ইশরাত, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত আবেগ, মায়া ও রোমাঞ্চে নড়ে যাওয়ায়, ছবিটা কেঁপে গেছে।
প্রতিবেদক: অনেক দিন পরে আবার কাগজের প্রথম পাতায় তোমার ছবি। মরে যাওয়া চারটে মানুষের মধ্যে তুমি এক জন। তোমার মনে হয় না, একুশ শতকের ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস লিখতে বসলে তোমার ওই মৃত শরীরের ছবিটা কোনও দিন এড়ানো যাবে না?
ইশরাত জাহান: যার যেমন কপাল, ইতিহাসে সে ভাবেই তার নাম লেখা হয়! আমি না হয় মৃতদেহ হয়েই লিখলাম। এই দেশ, তার সরকার, সরকারের পুলিশ, পুলিশের বন্দুক, বন্দুকের বুলেট সেটাই চেয়েছে। আমার উনিশ বছরের জ্যান্ত-টাটকা বেঁচে থাকাটাকে মৃত বানিয়েছে, মৃতদেহটাকে ছবি বানিয়েছে, আর ছবিটাকে দলিল। ক্যাপশনে লেখা— এই পড়ে আছে ইশরাত জাহান। সাকিন মুম্ব্রা, জেলা ঠানে, মহারাষ্ট্র। লস্কর-ই-তৈবার ফিদাইন জঙ্গি। পিস্তল, গ্রেনেড ছুড়তে পারে। একে ৫৬-ও চালাতে পারে। আরডিএক্স ব্যবহারে দক্ষ। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে খুন করতে এসে, পুলিশের এনকাউন্টারে খতম। পাকিস্তানের পয়সা হজম!
প্রতি: এমন করে বেঁকিয়ে-বিঁধিয়ে বলছ, যেন কথাগুলো বানানো! যেন লস্কর-ই-তৈবা তোমাকে ট্রেনিং দেয়নি! যেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মারতে তুমি তোমার ‘জাভেদ আংকল’ ওরফে জাভেদ গুলাম শেখ, ওরফে প্রাণেশ পিল্লাইয়ের সঙ্গে গুজরাতে যাওইনি?
ইশরাত: কখন বললাম? আর বললেই বা শুনছে কে? ২০০৪ সালেও আমার মায়ের কথা, আমার কাকার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, এ বারেও করবে না! আমার নামটা যদি ইশরাত জাহান না হয়ে ইশা আমনকর বা ঈশানী রায় হত, তা হলে লোকে হয়তো বিশ্বাস করতে পারত— এ দেশের আর পাঁচটা হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের কলেজে পড়া মেয়ের মতোই আমাকেও পড়ার খরচ, সংসারের খরচ টানবার জন্য একটু বাড়তি রোজগারের ধান্দা খুঁজতে হয়েছিল! ছেলে পড়িয়ে, পাড়া-প্রতিবেশীর জামাকাপড় সেলাই করেও চালানো যাচ্ছে না বলেই পাড়ার জাভেদ চাচার ব্যবসার খাতা লেখার কাজটাও আমায় নিতে হয়েছিল! কিন্তু আমি তো ইশরাত জাহান। আমার বিহারি মুসলমান বাবা নিজের মুলুক ছেড়ে মুম্বইয়ে এসে ডেরা বেঁধেছিল। যে জায়গাটায় আমাদের ঘর, সেখানেও চার দিকে মুসলমান মানুষজন থিকথিক করছে। দু’বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের সাত ভাইবোনের সংসারেও নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা! সব মিলিয়ে জঙ্গি বনে যাওয়ার একটা আদর্শ পরিস্থিতি! এমন একটা মুসলমান বাড়ির মেয়েটাকে যে পাড়াতুতো জেহাদি জাভেদ, দুটো বাড়তি টাকার লোভ দেখিয়ে লস্কর-ই-তৈবার দলে ভর্তি করে নেবে, এটা কী এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপার! তা-ই পুলিশ বিশ্বাস করবে, মিডিয়া বিশ্বাস করবে, সেই মিডিয়ার খবর যারা দেখে-শোনে-মাখে-খায়, সেই পাবলিকও বিশ্বাস করবে।
প্রতি: তুমি তো সেই সাত-পুরনো কাসুন্দিই আবার ঘেঁটে ফেললে! ১৯৯৩-এ মুম্বই বিস্ফোরণের সময় থেকেই এই অভিযোগটা তোলা হচ্ছে, ভারতের মুসলমানেরা সব নাকি গরিব-বেচারা! সন্ত্রাসের ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না। শুধু খান-জাহান-রহমান-আলি-আকবর-শেখ-সৈয়দ এই সব নামের ফেরেই নাকি তারা রাষ্ট্রের দরবারে রোজ ঠোনা খাচ্ছে! আচ্ছা, রাষ্ট্র কি সত্যিই এতটা ক্যাবলা? হ্যাঁ, একশোটা সন্ত্রাসবাদীকে ধরতে গিয়ে হয়তো পাঁচ-সাত জন নিরীহ মুসলমান পুলিশ লকআপে ধোলাই খেয়েছে! বিনা দোষে জেল খাটতে খাটতে দু-চার জনের লাইফ হয়তো বরবাদ হয়ে গেছে। কিন্তু এ সব তো ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। তাই বলে মুসলমান পরিচয়ের জন্যই সব্বাই তোমাদের টার্গেট করছে, এটা একটু বাড়াবাড়ি নয়?
ইশরাত: কোন মুখে বলছেন? এই জেএনইউ কাণ্ডেই দেখুন না। ক্যাম্পাসে আফজল গুরু নিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা নাকি পাঁচ জন। সব ক’জনই অতি-বাম ছাত্র সংগঠন করে। কিন্তু ‘দেশদ্রোহী’দের পান্ডা হিসেবে চ্যানেলে-চ্যানেলে, কাগজে-কাগজে দেখুন একটাই নাম উঠে আসছে— উমর খলিদ! কেন? ওর নামটায় মুসলমান গন্ধ বলেই কাশ্মীরের ‘আজাদি’ বা আফজল নিয়ে মাথাব্যথা অন্যদের চেয়ে বেশি? বাকিরা মাওবাদী মগজ-ধোলাইয়ে ‘দেশবিরোধী’— কিন্তু উমরের দেশবিরোধিতা বুঝি ওর জন্মে? ওর রক্তে?
প্রতি: কিন্তু এটা তো মানবে, এ দেশের মুসলমানেরা নিজেদের বাকিদের থেকে সরিয়ে রাখতেই পছন্দ করে! বলিউডের বাইরে, মুম্বইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড কিংবা ফাঁসিতে ঝোলা সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষে মিছিলে ছাড়া, দেশের কোনও ব্যাপারে তাদের গরজ করে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না! দেশের বাকি লোক তাদের কী চোখে দেখবে?
ইশরাত: আপনার এই ‘দেশের লোক’ কারা বলুন তো? তাদের ‘দেখা’, ‘বোঝা’ কারা ঠিক করে? ওই যে রকমারি কোট-স্যুট-টাই পরা টিভি-অ্যাংকররা, যাঁরা সন্ধে হলেই জাতীয়তাবাদী হল্লা-ব্রিগেড নিয়ে (দেশ)ভক্তিরসের আসর জমান— সেখানে গোঁফ চুমরে অমুক মেজর আর দাড়ি চুলকে তমুক মাইনর এসে, হয় ‘পাকিস্তানে এক্ষুনি বোম্মারুন’ বলে বিকট চ্যাঁচান, নয় লোকে কেন আশি ফুট লম্বা আটষট্টি ফুট চওড়া জাতীয় পতাকা ওড়াতে আপত্তি করছে ভেবে ফোঁতফোঁত করে কাঁদেন, সেখানেই তো আদর্শ ভারতীয়ের মডেল ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ লেখা হচ্ছে, তাই না? মিডিয়া ‘দেশদ্রোহী’দের ভিডিয়ো ‘বানাচ্ছে’, পুলিশ তাই নিয়ে আদালতে যাচ্ছে! পদ্ম-পদক পাওয়া সরকারি উকিলও তো টিভির পরদাতেই জানান, ডেভিড হেডলিকে তাঁরা তিনটে মুসলমান মেয়ের নাম বলেছিলেন, সেখান থেকে সে নাকি একটা নাম বেছে দিয়েছে— ইশরাত জাহান! ব্যস! দিকে দিকে সেই বার্তা রটে যায়, ছবিতে ভালমানুষের মতো মুখ করে থাকা ওই বেটি জঙ্গি! ই-ই-ইশ, ওর জন্যই গুজরাতের দেশভক্ত বেচারা পুলিশ-মুখ্যমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের কী হেনস্থাটাই না হতে হল! ওটাকে আর এক দফা এনকাউন্টার করতে পারলে তবে জাতীয়তাবাদী জ্বালা জুড়োয়! দেশপ্রেমের যুক্তিটা কী সহজ ভাবুন! ইশরাতকে এক বার জঙ্গি প্রমাণ করতে পারলেই সরকারের চার খুন মাপ! এনকাউন্টার সাজানো হলেও তখন দেশভক্তিতে কোনও খাদ থাকে না! সবটাই ‘জায়েজ’, বৈধ!
প্রতি: কিন্তু এটা ভাবো, মানুষের জন্য প্রাণ দিয়ে নীরজা ভানোত যখন অশোকচক্র পায়, তখন ইশরাত জাহানদের অমন অপমানের এনকাউন্টারে মরতে হয়ই বা কেন?
ইশরাত: কারণটা তো আগেও খানিকটা বলেছি। টেলিভিশনের পরদায় দেশপ্রেমের আসরে অতিথিরা যেমন খোপে খোপে সাঁটা থাকেন, তেমনই এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরেও নীরজাদের জন্য আলাদা খোপ, ইশরাতদের জন্য আলাদা! ইশরাতরা সেই খোপে কোনও রকমে খেয়েপরে বেঁচেবর্তে থাকতে পারলেই যথেষ্ট! তবে দেশভক্ত-ব্রিগেডের নতুন জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার দৌলতে আমাদের ‘সন্দেহভাজন’ খোপটাও একটু একটু বাড়ছে মনে হচ্ছে। রোহিত ভেমুলা, কানহাইয়া কুমারদের ইতিমধ্যে সেখানে পুরে দেওয়া হয়েছে। এ বার ‘দেশবিরোধী দস্যিপনা’র আখড়াগুলোয় ঢুকে নিয়মিত পেট্রোল বোমা ছোড়া, বেয়াড়া ছাত্রীদের চুলের মুঠি, অবাধ্য উপাচার্যদের কলার ধরার কর্মসূচি শুরু হলে, খোপটা আরও বাড়বে! ইশরাতদের তখন বোধহয় নাসিক থেকে তুলে এনে আমদাবাদের মাটিতে দাঁড় করিয়ে ঝপাঝপ দশ-বিশটা বুলেট গুঁজে দেওয়া অতটা সহজ থাকবে না।
sanajkol@gmail.com