নাট্যপ্রিয়: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পরিমল গোস্বামী
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে অধিকাংশ বাঙালি ঔপন্যাসিক বলেই জানেন। ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’-র মতো কয়েকটি গান লিখলেও মুখ্যত কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তিনি বাঙালির কাছে পরিচিত। কিন্তু এই লেখক যে ছোটবেলায় নাট্যকার হতে চেয়েছিলেন, সে তথ্য অনেকের কাছেই তেমন পরিচিত নয়।
নাটক লেখা দিয়েই সাহিত্যের জগতে পা রাখেন তারাশঙ্কর। ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘...অভিনয় ভালো লাগে, নাটক রচনা করি। সে রচনা অবশ্য তখন solitary pride-এর সামিল আমার কাছে। মধ্যে মধ্যে জমজমাট নাট্যমঞ্চে অভিনয় করি। দেশপ্রেম, নাট্য রচনা ও অভিনয়-স্পৃহা এই তিনের সম্মিলিত ফল এক সময় দাঁড়াল একখানি পঞ্চাঙ্ক নাটক। নাম ‘মারাঠা তর্পণ’।’ শোনা যায়, স্কুলজীবনে এক বার ব্রিটিশ-বিরোধী নাটকে অভিনয় করে স্থানীয়দের ধিক্কারের পাত্র হয়েছিলেন তারাশঙ্কর।
যা-ই হোক, পরবর্তী কালে তাঁর লেখা ‘মারাঠা তর্পণ’ নাটকটি বীরভূমের বিশিষ্ট অভিনেতা-নাট্যকার নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়—তিনি সম্পর্কে তারাশঙ্করের আত্মীয় ছিলেন— কলকাতার পেশাদার মঞ্চে অভিনয়ের জন্যে দেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে। শোনা যায়, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘মারাঠা তর্পণ’ না পড়েই নির্মলশিবকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনায় তারাশঙ্কর দুঃখ পেয়ে এই নাটকের পাণ্ডুলিপিই আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। আর এই ঘটনার পরেই তিনি নাটক থেকে সরে এসে কথাসাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু করেন।
সময় গড়িয়ে যায়। তারাশঙ্কর ছোটগল্প, উপন্যাস লেখায় মনোনিবেশ করেন। ক্রমশ সাহিত্যজগতে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি দুই-ই বাড়তে থাকে। আর সেই খ্যাতির সূত্রেই আবার সদর্পে তিনি প্রবেশ করেন নাটকে। মনের গভীরে কোথাও নাটকের প্রতি ভালবাসা যেন লুকিয়ে ছিলই। তারাশঙ্করের ‘রাইকমল’ উপন্যাসটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশির ভাদুড়িকে এই উপন্যাস থেকে নাটক করার সুপারিশ করেন। শিশির ভাদুড়ি তখন ভাল নাটকের সন্ধানে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথায়, শিশিরকুমারের অনুরোধে তারাশঙ্কর ‘রাইকমল’ উপন্যাসের নাট্যরূপও দেন। কিন্তু নানা টানাপড়েনে ‘রাইকমল’ মঞ্চস্থ হয়নি। এর পর ‘রঙমহল’-এ তারাশঙ্করের ‘দুই পুরুষ’ নাটকটি গৃহীত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নাটকও মঞ্চে নামেনি।
গিঁট খুলছিল না কিছুতেই। শেষে ১৯৪১ সালের ১২ জুলাই ‘নাট্যনিকেতন’ মঞ্চস্থ করল তারাশঙ্করের ‘কালিন্দী’ নাটক। গীত রচনা ও সুর-সৃজন করলেন স্বয়ং কাজি নজরুল ইসলাম। ২৭ রজনীর পর মামলা সংক্রান্ত ঝামেলায় এ নাটকের প্রদর্শন বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু নাটকের জগতে তারাশঙ্করের জায়গা বেশ পাকাপোক্ত হল। পরের বছর, ১৯৪২ সালের ১৮ মে ‘নাট্যভারতী’ তারাশঙ্করের ‘দুই পুরুষ’ মঞ্চে নিয়ে আসে। নুটু ও রানির চরিত্রে অভিনয় করেন যথাক্রমে ছবি বিশ্বাস ও প্রভা দেবী। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত ‘পথের ডাক’, ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘যুগ বিপ্লব’, ‘কবি’, ‘কালরাত্রি’, ‘সংঘাত’, ‘আরোগ্য নিকেতন’ ইত্যাদি নাটক অভিনীত হতে থাকে ‘নাট্যনিকেতন’, ‘রঙমহল’, ‘স্টার’, ‘বিশ্বরূপা’ ইত্যাদি বিখ্যাত নাট্যমঞ্চে, বিপুল দর্শক-সমর্থন নিয়ে। তারাশঙ্করের লেখা অধিকাংশ নাটকেই বীরভূমের জল-মাটি-হাওয়ার গন্ধ পাওয়া যায়, এ কথা পাঠক থেকে শুরু করে সাহিত্য সমালোচক সকলেরই দাবি। ‘বিংশ শতাব্দী’ ও ‘পথের ডাক’ নাটক দু’টি অবশ্য আলাদা।
তারাশঙ্করের বেশির ভাগ নাটকই তাঁর গল্প ও উপন্যাস থেকে লেখা। শুধু ‘যুগবিপ্লব’ ও ‘দ্বীপান্তর’ নাটক দু’টি সরাসরি নাটক হিসেবেই লিখেছিলেন। সম্ভবত এ তালিকায় ‘মারাঠা তর্পণ’-এর নামও ঢুকবে। তবে তাঁর কথাসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি যেমন তুঙ্গে উঠেছিল, নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি ততটা হয়নি। যদিও তাঁর বেশ কিছু নাটক জনপ্রিয়তার নিরিখে ভাল মঞ্চসাফল্য পেয়েছিল। অজিতকুমার ঘোষ তারাশঙ্করের গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে তাই লেখেন, ‘নাটকের ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা যেন সতর্ক ও দ্বিধাজড়িত। এ যেন তাঁর ব্যস্ত কথাসাহিত্যিক জীবনের ফাঁকে ফাঁকে অবকাশ-বিলাস।’ তবু নাটকের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল আজীবন। শুধু নাটক লেখা নয়, নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর উৎসাহ ছিল অসীম।
বীরভূমের লাভপুরের অতুলশিব মঞ্চে তিনি অনেক নাটকে অভিনয় করেন। ‘সীতা’ নাটকে তিনি সীতার চরিত্রে অভিনয় করে জন-সমাদৃত হয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে ওই অঞ্চলে। এ ছাড়াও ‘গৃহলক্ষ্মী’ নাটকে মেজবৌ, ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে কল্যাণী, ‘চাঁদবিবি’ নাটকে মরিয়ম, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নাটকে বিনোদিনীর চরিত্রেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। তৎকালে পুরুষ শিল্পীরা মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন, এটা খুব আশ্চর্যের ছিল না। তবে তারাশঙ্কর শুধু নারী চরিত্রেই নয়, ‘কর্ণার্জুন’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘বশীকরণ’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ ইত্যাদি নাটকে তিনি পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেও প্রশংসা পেয়েছিলেন। এ ছাড়া ‘পার্থসারথি’, ‘পোষ্যপুত্র’, ‘প্রফুল্ল’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘সরমা’ ইত্যাদি নাটকেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। তবে এই নাটকগুলোয় কোন কোন চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন তার সব তথ্য পাওয়া যায় না। এই সব নাটকের অনেকগুলিই তারাশঙ্করের নির্দেশনাতেই মঞ্চস্থ হয়েছিল, প্রায় সব নাটকই মঞ্চস্থ হয় লাভপুরের অতুলশিব মঞ্চে ও সংলগ্ন অঞ্চলে।
কলকাতায় এক বারই মঞ্চে নেমেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘বশীকরণ’ নাটকে। বহু সাহিত্যিকের সম্মিলিত প্রয়াসে মঞ্চস্থ হয়েছিল এই নাটক। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে ছিলেন। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ রচনায় তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘আজ বলি আমার সাহিত্যিক জীবনে এই রঙ্গমঞ্চের সাহায্য পরিমাণে সামান্য হলেও দুঃসময়ের পাওনা হিসাবে অসামান্য। সেদিন রঙ্গমঞ্চের এই সাহায্য না পেলে সাধনার অকৃত্রিম নিষ্ঠা সত্ত্বেও আমার জীবনে এ সাফল্য অর্জন সম্ভবপর হত না।’
কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে খ্যাতির চূড়ায় উঠলেও নাটককে সব সময় মনের কাছাকাছিই রেখেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। নাটকের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা না থাকলে এমন উচ্চারণ অসম্ভব।