অতিমারি পাল্টে দিল সব হিসেব। এখন ঘরে বসে মানসভ্রমণই নিউ নর্মাল।
travel

Travel: বেড়ানোর দিনবদল

রেল চালু হতে বাড়ল সুবিধে, বাড়ল ভ্রমণে দূরত্বের পাল্লা। বাড়ির দুর্গোৎসব ফেলেও অনেকে ছুটতেন দেশ দেখতে। সেই সূত্রেই বদলে গেল বাঙালির ডেস্টিনেশন।

Advertisement

অরিন্দম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২১ ০৯:২৮
Share:

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

দুর্গোৎসবের ছুটিতে হাওড়া হতে এলাহাবাদ পর্যন্ত রেলওয়ে খুলেছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল কালো অক্ষরে ছাপানো ইংরেজী বাঙ্গলায় এস্তেহার মারা গেছে; অনেকেই আমোদ করে বেড়াতে যাচ্ছেন— তীর্থযাত্রীও বিস্তর। শ্রীপাঠ নিমতলার প্রেমানন্দ বাবাজীও এই অবকাশে বারানসী দর্শন কত্তে কৃতসঙ্কল্প হয়েছিলেন।’ প্রেমানন্দ বাবাজিদের জীবনে সারা বছরই ছুটি। কিন্তু যাদের একটু রেস্ত ছিল, সে সব বঙ্গসন্তানের তো পূজাবকাশ, গ্রীষ্মাবকাশ এ সব দরকার হত। পায়ের তলায় সরষে লাগানো বাঙালি যে ‘ভ্রমণখোর’, হুতোমের মতো দুঁদে যন্তর সেটা বুঝেই তো জায়গামতো শুনিয়ে দিয়েছিলেন রেল চালু হলে পুজোর ছুটিতে বাঙালির বেরিয়ে পড়ার কথা। আর কাজের মানুষ ছুটি না পেলে বেড়াতে বেরোবেন কী করে? কাজ করেই তো তাঁর রোজগার!

Advertisement

ভ্রমণের নেশা বাঙালিকে কবে থেকে যে গ্রাস করল বলা শক্ত। তখন অবশ্য যাওয়ার জায়গা বলতে ছিল গয়া কাশী বৃন্দাবন। পুরী বা প্রয়াগও ছিল সেই লিস্টে। যাকে বলে তীর্থযাত্রা। আঠেরো শতকে লেখা বিজয়রাম সেনের ভ্রমণ বিবরণীর নামই তো ছিল ‘তীর্থমঙ্গল’। বিজয়রাম থেকে হুতোম— সময়ের ব্যবধান অনেকটাই। হুতোমের লেখা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, তত দিনে আমোদ করে বেড়াতে যাওয়া লোকজন আর তীর্থযাত্রী— দুই যেন আলাদা গোত্র। তবে আমুদে বঙ্গসন্তান পুরী গিয়ে সমুদ্রদর্শনের পাশাপাশি জগন্নাথের চাঁদমুখ না দেখে কি আর ফিরে আসতেন?

রেল চালু হওয়ার অনেক কাল আগে থেকেই বাঙালি হিন্দু পায়ে হেঁটে, নৌকো করে প্রাণের নাথকে দর্শন করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। হুগলির রাধানগর নিবাসী যদুনাথ সর্বাধিকারী তামাম উত্তর ভারত সফর করে যে বছর ফিরলেন, তার পর রেল চালু হল। যদুনাথই তো লিখেছিলেন, পুণ্য লাভের জন্য ও পারলৌকিক উন্নতি প্রাপ্তির আশায় মানুষ শত শত ক্রোশ অতিক্রম করত। তখন তো রীতিমতো উইল করে মানুষ বেরোতেন। ভোলানাথ চন্দ্র গেছেন, দত্তফুলিয়ার দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায় গেছেন, মনোমোহন বসু গেছেন... আরও কত মানুষই গেছেন। সবাই তো আর ‘সেলেব’ ছিলেন না।

Advertisement

বাষ্পরথে চড়ে এক দিনে কাশী, দু’দিনে মথুরা অনেকের কাছে ঠিক তীর্থভ্রমণ বলে মনে হয়নি। যে কারণে ‘তীর্থ-ভ্রমণ’-এর আলোচনায় যাদবেশ্বর শর্মা লিখেছিলেন ‘রহিয়া রহিয়া সহিয়া সহিয়া জিরাইয়া জিরাইয়া, চটীতে চটীতে অবস্থিতি করিয়া’ তীর্থে গেলে ‘তীর্থে আসিয়াছি বলিয়া যেমন একটা ভাব’ জন্মে, রেলগাড়িতে চড়ে তড়িঘড়ি ‘তীর্থ প্রাপ্তিতে সে ভাব, সে বোধ আসিতে পারে না’। ‘বেঙ্গল হরকরা’ লিখেছিল, এক ভদ্রলোক নাকি রেলে চড়ে হুগলি পৌঁছে আর রেলে কলকাতায় ফিরতে চাননি। কারণ বিচিত্র— ‘আগুনের রথে বেশিক্ষণ যাতায়াত মানবজীবনের আয়ুষ্কাল খর্ব করবে’। আবার পুজোর ছুটিতে উত্তর ভারত বেড়াতে গিয়ে আগরা থেকে মোটরে মথুরা এসে এক মহিলার মনে হয়েছিল, ওটা মোটরে বা বাসে যাওয়াই সুবিধে, কারণ রেলে ওঠা নামা নাকি বড় সমস্যা। বাসে উঠলে একেবারে হোটেলের সামনে নামা যায়। এটা ১৯৩৮-এর কথা। অর্থাৎ রেল চালু হওয়ার অত দিন পরেও অনেকের কাছে রেল যেন হাঙ্গামার বস্তু!

রেল চালু হলে বেড়াতে যাওয়ার এই বাড়তি আনন্দটা হারিয়ে গেল, সে ঠিক কথা। কিন্তু সবার তো আর পায়ে হেঁটে যাওয়ার শক্তি ছিল না। আর মানুষের ব্যস্ততাও বাড়ছিল। অত সময়ই বা কোথায়। সীমিত অবকাশে হুট করে বেরিয়ে ঘুরে আসা ছাড়া আর উপায়ান্তরও ছিল না। ভ্রমণপ্রিয় মানুষ আজকের মতো সে দিনও ক্যালেন্ডারে ‘পূজার বন্ধের’ দিনগুলো দাগিয়ে রাখতেন। নবীন সেন-এর মতো বড় সাহেবদের আর সময় হত কোথায়। ওই ‘বেহারে অবস্থিতি কালে’ এক বার ‘পূজার বন্ধে’ গয়া দর্শন করতে যান। আর ‘পরের বৎসর পূজার বন্ধে’ গেলেন পশ্চিমের কয়েকটা তীর্থ দর্শন করতে। রেল কোম্পানিও মওকা বুঝে তাই পুজোর সময়ই খবরের কাগজে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিত যাত্রী টানতে। ১২৮২-র ‘সুলভ সমাচার’-এ প্রকাশিত তেমনই একটি বিজ্ঞাপন নজর কেড়েছিল— পুজোর ছুটিতে যাঁরা বেড়াতে যেতে চান তাঁদের সুবিধের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ‘মাসিক রিটার্ণ টিকিট সিঙ্গেল টিকিটের দেড় গুণ মূল্যে’ ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিদিন বিক্রি হবে। তবে যাঁরা কেবল ৫০ মাইলের বেশি দূরে ভ্রমণ করবেন তাদের জন্যই এই সুযোগ সীমাবদ্ধ ছিল। লোক কেমন এই ছাড়ের সুযোগ নিত তার কথা পেয়েছিলাম ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের কথা’ (১৯১৮) বইতে। তিনি লিখছেন— ‘কনসেসনের শেষ দিন। ষ্টেশনে অত্যন্ত ভিড়। বহুকষ্টে একখানি টিকিট কিনিয়া বিস্তর ঠেলাঠেলি ও উমেদারীর পর পাঞ্জাবমেলে একটু স্থান সংগ্রহ করিলাম।… নড়িবার চড়িবার উপায় নাই।’ যারা সে কালে ওই ভ্রমণ গাইড গোছের বইপত্তর লিখতেন, তাঁরাও দুটো কারণে পুজোর ছুটিকে প্রাধান্য দিতেন। এক তো তখন ‘জলবৃষ্টি বা রোগাদির তত ভয় নাই, অথচ শীত গ্রীষ্ম প্রবল নহে’। আর দ্বিতীয় কারণ রেলের টিকিটে ‘পূজা কনসেশন’। বড়দিনে ওটি পাওয়া গেলেও তার মেয়াদ কম। রোগাদির ভয় না থাকলেও পেটরোগা বাঙালি কি আর ওষুধ না নিয়ে ছুটি কাটাতে বেরোত? তাই ওষুধ কোম্পানিও সুযোগ হাতছাড়া না করে রেলের প্রকাশিত ‘পূজার ছুটী’-তে এ রকম বিজ্ঞাপন দিত— ‘পূজার ছুটিতে বাহিরে যাইবার সময় ইলেক্ট্রো-আয়ুর্ব্বেদিক গার্হস্থ্য ঔষধাবলীর একটা পকেট কেশ লইতে ভুলিবেন না’। যে যার ধান্দায় আর কী!

ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে বাংলা, ইংরেজিতে ‘পূজার ছুটী’/ ‘Pooja Holidays’ নামে ফি-বছর যে প্রচারপুস্তিকা বার করত, সেখানে তাদের বিজ্ঞাপনের কায়দাও ছিল লক্ষণীয়— ‘দুর্গাপূজার ছুটিতে হিমালয়ের সুন্দর স্বাস্থ্যজনক স্থানসমূহ দেখিবার বিশেষ সুবিধা।’ এর পর উচ্চতা উল্লেখ করে নৈনিতাল, আলমোড়া, রানিখেত বা কাশ্মীরের নাম। বলা হচ্ছে, পুজোয় ভ্রমণের যে পরিকল্পনাগুলো করা হয়, তার মধ্যে কাশ্মীর যাওয়ার ছক কষা সব দিক থেকে নাকি লাভজনক। কখনও ভাষা ছিল আর এক রকম, ‘যাঁহারা পূজার ছুটির সময়টীকে আনন্দে কাটাইতে চাহেন ভারতবর্ষের পৃথিবীবিখ্যাত স্থানসমূহ তাঁহাদের দর্শন করা উচিত।’ সেই স্থানতালিকায় বারাণসী, গয়া, লখনউ বা দিল্লির পাশাপাশি কানপুরও ছিল, ‘শ্রমজীবী কার্য্যের কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে। স্বাস্থ্যকর আর ঐতিহাসিক জায়গা দেখানোর সঙ্গে ছুটিতে ভারতের ‘প্রাচীন’ ও ‘পবিত্র মন্দিরসমূহ’ দেখার বিশেষ অফারও থাকত। সেখানে হরিদ্বার, মথুরার পাশাপাশি আমাদের নবদ্বীপ বা তারকেশ্বরেরও ঠাঁই হয়েছিল।

ভ্রমণ বিষয়ক সাহিত্যকর্মগুলোতেও এই রকম তথ্য ছিল। ‘কাশীধাম’-এ মন্মথনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, পুজোর সময় মধ্যম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে যাত্রীদের স্বার্থে রেল কোম্পানির অল্প ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করার কথা। এই সুযোগে কলকাতাবাসী চাকুরেরাও যে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার শখ মেটাতে শুরু করলেন, সে কথা রসরাজ অমৃতলালই তো লিখেছেন। সবারটা জানা যায় না, তবে বড় ঘরের মহিলাদের লেখাতেও শরৎকালীন ভ্রমণের খবর সুলভ। অবলা বসু লিখলেন পুজোর ছুটিতে কাশ্মীর বেড়ানোর স্মৃতি। পুজোর ছুটিতে অনেক দিন ধরেই ইলাহাবাদ যাওয়ার কথা ভেবে ভেবে এক বিকেলে দুম করে প্ল্যান করে পরদিনই স্বর্ণকুমারী দেবী চলে গেলেন প্রয়াগ। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-দুহিতা পুণ্যলতা চক্রবর্তী লিখছেন, প্রত্যেক বছর ছুটির সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন পাহাড়ে, পশ্চিমে কিংবা নিজের ‘দেশে’। ট্রেনে স্টিমারে নৌকোয় অবশেষে হাতি বা পালকিতে চড়ে পূর্ব বাংলায় তাঁদের সেই গ্রামে যাওয়া অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। সপরিবারে হাওড়া থেকে পুজোর ঠিক আগে রাতের গাড়িতে পশ্চিমে রওনা হয়ে ভোরবেলায় মোগলসরাই (এই নামের সঙ্গে বাঙালি জীবনের সংযোগ বোঝা সবার কম্মো নয়) থুড়ি, এ কালের দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশনে নেমে গৃহকর্তার নির্দেশে কেলনার কোম্পানির মাখন-মাখানো রুটি, ডিমসেদ্ধ, দুধ এবং বড়দের জন্য চা খাওয়ার গল্প যে সে কালের কত মানুষ লিখেছিলেন, গুনে শেষ করা যাবে না।

আর্থিক কারণে বা সাহসের অভাবে সবাই যে খুব দূরে যেতে পারতেন, এমনটা নয়। ছোটনাগপুর বা সাঁওতাল পরগনা অঞ্চল খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বিয়ের পর এক বার কেবল পুজোর ছুটিতে কাশী যান। তার পর ১৯০৮ থেকে ৩০ বছর ধরে প্রতি পুজোর ছুটিতে তাঁর ঠিকানা ছিল রাঁচির মোরাবাদি পাহাড়ের শান্তিধাম। যে বিভূতিভূষণ ঘাটশিলায় জীবন কাটালেন, তিনি এক বার লিখেছেন— ‘১৩৩৭ সালের কথা। পূজার ছুটি সেই দিন হল। ভাগলপুরের বার লাইব্রেরিতে বসে কথাবার্তা চলচে বন্ধুদের সঙ্গে, ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়।’ প্রবীণ উকিল অবিনাশবাবুর পরামর্শে ক্রমে তিনি আর তাঁর বন্ধু অম্বিকা খাকি হাফপ্যান্ট, গায়ে সাদা টুইলের হাতকাটা শার্ট, মাথায় সোলার টুপি, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত উলের মোজা আর বুটজুতো গলিয়ে রওনা দিলেন দেওঘরের উদ্দেশে। প্রতি বছর শারদীয়া পুজোর অবকাশে বাংলার বাইরে ঘুরে আসা তাঁর দীর্ঘকালের ‘নেশা বা পেশা’ বলেই জানকীনাথ মুখোপাধ্যায় তিন বন্ধুকে নিয়ে ১৩৩৪ সালের দুর্গানবমীতে খড়দা থেকে ওই দেওঘরের উদ্দেশেই রওনা দেন। তার পর ওখান থেকে মুর্শিদাবাদ। বাঙালি ডেপুটি গিরিশচন্দ্র নাগ কর্মসূত্রে উনিশ শতকের শেষে দেওঘরে ছিলেন দীর্ঘ দিন। লিখেছেন ভারী মজার। একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রথমে একটু ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু অচিরেই তার উপযোগিতা অনুভব করলেন। আত্মীয়স্বজনরা হাওয়া বদল আর তীর্থ করতে দলে দলে এসে উঠতে লাগলেন তাঁর বাড়িতে। বলছেন, পুজোর ছুটিতে এই সব অতিথিতে তাঁর বাড়ি ‘ওভারক্রাউডেড’ হত। শুধু ওঁর বাড়ি নয়। নাগমশাই বলছেন, পুজোর সময় থেকে প্রায় বৈশাখ মাস পর্যন্ত দেওঘর শহরটা ‘বাঙ্গালী বাবু ও তাঁহাদের পরিবার দ্বারা পূর্ণ থাকিত’। তখন তো স্বল্প বাজেটের মানুষ এ ভাবেই চেনা-পরিচিতের আশ্রয় খুঁজতেন। ওই ফকিরচন্দ্র যেমন এক বার পুজোর সময় পশ্চিমে বেড়াতে গিয়ে বন্ধুর অসুবিধে সত্ত্বেও তাঁর টুন্ডলার বাড়িতেই কাটান। অত বিলাসিতা আর স্বাচ্ছন্দ্য তখন খুব আবশ্যক হয়নি তো।

আজ যেমন অনেকের কাছেই গন্তব্যস্থল মর্যাদার সূচক। কেউ শুনি কাকদ্বীপ ঘুরে এসে কেরালা, বা তারাপীঠ ঘুরে এসে তপ্তপানির গল্প ফাঁদেন। সে দিন কিন্তু এমনটা ছিল না। কোথায় গেলেন সেটা বড় কথা নয়, মুখ্য বিষয় ছিল ছুটি কাটানো। অমৃতলাল বসু ১৮৬৩-তে মস্ত এক নৌকো চড়ে বাবা এবং তার দু’-এক জন বন্ধুর সঙ্গে পুজোর ছুটিতে কালনা পর্যন্ত গেলেন। আজ তো পুজোর ছুটিতে কালনাকে ‘ডেস্টিনেশন’ হিসেবে ভাবাই যায় না। অনেক কাল আগে সে কালের দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে— ‘জুয়াচোরের বাহাদুরী’। সেখানে বলছেন, ভাগীরথী দিয়ে কাটোয়ার দিকে যিনিই কখনও গেছেন, এক দিনের জন্যও হলে তাঁকে কালনায় থাকতে হয়েছে। কালনার দেবমন্দির না দেখে কাটোয়ার দিকে গেছেন, দারোগা সাহেবের কথা অনুযায়ী, ‘এরূপ মনুষ্য এদেশে বিরল’।
সত্যিই কত বিখ্যাত মানুষ পুজোর ছুটিতে ধারেকাছেও কাটাতেন। নির্মলকুমার বসু যেমন লিখেছেন, ‘একবার পূজার সময়ে বাঁকুড়া শহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম’।

তবে কারও কারও কাছে পুজোয় বেরনোটা স্টেটাস সিম্বলের মতো। এ বারে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না, বলাটায় যেন একটা হীনম্মন্যতার পরিচয় ছিল। ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখকদের লেখাতেই তার যেন একটা আভাস পাই। বিশ শতকের তিরিশের দশকে দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু লিখছেন (‘গঙ্গোত্তরী ও যমুনোত্তরী’, ১৩৩০) পুজোর আগে আদালত বন্ধর আগে থেকেই সবার মুখে যেন একটাই প্রশ্ন— ‘এবার কোথা যাচ্চ?’ আর এক জন আবার লিখছেন, প্রত্যেক বছরই পুজোর ছুটির আগে বন্ধুমহলে প্রশ্ন ওঠে ‘এবার কে কোথায় যাচ্চেন’। জোর আলোচনা হত। ১৩২০ বঙ্গাব্দের পূজাবকাশে কোথায় যাওয়া যায় আর কিসে আনন্দ পাওয়া যায়, তাই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক আলোচনা আর তর্কবিতর্কের পর মধ্যপ্রদেশের জবলপুরে যাওয়া ঠিক করেছিলেন জনৈক ভোলানাথ দত্ত। সে বিবরণ আবার লিখে পাঠান ‘মানসী’ পত্রিকায়। উলোর সুপ্রসিদ্ধ মুস্তৌফী বাড়ির মণীন্দ্রনাথ যেমন ১৯২৬-এর ৪ সেপ্টেম্বর হেদুয়ায় চার বন্ধু মিলে সাঁতার কাটতে কাটতে পুজোর ছুটিতে সাইকেলে ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার প্ল্যান করলেন। ইতিমধ্যে আর এক শাগরেদ এলেন। পাঁচ জন মিলে পুজোর ছুটিতে কী করা যায় তা নিয়ে অনেক ‘তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হ’ল— সাইকেল ক’রে চারিদিক দেখতে দেখতে কাশীধাম পর্য্যন্তই পাড়ি দিতে হবে।’

অনেকে নিজের বাড়ির পুজো ফেলেই ছুটেছেন। রসরাজ অমৃতলাল তাঁদের খানিকটা গালও পেড়েছেন— ‘আজকাল ছুটি পেলেই নিজের বাড়ির পুজো ফেলে বাবুরা হিল্লী দিল্লী কিষ্কিন্ধা দার্জিলিং ছোটেন। তা সাহেবদের কথা বলব কোন মুখে।’ পুজোর ছুটিতে দেশ ছেড়ে বাঙালি ভদ্রলোকেদের একাংশের এই বিদেশ ভ্রমণ অনেকেই সুনজরে দেখেননি। তাদের বক্তব্য ছিল কলকাতাবাসী মফস্সলের সম্ভ্রান্ত মানুষজন পুজোর ছুটিতে বাইরে বেড়াতে গিয়ে টাকা খরচ না করে ওই সময়টা নিজের গ্রামে এসে জন্মভূমির উন্নতি করুন। শান্তিপুরের ‘যুবক’ পত্রিকা যেমন এক বার লিখেছিল, পল্লিগ্রামে কতশত মুন্সেফ ডেপুটি আর জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িঘর ‘বিজন কাননে’ পরিণত হচ্ছে। আর অন্য দিকে তাঁদের নতুন নতুন অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে পুরী গিরিডি বা মধুপুরে। বিশ শতকের কুড়ির দশকে ‘বিক্রমপুর সম্মিলনী’-র সম্পাদক গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী, বহরমপুরের বৈকুণ্ঠনাথ রায়ের কাছে সে বছরে পুজোর ছুটিতে তিনি কোথায় যাচ্ছেন, তা জানতে চেয়েছিলেন। তাতে বৈকুণ্ঠনাথের উত্তর ছিল, তিনি মুসৌরি, দেহরাদূন, দার্জিলিং বা উটি বোঝেন না। বাপ-চোদ্দোপুরুষের ভিটেই তাঁর প্রধান আকর্ষণ। বিস্মিত গিরিশ্চন্দ্রের মনে হয়েছিল, বৈকুণ্ঠবাবুর মতো সকলেই যদি নিজের গ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেন, তা হলে পল্লিবাংলার এই দশা হত না।

পুজোর ছুটিতে বাঙালির এই খরচপত্তর করে বেড়াতে যাওয়া দীনেশ সেন খুব ভাল চোখে দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি লিখলেন, ‘পূজা পার্ব্বণে যে ব্যয় হইত তাহার অধিকাংশ এখন রেলওয়ে ও স্টিমার কোম্পানীর হাতে যাইয়া পড়িতেছে’। তাঁর কথায় পুজোর ছুটিতে ‘পূজা দর্শন’ ঘটে না, বিদেশ ভ্রমণ ঘটে থাকে। যতই সমালোচনা হোক, বাঙালি তো এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন পুজোয় বেড়ানো বা বেড়ানোর ছক কষেই। বাঙালি মুসলিমরাও কি বাদ ছিলেন? ‘আজমীর ভ্রমণ’-এ মৌলবি খোন্দকার গোলাম আহমদ স্পষ্টই লিখেছিলেন, দার্জিলিং যাওয়া বাতিল করে সপরিবার আজমীর শরিফ যাত্রা করেন ওই ১৩২৭ সালের পুজোর ছুটিতেই।

ওই যে বলছিলাম বেড়ানোর ছক কষার কথা, তো তেমন কিছু যন্ত্রণার কথাও তো ছিল। বিভূতিভূষণের দু’টি লেখার উল্লেখ করি। প্রথম তো ‘অপরাজিত’-র হতাশ অপুর কথা মনে পড়ে। দু’বছর ধরে অপু যেখানে চাকরি করছে, পুজোর আগে প্রত্যেক বার সে আর নৃপেন টাইপিস্ট ‘কোথাও না কোথাও যাইবার পরামর্শ আঁটিতেছে, নকসা আঁকিতেছে, ভাড়া করিয়াছে, কখনও পুরুলিয়া কখনও পুরী’— যাওয়া অবশ্য হয় না। তবুও ‘যাইবার কল্পনা করিয়াও মনটা খুশি হয়’ মনকে বোঝায় ‘এবার না হয় আগামী পুজোয় নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই...’। একই রকম ছবি তো তাঁর আর এক লেখা ‘একটি ভ্রমণ কাহিনী’-র সেই শম্ভু ডাক্তার আর কেরানি গোপীকৃষ্ণের। সকলেই পড়েছি বাঙালি মধ্যবিত্ত গৃহস্থের প্রতিরূপ সে গল্প। সীমিত আয়ে মেটে না যাঁদের জীবনের বিচিত্র স্বাদ-আহ্লাদ। দু’জনেই প্রতি বছর পুজোর আগে বসে বিদেশ ভ্রমণের প্ল্যান আঁটেন। সামনে থাকে একখানি টাইমটেবিল। কাশী, গয়া, সাঁওতাল পরগনা, নাকি চিত্রকূট। বেডিং কী নেওয়া যায় থেকে রেলে রাতের মেনু অবধি ঠিক হয়ে যায়। পুজোর আর দিন সাতেক বাকি, এমন সময় এক দিন আপিসের বড়বাবু গোপীকৃষ্ণকে ডেকে জানালেন, ‘এবছর’ পুজোর বোনাস প্রাপকদের তালিকায় তাঁর নামটি নেই। হতাশ গোপীকৃষ্ণ কিছু অগ্রিমের দরখাস্ত করলেন। পনেরো টাকা মঞ্জুরও হল। কিন্তু দেশের বাড়ি থেকে চিঠি এল, চৌকিদারি কর বাকি পড়েছে অনেক দিনের। এ বারে না দিলে ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত হবে।

এর পরেও সাহসে ভর করে যাওয়ার কথা তুললেন গোপীকৃষ্ণ, কিন্তু শম্ভু ডাক্তার বললেন, ছেলেমেয়েদের কাপড় কিনতে এ মাসে সব টাকা শেষ, ভরসা একটাই, যদি কোনও কঠিন রোগে আক্রান্ত লোক এসে হাজির হয়। তবুও চলল আলোচনা, যদি পরেশনাথ পাহাড়টা অন্তত হয়। কিন্তু হঠাৎ রোগীও যেন কমে গেল। পাঁচ আনার নাক্স ভোমিকাও বিক্রি হয় না। তার ওপর দেশে অবস্থা খারাপ হওয়ায় মামাতো ভাই সস্ত্রীক এসে হাজির। শেষ অবধি পুজো যখন এসেই গেল, তখন দুই বন্ধু শেষ পর্যন্ত বারাসতের কাছে লাঙ্গলপোতায় অফিসের সহকর্মীর বাড়ি যাওয়াই ঠিক করলেন। সর্বজনীন দুর্গোৎসব উপলক্ষে কেষ্টযাত্রা রামায়ণ গান এ সব দেখে ক’টা দিন ভালই কাটল গোপীকৃষ্ণ আর শম্ভু ডাক্তারের। না-ই বা হল পরেশনাথ, গয়া-কাশী বা চিত্রকূট। সাধ আর সাধ্যের ব্যবধানে পুজোর ছুটিতে বেড়ানোর এমন কত ছক ভেস্তে গেছে কে জানে। আর আজ তো অতিমারির আবহ। সাধ্য, রেস্ত থাকলেও লোকে ভয়ে কাঁটা। কোথাও গিয়েও তো সেই করোনার আতঙ্ক। তার চেয়ে বাড়িতেই ভ্রমণ বিষয়ক পত্রিকার পাতা ওল্টাই, কেমন? ‘ঘরে বসেই মানস ভ্রমণ’— অগুনতি বঙ্গসন্তানের রোজনামচা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement