Francis Johnson

কলকাতাই তাঁর ঠিকানা

জন্ম তামিলনাড়ুতে। ফ্রান্সিস জনসন ইংল্যান্ডের বিলাসী জীবনের হাতছানি ছেড়ে এই শহরেই কাটিয়েছেন জীবনের বেশির ভাগ সময়। ভারত তখন মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনাধীন। দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে চলছে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াই।

Advertisement

সুব্রত পাল

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

স্মৃতি: সেন্ট জন’স চার্চে ফ্রান্সিস জনসনের সমাধি

কলকাতার প্রাচীন গির্জা সেন্ট জন’স চার্চ। হলওয়েল অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতি, জোব চার্নকের সমাধি, রোহিলা যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ আছে এখানেই। এরই মাঝে এক সমাধিতে শুয়ে আছেন শ্রীমতী ফ্রান্সিস জনসন (১৭২৫-১৮১২)।

Advertisement

ভারত তখন মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনাধীন। দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে চলছে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াই। এমনই এক সময়ে ফ্রান্সিস ১৭২৫ সালের ১০ এপ্রিল বর্তমান তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের দক্ষিণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যঘাঁটি সেন্ট ডেভিডে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ফোর্ট ডেভিডের গভর্নর। মাত্র তেরো বছর বয়সে, কলকাতার তৎকালীন গভর্নরের ভ্রাতুষ্পুত্র প্যারি টেম্পলার-এর সঙ্গে বিয়ে হয় ফ্রান্সিসের। দু’টি সন্তানও হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামী ও দুই সন্তানেরই মৃত্যু হয়। এর পর জেমস অ্যালথাম নামে কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সঙ্গে বিয়ে, তিনিও অল্প দিনের মধ্যেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তৎকালীন বাংলার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য উইলিয়াম ওয়াটস-এর সঙ্গে বিয়ে হল যখন, তখন ফ্রান্সিসের বয়স চব্বিশ। উইলিয়াম মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার কুঠির প্রধান নির্বাচিত হন, মুর্শিদাবাদের নবাবের সঙ্গে কোম্পানির দৌত্যের ভার তাঁকেই দিয়েছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর উইলিয়াম কিছু দিনের জন্য ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নরও নির্বাচিত হন। এর পরই স্ত্রী ফ্রান্সিসকে নিয়ে ওয়াটস ইংল্যান্ডে ফিরে যান। প্রায় আড়াই দশকের বিবাহিত জীবনে দু’টি পুত্র এবং দু’টি কন্যা হয় ফ্রান্সিসের ।

১৭৬৪-তে ইংল্যান্ডে উইলিয়াম ওয়াটস-এর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন ফ্রান্সিস। ওয়াটসের রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি, প্রাসাদোপম বাড়ি ও সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যের মায়া কাটিয়ে যাত্রা করলেন বাংলার উদ্দেশে। কয়েক মাসের দীর্ঘ, বিপদসঙ্কুল সমুদ্রযাত্রাও দমাতে পারেনি মধ্যবয়সি এই নারীকে।

Advertisement

বৈবাহিক সূত্রে যথেষ্ট সম্পদের অধিকারী ফ্রান্সিস কলকাতার ব্রিটিশ সমাজে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। কলকাতা ফেরার পাঁচ বছর পর ফোর্ট উইলিয়ামের সেনাবাহিনীর প্রধান যাজক উইলিয়াম জনসনের সঙ্গে তাঁর চতুর্থ ও শেষ বার বিয়ে হয়। উইলিয়াম জনসনের প্রচেষ্টাতেই সেন্ট জন’স চার্চ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই কলকাতার প্রধান গির্জা হিসাবে এই চার্চ প্রতিষ্ঠা পায়। উইলিয়াম জনসন সস্ত্রীক ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শ্রীমতী ফ্রান্সিস কলকাতাতেই থেকে যাওয়া মনস্থির করেন। বাংলার আবহাওয়া, সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তিনি। উইলিয়াম জনসন চলে যাওয়ার পর প্রায় দু’দশকেরও বেশি সময় কলকাতায় ছিলেন তিনি। ৮৭ বছর বয়সে ১৮১২ সালে এখানেই মৃত্যু হয় ফ্রান্সিসের। সেন্ট জন’স চার্চেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।

তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজে ফ্রান্সিস এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ব্রিটিশ নারীরা সচরাচর দীর্ঘ কালের জন্য ভারতে আসতেন না, মাঝেমধ্যে স্বামী বা পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য আসতেন। ভারতের উষ্ণ আবহাওয়া অল্প দিনের মধ্যে তাঁদের ইংল্যান্ডমুখী করত। ফ্রান্সিস জনসন কিন্তু তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রায় পুরোটাই ভারতে কাটিয়েছেন, বেশির ভাগটাই কলকাতায়। শহরের ইংরেজ সমাজে তিনি ছিলেন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয়।

ফ্রান্সিসের বড় মেয়ে অ্যামেলিয়ার বিয়ে হয়েছিল লিভারপুলের প্রথম আর্ল চার্লস জেনকিনসনের সঙ্গে। তাঁদের ছেলে রবার্ট জেনকিনসন পরে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। যে বছর তাঁর দিদিমা কলকাতায় মারা যান, সেই ১৮১২ সালেই। এও এক আশ্চর্য সমাপতন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement