ ছিল না। পোস্টমাস্টার আর রতনের মতোই এই দুই চরিত্রের মধ্যকার নিরুচ্চার প্রেমের মাধুর্য পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। অনুর মায়েরও ইচ্ছে ছিল সত্যধনের মতো ভাল ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেন। বিবাহ হল না, বরং এর পর থেকে অর্থনীতির মনস্তত্ত্ব গল্পটির নির্ণায়ক-শক্তি হয়ে উঠল। সম্ভাব্য বিবাহ থেকে নর-নারীর সম্পর্ক ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উদ্যাপনের দিকে সরে যাওয়া— একশো ছ’বছর আগে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ঠুনকো, স্বার্থপর সম্পর্কের রাজনীতিকে ‘ভাইফোঁটা’ গল্পে সজোরে থাপ্পড় মেরেছিলেন! যদিও ছোড়দিদি বর্ণকুমারী দেবীর মামলার মুখোমুখি হতে তাঁর তখনও বছর কুড়ি বাকি ছিল।